নীল বিদ্রোহ এবং নীলদর্পণ নাটক: ভিন্ন দৃষ্টিতে
পর্ব ১
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : মে ২৭, ২০২১
বাংলার নীলবিদ্রোহ ও নীলচাষের ঘটনা বাদ দিয়ে নীলদর্পণ নাটকের আলোচনা হতে পারে না। কারণ বাংলার নীলচাষের ঘটনা না ঘটলে নীলদর্পণ নাটক লেখারই কোনো প্রয়োজন পড়ত না। নীলদর্পণ নাটক রচনা প্রসঙ্গে নাট্যকার নিজেই ভূমিকায় লিখেছেন, ‘নীলকরনিকরকরে নীলদর্পণ অর্পণ করিলাম। এক্ষণে তাঁহারা নিজ মুখ সন্দর্শনপূর্বক তাঁহাদিগের ললাটে বিরাজমান স্বার্থপরতা-কলঙ্ক-তিলক বিমোচন করিয়া তৎপরিবর্তে পরোপকার-শ্বেতচন্দন ধারণ করুন, তাহা হইলেই আমার পরিশ্রমের সাফল্য, নিরাশ্রয় প্রজাব্রজের মঙ্গল এবং বিলাতের মুখরক্ষা।’
খুব স্পষ্ট করেই নাট্যকার বলতে চেয়েছেন নীলচাষই তাঁর নাটকের বিষয়, বিশেষ করে নীলকরদের অত্যাচার। তিনি নিজদেশের নিরাশ্রয় লোকদের নীলকরদের অত্যাচার থেকে বাঁচাতে চান, আবার বিলাতেরও মুখরক্ষা করতে চান। নাট্যকার নীলচাষের হাত থেকে চাষীদের বাঁচাবার জন্য মূলত ইংরেজ শাসকদের দয়া চাইছেন। তিনি চাষীদের লড়াই করার কথা বলছেন না। ঠিক এইখানে এসেই বর্তমান প্রবন্ধের সূত্রপাত। নীলদর্পণ নাটক সম্পর্কে ইতিমধ্যেই ন্যূনতম দুটি চমৎকার সমালোচনা লেখা হয়েছে। যার একটি আশুতোষ ভট্টাচার্যের এবং অপরটি উৎপল দত্তের।
সে দুটি রচনায় বিশদভাবে নাটকটিকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করা হয়েছে। বর্তমান নিবন্ধটি কিছু ভিন্ন প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছা রাখে। বিশেষ করে নাট্যকারের ইংরেজ শাসকদের কাছে দয়া চাইবার ব্যাপারাটকে প্রবন্ধকার ভিন্ন অবস্থান থেকে দেখতে চাইছেন। নাট্যকারের উল্লিখিত বক্তব্যের ভিতর দিয়ে নীলবিদ্রোহের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে। যথা সময়ে সে প্রসঙ্গে আসা যাবে। তার পূর্বে বাংলার নীলচাষ সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা যাক।
বাংলায় বিদেশী মূলধন বিনিয়োগে নীল ও পাট চাষ দুটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে রয়েছে। ইংরেজ ধনীকরা বুঝলেন নীল ও পাট ইত্যাদি বাণিজ্য-ফসল বাংলার মাটিতে ফলাতে পারলে প্রচুর লাভ। বাংলার দরিদ্র চাষী-মজুরের সুলভ পারিশ্রমিকে নীল ও পাট চাষ করিয়ে ইংল্যান্ড ও অন্যত্র রপ্তানী করতে পারলে পর্যাপ্ত মুনাফা লাভের সম্ভাবনা, যা ভিন্ন কোনো সাধারণ ব্যবসা-বাণিজ্যে সহজে করা সম্ভব নয়। ব্রিটিশ ব্যবসায়ীর মূলধন তাই বাণিজ্য-ফসলে বিনিয়োগ করা হলো। বিশেষ করে নীলচাষে। বাংলার গ্রাম্যজীবনের সাথে নীলকর এবং নীলচাষের সম্পর্ক ইতিহাসের একটি নির্মম অধ্যায়। কারণ নীল চাষের ব্যাপারে নীলকর সাহেবরা বাংলার গ্রামাঞ্চলে শুধু ব্যবসায়ীরূপে নয়, ভয়াবহ অত্যাচারী রূপেও বিরাজ করতো। চাষের ক্ষেত্র থেকে আরম্ভ করে তাদের নীলকুঠি পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে তারা এক বিচিত্র রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে বসেছিল। নীলকর সাহেবরা ছিল বিদেশী শাসকদের প্রতিভূ, কাজেই স্থানীয় জমিদার-তালুকদার-পত্তনিদারদের চেয়েও তাদের প্রতাপ-প্রতিপত্তি শতগুণ বেশি ছিল। দোর্দণ্ড প্রতাপ জমিদাররাও তাদের অধীন নীলকর সাহেবদের যথেষ্ট সমীহ ও ভয় করে চলতেন।
