প্রতীকী ছবি
নাবালক না থেকে দৃষ্টি পাল্টান, তারকা পূজা বাদ দিন
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৪
মাসুম রেজা বাংলাদেশের স্বনামধন্য নাট্যকার। মঞ্চে তার নিত্যপুরাণ খুবই আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল এবং দশর্কদের মুগ্ধ করেছিল। মুগ্ধ বললে কম হয়, নাটকটা দেড়শো বছরের বাংলা মঞ্চের ইতিহাসে স্মরণীয় ঘটনা। মাসুমের দ্বিতীয় যে নাটকটা আমাকে খুব মুগ্ধ করেছিল তা হলো ‘পারাপার’। মাসুমের নাটক আজকের মূল আলোচনার বিষয় নয়। কিন্তু আজকের আলোচনার মূল বক্তব্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। মাসুমের এ নাটকে শিল্পীদের সম্পর্কে কিংবা অভিনেতা কিংবা নাটকের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের সস্পর্কে নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করবে দর্শক।
নাটকে দেখা যায়, নাটকের সঙ্গে যুক্ত মানুষরা সীমান্ত দিয়ে নারী পাচার করে ভারতে। নাটকের সঙ্গে যুক্ত কতিপয় মানুষ নারী পাচার চক্রের সঙ্গে যুক্ত। নাটকটা আসলে তাদের বহিরঙ্গের বেশ, ভিতরে তারা খুনী, মুনাফাবাজ ও নিষ্ঠুর। শুধুমাত্র নারী পাচার নয়, সেই উদ্দেশ্যে খুনখারাবিসহ সব করতে তারা প্রস্তুত। সেখানে বন্ধুত্ব বলে কিছু নেই, আছে শুধু মুনাফার প্রশ্ন। কিছু মানুষ কখনো কখনো নাটকের মধ্যে দিয়ে নিজের একটা বিশেষ ভাবমূর্তি গড়ে তোলে, এরপর সেটাকে ব্যবসা বা মুনাফার কাজে লাগায়। বাংলাদেশে এর প্রমাণ অনেক বেশি।
নাটক করাটা আসলে অনেকের কাছে একটা উপলক্ষ্য, নাটক করার আড়ালে টাকা বানানোটা লক্ষ্য। মাসুমের পারাপার নাটকে এ কথাটা সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। মানুষ যখন ব্যবসা বা মুনাফার পথে নামে, হেন কর্ম নাই যা করতে সে পিছপা হয়। মানুষ খুন পর্যন্ত করতে পারে। বাংলাদেশে নাটকের সঙ্গে যুক্ত কজন মানুষ আছেন, যারা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত নন? ব্যবসা মানেই মুনাফা, মুনাফা মানেই সব পাপের পথে লিপ্ত হতে তৈরি থাকা। যারা নাটক করেন আবার ব্যবসা করেন; তাদের মূল পরিচয় কোনটা? ব্যবসায়ী নাকি নাট্যকর্মী, সে কথাটার কি মিমাংসা হয়েছে?
