প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

নাট্যকার, দার্শনিক আর বিজ্ঞানীদের অদ্ভুত শহর ভ্রমণ

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : মার্চ ০২, ২০২৪

নাট্যকার সেনেকা সঙ্গীদের নিয়ে একটা নতুন শহরে প্রবেশ করে বিস্মিত হলেন। শহরটার ভিতরে সব মৃত মানুষেরা হেঁটে বেড়াচ্ছে। মৃত মানুষরা এভাবে হেঁটে বেড়ায়, এটা কী সম্ভব! মৃত মানুষগুলোর নাক চোখ কান সব আছে। কিন্তু নির্বিকার। সেনেকার সঙ্গী বিজ্ঞানী গ্যালিলিও বললেন, সন্ধান নিয়ে জানা গেছে, এ শহরে সব মৃত মানুষেরাই জন্মায়। বিষয়টা খুব তাৎপর্যপূর্ণ নয় কি? দার্শনিক টমাস মোর  বললেন, রাষ্ট্রের ভিতরে কেমন মানুষ জন্মাবে আর জন্মের পর তারা কেমন আচরণ করবে তা নির্ভর করে রাষ্ট্র পরিচালকরা কীভাবে তা পরিচালনা করে, তার ওপর। গ্যালিলিও বললেন, ঠিক তাই। চার্চের রক্তচক্ষুর সামনে দাঁড়িয়ে আমি নিজেই কি ভয়ে আত্মসমর্পণ করিনি? কারণ রাষ্ট্র চালিত হতো তখন চার্চের কথায়। যদি আমি শাসকদের রক্তচক্ষুর সামনে দাঁড়িয়ে আত্মসমর্পণ না করতাম, যদি আমি শাসকদের অন্যায় দাবি না মেনে নিতাম তাহলে ওরা আমাকে পুড়িয়ে মারতো।

নাট্যকার সেনেকা বললেন, ঠিক বলেছ তুমি গ্যালিলিও। ব্রুনোকে ওরা পুড়িয়ে মেরেছিল। গ্যালিলিও বললেন, শুধু ব্রুনোকে নয় আরো বহু জ্ঞানী মানুষকে সত্য উচ্চারণ করার জন্য ওরা পুড়িয়ে মেরেছিল। সেটা দেখেই আমি ভয় পেয়েছিলাম। নাট্যকার সেনেকা বললেন, গণতান্ত্রিক শাসনের নাম করে রাষ্ট্র সক্রেটিসকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। প্লাটো তাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চলে যান। তথাকথিত গণতন্ত্র তাঁর পছন্দ ছিল না। তিনি চাইলেন, জ্ঞানী মানুষদের শাসন। তিনি বললেন, শাসকদের অবশ্যই জ্ঞানী হতে হবে। টমাস বললেন, প্লাটো গোড়াতেই সমস্যার একটা সমাধান দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন, শাসকরা ক্ষমতায় গিয়েই সন্তান আর পরিবারের জন্য লুটপাট করে। সম্পদের পাহাড় বানায়। প্লাটো তাই আইন করে দিয়েছিলেন, শাসকরা বিয়ে করতে পারবে না। শাসকরা বিয়ে ছাড়াই নারীর সঙ্গে মিলিত হতে পারবে। কিন্তু সেইসব নারীদের সন্তানরা হবে রাষ্ট্রের সাধারণ সম্পত্তি। রাষ্ট্র তাদের দেখভাল করবে। শাসকরা জানতে পারবে না সন্তানটি কার।

গ্যালিলিও বললেন, সন্তানরাই তবে কি পিতামাতার জীবনে এক সঙ্কট? সন্তানের জন্য নিজেরা না খেয়ে থাকে। সন্তানের সুখের জন্য অপরাধে লিপ্ত হয়। কথাটা ঠিক। কিন্তু সত্যি বলতে প্লাটোর বিধান পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্র তাদের সংবিধানে মেনে নেয়নি। সম্ভবত মেনে নিলেই ভালো হতো। সন্তানদের নামেই লুটপাট হচ্ছে রাষ্ট্রের সকল সম্পদ।

