নীল রাত্রি
আবু তাহের সরফরাজপ্রকাশিত : মার্চ ২৪, ২০১৮
শেষ রাতের দিকে শীতটা বেশ জাঁকিয়ে উঠেছিল।
কালীপদ চুর চুর হয়ে দুলছে। আরও জনাপাঁচেক যারা, সকলেই এই শীতের উদোম হাওয়ায় একটু একটু কাহিল হতে হতে এ ওর দিকে ঝুঁকছে। কালীপদ ঝুঁকছে না। সে নিজের মনেই দুলছে। দোল দোল দোলনি, রাঙা মাথার চিরুনি। ঝুপড়িটা ছোট। গঞ্জের কয়েকটা দোকানের পেছনে। ঝুপড়ির একটা কোণার দিকে টেবিল। ভাঙা একটা টেবিল। একপাশ ইট দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে কোনও রকমে। টেবিলের ওপর টিমটিমিয়ে জ্বলছে হারিকেন। তেল শেষের দিকে, আলোর রমরমা আগের মতো আর নেই। সারা রাত ধরে জ্বলতে জ্বলতে ফুরিয়ে এসেছে প্রাণশক্তি। আবছা আলো-আঁধারি ঘরটার ভেতর নেশার রং ধরিয়ে দিয়েছে। ঝুপড়ির কোণাকানচিতে কোথায় যেন ব্যাঙ উঠেছে। ঘ্যাং ঘ্যাং ডেকেই যাচ্ছে। মশাও সুযোগ বুঝে ফেলেছে। চোরাগোপ্তা হামলায় কেঁপে কেঁপে উঠছে ঘোর নেশারু কয়েকজন। ভাঙা চাটাইয়ের ফাঁক-ফোকর গলে শীতের শুকনো হাওয়া ঢুকছে হু হু করে। কনকনে হাওয়ার চাবুক।
কালীপদ চটাস করে চাপড় মারল ঊরুতে। বিড়বিড় করে উঠল, শা-ল-লা ! উঠে দাঁড়াল তারপর টলতে টলতে। একটু কেঁপে উঠল ধীরেন। শীতের চাবুক পিঠে পড়তেই নাকি মশার মিসাইলে বোঝা মুশকিল। মুখ তুলে চাইল কালীপদর পোড় খাওয়া মুখের দিকে। মুখের চামড়া একটু কুঞ্চিত হলো। কাঁপা কাঁপা গলায় জিগেশ করল, যাও কই কালিদা?
এট্টু মাগিগো কাছে যাই। ফুরতি কইরা আসি।
অ, যাও গিয়া।
যাইবি নাকি?
না, যাও গিয়া। মালকড়ি নাই পকেটে।
ফকিন্নি গো কথা। তুই তো ফকিন্নি ছিলি না ধীরেন।
ধীরেন কথা বলে না। গায়েও মাখে না কালীপদর কথা।
গলার সবটুকু দরদ ঢেলে কালীপদ এবার বললো, মাগিগো গতর অইল গিয়া পাগলা পানির চাইয়াও বড় পানি, ঠকতে আমি রাজি না ! বুঝলি রে...
ধীরেন অদ্ভুত এক কায়দায় মাথা নাড়ে। সে বুঝেছে।
দুপায়ে সমান তাল রেখে কালীপদ বেরিয়ে এলো বাইরে। পা দুটো টলছে একটু একটু। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। কুয়াশার চাদর ছিঁড়েখুঁড়ে চাঁদের রং ছিটেফোটা এসে পড়েছে পৃথিবীর ওপর। আচ্ছন্নতার রং। সুনসান নীরবতা চারদিকটায়। একটু দাঁড়াল কালীপদ। ভাবল কি যেন খানিক। চোখ পিটপিট করে চেয়ে দেখল পাড়াটা। বাজারের শেষ সীমানায় সার সার ঝুপড়ি। কোনও কোনওটাতে এই রাতেও আলো জ্বলছে। এগোলো কালীপদ ধীর পায়ে। একটা ঝুপড়িতে গিয়ে সেঁধোল। খাটের ওপর গোল হয়ে শুয়ে ছিল মেয়েটা। বেশ ভরাট শরীর। দেখতে তেমন সুন্দর না হলেও এক ধরনের লাবণ্য ঢলঢল করছে মুখখানায়। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। বেশ উঁচু বুক। পিরামিডের মতো দেখতে। ঝুলে পড়েনি এখনো। চিকন সুতোর কমদামি হলুদ জমিন লালপেড়ে শাড়ি পরনে। দরজা খোলার শব্দে মুখ তুলল সে। দেখল কালীপদকে। হাসল। তারপর সারা গা দুলিয়ে উঠে বসতে বসতে বললো, কি গো বড় কুটুম, কেমুন আছো?
