নাটক ‘স্তালিন’ সম্পর্কে কিছু কথা

শাহেরিন আরাফাত

প্রকাশিত : জুন ৩০, ২০১৯

সম্প্রতি কামালউদ্দিন নীলুর নির্দেশনায় একটি নাটক শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় মঞ্চস্থ হয়। নামের কারণেই নাটকটি দেখতে সমাজতন্ত্র-কমিউনিজমে আস্থাশীল অনেকে আগ্রহ বোধ করেন। কিন্তু ‘স্তালিন’ নামের এ নাটকে কমিউনিস্ট আন্দোলনের মহান শিক্ষক কমরেড যোসেফ স্তালিনকে বিতর্কিত ও বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়। এ নিয়ে নাটকটি দেখতে আসা দর্শকরা মঞ্চস্থলেই প্রতিবাদ জানান। উপস্থিত একাধিক দর্শক জানান, তারা আগেই ভেবেছিলেন ‘স্তালিন’ নাটকটিতে হয়তো স্তালিনকে দ্বান্দ্বিকভাবে উপস্থাপন করা হবে। অর্থাৎ, এতে স্তালিনের সমালোচনাও থাকতে পারে, এটা তারা জানতেন। তবে যেভাবে ইতিহাস বিকৃতি ঘটানো হয়েছে, স্তালিনের সমসাময়িক যে ঐতিহাসিক বাস্তবতা সাম্রাজ্যবাদীরাও প্রকাশ্য ও গোপন দলিলে মেনে নিতে বাধ্য হয়, সেটাকেও ওই নাটকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়। আর এ নিয়েই দর্শকরা কামালউদ্দিন নীলুকে তাদের আপত্তির কথা জানান। এতে নীলু দর্শকদের সঙ্গে অসৌজন্য আচরণ করেন। ঘটনার পরদিন, ১২ জুন উপস্থিত দর্শক, বিভিন্ন বামপন্থী ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগঠন বিক্ষোভ সমাবেশ করে শিল্পকলা একাডেমির সামনে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের বিভিন্ন মতামত ও অবস্থান দেখা যায়।

বামপন্থী ও কমিউনিস্টরা এ নাটককে সাম্রাজ্যবাদী প্রপাগাণ্ডা হিসেবেই আখ্যায়িত করেছেন এবং এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানিয়েছেন। প্রগতিশীল নামধারীদের একাংশ আবার এ বিক্ষোভকে ‘হঠকারী’ বলেও আখ্যায়িত করেছে। তাদের মতে, নাটকের বিক্ষোভ নাকি শুধু পত্রিকায় লেখা দিয়ে করতে হবে! তা না হলে নাকি গণতন্ত্রের জাত যাবে! এই অংশটি আবার বিভিন্ন সময়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও থেকেছে, তাই সংখ্যায় অল্প হলেও তাদের বিভ্রান্তি নিয়ে বলাটা খুব জরুরি। এখানে উল্লেখ্য যে, সরকারপন্থী বুদ্ধিজীবী বা সাংস্কৃতিক জোট আবার কামালউদ্দিন নীলুকে লক্ষ্য করেই আক্রমণ করতে চাইছে। যেহেতু নীলু নরওয়ে ও ড. ইউনুসের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই সরকারপন্থীরা ‘স্তালিন’ প্রশ্নে নয়, নীলুকেন্দিক এক সমালোচনা সামনে আনতে চাইছে। তাই এই লেখায় তাদের অবস্থানটা পুরোপুরি ত্যাজ্য ধরেই এগোনো হচ্ছে।

নাটক ‘স্তালিন’ মঞ্চস্থ হওয়ার পর, এই সাম্রাজ্যবাদী প্রপাগাণ্ডার পক্ষে-বিপক্ষে বা কথিত নিরপেক্ষ স্তরে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের বহুবিধ মতামত, মন্তব্য, অবস্থান সামনে এসেছে। এর ফলে কিছু মৌলিক প্রশ্নও নতুন করে সামনে আসে- স্তালিন কেন আক্রমণের লক্ষ্য? শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রশ্নে বিপ্লবী মার্ক্সবাদীদের অবস্থান কি হবে? মুক্তি কোন পথে? সাম্রাজ্যবাদী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদবিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে যা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