বাংলাদেশের বহুজন ব্যবসা করতে গিয়ে নাটক ছেড়েছেন। বহুজন রাজনীতিক হয়েছেন। নাটক সেখানে একটা আলখাল্লা, মূল লক্ষ্য ক্ষমতা ও অর্থ বানানো। মাসুমের নাটকটা সেকথাই বলে। মাসুমের পারাপার নাটকে সীমান্তের কাছে একদল মানুষ অনেক কিছু নিয়ে ব্যবসা করে, নারী সেখানে প্রধান পণ্য। সেই অন্ধকার জগৎটা নিয়ন্ত্রণ যে করে সে একজন শিল্পী, মাঝে মধ্যে সে নাটকের আসর বসায়। কিন্তু বাংলাদেশের নাবালকরা মনে করে, অভিনেতা মানে ধোয়া তুলসিপাতা। নাটকের চরিত্রের মতনই বুঝি সেই মানুষটার ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি। সেই সব নাবালকদের মাসুম রেজার নাটকটা দেখা দরকার বা পড়া দরকার।
মাসুম আসলে পারাপার নামের এ নাটকটা করতে গিয়ে বিগত সরকারের আমলের নাটকের সঙ্গে যুক্ত বহু মানুষের চরিত্র তুলে ধরেছেন বা মুখোস খুলে দিয়েছেন। নাটকের শুরুতে দেখা যায়, একটি যুবক যে নাটক করার নাম করে পরিকল্পিতভাবে একটি মেয়েকে মুগ্ধ করে। সেই মেয়েটিকে সে বিয়ে করে এই উদ্দেশ্য নিয়ে যে, সীমান্তে নিয়ে গিয়ে তাকে বিক্রি করে দেবে। সে মেয়েটিকে বিয়ে করে নিরাপদে নির্ঝঞ্ঝাটে সীমান্তে নিয়ে যাবার জন্য। সীমান্তে যে এইসব নারী বেচাকেনার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে, সেও নাটক করে। কিন্তু আমাদের নাবালকরা মনে করে, নাটক যিনি করেন তিনি সম্পূর্ণ ফেরেস্তা।
মানুষের মূর্খতার একটা সীমা থাকার কথা, কিন্তু নাবালকদের কারো কারো মূর্খতা তাদের বাচাল করে তোলে। বাচালের মতন বারবার একই উক্তি করতে থাকে। তাহারা মনে করে অভিনেতারা গ্রেফতার হতে পারেন না। কারণ তাহারা ফেরেস্তা। মাসুমের নাটকের দুই নারী পাচারকারীকে সরকার বা পুলিশ গ্রেফতার করলে এসব বাচালরা তাই বলবে। মানুষ কি সত্যি এতটা মূর্খ হয়! সাংবাদিকরা খুনী হতে পারে, বেশ্যার দালাল হতে পারে, মাদক পাচারকারী হতে পারে। যখন তাকে খুনী হিসেবে বা মাদক পাচারকারী হিসেবে গ্রেফতার করা হয়, তখন আর সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয় না। সে তখন আর সাংবাদিক থাকে না, সেজন্য সেক্ষেত্রে একজন খুনী বা মাদক পাচারকারীকে গ্রেফতার করা হয়।
নাবালক বাচ্চারা এসব কবে বুঝতে শিখবে? কবি ভণ্ড হতে পারে, রাজনীতিক হতে পারে। রাজনৈতিক অপরাধে ধরা পড়লে যদি কেউ বলে, কবিকে গ্রেফতার করা হলো কেন, তখন তাকে নাবালক ছাড়া আর কী ভাবা যেতে পারে? তিনি কবি ছিলেন সেটাই বড় হয়ে গেল? তিনি যে রাজনৈতিক দলের সাংসদ মন্ত্রী ছিলেন সেটা কি হারিয়ে গেল? হিসেব করলে দেখা যাবে, কবি হওয়াটা ছিল তার উপলক্ষ্য, মন্ত্রী হওয়াটা ছিল লক্ষ্য। কারণ সেই কবি মন্ত্রী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের কবিতাকে পদ-পদবীর কাছে বিক্রি করেছেন। সবকিছু বিচার করার কথা নির্মোহভাবে, কিন্তু বিচার করা হয় নিজের সুবিধা মতন। ফলে তাদের বিচারে মন্ত্রী, সাংসদ বা রাজনীতিক গ্রেফতার হয়নি, গ্রেফতার হয়েছে কবি।
কবি গ্রেফতার হওয়া নিয়ে তাদের মায়াকান্না দেখে বিস্মিত হতে হয়। যখন মনে পড়ে ইতিপূর্বে লেখক কার্টুনিস্টদের কারাগারে ঢুকিয়ে যখন অত্যাচার করা হয়েছে, তখন নির্দ্বিধায় ইহারা মুখ বন্ধ করে ছিলেন। কবি বলতে তারা শুধু নিজের দলের লোকদের বোঝেন, বাকিরা মার খেয়ে মরে গেলে কী যায় আসে তাদের! কারণ তাহারা চেতনাবাজ। তাদের কাছে সব মিথ্যা, একমাত্র হাসিনা সত্য।
মাসুম রেজার পারাপার নাটক রচনার বহু আগে, `জন অরণ্য` নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন শংকর। সত্যজিৎ রায় সে গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র বানিয়েছিলেন। সেখানে দেখা যায়, ব্যবসায় সাফল্য লাভ করতে গিয়ে এক যুবক একজন ঝানু দালালের পরামর্শে বড়কর্তাকে নারী সরবরাহ করতে রাজি হয়। প্রথম যুবকটি মন থেকে এটা মেনে নিতে পারে না, পরে ব্যবসার সাফল্যে সে এটা করতে রাজি হয়েছিল। যখন বড়কর্তাকে মেয়েটাকে পাঠানো হয়, দেখা গেল সেই মেয়েটি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বোন। সেই মেয়েটি জীবনযুদ্ধে বেঁচে থাকতে এই পথ বেছে নেয়। বাংলাদেশে বড় বড় ব্যবসা পেতে কি এভাবে নারী সরবরাহ করতে হয় না?
