নিহার লিখন
নীহার লিখনের কবিতা ‘কুয়াশা’
প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৭, ২০২০
এক.
তার দুটি প্রান্ত, অরণ্যের মতোই
একটি মানুষের সামনে তোমার নেড়ে দেয়া শাড়িটির আঁচলের মতো পড়ে থাকে, আরেকটা যেন গহীনের জমিনের ফুল, যার ঠিকুজি ও রঙ জানে অচিন গাছের পাতারা
এমনও বলা যায়, কুয়াশায় আজন্মই মানুষের একটা জীবন থাকে সুস্থির, যেখানে একটা টিনের পাঠশালাটিতে অবিরত গল্প বলে যায় ঈশপ, কোরাসের সুরে শোনা যায় কুসুমকুমারী দাশ
আরেকটা জীবন থাকে পরিব্রজনে, দৃশ্যত আলোয় ঘেরা, এখানে থাকে সুরম্য সময়, ভবন, ছাদের কার্নিশে বোকা কবুতর, নিকটবর্তী মেঘ, পানশালার বাতি, টার্মিনালের হর্ন, ট্রাম আর জীবনানন্দ দাশ
দুই.
যেন ধূপের আরতি
নাসারন্ধ্রে ফুটাচ্ছে জাগতিক শল্য সকাল
তারপর বধিরতা, চালাচ্ছে চাকু
ফালি-চাঁদ গলে পড়ে পাচ্ছে মাটির সাক্ষাৎ,
বিরান পাখিরা ঠোঁট বাজাচ্ছে ধূমায়িত অস্তাচলে
ফুটো করে নামছে জোৎস্না ঘুমন্ত এক গ্রামে তোমার আমার অভিসারে, ঢালছে সুজয় প্রণতি
অন্ধ সুফিটা আমি; আকরিক হীরার মতন,
রুষ্ট পাথর, ভাঙা এক স্টেশনটি দূরের জগতি;
ফিলিং স্টেশন, ধুলা জমে আছে টাংকিতে, সামনে রাস্তা, বেলুনের মতো সব গাড়ি, ভেঁপু দিয়ে চলে যাচ্ছে পৃথিবীটা বাড়িয়ে গতি
উপলব্ধিতে এক কালা-মোষ, আধশোয়া তাকাচ্ছে, গায়ে যার কাদা
মনে কি পড়ে না আর সেই ছোট নদী, `দুই ধারে কাশফুল ফুলে ফুলে সাদা`?
মুখটা ফেরায় না কবুতরও, ডানা নিয়ে যদি উড়ে যায়,
যদি অন্য খুপেই পায় দিন; এরকম অজস্র হিসাব থাকার পরও, শোধাতে চাইছি কোনো ঋণ!
চলে গ্যাছে বিশালের আমন ধানের সেই মাস,
কবের কথা;
তারপরও কাকতাড়ুয়া কিসের ডিউটি করে,
নিজেকে জিগাই; বৃন্দাবন মরে গ্যাছে কবে মনে নাই, তবু সাক্ষাতে আসে আজ জগাই-মাধাই,
তাদের সন্ততিরা নির্বাণ-জ্যোতি দিয়ে কাটছে পাহাড়, অমাবস্যার, এরপর ধাম, এরপর নয়া নয়া নাম, সংকীর্তন
ইতিহাসে অন্ধ সুফিটি যেন এক বটগাছ; কবে যেন ছিল, নাম আছে, আছে ঠিকানায়,
চলিষ্ণু জীবনে তার হাতে আজ তরবারি জানছে সবাই, অদ্ভুৎ বাঁশিটির শূন্য স্থানে, পায়ের বৃত্তে আজ আওয়াজ করছে কোন অদান ঘুঙুর, ভীন মৌতাতে পৃথিবী তাকিয়ে দেখে শিউলি ফুলের মতো ফুটছে ডুমুর!
কোন উপমায় বলো ডাকবো তোমাকে কুয়াশায়, সূর্যও পোষা কোনো বিড়ালের মতো যদি মাথা নুয়ে থাবা চাটে মুগের ডালে!
ঈশ্বর নাকি মহাজন?
ভাবি, একটা খটখটা গাঙ
সাঁতরে যাচ্ছে বুনোহাঁস, পাড়ে এসে পেরে গিয়ে ডিম, বুকে যার ভাসছে মেঘের সব রেখা
এমন ছবির ফ্রেম যদি বলি উপমা তোমার, লুকাবো কোথায় গলা লাশ!
ধরো, গন্তব্য জানা নেই, এমন একটা যাত্রায়
বেরিয়ে গেছি, ছেড়ে-ছুটে, কিছুই না চেয়ে,
হাতে-সাথে কিছুই নেইনি দুনিয়ার
তারপরও যদি ধরে রাষ্ট্র-পুলিশ, আমার আর কী আর বলার আছেটা বলো
তারপরও বেলাজা আমার মন, এতকিছু ঘটার এহেন কালে, বলে `ভাবের দেশে চলো`
তিন.
বাবার শোক সংবাদ বয়ে নিয়ে আসে প্রতিবার কুয়াশাই, গ্রহান্তরিত কোনো মায়াটাও
সাদাকালো ছবিটি তার ঝুলায় এক বিমল বিমর্ষতা, কষ্টিপাথর, যার স্থির চোখ যেন জীবন্ত হয়ে যায় ধোঁয়া— গ্রন্থিতে, ছুঁয়ে দিতে চায় কপালের চুল
মায়ের বিধবা মুখেও কুয়াশা যেন এক সহোদর দুধের ভাইটি, থ মেরে থাকে, থামিয়ে সকল হুলস্থূল
ঠিকানাটা ভুলে যাওয়া তোমাকেও প্রতিবার মনে নিয়ে আসে বজ্জাত এই হারামি
কুয়াশা আসলে সেই কাতরতাটাই পৃথিবীর, প্রকৃত অন্তর্যামী