দুই.
নাটকের শুরুই হয়েছে মিথ্যাচারের মধ্যদিয়ে। উপস্থিত বন্ধুরা জানিয়েছেন, ‘স্তালিন’ নাটকের শুরুতেই বলা হয়, এ নাটকের কোনো ঘটনা, চরিত্র বা স্থান-কালের সঙ্গে বাস্তবের মিল খোঁজার চেষ্টা যেন দর্শকরা না করেন। অথচ নাটকের প্রতিটা চরিত্র ও ঘটনাক্রম ঐতিহাসিক এবং অবশ্যই বিকৃত। নাটকের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত স্তালিনকে উপস্থাপন করা হয়েছে একজন মাতাল, খুনি ও উন্মাদ হিসেবে। সেখানে খুব কৌশলে দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধের ঘটনাক্রম এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। যেন মাতাল হয়ে, মানুষ খুন করেই হিটলারের মতো দোর্দণ্ড ফ্যাসিবাদকে আটকে দেওয়ার কৌশল আবিষ্কার হয়েছিলো! দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধে তাঁর নায়কোচিত বিপ্লবী অবস্থান তাঁকে মানব ইতিহাসে বিশেষ স্থানে আসীন করেছে। কার্যত তিনি ফ্যাসিবাদের সামনে বুক পেতে দিয়ে পরম মমতায় মানবজাতিকে আগলে রেখে বাঁচিয়েছিলেন। আজ যে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দালালেরা মুখ উঁচিয়ে কথা বলতে পারে, হিটলারের আগ্রাসন থেকে না বাঁচালে, তারা হয়তো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পেই আত্মাহুতি দিতো!

সাম্রাজ্যবাদীরা ঐতিহাসিকভাবে বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্ট, গণতান্ত্রিক ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধীদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক মোড়কে প্রপাগাণ্ডা চালিয়ে আসছে। আর বরাবরই এ আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য করা হয় কমরেড স্তালিনকে। কারণ তিনি সাম্রাজ্যবাদীদের নাভিশ্বাস তুলেছিলেন। কমরেড লেনিন পরবর্তী সময়ে যোগ্য নেতৃত্ব হিসেবেই কমরেড স্তালিন বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট বিপ্লব ও জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম অগ্রসর করতে ভূমিকা রেখেছিলেন। ঘরে-বাইরে বিভিন্ন ফ্রন্টে সংগ্রাম পরিচালনা করতে হয় স্তালিনকে, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে সফল করার জন্য সংগ্রাম, ট্রটস্কিবাদের বিরুদ্ধে তীব্র মতাদর্শগত সংগ্রাম, বিপ্লবোত্তর পরিস্থিতিতে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম, কমরেড লেনিনের জীবনাবসানের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক অগ্রগতি অব্যাহত রাখার সংগ্রাম এবং সর্বোপরি হিংস্র উন্মত্ত ফ্যাসিবাদের কবল থেকে মানবজাতিকে রক্ষার সংগ্রাম। শুধু তা-ই নয়, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে অটুট রাখতে তিনি পুঁজিবাদী ও উপনিবেশিক দেশগুলোতে কমিউনিস্ট পার্টি গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।

