নারীর মর্মবেদনার আখ্যান ‘সময়ের কাছে’
প্রাচ্য তাহেরপ্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২০
মানুষের জীবন নানা ঘটনার অবিচ্ছিন্ন প্রবাহ। কত কত ঘটনায় যে প্রতিমুহূর্তে ঘটে যায় আমাদের জীবনে! কিছু ঘটনা আমরা মনে রাখি না। আবার, কিছু ঘটনা আমাদের মনে গাঁথা হয়ে যায় চিরজীবনের জন্যে। বলা হয়, সাহিত্য জীবনের দর্পন। তাহলে কি জীবনের ঘটে যাওয়া নানা ঘটনাকে নিংড়েই সাহিত্যিক তার সাহিত্যকর্ম রচনা করেন?
হ্যাঁ, সাহিত্যিকের কাজ অনেকটা সেরকমই। জীবনের টুকরো টুকরো নানা ছবি লেখকের মানসজগতে আলোড়ন তোলে। এরপর লেখক তাড়িত হন সেসব ঘটনাকে অক্ষরের বুননে গল্পের রূপ দিতে। এই রূপ দেয়াই হচ্ছে শিল্পের কাজ। যে যত দক্ষতার সঙ্গে এ কাজটি করতে পারেন, গল্পকার হিশেসে সে তত সফল।
গল্পলিখিয়ে হিশেবে মারিয়া সালামের যাত্রা বছর পাঁচেক হলেও এরই মধ্যে পাঠকরুচিতে তিনি ভিন্ন স্বাদ এনে দিয়েছেন। সাহিত্যের প্রচলিত ডামাডোলের বাইরে থেকে নিজের মতো করে তিনি লেখালেখি করেন। তবে লিখতে যত না আনন্দ, তারচে বেশি আনন্দ পান পড়াশোনা করতে। আর কে না জানে, পড়াশোনা মানুষের ভাবনার জগৎকে ঋদ্ধ করে তোলে।
অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৯ এ প্রকাশিত হয়েছিল তার প্রথম গল্পের বই ‘নীলকণ্ঠী’। বইমেলাতেই দ্বিতীয় সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে যায়। মূলত এসময় থেকেই বাংলা ছোটগল্পে তার আভিজাত্য পাঠককে আগ্রহী করে তোলে। এই আগ্রহই একজন লেখকের এগিয়ে যাওয়ার পথে সবচেয়ে বড় পাথেয়।
অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০২০ এ প্রকাশিত হয়েছে মারিয়ার দ্বিতীয় গল্পের বই ‘সময়ের কাছে’। দশটি ছোটগল্পের সংকলন নিয়ে মলাটবন্দি হচ্ছে বইটি। প্রচ্ছদ এঁকেছেন রিফাত বিন সালাম। গল্পগুলো হচ্ছে, সময়ের কাছে, আবাহন, সাইবেরিয়ার ডাইনি, বর্ষা মঙ্গল, অসমাপ্ত, জামার ডানা, অপেক্ষা, যশোর রোড এবং সর্বশেষ গল্প লেখিকার প্রেমিকারা।
সময় ধারণাটি যদিও বিমূর্ত, এরপরও মানুষের ইতিহাসে সময়কেই সবচে বেশি অবলম্বন করা হয়। নানা কালখণ্ডে মানুষের জীবনযাপনের বর্ণনা দিতে সময়কে ধরে এগোনোই সুবিধেজনক। আর তাই সমকালীন জীবনবোধ উপস্থাপনে মারিয়া তার গল্পগন্থের নামকরণ করেছেন, সময়ের কাছে।
মানুষ যেন সময়ের হাতে বন্দি এক একজন ক্রীতদাস। সময়ের বিপুল উচ্ছ্বাস মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আর মানুষ, অসহায় চোখে চেয়ে থাকে কালের গতির দিকে। এটাই যেন মানবজীবনের সবচে বড় নিয়তি! মারিয়ার গল্পগুলোর চরিত্রগুলোও এই নিয়তির বাইরে নয়। চরিত্রগুলো যেন সময়ের কাছে হাঁটু মুড়ে বসে চেয়ে আছে অনন্তের পানে।
মারিয়ার এই বইয়ের প্রতিটি গল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, নারীজীবনের নানা ক্ষেত্র। সময়ের প্রসঙ্গেই যদি বলতে হয়, তবে বলব যে, আদিম সমাজব্যবস্থা থেকে আজকের সময় পর্যন্ত মানুষ নানা পথপরিক্রমায় সভ্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির খুব বেশি বদল হয়নি। অথচ সভ্যতা গড়ে ওঠে নারী-পুরুষের সম্মিলিত উদ্যোগে।
মানব জাতির প্রতিটি সমাজ ব্যবস্থার নিজস্ব একটা দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। দেখা গেছে, পৃথিবীর প্রতিটি সমাজেই নারীকে ভোগ্যপণ্য হিশেবে উপস্থাপনের একটা প্রয়াস থাকে। নারী যেন ফেরিঅলা। তাকে দিয়ে টুথপেস্ট থেকে শুরু করে মোবাইলের সিমকার্ড পর্যন্ত ভোক্তাদের কাছে ফেরি করা হয়। শুধু বাজারি ব্যবস্থায় নয়, নারী নিগৃহীত হয় পরিবারেও।
সময় বদলালেও নারীর সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থার বদল মোটেও ঘটেনি। এ অবস্থা বিবেকবান প্রতিটি মানুষের অন্তর্দহনের কারণ। মারিয়াকেও নারীর এই করুণ চিত্র ব্যথিত করেছে। আর তাই তিনি নারীর মর্মবেদনার কথা তুলে এনেছেন ‘সময়ের কাছে’র দশটি গল্পে। মারিয়ার ভাষা বেশ ঝরঝরে, নিজেকে জাহির করতে অহেতুক শব্দের প্যাঁচ তিনি কষেননি। তার গল্পপাঠে পাঠক ছবির মতো দেখতে পারে চরিত্রগুলোকে। এখানেই গল্পকার হিশেবে মারিয়া সালামের কৃতিত্ব।
বইয়ের প্রতিটি গল্পের মূল চরিত্র নারী হলেও পুরুষ মনস্তত্ত্বও বাদ পড়েনি। সমাজের মানুষ হিশেবে নারী-পুরষের সীমাবদ্ধতার কথা বিশেষ মুনশিয়ানায় মারিয়া তুলে এনেছেন তার গল্পে। প্রিয় মানুষদের প্রতি তাদের আবেগের বহিপ্রকাশের ধরণ আর পরিবারের জন্য নারীর ত্যাগ— সবই উঠে এসেছে নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে।
বইটির আরো একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, প্রয়াত গল্পকার শাহরুখ পিকলুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বইটিতে যুক্ত করা হয়েছে তার ছয়টি অণু গল্প।
প্রকাশনা সংস্থা কাশবন থেকে প্রকাশিত এ গল্পগ্রন্থটি বইমেলায় পাওয়া যাচ্ছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কাশবন প্রকাশনার ৭১৬ নম্বর স্টলে।