মৃত মানুষরা শহরের চারদিকে হেঁটে বেড়াচ্ছে নির্লিপ্তভাবে। বিদেশি আগন্তুকরা তার মধ্যদিয়ে পথ চলছে। হাতে তাদের সময় কম। পৃথিবীতে এককালে কিছু ভালো কাজ করার জন্য জিউসের নির্দেশে প্লুটার্ক তাদের কয়েকজনকে কয়েকদিন বিশেষ বিশেষ শহর ঘুরে বেড়াবার সুযোগ দিয়েছে। গৌতম বুদ্ধ তখন তাঁদেরকে বলেছিলেন একটা বিশেষ শহরের নাম। বলেছিলেন, মান্যবররা আমার ধর্ম একসময় সেই শহরে বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিল। অনেকগুলো বড় বিহার ছিল আমার নামে। যদি সুযোগ হয় দেখে আসবেন শহরটা। গৌতম বুদ্ধ সকলের খুব প্রিয় ও সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। নাট্যকার সেনেকার সঙ্গে আবার বুদ্ধের চিন্তার বিরাট মিল হচ্ছে এই যে, দুজনেই ব্যক্তিগত সম্পত্তি উচ্ছেদের কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, এই সম্পদই মানুষকে ভোগবাদী করে এবং সকল সঙ্কটের কারণ। টমাস নিজেও সেই ঘরানার মানুষ। নিজের বিশ্বাস থেকে তিনি লিখে ফেললেন আস্ত একখানা বই. যার নাম দিয়েছিলেন, `ইউটোপিয়া`। তিনি সঙ্গীদের বললেন, চলুন ঘুরে দেখে আসি কোথাও ইউটোপিয়ার মতো রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিনা।

নাট্যকার সেনেকা বললেন, প্রথম যাওয়া যাক বুদ্ধের প্রস্তাবিত সেই শহরে। চারজন চলে এলেন সেই শহরে, সেখানে এসে সব মৃত নির্বিকার মানুষদের দেখতে পেলেন।  না আছে তাদের মধ্যে জীবনের স্পন্দন, না আছে মনে তাদের কোনো প্রশ্ন। কবি গ্যেটে এই ভ্রমণকারীদের দলে ছিলেন। তিনি কথা না বলে সে শহরের সাহিত্য পাঠে মন দিলেন। নানাভাবে সাম্প্রতিক রচনাগুলি সংগ্রহ করলেন। গ্যেটের চিন্তা পরিষ্কার। সাহিত্য পাঠ করলেই সেই শহরের আসল পরিচয় পাওয়া যাবে। গ্যেটে সমকালীন সাহিত্য পাঠ করে দেখলেন, প্রায় সব সাহিত্য একজনের প্রশংসায় ভরা। খুব কষ্ট হলো গ্যেটের সেসব পাঠ করতে। কারণ সৃষ্টিশীল রচনা মাত্র কয়েকখানি হাতেগোনা, বাকি সব ব্যক্তিপূজা। গ্যেটে বুঝলেন, এই শহর পরিচালনা করছে এমন একজন যাকে প্রায় সবাই দেবতায় উন্নীত করেছে। গ্যেটে মনে মনে হাসলেন, পৃথিবীতে এটা প্রথমবার নয়। মানুষেরাই কখনো কখনো দেবতা হয়ে দাঁড়ায়।

সবাই তারা হাঁটতে হাঁটতে শহরের আর এক প্রান্তে গিয়ে দেখলেন, যেন একটা উৎসব বসেছে। মহাভোজ চলছে একই সঙ্গে। সবাই তাহলে এ শহরে মৃত নয়। ফূর্তিবাজ মানুষরাও বহাল তবিয়তে আছে। গ্যালিলিও বললেন, নিশ্চয় এ শহরে বিশেষ কোনো দিবস পালিত হচ্ছে আজ। গ্যালিলিও কিছুটা সরলভাবে জানতে চাইলেন, শহরের সব মানুষরা তবে এই উৎসবে যোগ দেয়নি কেন? সেনেকা এক কথায় বললেন, এই উৎসবটা সবার নয়, তাই। গ্যালিলিও পুনরায় প্রশ্ন করলেন, শহরের সবাই কি তবে এ উৎসবে আমন্ত্রণ পায়নি? টমাস কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন, গ্যালিলিও আপনি একজন সম্মানিত বিজ্ঞানী। রাষ্ট্র ও শহর সম্পর্কে কিছুটা ধারণা রাখার চেষ্টা করেন। বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রনীতিও কিছুটা বুঝতে হবে আপনাকে। যখন চার্চ আপনার বিচার করছিল, সবাই কি সেখানে একইরকম মতের মানুষ ছিল? যদি সেটাকে আজ আমরা চার্চের একটা উৎসব বলে ধরে নেই, সেখানে আপনার পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন রকম মানুষই ছিল। নাকি? গ্যালিলিও একটু লজ্জা পেয়ে বললেন, হ্যাঁ, তা অবশ্য ঠিক। সবাই সেদিন আমার বিরুদ্ধে ছিল না। সময়টা ছিল আসলে আমার বিরুদ্ধে।

