অঙ্কনঃ রিফাহ সানজিদা

অঙ্কনঃ রিফাহ সানজিদা

নাটা হারুন

এস এম শাহরুখ পিকলু

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৮

যে দিন নাটা হারুনের লাশটা গুলশান লেকের কোন এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী জেলের ছিপের আংটায় বিঁধলো আমি কেমন যেন এক মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় পড়ে গেলাম। মরা-পচা গুলশান লেকে কোন পাগল ছিপ ফ্যালে তা নয় কিন্তু হারুন ছেলেটাকে আমি চিনতাম। ওর প্রস্থানে যে এলাকাবাসী খুশি হলো তা বুঝলাম। তারা খুশি হবে নাই-বা কেন- চাঁদাবাজি, মারামারি, প্রয়োজনে ক্ষুর-চাপাতির ব্যবহার, দু’চারটা খুনের (ভিত্তিহীন নয়) অপবাদ সবই তার ছিলো। ওর মৃত্যুতে আমার কেন খারাপ লাগবে তা আম-জনতা বুঝবে না, তারা এটাও বুঝবে না যে এখন মোটু জাফর বা কানা কামাল সেই একই কাজ করবে। পাবলিক ঠিকই চাঁদা দেবে, মেয়েরা অহেতুক হয়রানিতে পড়বে, কারো বোনের স্তন বা নিতম্ব হঠাৎ কোন চাপে পড়বে, কেউ কেউ খুন হবে কিন্তু বর্তমানের আপদ বিদায়ে মানুষ আপদের স্থায়ীত্বের কথা ভুলে যায়। কাল সূর্য উঠবে, নতুন দিন শুরু হবে- মানুষ বোঝে না যে ঐ নতুনে কোন নতুনত্ব, প্রায়ই থাকে না। যে-কার সেই।
 
 
হারুনের মৃত্যুকালে ওর বয়স আর কতই হবে, পঁচিশ কি ছাব্বিশ- কথিত বন্দুকযুদ্ধ নাকি স্রেফ খুন তা জানিনি, জানার ইচ্ছাও হয়নি, তবে সে এখন অতীতের একটা অংশ যা কিনা সবাই ভুলে যাবে কোন লম্বু বা টাক্কু মাস্তানের দাপটে। আমি?...নাহ্‌, তা পারবো না। আমি ওর থেকে দশ/এগারো বছরের বড় ছিলাম। ছেলেটার দেশের বাড়ি ছিলো চাঁপাই নওয়াবগঞ্জে, বাপের সূত্রে জামাতি কিন্তু ওর ‘গডফাদার’ ছিলো ‘চেতনা-য় ‘উদ্বুদ্ধ’। এই অন্ধকার রাজ্যে কোথাকার পানি কোন মদে মিশে কার মাঝে কি উন্মত্ততা সৃষ্টি করে তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না- মদে ভেজাল, পানিতে দুর্ঘন্ধ। আমি এক রকমারি দোকান চালাই, তার পাশের দোকানটা ছিলো গাড়ির গ্যারেজ, ওখানেই হারুনের ছুটকা চাকরি, সে যখন পনেরো কি ষোলো। বেঁটে, পেট মোটা হারুনের কপালে প্রথমে জুটলো বাট্টু নামটা, পরে তা হলো নাটা। নাটা মাছের মত দৈহিক গড়ন কিনা জানি না কিন্তু নাটা নামে তার কোন আপত্তি ছিলো বলে মনে হয় না। আমাকে সে ডাকতো ভাইজান। আমি ওকে ঢাকা শহরের ‘রূপ’ সম্পর্কে বিভিন্ন জ্ঞান দিয়েছিলাম বলে সে আমাকে মানতো, বোধ হয় শ্রদ্ধাও করতো। কিন্তু শ্রদ্ধা জিনিসটা কী তা সে জানতো কিনা সে আল্লাহই জানে।
 
