নিঝুম শাহ্
নিঝুম শাহ্’র গদ্য ‘মোপাসাাঁর শ্রেষ্ঠ গল্পপাঠ’
প্রকাশিত : জুলাই ১০, ২০২১
শিবের গীত
ঠিক কবে প্রথম মোপাসাঁর গল্প পড়েছিলাম, দিন-তারিখ বলতে পারব না। তবে পড়ার নেশার জন্য দূরন্ত কৈশোরে মায়ের চাপে পড়ে কারো বাড়িতে গেলে প্রথম আমার যে ব্যাপারে চোখ আটকে যেত তার প্রথমটি বই। টেবিলে, বুক সেলফে, কোনো ঘুপচিতে থাকা বইগুলো আমাকে অন্যরকম আকর্ষণ করত। একটা সময় বুঝে গেলাম, সবচেয়ে বেশি বইয়ের সন্ধান পাওয়া যায় সেসব বাসায় সেখানে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কোনো বড় ভাইবোন থাকে বা বাড়ি ছেড়ে গেছে উচ্চ শিক্ষার জন্য। একটু কাঁই-কুঁই করলেই তাদের কাছ থেকে বই জোগাড় করা যেত। বা যারা বাড়ি থাকে না তাদের বাবা-মা বালাইশাট ভেবে বই দিয়ে দিতেন।
বইগুলো হাতে পেলে মনে হতো, একটা রাজ্য জয় করে ফেলেছি। এভাবেই কালক্রমে যেমন দুই সমরেশ, শীর্ষেন্দু, শরদিন্দু, ফাল্গুনী, সত্যজিৎ, মুজতবা, তসলিমা, আজাদ, বিভূতি, মানিক, তারাশঙ্কর, শরৎ ও রবীন্দ্রনাথ এসেছে পাশাপাশি হাতে এসেছে ক্যারানিনা, জ্যাক লন্ডন, বেলায়েভ, গোর্কি, ব্রাউন ও মোপাসাঁরা। তবে তখন সব বুঝেছি, তাও না। অনেক বই পড়ার পর মনে হয়েছিল, কী হলো! কিছুই বুঝলাম না। সেসব নিয়ে উল্টেপাল্টে অনুরণিত করার সময় কই আর? উচ্চ মাধ্যমিকের পর বাড়ির বাইরের আরো বইয়ের পথ তখন উন্মুক্ত হয়েছে। অবগাহন করছি নিজের ইচ্ছায় যা-তা পড়ার স্বাধীনতায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর পুরো বিষয়টা পাল্টে গেল। বিশেষ করে শুধু পড়ার জন্য পড়া নয়, তাকে নানাভাবে দেখার যে মাত্রা তা আবিষ্কার করতে শিখলাম। এক সময় নিজেকে কলম্বাস মনে হতো। সারারাত জেগে জেগে পড়া ছাত্রটির চেয়েও যখন এক ঘণ্টা পড়লে বেশি গভীরে পৌঁছুতে পারতাম, একটা ভালো লাগা কাজ করত। সেই ভালো লাগা এখনো কাজ করে। বিশেষ করে যে বইগুলো কিশোর মনে শুধু পড়েছি, অমীমাংসিত রয়ে গেছে অনেক কিছু, এই লকডাউনে সেগুলো আবার নতুন করে পড়া শুরু করলাম।
ভাঙা ধান
এতকিছু বললাম, কারণ মোপাসাঁর গল্পগুলো কাহিনির মতোই পড়েছিলাম। বিশেষ করে অনুবাদ গ্রন্থগুলোর ক্ষেত্রে তা আরো সত্য। অনুবাদের ফলে মূল লেখকের ভাষার সৌন্দর্য প্রায় হারিয়ে যায় বলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মূল লেখকের ধাঁচ বুঝতে পারা কঠিন। ফলে পড়ে হৃদয়ঙ্গম করতে না পারলেও তা আরেকবার পড়ার ইচ্ছা কৈশোরে জন্মায় না বা সেই আকাঙ্ক্ষা যুক্ত হয় না। কেন, কীভাবে, পদ্ধতি-শব্দগুলো শৈশব-কৈশোরে না আসলেও পরিণত বয়সে আসে। আসে বলেই মোপাসাঁর শ্রেষ্ঠ গল্প বইটি নিয়ে কিছু প্রশ্ন মনে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই খচখচ করে।
ফ্লবেয়ারের পরিমিতি বোধ, টেনে ধরার ক্ষমতা, শিল্প-সংযম বা এমিল জোলার বাস্তববাদীতার প্রভাব সত্ত্বেও মোপাসাঁ তার গল্পে নিজস্ব স্বকীয়তার পরিচয় দিতে পেরেছিলেন। তার লেখা `নেকলেস` গল্পটি তো এখন পাঠ্যবইয়েও অন্তর্ভুক্ত। মূলত ফ্রাঙ্কো-প্রাসিয়ান যুদ্ধ আর মধ্যবিত্তদের জীবনের সামাজিক বাস্তবতা, ওই সময়ের ফরাসি জীবনের যৌনাচার তার গল্পের মূল উপজীব্য।
সুধাংশুরঞ্জন ঘোষ, অরুণ চক্রবর্তী, বিমল দত্ত, মীজানুর রহমান, সুনীলকুমার ঘোষ ও গীতা গুহরায়ের অনুবাদ করা গল্পগুলোর মধ্যে ব্যক্তিকভাবে সুধাংশুরঞ্জন ও সুনীলকুমার ঘোষের অনুবাদ পড়তে বেশি আরামবোধ করেছি। বিশেষ করে শিল্পী, ঘোড়ার পিঠে, বেড নম্বর ২৯ গল্পগুলো পড়ার পর অনুরণিত হচ্ছি এখনো। ঘোড়ার পিঠে গল্পটি পড়ে বারবার মনে হচ্ছে, গরিবের ঘোড়ারোগ বাগধারাটি কী এখান থেকেই এলো! নাকি এই ঘোড়ারোগ তো আমাদের মধ্যবিত্তের মজ্জাগত সহজাত বৈশিষ্ট্য বলেই মিলে গেছে?