সতেরশো সত্তর থেকে সতেরশো আশি সালের মধ্যে বাংলাদেশে নীল চাষ আরম্ভ হয়। কোন্ ব্যক্তি প্রথমে নীলচাষ আরম্ভ করে তা নিয়ে মতভেদ থাকলেও জানা যায় যে, ল্যুই বোনদ নামে এক ব্যক্তি মরিশাসে নীলচাষ করে ব্যর্থ হয়ে বাংলায় আসে। সতেরশো বাহাত্তর সালে সে চন্দননগরের কাছে গোঁদলপাড়া গ্রামে একটি ছোট নীলকুঠি স্থাপন করে। এটাই বাংলার প্রথম নীলকুঠি। সতেরশো তিয়াত্তর সালে বোনদ চন্দননগর ও চুচুঁড়ার মাঝামাঝি একটি জায়গায় আর একটি নীলকুঠি স্থাপন করে। হাওড়ার শ্যামপুকুরে দু-জন ফরাসী চিকিৎসক প্রায় এই একই সময় একটি নীলকুঠি স্থাপন করে।
সতেরশো তিরাশি সালের মধ্যে বাংলার বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি কুঠি স্থাপিত হয়। বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে সে বছর বারো-তেরোশো মন নীল রপ্তানী হয়। সতেরশো ছিয়ানব্বই থেকে আঠারশো চার সালের মধ্যে বছরে চব্বিশশো থেকে বেড়ে বাষট্টি হাজার মন নীল উৎপন্ন হয় বাংলাদেশে। আঠারশো পনেরো সালে পঁচাশি হাজার চারশো আট মন নীল কলকাতা থেকে লন্ডনে চালান দেওয়া হয়। বাংলায় নীলচাষের জন্য ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এবং ব্যক্তিগত ব্যবসায়ী উভয়েই মূলধন খাটাতো। দেখা গেছে বাংলা থেকে দেড়শো-দুশো টাকা মনে নীল কিনে তারা তিন-চার গুণ বেশিমূল্যে লন্ডনের বাজারে বিক্রি করতো।
নীলকরদের দাদন দিয়ে নীল সরবরাহের ব্যবস্থা করা হতো। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আঠারশো বিশ সাল থেকে আঠারশো সাতাশ সাল পর্যন্ত নীলবাণিজ্য থেকে ইংরেজরা মুনাফা করে পঁয়তাল্লিশ লক্ষ টাকা। এটা ব্যবসায়ীদের ঘোষিত মুনাফা, মূল মুনাফা ছিল অন্তত দ্বিগুণ। আঠারশো বিশ থেকে ত্রিশ সাল পর্যন্ত নীলচাষ থেকে শুধুমাত্র ইস্টেইন্ডিয়া কোম্পানীর বাৎসরিক মুনাফার পরিমাণ ছিল দশ-বারো লক্ষ টাকা।
নীলচাষের এই প্রথম পর্বের ইতিহাস থেকে বোঝা যায় আঠার শতকের শেষ দশক থেকে উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত বাণিজ্য-ফসল নীলচাষে কতদূর পর্যন্ত জবর দখল করা হয়েছিল এবং নীলকর ও নীলকুঠির প্রভাব বাংলার গ্রামে কতদূর বিস্তৃত হয়েছিল। হাওড়া-হুগলি, চব্বিশ পরগণা, বর্ধমান, বীরভূম, নদীয়া, যশোর প্রভৃতি জেলায় কিছুকাল আগেও নীলকুঠির ভগ্নস্তুপ দেখা যেতো। উনিশ শতকের বাংলা ও ইংরেজী সাময়িকপত্রে নীলকরদের দৌরাত্ম্য ও দুর্বিনীত আচরণের প্রচুর সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। বাংলা বারশো পঞ্চান্ন সালের তেশরা আষাঢ় সংবাদ প্রভাকর-এ লেখা হয়েছিল, নীলকরদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ বা মামলা-মোকদ্দমা করা যায় না। কারণ ম্যাজিস্ট্রেটদের সাথে নীলকরদের ঘনিষ্ট পরিচয় থাকে এবং ম্যাজিস্ট্রেটরা প্রায় নীলকরদের আতিথ্য গ্রহণ করে। জেলার কর্তা যদি