কমরেড স্তালিনই সর্বপ্রথম কমরেড লেনিনের শিক্ষা ও তত্ত্বকে সূত্রবদ্ধ করে ‘লেনিনবাদ’ প্রতিষ্ঠিত করেন। লেনিনবাদকে মার্ক্সবাদের বিকশিত রূপ হিসেবে উল্লেখ করে, এটিকে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার ভিত্তিতে দাঁড় করিয়েছেন কমরেড স্তালিন। তিনি বলেন, ‘লেনিনবাদ হলো সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের যুগের মার্ক্সবাদ। আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, লেনিনবাদ হলো সাধারণভাবে সর্বহারা বিপ্লবের মতবাদ ও রণকৌশল এবং বিশেষভাবে এ হলো শ্রমিকশ্রেণির মতবাদ ও রণকৌশল।’ ১৯২৪ সালে ‘লেনিনবাদের ভিত্তি’ এবং ১৯২৬ সালে ‘লেনিনবাদের সমস্যা’ গ্রন্থ দুটিতে লেনিনবাদের বিস্তৃত আদর্শগত ব্যাখ্যা দেন স্তালিন। কমরেড লেনিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে তীব্র মতাদর্শগত বিরোধ দেখা দেয়। ১৯২২ সালের ৩ এপ্রিল পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে কমরেড লেনিনের প্রস্তাবে কমরেড স্তালিন পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, একই বছরে গঠিত হয় ‘ইউনাইটেড সোভিয়েত সোস্যালিস্ট রিপাবলিক’ সংক্ষেপে ইউএসএসআর। কমরেড লেনিনের অবর্তমানে কমরেড স্তালিনকে একদিকে সোভিয়েতের সমাজতান্ত্রিক নির্মাণকাজ চালু রাখতে হয়, আবার পার্টির অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা ট্রটস্কি-বুখারিন-জিনোভিয়েভ-কামেনেভ-রাডেক চক্রের পার্টি, স্তালিন ও সোভিয়েত সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই চলতে থাকা কার্যকলাপ মোকাবিলা করতে হয়। এই সংকটের মধ্যেই তিনি লেনিনবাদের ভিত্তিতে তীব্র আন্তঃপার্টি সংগ্রাম পরিচালনা করেছিলেন।

কমরেড স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েতে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯২৮-৩২) পরিচালিত হয় এবং সাফল্য অর্জন করে। অথচ ওই সময়ে পুঁজিবাদের তীব্র আর্থিক মন্দা চলতে থাকে। পরিকল্পনার চার বছরে সোভিয়েতে যখন শিল্পোৎপাদন বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে তখন পুঁজিবাদী দেশ যথাক্রমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তা কমেছে শতকরা ৫৭ ভাগ, ব্রিটেনে কমেছে শতকরা ১৮ ভাগ, জার্মানিতে কমেছে শতকরা ৪০ ভাগ এবং ফ্রান্সে কমেছে শতকরা ৩০ ভাগ। দ্বিতীয় পরিকল্পনায় (১৯৩৩-৩৭) কৃষিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিলো। এর ফলে ১৯৩৫ সালের গোড়াতেই শতকরা ৮৫ ভাগ জমি যৌথ খামারের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং উৎপাদিত পণ্য বৃদ্ধি পায় শতকরা ২৬৯ ভাগ।

১৯৩৬ সালে সোভিয়েতের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে এক আমূল পরিবর্তন ঘটে। ওই বছরই এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নতুন সংবিধান রচিত হয়। ওই সংবিধানে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের তুলনায় আরও অনেক বেশি গণতান্ত্রিক অধিকার দেওয়া হয়। ১৯৩৮ সালে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির অনুমোদনক্রমে কমরেড স্তালিন রচনা করেন ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির (বলশেভিক) ইতিহাস- সংক্ষিপ্ত পাঠ’। ১৯৪১ সালের ২২ জুন হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে। প্রতিরোধ যুদ্ধে কমরেড স্তালিন ঘোষণা করলেন, “কেবল আমাদের দেশকেই মুক্ত করা নয়, ফ্যাসিবাদী প্রভুত্বে নিপীড়িত জনগণকেও আমরা মুক্ত হতে সাহায্য করব। ...এ যুদ্ধ সমগ্র মানবজাতির মুক্তি ও গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপান্তরিত হবে।”