হঠাৎ সেনেকা বললেন, লক্ষ্য করছেন আপনারা? সবাই জানতে চাইলেন কি? খুব হিসেব করে সেনেকা বললেন, কিছুক্ষণ আগে আমরা মৃত মানুষদের পথ চলতে দেখে এসেছি। কিন্তু এই জীবিত মানুষগুলোকে দেখুন। কারোরই মস্তিষ্ক নেই। সবাই একইরকম ভাবভঙ্গি করছে। মহাআনন্দে ভোজসভায় যোগ দিয়ে পানাহারে লিপ্ত কিন্তু এদের কারো মধ্যে আলাদা ব্যক্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। লক্ষ্য করুন, সবার হাসি কান্না পর্যন্ত একরকম।

কিছুটা গর্ব নিয়ে গ্যেটে এই প্রথম কথা বললেন, আপনারা কি আমার `ফাউস্ট` পড়েননি? মনে রাখবেন, লেখাপড়া না করা সমাজটাই হলো একটা মৃত সমাজ। যারা নিজের ইতিহাসটা ভালো করে জানতে চায় না, সেইসব ভীতুর ডিম যারা সঠিকভাবে কিছুই বুঝতে চায় না তারা সবাই মৃত। যাদের একটু আগে দেখে এসেছেন তারা কি তেমন ছিল না? কিছুটা তীক্ষ্ন দৃষ্টি হেনে সেনেকা বললেন, মহান পণ্ডিত গ্যেটে, আপনি জন্মেছেন আমাদের সবার শেষে। আপনার লেখা পড়ার সুযোগ হবে কী করে আমাদের? গ্যালিলিও বললেন, সমালোচকরা বলে আপনি নাকি লিখেছেন সব ছোটলোকদের কথা ভেবে। গ্যেটে বললেন, সমালোচকরা বলবে কেন, ফাউস্টের মুখবন্ধে আমি নিজেই লিখেছি হাটবাজার আর ভিড়ের মানুষদের আমার বেশি পছন্দ। লিখি্ আমি তাদের জন্য। টমাস বললেন, আপনার দুর্ভাগ্য এই যে, ভদ্রসমাজ আপনার লেখা বেশি পাঠ করে। হ্যাঁ, ভদ্রসমাজে আপনার অনেক বেশি ভক্ত ছিল তা আমি জানি। গ্যালিলিও বললেন, মহৎ সাহিত্যের এটাই গুণ তা সকলের হয়ে ওঠে। গ্যেটে বললেন, বাদ দিন সেসব কথা বরং প্রসঙ্গে ফিরে আসুন। ফাউস্টে কি আমি দেখাইনি যে জ্ঞানী মানুষরা পর্যন্ত দীর্ঘকাল সুখ সুবিধা ভোগ করার জন্য শয়তানের কাছে নিজের আত্মাকে বিক্রি করে দেয়? ফাউস্ট অমরত্ব লাভের জন্য তার আত্মা বিক্রি করলো শয়তানের কাছে। পরে অনুতাপ করেও আর কাজ হয়নি। কথাটা ঠিক যে ফাউস্ট হচ্ছে একটি লোককথা, আর আমি তাকে আবার নতুন করে সৃষ্টি করেছিলাম। ফলে এটা এমন কোনো নতুন কথা নয়।  বহুকাল ধরে সাধারণ মানুষ এসব বিশ্বাস করেছে। মানুষ শয়তানের কাছে আত্মা বিক্রি করে, শাসকদের কাছে মস্তিষ্ক বিক্রি করে এসব সাধারণ মানুষের অজানা নয়।

টমাস খুব শান্ত আর নিস্পৃহভাবে একটা শব্দ উচ্চারণ করলেন, `ঠিক`। নাট্যকার সেনেকা বললেন, টমাস মোর আপনি শাসকদের কাছে মাথা বিক্রি করেননি বলেই আপনার মাথাটা কাটা পড়েছিল। টমাস বললেন, মান্যবর সেনেকা আপনি মাথা বিক্রি করতে রাজি হলেন না বলেই সম্রাট নিরো আপনার কী হাল করেছিল।