এক বড় প্রতিষ্ঠানের মালিক আর এক বড় প্রতিষ্ঠানের মালিককে নারী সরবরাহ করেন নানাভাবে নানা উছিলায়। বহু মালকিন নিজেই গিয়ে শুয়ে পড়েন ব্যবসা বাগাতে। বাংলাদেশের বহু নাট্যকার, অভিনেতা-অভিনেত্রী ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। ব্যবসার নিয়ম কি তাদের জন্য আলাদা? বড়কর্তারা কি শুধু তাদের মুখের হাসি দেখেই তাদের ব্যবসা দিয়ে দেয়? বাংলাদেশের তথাকথিত বড় বড় তারকারা প্রায় সবাই যখন হাসিনার হত্যাকাণ্ডে মুখ বন্ধ করে থাকে তার কারণটা কি? হাসিনাকে ভালোবাসে তারা? মোটেও না। তেমন ঘটনা দু একটা হলে হতে পারে। বাকিরা হাসিনার লুটের ভাগীদার ছিল, হাসিনা টিকে থাকলেই প্রতিবছর তাদের সম্পদ বাড়বে। ফলে হাসিনা হাজার হাজার লোককে মেরে ফেললে তাদের কিছু যায় আসে না। কারণ সম্পত্তির লোভে তাদের বিবেক মরে গেছে।
পারাপার নাটকে দেখা যাবে, কীভাবে মানুষের বিবেক হারিয়ে যায় মানুষের মুনাফা বা সম্পত্তি বানাবার স্বার্থে। মানুষকে হত্যা করতে তখন বিবেকে বাধে না, মন অপরাধবোধে উদ্বিগ্ন হয় না। পারাপার নাটকে দেখা যায়, নাটক করছে যে মানুষটা, কত সহজে সে মুনাফার স্বার্থে বন্ধুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়। কত সহজে একটি মেয়েকে হত্যা করতে পারে। হাসিনার সঙ্গে পারাপার নাটকের সেই মুখোশধারী শিল্পীদের পার্থক্য নেই। সীমান্তে নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে বহু মানুষকে হত্যা করতে প্রস্তুত তারা। কথা হলো, কর্তৃত্ব মানেই সম্পত্তি। বাংলাদেশে সাংসদ, মন্ত্রী হওয়া মানেই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে জুলুম করতে প্রস্তুত থাকা। নাবালকরা মনে করে, নাটক যে করে সে শুধু নাটক করে; সে রাজনীতি করে না। সাংসদ হলেও তার পরিচয় অভিনেতা, রাজনীতিক নয়। নাটকের চরিত্রের রূপটাই মনে হয় তার কাছে অভিনেতার একমাত্র রূপ। কিন্তু অভিনেতার অভিনীত চরিত্র আর অভিনেতা যে এক চিরত্র নয়, সেটা নাবালকদের মাথায় নাকি ঢুকছে না।
বাংলাদেশের বহু অভিনেতা-অভিনেত্রী, নাট্যকারদের আসল চেহারা সামনে আনলে সাধারণ মানুষ চমকে যাবে। বিশ্বাস করতেই চাইবে না, এটাও কি সম্ভব? যুক্তরাষ্ট্রের এক রাষ্ট্রপতি একবার বলেছিলেন, ‘মানুষ যদি জানতো কত অযোগ্যরা তাদের নেতৃত্ব দেয়, তাহলে প্রতিদিন একটা করে বিপ্লব হতো।’ মানুষ যদি জানতো বাংলাদেশের নাট্যজগতের মানুষরা কীভাবে সরকারের দাসত্ব আর চাটুকারিতা করে, তাহলে নাটক দেখা ছেড়েই দিতো। বিজ্ঞাপনের জগতে, টেলিভিশন মাধ্যমসহ বহু জায়গায় নারীকে পণ্য বানানো হয়েছে, কখনো কখনো নারী নিজেই বাস্তবতার ভূমিতে দাঁড়িয়ে পণ্য হতে উদগ্রীব। নাটকের জগতের একজন মহামানব একবার রুচির দুর্ভিক্ষের কথা বলেছিলেন। যদি তার নিজের বিভিন্ন রুচির নমুনা উপস্থিত করা হয়, মানুষ ধাক্কা খাবে। নাট্যজগতের লোকরা কী সেসব জানেন না?