কমরেড স্তালিনের আহ্বানে লেনিনগ্রাদের যুদ্ধে ৩ লাখ লালফৌজের পাশে সমবেত হয় সমগ্র লেনিনগ্রাদের জনসাধারণ। প্রবল প্রতিরোধের মুখে পিছু হটতে হয় হিটলারের ২ লাখ সেনা, ৮৪৬টি বিমান এবং ৪০০টি ট্যাঙ্ককে। হিটলারের মস্কো দখলের পরিকল্পনা ‘অপারেশন টাইফুন’ মুখ থুবড়ে পড়ে। লালফৌজের সবচেয়ে গৌরবের লড়াই ছিলো স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ। এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মার্শাল জুকভ। শুরুতে নাৎসিরা স্তালিনগ্রাদের শতকরা ৭৫ ভাগ অংশই দখল করে নেয়। স্তালিনগ্রাদের জনগণ লালফৌজের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে পুরোটাই তাদের হাত থেকে মুক্ত করে। লেনিনগ্রাদ, মস্কো, স্তালিনগ্রাদের লড়াইয়ে লালফৌজের কাছে আত্মসমর্পণ হিটলারের জন্য ছিলো খুব বড় আঘাত। ১৯৪৫ সালের ১ মে কমরেড স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত লালফৌজ বার্লিনের রাইখস্ট্যাগে কাস্তে-হাতুড়ির লাল পতাকা উড়িয়ে মানবজাতির চরমতম শত্রু ফ্যাসিবাদের পরাজয় ঘোষণা করেছিলো।

স্তালিনের বড় ছেলে, রেড আর্মির লেফটেন্যান্ট ইয়াকভ জুগাশভিলি ফ্যাসি-বিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধ চলাকালীন হিটলারের নাৎসি বাহিনীর হাতে বন্দি হন। তাঁকে মুক্তির বিনিময়ে নাৎসি জেনারেলের বন্দি বিনিময়ের প্রস্তাবও স্তালিন অগ্রাহ্য করেন। কারণ তিনি নিজের ছেলেকে রেড আর্মির আর দশজন সদস্য থেকে ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করেননি। পরে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দি ইয়াকভকে গুলি করে হত্যা করা হয় বলে ব্রিটিশদের হাতে থাকা জার্মান নথি সূত্রে জানা যায়। ফ্যাসিবিরোধী যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিলো প্রথম স্থানে। এই যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিলেন ২ কোটি সোভিয়েত জনগণ। যুদ্ধের সময় শিশুসহ ৫০ হাজারের বেশি মানুষকে জার্মানিতে দাস শ্রমিক হিসেবে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। যুদ্ধ চলাকালীন সোভিয়েতের ৫৩ লাখ যুদ্ধবন্দির মধ্যে যুদ্ধের শেষে মাত্র ১০ লাখকে জীবিত পাওয়া গিয়েছিলো। ফ্যাসিবাদের আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো সোভিয়েতের ছোট-বড় মিলিয়ে ১ হাজারেরও বেশি শহর, ৭০ হাজার গ্রাম, ৩২ হাজার শিল্প সংস্থাকে এবং ৯৮ হাজার যৌথ ও রাষ্ট্রীয় খামার। যুদ্ধ চলাকালীন সোভিয়েতকে ৬০০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু যুদ্ধপরবর্তী সময়ে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের জীবনাবসানের পর ট্রুম্যান প্রেসিডেন্ট হন এবং ওই প্রতিশ্রুতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। তবে কমরেড স্তালিন এতে দমে যাননি। সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে কোনো আপসও করেননি। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে সমস্ত যুদ্ধকালীন ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠে সোভিয়েত ইউনিয়ন। পূর্ব ইউরোপের সদ্য মুক্ত হওয়া দেশগুলোতে সমাজতান্ত্রিক গঠনকার্যেও সোভিয়েত তার সমগ্র শক্তিকে ব্যবহার করেছিলো।