ভরাট গলায় কালীপদ বললো, কি মনে হয়?
চৌকি থেকে নেমে এসে কালীপদর হাত ধরলো মেয়েটা। বললো, আইসো, আইজ দুইজনে মিইলা রসের গপপো কইবো।
কালীপদ নড়ে না। ঝুপড়ির মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে বিড়ালের মতো। স্থির চোখে চেয়ে থাকে মেয়েটার দিকে। কী যেন খোঁজে তার মুখখানায়।
আরে মরদ অইলো কি, ভূতে পাইছে?
চল। কালীপদ ওর কোমর পেঁচিয়ে ধরে সাপের মতো।
শ্যাষ রাইতে আইসা কি আর পোষায়। আরও আগেভাগে আইলে পারতা। মেয়েটার কথার জবাবে কালীপদ ওর নরম মাংসল ঊরুর মাঝখানে মুখ লুকোয়। যেন রাত শেষ করে এসে সে মহা অপরাধ করে ফেলেছে। আর এই অপরাধী মুখ কাউকে সে দেখতে দিতে চায় না। শাড়ির ওপর দিয়ে নাভির নিচের জায়গাটুকুতে ক্রমাগত মুখ ঘষতে থাকে কালীপদ। কী এক ঘোরের ভেতর যেন ডুবে যায় সে। খিলখিল হেসে ওঠে মাগিটা। বাইরে শিশির ঝরতে থাকে টুপটাপ শব্দ তুলে।
ঝুপড়ি থেকে যখন বেরলো কালীপদ দিনের আলো ফুটে গেছে তখন। ঝিরঝির করে হাওয়া বইতে আরম্ভ করে দিয়েছে। পচে যাওয়া চোখটা তার চিড়বিড় করে ওঠে আলোর ঝলকানিতে। চিড়িক দিয়ে ওঠে থেকে থেকে। কালীপদর মনে হয়, তার লাইফটাই পাগলা পানির মতো হজম করে দিয়েছে ওইদিন। তার চোদ্দ পুরুষের পুণ্যি ছিল, তাই বেঁচে গেছে। সে কাজ করে এক লোহার কারখানায়। টকটকে গলানো লোহার সঙ্গে কাটাতে হয় সারাটা দিন। কখনো কখনো রাতেও ডিউটি পড়ে। যে দিন রাতে ডিউটি থাকে তার সন্ধের আগদিয়ে ভালো মতো চোলায় ঢেলে নেয় গলায়। তাগৎ পায় সারা রাত্রির কাজে। মনের জোড় পায়। দিনেমানে ডিউটি ছিল ওইদিন। দুপুরে ঘেমে-নেয়ে কারখানা থেকে বেরিয়ে গায়ের জামা খুলে হাওয়া খেতে খেতে রাস্তার উল্টোদিকে পান-বিড়ির দোকানে যাচ্ছিল। আর তখনই ঘটে কাণ্ডটা। চোখের পলক মাত্র। কোত্থেকে যেন একটা মাল বোঝায় ট্রাক দৌড়ে এসে ফেলে দিল তাকে রাস্তার একেবারে মাঝ বরাবর। ব্যস, দেখতে হয়নি আর। সকলেই বুঝে গিয়েছিল কালীপদ ব্যাটাটা এবার গেছে। কিন্তু বলতে কি, তার কপাল আশ্চর্য রকমের ভালো। প্রায়ই সে চোখ বুজলে একটা ছবি দেখতে পায়। ঝাপসা নয়, একেবারে স্পষ্ট জ্বলজ্বলে। সদরে পুরনো লাশকাটা ঘরটাতে ভাঙাচোরা টেবিলটার ওপর শুয়ে আছে সে। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। কপালের দুপাশের রগ ছিঁড়ে যাচ্ছে। সারা মুখ ভেসে যাচ্ছে রক্তে। মাথার ওপর জ্বলছে পাঁচশো পাওয়ারের একটা বালব। তার জোরাল আলোয় বুকের বাঁ পাশটাতে চোখ পড়তেই দারুণভাবে চমকে ওঠে সে। বাঁ পাশটা নেই। খুবলে পড়ে গেছে যেন কোথায়। বুকের ডান অংশটাই নিয়ে সে শুয়ে আছে।
