নারী-পুরুষের যৌথ জ্ঞানার্জন: ইবনুল হাজ্জের বয়ান
তুহিন খানপ্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৩, ২০২৩
আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ আল-আবদারি আল-ফাসি (মৃ. ৭৩৭ হি.), যিনি ইসলামি অ্যাকাডেমিয়ায় ‘ইবনুল হাজ্জ’ নামে খ্যাত, ছিলেন মালেকি জুরিসপ্রুডেন্সে বিশেষজ্ঞ একজন স্কলার। মরক্কোর ফাস শহরে জন্ম নিলেও, পরে তিনি মিশরে চলে আসেন, এবং হিজরি ৮ম শতকের মাঝামাঝি সময়ে মামলুকদের শাসনাধীন মিশরে মারা যান। সুফি ভাবধারায় দীক্ষিত এই স্কলার তার দুনিয়াবিমুখতা ও আধ্যাত্মিক একাগ্রতার জন্য বিশেষ খ্যাতি লাভ করছিলেন। তার সবচে বিখ্যাত বই হইল ‘আল মাদখাল’, যা বর্তমানে কায়রোর দারুত তুরাস থেকে ৪ খণ্ডে প্রকাশিত।
বইটা গতানুগতিক ‘ফিকহ’ শাস্ত্রের বই নয়। ফিকহ শাস্ত্রের অন্যান্য বইয়ের মতো এই বইতে পবিত্রতা, নামাজ, রোজা, যাকাত, বিবাহ— এ ধরনের আলাদা আলাদা অধ্যায় ভাগ করে আলাপ করা হয় নাই। বরং এবাদত, সামাজিক কেতা, আদব-আখলাকসহ আরো বিভিন্ন বিষয়ে, তৎকালীন সমাজে ও ধর্মীয় সার্কেলে প্রচলিত বিভিন্ন ‘বাজে প্রাক্টিস’ বা ‘বেদাত’ চিহ্নিত কইরা, সেগুলার সঠিক শরিয়তি পন্থা বাতলে দেওয়া হইছে। ফলে এক হিশাবে এই বইরে ‘পপ-ফিকহ’ জনরার ‘সমাজ সংস্কারমূলক’ বই বলা যাইতে পারে। ‘বেদাত’র বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টি ছিল ইবনুল হাজ্জের সামগ্রিক লেখালেখি ও অ্যাক্টিভিজমের অন্যতম প্রধান ফিচার।
মধ্যযুগের ইসলামি জ্ঞানকেন্দ্রগুলোতে নারী-পুরুষের একত্রে ক্লাশ করা, বা ধর্মীয় মজলিশে নারী-পুরুষের একত্রে অংশগ্রহণ করার ধরন বা ফিজিকাল এরেঞ্জমেন্ট সম্পর্কে ইতিহাসের বইপত্রগুলোতে খুব পষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। তাছাড়া এসব ক্লাশ বা মজলিশের এরেঞ্জমেন্টের ব্যাপারে তৎকালীন স্কলারদের কারো কোন আপত্তি ছিল কিনা, সে আপত্তি তারা তুলছিলেন কিনা পাব্লিকলি— সে-ব্যাপারেও আমার মনে প্রশ্ন ছিল। আজ সকালে একটা দরকারে ঘাঁটতেছিলাম ইবনুল হাজ্জের ‘আল মাদখাল’। নারী-পুরুষের কম্বাইন্ড মজলিশের অন্তত একটা ধরন সম্পর্কে বেশ বিরল ও বিস্তারিত চিত্র পাওয়া গেল এই কেতাবে।