 
তবে সম্যক জ্ঞান যাকে বলে তা সে আমার থেকে বেশিই রাখতো। ক্রমে ক্রমে সে এলাকার তদকালীন গডফাদারের লোকেদের এবং পরে স্বয়ং গডফাদারের কাছে পৌঁছে গেলো নিজ ‘গুণ’-এ। নাম হলো তার নাটা হারুন- বড় রংবাজ, সে কারোর দিকে চোখ রাঙালে তার খবর আছে জাতিয় অবস্থা। সে একটা মোটরসাইকেল কিনলো, নাম যদিও তার চীনা, হুয়াংহো বা সিনঝিন জাতিয় কিছু কিন্তু আমাকে সে জানালো একদিন, “ভাইজান, একটা হুন্ডা কিনছি”। বাংলাদেশে সব মোটরসাইকেলের নামই প্রথমে হুন্ডা, পরে অন্য কিছু। তা আমি ওকে আমার ইন্টার পাশের জ্ঞান জাহির করে বলতে চেয়েছিলাম যে, হোন্ডা তো জাপানি দামি ব্র্যান্ড কিন্তু ওর বেলুনটা আর ফুটো করলাম না। বরং তাকে বললাম, “কিরে, তুই নাকি এখন বড় রংবাজ, কাশেম মিঞার চ্যালা? তুই কি জানোস যে কাসেম নৌকা করে?” দাঁত ক্যালিয়ে আমাকে বললো, “কাসেম মিঞা জাহাজ করলেই আমার কি? আমি কাজের মজুরি পাই। এর বেসি (ও বেশিকে তখনো বেসি উচ্চারণ করে, যেমন স্যুপকে বলে শুপ)আর কি দরকার?” আরো বললো যে, তাকে সবাই নাটা হারুন ডাকে আর সেই নাম নাকি ভীতিপ্রদ। ও নাটা উপাধিতে কেন গর্ব অনুভব করে সে রকম দার্শনিক প্রশ্ন ওকে আর করলাম না। আমি এতটা বোকা নই যে, ঢাকার মাস্তানদের নামের আগে একটা বিশেষণ লাগে সেটা বুঝি না। খুব অল্প বয়সে সুইডেন আসলামের নাম শুনেছিলাম, সে নাকি এখনো কোন এক জেলে রাজার হালে আছে। তা নামের আগে সুইডেন বা ব্রিটেন বা মালয়েশিয়া থাকলে সমস্যা দেখি না কিন্তু এটাও মনে পড়ে আজ থেকে প্রায় পনেরো বছর আগে অপারেশন ক্লিন হার্ট বা ক্লিন কিছুর গুলিতে শান্তিনগর বাজারের সামনে মরেছিলো মুরগি মিলন। সেই মিলন কী নিজের নামের আগের বিশেষণে বুক ফুলিয়ে হাঁটতো, মুরগির বাচ্চার মত। ব্যাপারটা তা হলে দুঃখজনক কারণ মুরগি নামে বাঘের কোন ব্যাঞ্জনা নেই, তা থাবায় যতই জোড় থাকুক।
 
 
তা সেই চাঁপাই নওয়াবগঞ্জের হারুন যে কিনা এক জামাতির বীর্যের ফল সে নৌকার গডফাদারের আকাম করে আজ মৃত। মৃত মানুষের কোন চিন্তাশক্তি নেই, যুক্তিবিদ্যা তাই বলে। ও কী এখনও পরজন্মে নিজের নামের আগের ‘নাটা’ সংযোজন নিয়ে গর্বিত? নাকি ওর জীবনে যা পাওয়ার তার থেকে এই পঁচিশ বছরেই তার চেয়ে বেশি পেয়ে সে মৃত হয়েও খুশি? পুলসেরাতে দ্যাখা হলে ওকে জিগ্যেস করবো। জীবন চলতে থাকে এ শহরে জীবনের রীতিতে। সে রীতি সত্য কি ন্যায়ের পথে তা নিয়ে কারোর মাথাব্যথা নেই, চললেই যেন হলো। জীবন্মৃত মানুষের ঢলে কে জীবিত, সেটা ধর্তব্য নেই আর, মরা মানুষ কবরে শুয়ে থাকে, তার মুখ কোন দিকে কী এসে যায় তাতে! বেঁচে থাকাই যেন জয়- করুণ জীবন, অসহনীয় অস্তিত্ব, বেঁচে থাকা যেন মৃত্যকে ঠেকিয়ে রাখার অপর নাম। মৃত্যুতেও মুক্তি নেই বলে চারদিকে মোল্লাদের প্রচার- মৃত্যুর পরেই নাকি আসল জীবন শুরু। লে হালুয়া – না চাইতেও মুখ থেকে বেরিয়ে যায়। মরেও তো শান্তি নেই! শান্তি তবে কোথায়- মদের বোতলে বা ফেন্সি বা ইয়াবায়। সর্বোনাশের আর বাকি কী তবে। মদ হারাম, বিজ্ঞজনে বলে। লে হালুয়া বলতে হয় বারংবার।