নানামুখি জীবনের গল্প ‘জীবন এখানে এমন’
কানিজ ফারিহাপ্রকাশিত : জানুয়ারি ০৫, ২০২১
মারুফ ইসলামের ‘জীবন এখানে এমন’ এমনই একটি গল্পগ্রন্থ যে গ্রন্থটি পর্যায়ক্রমে নানামুখি জীবনের গল্প শোনায় পাঠককে। পাঠককে দেখায় জীবনের বাস্তব রূপ কতটা করুণ, কঠিন ও নিষ্ঠুর হতে পারে! অর্থাৎ লেখক নিজের ও চারপাশের বাস্তব জীবনের রূঢ় অভিজ্ঞতায় ব্যথিত হয়ে বেদনাহত হৃদয় নিয়ে পাঠককে জানিয়েছেন সেইসব জীবনের গল্পগুলো, জানিয়েছেন সেইসব জীবনের অর্থ!
প্রতিটি মানুষকে তার পরিবেশ, পরিস্থিতি সময়ের সাথে সাথে জানিয়ে দেয় তার জীবনের মূলভাব ঠিক কেমন। সময়ের বালুচরে জীবন মুখচোরা পাখির মতো হেসে হেসে বেদনা লুকায়, কখনো কখনো আপন অশ্রুবৃষ্টিতে ভিজে ওঠে প্রচণ্ড নিঃসঙ্গতায়। আবার কখনো পুড়ে যায় রাগ-অভিমান-ক্রোধের রৌদ্র দহনে। তবুও জীবন থেমে থাকে না। আপন গতিপথে দ্বিধাহীনভাবে কেবল ছুটেই চলে দিগদিগন্তে।
তাই দিনশেষে আমরা এটা ভেবেই নিজেকে সান্ত্বনা দেই যে, বিশ্বসংসারে জীবনের সংজ্ঞা এমনই অর্থাৎ লেখক মারুফ ইসলামের ভাষায় ‘জীবন এখানে এমন’ বইটিতে মোট বারোটি গল্প গ্রন্থিত হয়েছে। তারমধ্যে নামগল্প ‘জীবন এখানে এমন’ উল্লেখযোগ্য। তাই সেই গল্পের নামেই লেখক বইটির নামকরণ করেছেন এবং নামটি যথার্থ সার্থকতা পেয়েছে বলে পাঠক হিসেবে আমি মনে করি।
এখানে বেশিরভাগ গল্পই ট্রাজেডিধর্মী। তারমানে যে হাস্যরস একদমই নেই, তা কিন্তু নয়! পাঠক যদি প্রকৃতই রসিক মনের মানুষ হয়ে থাকেন তবেই তিনি এই হাস্যরসবোধ উপভোগ করতে পারবেন, নচেৎ নয়। যেমন একটা উদাহরণ দেই, ‘আমরা এমনি ভেসে যাই’ গল্পে লেখক তার শৈশবের বন্ধু রবির সাথে ফেলে আসা দিনের স্মৃতিচারণে বলেছেন যে, পরীক্ষার সময় রবি তার খাতা দেখে লেখার বলতো, অ্যানা ব্যাকা হয়্যা বসদিনি, তোর খাতা তো দেকপার পাচ্ছি না... অন্তস্থ ক্যাঙ্কা কর্যা ল্যাখে রে...। এইসব ছোট ছোট ঘটনা নিঃসন্দেহে পাঠক হৃদয়ে মৃদু হাস্যরস সৃষ্টি করতে সক্ষম।
কিছু কিছু জায়গায় লেখক মায়ার বন্ধনকে বড় করে তুলেছেন, যেমন ছাতা নামক প্রথম গল্পে। ছাতা মূলত ভালোবাসার প্রতীক যেখানে মঞ্জুর মতো নির্দয় পাষাণ্ডের জন্যও তার অসুস্থ স্ত্রীর হৃদয়ের ব্যাকুলতা প্রকাশিত হয়েছে। মঞ্জুও তার স্ত্রীকে ভালোবাসে বলেই তার ওষুধের টাকা, ভরণপোষণের টাকা জোগাড় করতে একটা নিরপরাধ রাখাল ছেলেকে হত্যা করে। এমনকি পতিতালয়ের সাথি নামের যেই মেয়েটি তাকে সুখ দেয়, ভালোবাসে, বিশ্বাস করে তার ওপর ভরসা করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে— সেই