সবাই তাঁরা উৎসবের দিকে এগিয়ে গেলেন। খানাপিনার কাছাকাছি গিয়ে দেখলেন সেখানে একপাল নাট্যকার বসে আছেন। বর্তমানকালের বহু বিদেশি অতিথি আছেন সেই সভায়। বহু কূটনীতিকে গিজগিজ করছে। নাট্যকার ইস্কাইলাস, সফোক্লিস, ইউরিপিডিস, অ্যারিস্টোফেনিস, মার্লো, শেক্সপিয়ার, বার্নার্ড শ, ব্রেশট প্রমুখ সবাই বসে আছেন সেখানে। ইবসেনসহ অবশ্য আরো অনেকে আসেননি। জানা গেল গৌতম বুদ্ধের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই তাঁরা সবাই এখানে এসেছেন। বুদ্ধ নাকি তাঁদেরকে বলেছেন মানুষের তানহা বা বড় বড় আকাঙ্ক্ষা কিংবা ভোগবাদিতার পরিণাম কী হতে পারে তা দেখে আসুন। মানুষের লোভ মানুষকে কত বড় দুর্বৃত্ত বানাতে পারে দেখে এসে দয়া করে আমাকে বিবৃত করুন। ইবসেন রাজি হননি। বলেছেন তিনি জানেন, মানুষের লোভ কতদূর যেতে পারে। ভাস, কালিদাস, বিশাখদত্ত, ভবভূতি, শূদ্রক প্রমুখ নাট্যকার বুদ্ধের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলেছেন বুদ্ধের পরামর্শ মেনে তাঁরা বুদ্ধের সেই শহরে যেতে লজ্জা পাচ্ছেন। কারণ সেই শহরের নাট্যকাররা নাকি বহু আগেই নিজেদের বিক্রি করে দিয়ে বসে আছেন। নাটক এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে পুরো মাত্রায় শাসকদের পদলেহনের উপায় মাত্র। ব্যতিক্রম হাতেগোনা। বুদ্ধ মন খারাপ করলেও আর জোর করেননি তাঁদের।

বাকিরা এসেছেন এই লক্ষ্য নিয়ে, নাট্যকার বা কবিরা যেখানে বিক্রি হয়ে যায় সেখানে নতুন নাট্য রচনার আখ্যান বা পদ্ধতি কেমন হতে পারে সেই নিরীক্ষা চালাতে। সব কিছু দেখার পর ইস্কাইলাস, সফোক্লিস আর ইউরিপিডিস তর্কে লিপ্ত হয়েছেন। বিশ্বাসই করতে পারছেন নাট্যকারদের এমন দশা  হতে পারে। নাটক তাদের রচনায় সমাজের দর্পন হতে পারছে না। হাসছেন কেবল নাট্যকার অ্যারিস্টোফেনিস মন খুলে।  মার্লো, শেক্সপিয়ার, বার্নার্ড শ, ব্রেশট পুঁজিবাদের যুগের মানুষ ছিলেন। নতুন এই শহরের মানুষের চাটুকারিতার ভাষা মনোযোগ দিয়ে রপ্ত করছিলেন। শেক্সপিয়ার ভাবছেন, এমন ভাষা তাঁর আগে জানা থাকলে তাঁর নাটকগুলোর সংলাপ ভিন্নভাবে সাজাতে পারতেন। কারণ তিনি পুঁজিবাদের শুরুটা দেখেছেন শেষটা দেখেননি। সামন্ত আর পুঁজিবাদের মাঝখানে তাঁর জন্ম। চাটুকারিতার বহু মাত্রিক রূপ দেখে বার্নার্ড শ মুগ্ধ। মার্লো ঘৃণা প্রকাশ না করে পারলেন না।