কালীপদ ইট বিছান রাস্তায় উঠে হাঁটতে লাগল বাড়ির পথে। কিছুক্ষণ নীরবে হাঁটার পর তার মনে হলো, আরে, সে যাচ্ছেটা কোথায়! বাড়িতে? কেন যাচ্ছে সে? সে তো যেতে চায় না আসলে বাড়িতে। তবে কেন প্রতিদিন ভুল করে এ পথটা ধরেই সে হেঁটে যায়। এত চেনা পথ। ভীষণ চেনাজানা। সে যেতে চায় অচেনা পথে। বাড়িতে কেন সে যাবে? কিসের জন্যে ফিরে যেতে হবে সংসারের কাছে, টানটা কিসের? তার পাগলি বউটাকে দেখতে? কিন্তু সে দেখবেটা কি? দেখবার তো আসলে নেই কিছুই। সারাটা দিন প্রায় চিৎকার আর হইচইতে সমস্ত বাড়িটা নরক হয়ে আছে। বউটার মুখ দিয়ে লালা ঝরতে থাকে সব সময়। চোখ দুটো কী ভীষণ লাল, জ্বলজ্বল করে। তাকালেই ভয় ধরে যায় কালীপদর। বাড়ির শেষ মাথায় একটা ছোট একচালা ঘরে পাগলি বউটাকে আটকে রেখেছে সে। কোনও রকমে ছাড়া পেলেই ছুটে চলে আসে বড় রাস্তায়। একবার তো গাড়ির তলে পড়তে পড়তে প্রায়...। আগে কালীপদ প্রায়ই ঘরটার জানলায় কাছটায় গিয়ে দাঁড়াত। কী এক মায়ায় যেন তাকে টানতো। এখন আর সে দাঁড়ায় না। ইচ্ছে হয় না। বউটাকে দেখলে ভারি এক কষ্ট হয় তার। বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। কী এক অভাব যেন টের পায় সে, খালি খালি লাগে নিজেকে খুব।
শখের তোলা চোদ্দ আনা। চোদ্দ আনা নয়, কালীপদ শখ করে গোটা জীবনটাই দিয়ে বিয়ে করেছিল সুন্দর মুখ দেখে। তারপর, নাহ, চোখে পানি এসে যাচ্ছে তার, কি দিয়ে যে কি হয়ে যায়। মানুষের জীবনটা বোধহয় লোহার কারখানার ঢালায় মেশিনের মতো। থমকে দাঁড়ায় কালীপদ। সে যাবে না বাড়ি ফিরে। অন্য কোথাও চলে যাবে। মংলায় গিয়ে জাহাজে কাজ জুটিয়ে নেবে। ভাসবে পানির ওপর। কেউ তার কোনও হদিস পাবে না আর। পরমুহূর্তেই আরেক ভাবনা ঠোক্কর খায় তার মাথায়, ছেলে দুটো কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তার। ওরা তো বসে আছে তার পথের দিকে চেয়ে। বাপ তাদের কখন ফিরবে কারখানা থেকে। ছেলে দুটোকে তো দেখাশুনা করার নেই কেউ। বড় ছেলেটা রান্না করতে করতে এতক্ষণে হয়তো হাত পুড়িয়ে ফেলেছে। রান্না করতে গিয়ে প্রায়ই সে হাত পুড়িয়ে ফেলে। বারো বছরের কচি হাতে ফোসকা পড়ে যায় তার। অথচ ছেলে তার কাঁদে না। বোধ হয় ওর ভেতরকার সব কান্না মরে গেছে। কালীপদর মনে হলো, তার চাইতে তার ছেলে দুটোই কষ্টে আছে। ওরা তো সংসার ছেড়ে, মাকে ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে না। তাহলে সে কেন পালাবে? তার দুই বাচ্চা ছেলের কাছে অত সহজে সে হেরে যাবে?
আর কোথাও যাওয়া হয় না কালীপদর। সে আবার ইট বিছানো রাস্তা ধরে বাড়ির পথে হাঁটতে লাগল। মাথা নিচু করে হাঁটতে লাগল একমনে। তার ভেতরটা কেবল আচ্ছন্ন হয়ে রইলো নীল রাত্রির বেঘোর আয়োজনে।