তিন.
কামালউদ্দিন নীলু সংবাদমাধ্যম প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, নাটকটির পাণ্ডুলিপি তৈরির ক্ষেত্রে সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, সাইমন সিব্যাগ মন্টিফিওরের ‘স্তালিন: দ্য কোর্ট অব দ্য রেড জার’, সভেৎলানা অ্যালিলুয়েভার ‘অনলি ওয়ান ইয়ার’ ও ‘টোয়েন্টি লেটারস টু আ ফ্রেন্ড’, ডেভিড পিনারের ‘দ্য টেডি বিয়ারস পিকনিক’ এবং রোজমেরি সুলিভানের ‘স্তালিনস ডটার’। এ গ্রন্থগুলোর প্রতিটাই সাম্রাজ্যবাদী পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত। উদাহরণসুলভ কমরেড স্তালিনের মেয়ে সভেৎলানা অ্যালিলুয়েভার ‘টোয়েন্টি লেটারস টু আ ফ্রেন্ড’ গ্রন্থটির কথাই ধরা যাক। স্তালিন পরবর্তী সময়কালে সংশোধনবাদী ক্রুশ্চেভ চক্র সোভিয়েতের ক্ষমতা দখল করে এবং স্তালিন বিরোধী প্রপাগান্ডা জোরদার করে। এ সময়ে স্তালিনের ছেলে সোভিয়েত বিমানবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল ভাসিলি স্তালিনকে মিথ্যা অভিযোগে আটক করে আট বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার দুই বছর পর ১৯৬২ সালের মার্চে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কার্যত এটি ওই সংশোধনবাদীদের কাঠামোগত হত্যাকাণ্ডেরই উদাহরণ মাত্র। এর পরের বছরই সভেৎলানা ওই গ্রন্থটি লিখেন। যেখানে কার্যত স্তালিনবিরোধী বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্যই পাওয়া যায়। ওই বছরই তিনি গ্রন্থটি তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ত্রিলোকী নাথ কৌলকে দেখান। তার মাধ্যমে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র এজেন্ট রবার্ট রাইলির সঙ্গে যোগাযোগ হয় সভেৎলানার। পরে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে তিনি রবার্ট রাইলির হাতে গ্রন্থটি হস্তান্তর করেন এবং ভারতের মার্কিন দূতাবাসে আশ্রয় নেন। পরে ১৯৬৭ সালে ওই গ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয় সভেৎলানার ‘অনলি ওয়ান ইয়ার’ গ্রন্থটি।

যে মানুষটি নিজের সন্তান আর অপরের সন্তানের পার্থক্যটি মিটিয়ে সমাজটাকে মানবিক করে তোলার জন্য জীবনভর সংগ্রাম করে গেছেন, সেই মানুষটিকে তাঁর সন্তান, বা অন্য কেউ আক্রমণ করার মাঝে কোনো পার্থক্য থাকে না। তবে সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে বায়োলজিক্যাল সম্পর্কটা সম্পত্তির উত্তরাধিকারের কারণেই অত্যধিক গুরুত্ব পেয়ে থাকে। পরিবার সাধারণ মানুষের এক আবেগের বস্তু। আর তাই সাধারণ মানুষকে আবেগতাড়িত করতে, স্তালিনের মেয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে এক বড় হাতিয়ার হয়ে সামনে আসে। শুধু ‘টোয়েন্টি লেটারস টু আ ফ্রেন্ড’ গ্রন্থটির রয়্যালটি থেকে সভেৎলানা পেয়েছেন ২৫ লাখ ডলার। তবে এটা যে সাম্রাজ্যবাদী চর্চায় ব্যবহৃত কোটি কোটি ডলার খরচেরই অংশ, তা বলাই বাহুল্য। উল্লেখ্য, কমরেড স্তালিন তাঁর কর্মময় জীবনে যে সর্বদা নির্ভুল ছিলেন, এমনটাও নয়। তার ভুল-ত্রুটি শুধু ব্যক্তির ভুলও নয়, এটা তৎকালীন সোভিয়েত কাঠামোর সঙ্গেও সম্পর্কিত। যে সমালোচনা বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের আরেক মহান শিক্ষক কমরেড মাও সে-তুঙ ‘সোভিয়েত অর্থনীতির সমালোচনা’সহ বেশ কয়েকটি আলোচনা ও পার্টি দলিলে তুলে ধরেছেন, আর সেটা কমরেড স্তালিনকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে, তাঁর কর্মকাণ্ডকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের আলোকে মূল্যায়ন করেই। এটা মনে রাখা জরুরি, যারা কাজ করেন তাদেরই ভুল হয়, আর সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই মানুষ আগ্রসর হয়। কামালউদ্দিন নীলুরা ওইসব ভুল-ত্রুটিকে এমন ঢঙে প্রকাশ করে, যেন এটাই স্তালিনের একমাত্র অভিব্যক্তি। অথচ কোনো ব্যক্তির মূল্যায়নের ক্ষেত্রে তার অপ্রধান প্রবণতাকে প্রধানভাবে উপস্থাপনের মানেই হলো- ইতিহাসের বিকৃত উপস্থাপনা। স্তালিনের কট্টর সমালোচকও স্তালিনকে মদ্যপ, খুনী বলে দিয়ে তাঁকে ইতিহাস থেকে খারিজ করতে পারেন না- যে ইতিহাসের নির্মাতাই তিনি। আবার যারা কমরেড স্তালিনকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার নামে ‘ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে’ বলে জাহির করেন, তারা কার্যত তাঁকে খারিজই করেন। কারণ তা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে খারিজ করে।