দূর থেকে ব্রেশটকে দেখে এগিয়ে এলেন গ্যালিলিও। গ্যালিলিওকে নিয়ে একটা নাটক লিখেছিলেন ব্রেশট। গ্যালিলিওর সম্মানটা ভালোভাবে রক্ষা করেছেন। তিনিই মানে ব্রেশট একমাত্র গ্যালিলিওর চার্চের কাছে আত্মসমর্পণের সঠিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তাঁর নাটকে দুটি সংলাপের মাধ্যমে। গ্যালিলিওকে দেখে ব্রেশট সসম্মানে এগিয়ে এলেন। টমাস জানতে চাইলেন ব্রেশটের কাছে, নতুন নাটকের আখ্যানের সন্ধানে কি এই শহরে এসেছেন? ব্রেশট বললেন, টমাস মোর আপনি আমার শিক্ষক সমতুল্য। মাথার মধ্যে একটা স্বপ্ন নিয়ে আমি নাটক লিখেছি। সেই স্বপ্নটা অনেক আগেই আপনি দেখেছেন আপনার ইউটোপিয়া গ্রন্থে। বুদ্ধের পরামর্শেই এই শহরে আমার আগমন সন্দেহ নেই। সেই সঙ্গে আমার নাটকে আমি যা বলার চেষ্টা করেছিলাম, তা ঠিক ঠিক বলতে পেরেছি কি না তা পর্যবেক্ষণ করতে আমার এখানে আসা। বুদ্ধকে আপনারা পছন্দ করেন তাঁর নির্লোভ মানসিকতার জন্য। কিন্তু আমি পছন্দ করি সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। তিনি বহু শতক আগেই ব্যক্তিগত সম্পত্তি উচ্ছেদের কথা বলেছিলেন। টমাস বললেন, পুঁজিবাদের কিছুই তো পেলাম না এই শহরে। না জ্ঞানবিজ্ঞানের অগ্রগতি না কর্মচঞ্চল তীক্ষ্ম মেধার মানুষ। মৃত মানুষ আর মস্তিষ্কহীন মানুষই দেখতে পাচ্ছি চারদিকে।

ব্রেশট বললেন, ক্ষমা করবেন টমাস। কখনো আমি ঘটনাটাকে বড় করে দেখি না, তার পেছনে কি কারণ আছে জানার চেষ্টা করি। এ শহরেও একটা বড় কারাগার আছে সেটা আপনারা দেখেননি এখনো। সেখানেও মস্তিষ্কহীন লোভী মানুষদের পাবেন। নিশ্চয় সেইসঙ্গে পাবেন ক্ষুব্ধ মানুষদের। কিছু বুদ্ধিমান আর আত্মত্যাগী মানুষদের পাবেন। যারা এ সমাজটাকে আর মানতে পারছে না। যারা লড়তে চায় তাদেরকে পর্যন্ত পাবেন। জানেন তো পুরানো মদ আর লড়াই দুটাই আমার পছন্দ। সেনেকা বললেন, নাট্যকার আপনার তো লড়াইটা হতে হয় আবার সব চিন্তাশীল মানুষদের নিয়ে। কার্ল মার্কস হলেন আপনার গুরু। সেই জন্য আপনি মনে করেন সঠিক চিন্তা বাদ দিয়ে সঠিক পথে লড়াই হয় না। কিন্তু শুনতে পেলাম এখানকার লড়াই করা মানুষরা নাকি রাষ্ট্রের শত্রুদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। ব্রেশট বললেন, কথাটা ঠিক বলেছেন। কিন্তু আপনার কি স্মরণ আছে আমার মতো একজন সমাজতন্ত্রী শাসকদের রক্তচক্ষুর ভয়ে পালিয়ে কোন দেশে গিয়েছিলাম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ঠিক শত্রুর দেশেই। কারণ আমার দেশের শাসকরা সেদিন আমার শত্রুর চেয়েও ভয়াবহ ছিল আমার জীবনে। নিঃসন্দেহে শত্রু রাষ্ট্র আরো ছিল সেদিন। কিন্তু শত্রু রাষ্ট্র মার্কিন দেশে আশ্রয় মিলেছিল আমার। সেদিন আইনস্টাইন সহ আরো বহুজনকে পালাতে হয়েছিল নিজেদের দেশ ছেড়ে।