শিকারে যায় স্থানীয় কোনো নীলকর সাহেবের অতিথি হয়ে নীলকুঠিতে অবস্থান করে। ফলে দেখা যায়, নীলকরদের নিষ্ঠুরতা ও হত্যাঘটিত বহু মোকদ্দমা হলেও তাতে সাধারণের কোনো উপকার হয় না। নীলকরদের শোষণ ও অত্যাচার কিছুমাত্র খর্ব করা যায় না। নদীয়া জেলায় নীলকরদের অত্যাচার প্রসঙ্গে সংবাদ প্রভাকর-এর বারশো ছিষট্টি সালের ছয় মাঘ সংখ্যায় লেখা হচ্ছে, ‘প্রদেশ মধ্যে রাজশাসন প্রণালী নাই বলিলেই হয়। নীলকরেরাই রাজা এবং হর্তা কর্তা যাহা মনে করেন তাহাই করিতে পারেন।’
নীলচাষের পক্ষে একের পর এক আইন করা হলো নীলকরদের শোষণকে নিরঙ্কুশ করতে। নীলকররা অধিকার পেল বাংলার তালুক ক্রয় করার। দেখা গেল নীলকরদের স্বার্থে আইনের যথেচ্ছ এবং নির্লজ্জ ব্যবহার। কারণ ইংরেজ বড়-ছোট কর্তা সকলেই নীলচাষের দ্বারা বহু ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছিল। মরে সাহেব নামে একজন নীলকরের সুন্দরবনে নীলের আবাদ ছিল। তার নামেই বাগেরহাটের মরেলগঞ্জ গ্রাম। সোমপ্রকাশ পত্রিকার বারোশো উনসত্তর সালের দোশরা বৈশাখ সংখ্যায় মরের স্বেচ্ছাচারিতার বিস্তৃত বিবরণ ছাপা হয়। তাতে দেখা যায়, হত্যা, বলাৎকার, জালকারিতা; সবধরনের দুষ্কর্মের সাথে সে জড়িত ছিল। বিদেশী একজনের লেখার বিবরণ থেকে দেখা যায়, নীলকুঠিতে গড়ে একশো বিশটি গরুর গাড়ি ও আটচল্লিশটি নৌকা থাকতো নীল ও অন্যান্য মালামাল বহণের জন্য। কুলির সংখ্যা থাকতো ন্যূনতম চারশো। ভদ্রলোক কর্মচারী; নায়েব, গোমস্তা, সরকার প্রভৃতি সংখ্যায় কম থাকে না। এর থেকে ধারণা করা যায় কেমন রমরমা ব্যবসা ছিল নীলচাষে।
বণিক ইংরেজদের এই অত্যাচার ও ব্যভিচারের ফলে দেশের চাষীদের মধ্যে বিদ্রোহের সত্তা জাগ্রত হয়। নীলকরদের চরম অত্যাচারের ফলেই আঠারশো ষাট সালে নীল বিদ্রোহ দেখা দেয়। নীল চাষীদের মনে জেগেছিল এক সুদৃঢ় সংকল্প তারা নীলচাষ করবে না। নীলচাষীদের এই বিদ্রোহ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। নীলকররা সেই সময়ে বাংলার ছোটলাট সাহেবের নিকট স্মারক লিখে জানায় যে, চাষীদের দ্বারা কিছুতেই নীলের চাষ করানো সম্ভব হচ্ছে না। সে স্মারকপত্রে আরো লেখা হয়, ‘মফস্বলের আদালতগুলিতে কোনো রায়তের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা সম্ভব হয় না, কারণ অভিযোগ প্রমাণ করার জন্য স্বাক্ষী পাওয়া যাচ্ছে না। এমন কি আমাদের কর্মচারিগণ পর্যন্ত আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে সাহস পায় না। রায়তরা খুবই উত্তেজিত অবস্থায় রয়েছে। প্রতিদিন তারা আমাদের কুঠি ও বীজের গোলায় আগুন লাগিয়ে দেবার চেষ্টায় রত আছে। বাসার অধিকাংশ চাকর-চাকরানী আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। কারণ, রায়তগণ তাদের হত্যা করার ভয় দেখিয়েছে। যে দু-একজন চাকর আমাদের সঙ্গে আছে তারাও শীঘ্র চলে যেতে বাধ্য হবে। কারণ, পার্শ্ববর্তী বাজার থেকে তারা নিজেদের খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করতে পারছে না।’