ইবনুল হাজ্জ লিখছেন, (মসজিদে) কিতাবের পাঠ শুনতে লোকজন (কোন আলেমের) পাশে জড়ো হয়, তারপর নারীরাও সেখানে আসে। পুরুষেরা একটা নির্দিষ্ট জায়গায় বসে, নারীরা বসে তাদের মুখোমুখি। এই সময়ে মাঝেমধ্যে এমনও হয় যে, কোন কোন নারী, তাদের দাবি মোতাবেক, (কোন একটা হাদিস বা কাহিনী শুনে বা অন্য কোন কারণে) অভিভূত হয়ে পড়েন; (ওই অবস্থায়) হুট করে দাঁড়িয়ে যান, আবার বইসা পড়েন, জোরে জোরে চিৎকার করতে থাকেন। তার এমন এমন অঙ্গ প্রকাশ পেয়ে যায়, এমনকি নিজের ঘরের মধ্যেও যেগুলা ঢাইকা রাখাই নিয়ম। তাইলে মসজিদে, এতগুলা পুরুষের সামনে এটা করা কীভাবে সম্ভব!’ (আল মাদখাল, ২/২১৯)
মূলত ইবনুল হাজ্জ এই প্রাক্টিসটার বিরোধিতা করছেন; এই প্রাক্টিসের ব্যাপারে আপত্তি জানাইছেন। মসজিদের ইমামদের তিনি নির্দেশনা দিছেন এই মর্মে যে, তারা যেন এ ধরনের মজলিশে না যায়; এবং মসজিদগুলায় এ ধরনের মজলিশ হইতে না দেয়। কারণ, তারাই মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন।
অন্তত দুইটা কারণে, ইবনুল হাজ্জের এই অ্যাকাউন্ট বেশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, এই বর্ণনা থেকে এ ধরনের কম্বাইন্ড মজলিশ বা হালকার এরেঞ্জমেন্টের একটা নমুনা পাওয়া যায়। মসজিদের হালকাগুলাতেই যদি এই প্রাক্টিস থাকে, তাহলে মসজিদের বাইরে, ব্যক্তিগত মজলিশ বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের প্রাক্টিস থাকা খুব স্বাভাবিক। দ্বিতীয়ত, এই বয়ান থেকে বোঝা যায় যে, সে-যুগেও কোন কোন স্কলার এই প্রাক্টিসের বিরুদ্ধে বলছেন, যেমন ইবনুল হাজ্জ। তবে, ইবনুল হাজ্জের এই আপত্তি যে-যুগের ভিন্ন মতাবলম্বী ওলামারা কতটুকু পালন করছেন, বা আদৌ করছেন কিনা তা নিশ্চিত না।
ইবনুল হাজ্জের এই বইয়ের ব্যাপারে স্কলারদের মতামত কী ছিল? হাদিস স্কলার ইবনে হাজার আসকালানি (মৃ. ৮৫২ হি.) এই বইয়ের কন্টেন্টের ব্যাপারে মতামত দিতে গিয়া বলেন: ‘(বইটিতে উল্লেখিত বেদাতি প্রাক্টিসগুলার মধ্যে) বেশিরভাগই অপছন্দনীয়; তবে এমন কিছু ব্যাপারও আছে, যেগুলা (বেদাত হওয়া বা না হওয়ার বিষয়টা) তর্কসাপেক্ষ।’ (‘আদ দুরারুল কামিনা’য় ইবনুল হাজ্জের জীবনী দ্রষ্টব্য)
অবশ্য ইতিহাসের আয়রনি এই যে, নানা ধরনের বেদাত চিহ্নিত করা এই বই, তথা আল মাদখাল, ও এর লেখকের ব্যাপারেও বেদাতের অভিযোগ উঠছে আধুনিক সময়ে। সালাফি স্কলার নাসিরুদ্দিন আলবানি (মৃ. ১৯৯৯) এই বইয়ের বিভিন্ন বক্তব্যরে ‘বেদাত’ মর্মে চিহ্নিত করেন, এবং বলেন যে, আইনের ক্ষেত্রে অন্যের মুকাল্লিদ (অনুসারী) হওয়া এবং সুফি ভাবধারার দীক্ষিত হওয়ার কারণে, ইবনুল হাজ্জের চিন্তাধারায় নানা বেদাত ঢুকে পড়ছে।
লেখক: কবি ও অনুবাদক