ঠিক ঠিক। বললেন টমাস মোর। সব পক্ষের যুক্তি আছে সম্মানিত ব্রেশট। শাসকরা সবাই একইরকম। যারা আমরা এখানে আছি আমরা কেউই সেইসব শাসকদের অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পাইনি। বলতে পারেন শাসনযন্ত্রের হাত থেকে। আমাদের কারো মাথা কাটা গেছে, কাউকে কারা বরণ করতে হয়েছে কাউকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে। শাসক পাল্টালেই যে শহরের সঙ্কটের সব সমাধান হয়ে যাবে তা নয়। দরকার বোধসম্পন্ন নাগরিক। যারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ব্যক্তিপূজায় বিশ্বাস করে না। গ্যালিলিও বললেন, যখন আপনার বাক স্বাধীনতাই কেড়ে নেয়া হয় আপনি তখন কী করবেন? যদি আমার বাক স্বাধীনতা কেড়ে না নেওয়া হতো আমি বিজ্ঞানকে আরো বহু কিছু দিতে পারতাম। হাসলেন সেনেকা। বললেন, কিন্তু কারাগারে আটকে রেখে চার্চ কি আপনার ইচ্ছাশক্তিকে দমাতে পেরেছিল? আপনি কারাগারের মধ্যে বসেই শাসকদের চোখ এড়িয়ে লিখে ফেললেন, বিজ্ঞানের সেই বিখ্যাত গ্রন্থ। আজ আপনিই টিকে আছেন সম্মান নিয়ে। যারা আপনাকে কারাগারে পাঠিয়েছিল আজ কোথায় তারা? ব্রেশট বললেন, একটা রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য কি জানেন? যখন বুদ্ধিজীবীরা সবাই মিলে শাসকদের পদলেহন করে। বিদগ্ধ মানুষের কাজ শাসকদের ভুল ত্রুটি ধরিয়ে দেয়া। দরকার মতো শাসকদের সমালোচনা করা। নিজেদের মতবাদটা সেইসঙ্গে প্রচার করা। কিন্তু সমাজের এগিয়ে থাকা মানুষরা যখন কিছু বাড়তি সুবিধালাভের জন্য  এই শাসক বা ঐ শাসকের চাটুকারিতায় লিপ্ত থাকে সেখানে সবার আগে ধ্বংস হয় শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হওয়ার পরিণাম হলো সবসময় এর বা ওর গোলামী করা। সেই সঙ্গে ভিন্ন রাষ্ট্রের দাসত্ব বরণ।

সকলে হঠাৎ লক্ষ্য করলেন দূরে সক্রেটিস দাঁড়িয়ে আছেন সঙ্গে জোয়ান অব আর্ককে নিয়ে। সক্রেটিস খুব ধীরে ধীরে জোয়ানকে বলছিলেন, পুরস্কারের লোভে কিছু না করাটাই হচ্ছে প্রকৃত দায়িত্ব পালন। প্রিয় জোয়ান, যখন তুমি শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে গেলে তখন কি কোনো পুরস্কার আশা করেছিলে? যখন ইংল্যান্ড ফ্রান্সকে দখল করে রেখেছিল, রাজা এবং জনসাধারণ তা নীরবে মেনে নিয়েছিল। সেটা তুমি মানতে পারোনি জোয়ান। মাত্র পনেরো বছরের বালিকা তুমি তখন। ভিন্ন রাষ্ট্রের তাবেদারি মানতে চাওনি। যারা তোমার দেশ দখল করে রেখেছিল অন্য শত্রুদের বাদ দিয়ে আগে তাদের হঠাতে চেয়েছো। ফ্রান্সের জনগণের মুক্তির লক্ষ্যে এগিয়ে গেলে তুমি। মৃত একটা জাতিকে জাগিয়ে তুললে। ঘুমন্ত দুর্বল আত্মবিশ্বাসহীন রাজাকে সাহস জোগালে। বললে, ভিন্ন রাষ্ট্রের তাবেদারি করা মানায় না আপনাকে। তাদের দখল থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে, স্বাধীনভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে। হ্যাঁ, তোমার ডাকে অবশেষে রাজার ঘুম ভাঙলো। যুদ্ধের নেতৃত্ব দিলে তুমি পনেরো বছরের বালিকা। বড় বড় সেনাধ্যক্ষ তোমার নির্দেশে লড়াই করলো। সকলের তাদের ছিল লড়াইয়ের দক্ষতা, তোমার ছিল মনোবল। ছিল স্বাধীনতা লাভের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে কতো লড়াইয়ে তাই তুমি জিতে গেলে দৃঢ়চিত্ত নিয়ে।

নাট্যকার ব্রেশট এদিকে বলছিলেন সবাইকে, আমি কখনো নেতিবাচক চিন্তা করি না। কারণ ইতিহাস সাময়িক বাধা অতিক্রম করে সামনের দিকে এগিয়ে চলে। সবার আগে তাই সামনের বাধাটাই দূর করতে হবে। চূড়ান্ত ভাগ্য পাল্টাবার প্রথম লক্ষণ সবচেয়ে  সম্মুখের বাধাটাই আগে সন্ধান করা।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