সমগ্র বঙ্গদেশের কৃষকদের আসন্ন বিদ্রোহের পূর্বাভাস লক্ষ্য করে ক্যালকাটা রিভিউ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, বাংলার গ্রামবাসীদের মধ্যে একটি আকস্মিক ও অত্যাশ্চর্য পরিবর্তন এসেছে। যে রায়তদের সাথে আমরা ক্রীতদাসদের মতো ব্যবহার করতে অভ্যস্ত ছিলাম, জমিদার ও নীলকরদের নির্বিরোধ যন্ত্ররূপে যাদের জানতাম অবশেষে তারা জেগে উঠেছে। কর্মতৎপর হয়েছে এবং প্রতিজ্ঞা করেছে নীলচাষ আর করবে না। আঠার ষাট সালে ইন্ডিয়ান ফিল্ড নামের মাসিক পত্রিকায় নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর হতে একজন জর্মন পাদ্রীর লিখিত পত্র থেকে বিদ্রোহের মূল চেহারা পাওয়া যায়। পত্রের বিবরণে বলা হয়, কৃষকগণ ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন দলে নিজেদের বিভক্ত করেছে। একটি দল গঠিত হয়েছে শুধুমাত্র তীর-ধনুক নিয়ে, ইটওয়ালাদের নিয়ে আর একটি দল; যারা ইটপাটকেল সংগ্রহ করছে। আর একটি দল বেলওয়ালাদের, তাদের কাজ শক্ত কাঁচা বেল নীলকুঠির লাঠিয়ালদের মাথা লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করা। থালাওয়ালাদের নিয়ে একটি দল, তারা তাদের পিতলের থালাগুলি শত্রুকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারে। তাতে শত্রুনিধন উত্তমরূপেই হয়। আর একটি দল যারা পোড়ানো খণ্ড কিংবা অখণ্ড মাটির বাসন নিয়ে শত্রুকে অভ্যর্থনা জানায়। বিশেষত বাঙালী স্ত্রীলোকরা এই অস্ত্র উত্তমরূপে ব্যবহার করতে জানে। যারা লাঠি চালাইতে পারে তাদের নিয়ে আর একটি দল গঠিত হয়েছে। দলের সর্বশ্রেষ্ঠ বাহিনীটি হলো বল্লমধারী বাহিনী। এরা সংখ্যায় অল্প হলেও খুবই দুর্ধর্ষ। নীলকরদের লাঠিয়ালরা এদের ভয়ে এতোই ভীত যে, কোনোরকম আক্রমণ করতে সাহস পাচ্ছে না।
কৃষকগণ নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য চমৎকার সব কৌশল গ্রহণ করেছিল। প্রত্যেক পল্লীর প্রান্তে তারা একটি করে দুন্দুভি রেখেছে। যখন কুঠির লাঠিয়ালরা গ্রাম আক্রমণ করার চেষ্টা করতো, কৃষকগণ তখন দুন্দুভির ধ্বনিদ্বারা পরবর্তী গ্রামের লোকদের সজাগ করে দিতো। এতে করে চার-পাঁচ গ্রামের লোক দ্রুত একত্র হয়ে কুঠির লাঠিয়ালদের কাবু করে ফেলতো। ঠিক এই ব্যাপারেই সতীশ মিত্র লিখেছেন, গ্রামের সীমায় একস্থানে একটি ঢাক থাকিত। নীলকরের লোক অত্যাচার করতে আসলে সেই ঢাক বাজানো হতো, অমনি শত শত লোক লাঠিসোটা নিয়ে দৌড়ে আসতো। নীলকরের লোকরা এই প্রতিরোধের সামনে দাঁড়াতে পারতো না। কারণ সম্মিলিত প্রজাশক্তির বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হওয়া সহজ ছিল না। সমগ্র বঙ্গদেশব্যাপী নীল-বিদ্রোহে ষাট লক্ষাধিক কৃষক যোগদান করেছিল। নদীয়া, যশোহর, খুলনা, ফরিদপুর, চব্বিশ পরগণা, পাবনা প্রভৃতি জেলার এরূপ গ্রাম কমই ছিল যে স্থানের সকল কৃষক সক্রিয়ভাবে এই সংগ্রামে অংশ নেয়নি। কৃষক জনসাধারণের উপর বহুকালের অসহনীয় শোষণ উৎপীড়নই এই বিদ্রোহকে ধীরে ধীরে প্রাণ সঞ্চার করে।