মেয়েটিকেও সে বিক্রি করে দেয়ার মতলব আঁটে। কিন্তু তার পাষাণ হৃদয়েও একটা ভালোবাসার জায়গা আছে যেখানে আজো সে তার হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া বড় বোনের জন্য অপেক্ষা করে আছে। তাই সেই স্নেহবোধ থেকে সে সাথিকে তার পরিবারের কাছে ফেরার ব্যবস্থা করে দেয় এবং আকাশ মেঘলা দেখে ছাতাটি দিয়ে দেয়।
এরকম গভীর মমত্ববোধ প্রকাশ পেয়েছে ‘এসি’ ও ‘ক্রান্তিকাল’ গল্পে। আর সবটুকু দিয়ে ভালোবেসে হারানোর যন্ত্রণায় ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে নামহীন শোক, লীলাক্ষেত্র, একদিন বৃষ্টিতে সন্ধ্যায়, ক্রান্তিকাল ও জীবন এখানে এমন গল্পগুলোতে। আর করুণ মহুর্তগুলি গল্পে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের অধঃপতনের বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে এক সাড়ে নয় বছরের শিশুর জীবনের করুণ অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে।
বইটির প্রচ্ছদ শিল্পী শিশির মল্লিক চমৎকারভাবে তা এক লাইনে বলেছেন এভাবে যে সাড়ে নয় বছরের কিশোর জানে না স্টেশন ছেড়ে যাওয়া ট্রেনের মতো কেন সবাই তাকে ছেড়ে চলে যায়। আবার সেই স্টেশনের কঠিন বুকে কান রেখে লেখক শুনিয়েছেন কাকতালীয়ভাবে নিঃসন্তান দম্পতির কাছে বেড়ে ওঠা আনোয়ার নামের একজন সাদামাটা নিরীহ ছেলের আনার পাগলা হয়ে যাওয়ার রহস্যময় কাহিনি ও তার করুণ মৃত্যুর বর্ণনা।
একজন সামান্য পাগলকে লেখক তার গল্পে অসামান্য চরিত্র করে তুলে ধরেছেন যা লেখকের মহৎহৃদয়ের বহিঃপ্রকাশ। এই গল্পটির শুরুর দিকে লেখকের লেখনি কৌশলের প্রতিভা সত্যিই প্রশংসনীয়। তাছাড়া লেখকের উপমা, উৎপ্রেক্ষা, বর্ণনা, শব্দ বিন্যাস, ভাষাশৈলী বরাবরই চমৎকার লাগে আমার কাছে। আর লেখকের শেকড়ের প্রতি আজন্ম গভীর মমত্ববোধ তাই তিনি নিজের জন্মস্থানের প্রিয় গ্রাম্যশহর নশরৎপুরের আঞ্চলিকতাকে সগর্বে তুলে ধরেছেন এবং লেখক শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত কাঠগোলাপ আর কৃষ্ণচূড়ার ছায়া ঢাকা নশরৎপুর স্টেশন আর রেললাইনের স্মৃতিচারণ করেছেন বারবার তার বিভিন্ন লেখনিতে।
তিনি জানিয়েছেন যে, ব্যস্ত শহরের ঐশ্বর্য তার মনে ক্ষণিকের জন্য নশরৎপুর নামটিকে ম্লান করে দিতে পারেনি। বইটির উৎসর্গ পঙক্তিটি বেশ মনোমুগ্ধকর, যে আমারে দেখিবারে পায় অসীম ক্ষমায়, ভালোমন্দ মিলায়ে সকলি।
পরিশেষে লেখকের জন্য অবিরাম শুভকামনা এবং নতুন বই পাঠের নির্মল আনন্দ উপভোগের অপেক্ষায় রইলাম আমি এক সামান্য পাঠিকা।