শুধু তার একার কেন, বহু অভিনেতা বা নাট্যজগতের সঙ্গে যুক্ত বহু ব্যক্তির মূল পরিচয়টা পেলে, মানুষ থু থু দেবে। লিয়াকত আলী লাকী নামক এক ভয়াবহ সংস্কৃতি ব্যক্তিত্বের রুচির কথা কি বলা দরকার আছে? লাকী কী করে বারোটা বছর একটা পদ দখল করে থাকলো। স্বনাম ধন্য সকলের শ্রদ্ধেয় সংস্কৃতি মন্ত্রী তখন কী করেছিলেন? লাকীর ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? মন্ত্রী নিজেই আসলে লাকীর দয়া নিয়ে চলতেন, এরকমই তিনি মেরুদণ্ডহীন ছিলেন নাটক ছেড়ে রাজনীতি করতে গিয়ে। সেই মন্ত্রী নাকি এতই পূত পবিত্র, সকলে তার ওপর অন্যায় নিয়ে কান্নাকাটি করছে। প্রশ্ন হলো, তিনি কি নিজে কোনোদিন সাগর-রুনির হত্যার বিচার চেয়েছেন? অন্যান্য গুম হত্যার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন? তাহলে কেমন মহান অভিনেতা তিনি?
চার্লি চ্যাপলিন একজন অভিনেতা, একজন চলচ্চিত্রকার। বলা যেতে পারে একই সঙ্গে একজন ব্যবসায়ী ও পুঁজিপতি। কিন্তু সবসময় শিল্পীর দায় পালন করেছেন। কখনো বিপথগামী হননি। তাঁর প্রতিটি ছবিতে তিনি ক্ষমতাবান মানুষদের কাটাচেরা করেছেন। পুঁজিবাদের অসঙ্গতি ফুটে উঠেছে তার বিভিন্ন চলচ্চিত্রে। মডার্ন টাইমস চলচ্চিত্র কী ভয়াবহভাবে মার্কসের চিন্তার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়। শেষের দিকের দুটি ছবি গ্রেট ডিক্টেটর ও মঁশিয়ে ভার্দুর জন্য মার্কিন সরকার তার নামে কমিউনিস্ট তকমা লাগিয়ে দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে যায় চ্যাপলিনের জন্য। কিন্তু তিনি মার্কিন সরকারের সঙ্গে আপস করেননি। সরকারের সঙ্গে আপস না করার জন্য তাঁর সেই বিরাট উপার্জনের বা মুনাফা করার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল। জনপ্রিয়তা কমতে থাকলো। তিনি তবুও অন্যায়ের কাছে মাথা নত করলেন না।
যখন আমাদের বড় বড় সেইসব তথাকথিত নাট্যকার, শিল্পী, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের হাসিনাকে নিয়ে ‘ডিক্টেটর’ ছবি বানাবার কথা, তখন তারা ডিক্টেটরের পদলেহন করছিলেন। বাংলাদেশের কিছু মানুষ তাদেরকে নিয়েই নাকি গর্ব করতে পছন্দ করে।
লেখক: সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