নীল চাষীদের মধ্যে যে বিদ্রোহ শুরু হলো, যে ক্ষোভ প্রতিভাত হলো তাতে বড়লাট ক্যানিং পর্যন্ত বিব্রত হলেন। তিনি একটা চিঠিতে লিখেছিলেন যে, নীলবিদ্রোহ আরম্ভ হবার প্রায় এক সপ্তাহকাল তিনি খুবই উৎকণ্ঠিত ছিলেন। সিপাহী বিদ্রোহের সময় দিল্লীর অবরোধেও তিনি এতোটা উদ্বিগ্ন হননি। তিনি সব সময় ভাবছিলেন, কোনো নির্বোধ নীলকর যদি ভয়ে বা ক্রোধে বিদ্রোহীদের দিকে একটিও গুলি ছোঁড়ে তা হলে সে মুহূর্তেই দক্ষিণবঙ্গের সকল কুঠিতে আগুন জ্বলবে। ক্যানিংয়ের ভয় মিথ্যা ছিল না। সমগ্র বঙ্গদেশব্যাপী সে আগুন সত্যিই জ্বলে উঠেছিল। চাষীগণ মরিয়া হয়ে ঘোষণা দিল তারা আর নীলচাষ করবে না। নীলকররাও বলপূর্বক নীলচাষ করাতে উদ্যত হলো। বারাসাতের ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন তখন ইডেন। চাষীদের সাথে নীলকরদের গোলযোগ দেখে কর্তৃপক্ষের নিকট স্পষ্ট লিখে জানালেন, ‘প্রজাই জমির মালিক, নীলকর নহে। প্রজার জমি বলপূর্বক দখল করবার কোনো অধিকার নীলকরদের নেই এবং নীলকরেরা যেখানে আইন অমান্য করবে, ম্যাজিস্ট্রেট সেখানে প্রজার স্বত্ব রক্ষা করতে বাধ্য।’ আঠারশো ঊনষাট সালে ইডেন বাংলা ভাষায় এক ঘোষণা দ্বারা জনসাধারণকে জানিয়ে দিলেন যে, নীলের চুক্তি করা বা না করা প্রজাদের সম্পূর্ণ ইচ্ছাধীন। নদীয়া জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হার্সেলও ইডেন সাহেবের পন্থা অনুসরণ করলেন। বঙ্গীয় সরকারের সম্মতি অনুসারে প্রজাদিগকে এই ঘোষণার নকল দিবার ব্যবস্থা করা হলো। শত শত প্রজা নকল সংগ্রহ করে তা সর্বত্র ছড়িয়ে দিল। এরপর প্রজারা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে নীলের চাষ বন্ধ করে দিল।
সমগ্র বঙ্গদেশ জুড়ে নীল-বিদ্রোহ আরম্ভ হবার সঙ্গে সঙ্গেই শাসকগণ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আঠারশো ষাট সালের একত্রিশে মার্চ নীলচাষীদের বিক্ষোভ ও নীলচাষ সম্বন্ধে তদন্ত করবার জন্য নীল-কমিশন গঠন করে। এই কমিশন যাঁদের নিয়ে গঠিত হয় তাঁদের মধ্যে একজন ব্যতীত বাকি সকলেই ছিলেন ইংরেজ। বঙ্গীয় জমিদার সভার একজন সদস্যকে কমিশনে রাখা হলেও কৃষকদের কোনো প্রতিনিধি ছিল না। নীল কমিশন প্রায় তিনমাস কালের মধ্যে সরকারের নিকট তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। কমিশন নীলকরদের বিরুদ্ধে অভিযোগসমূহের অধিকাংশ স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয় এবং স্পষ্টভাবে নির্দেশনা দেয় যে, ‘নীলকরদিগের ব্যবসা-পদ্ধতি উদ্দেশ্যত পাপজনক, কার্যত ক্ষতিকারক এবং মূলত ভ্রমসঙ্কুল’। প্রতিবেদন সম্পর্কে বাংলার ছোটলাট গ্র্যাণ্ট যে মন্তব্য করেছিলেন তাতে নীলকরদের অপকর্মের ধারাবাহিক বিবরণ পাওয়া যায়। ছোটলাট স্পষ্ট স্বীকার করেন, ‘বাংলার প্রজা ক্রীতদাস নহে, পরন্তু প্রকৃতপক্ষে জমির স্বত্বাধিকারী। নিজেদের ক্ষতি হয় এমন কিছুর বিপক্ষে দাঁড়ানো তাদের জন্য বিস্ময়কর নহে। যা ক্ষতিজনক তা করাতে গেলে অত্যাচার অবশ্যম্ভাবী, এই অত্যাচারের আতিশয্যই নীল বপনে প্রজার আপত্তির মূল কারণ।’ চলবে
নীলদর্পণ নাটকের পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গের কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ অতিথি হিসেবে দেয়া লেখকের বক্তব্য