চার.
নির্দিষ্ট সমাজের অর্থনীতি ও রাজনীতির ওপর তার সাংস্কৃতিক রূপ ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল। অর্থনীতি হলো সমাজের ভিত্তি স্বরূপ। তার ওপরই গড়ে ওঠে রাজনীতি-দর্শন-সংস্কৃতি, সকল বুদ্ধিবৃত্তিক ও সৃজনশীল বিষয়াবলি, যা সে সমাজের উপরিকাঠামো। আর তাই সাংস্কৃতিক আন্দোলন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের অধীন, অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতিফলনই দেখা যায় সাংস্কৃতিক আন্দোলনে। সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে যখন অরাজনৈতিক মোড়কে বন্দি করা হয়, তখনও তাতে রাজনীতি বিদ্যমান থাকে। আর তা হলো, বিরাজনীতিকরণের রাজনীতি। এর প্রভাবে কারো এমন অবস্থানও চোখে পড়ছে, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করাও নাকি ‘হঠকারী’ সিদ্ধান্ত! কার্যত এমন অবস্থানের ভিত্তি হলো, সাধারণ মেহনতি মানুষের জীবন-সংগ্রাম, বাস্তব আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক ধরনের প্রগতিশীলতার চর্চা। বিক্ষোভ সমাবেশকে ‘হঠকারী’ বলার মধ্যদিয়ে তারা কার্যত এ ধরনের কর্মসূচীকে ‘গণতান্ত্রিক নয়’ বলেই আখ্যায়িত করছেন। যেন পত্রিকায় লিখে দিলেই নিজের কাজ সমাধা হয়ে গেল! শাসক-শোষক, সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদের যেকোনো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পত্রিকা বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখালেখি করাটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, আর তা করতেও হবে। কিন্তু তার মানে এ নয় যে, এটাই প্রতিবাদ জানানোর একমাত্র পথ। বরং এর বিরুদ্ধে সভা-সমাবেশ-বিক্ষোভ কর্মসূচীও গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক পথ। এক শ্রেণির প্রগতিশীল নামধারীরা পুঁথিগত বিদ্যা চর্চায় এক ধরনের আত্মতুষ্টি পেয়ে থাকেন বলেই, নিজের গণ্ডিটাকে তারা আরও ছোট করে নিয়ে আসেন- যে গণ্ডিতে তারা কেবল বাহবাই পাবেন! সমালোচনা-আত্মসমালোচনা-পর্যালোচনার পদ্ধতি তাই তাদের কাছে বড়ই কঠিন মনে হতে পারে!

বিপ্লবী মার্ক্সীয় বা গণতান্ত্রিক চেতনা কোনো নাটক জোর করে বন্ধ করে দিতে বলে না। একইভাবে এমন সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদের প্রজেক্ট নাটক-সিনেমার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা, জনগণকে এ সম্পর্কে অবহিত করাটা মার্ক্সবাদীদের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। যেখান থেকে আগ্রাসী গণবিরোধী সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতির বিপরীত নয়া-গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নির্মাণ ও বিকাশের তাগিদ গড়ে উঠতে পারে। আবার বিতর্কিত নাটকটি বন্ধের বিরোধিতা করে কোনো কোনো কথিত প্রগতিশীল নামধারীরা গণতন্ত্রের দীক্ষা দিচ্ছেন! এ সমাবেশের ফলে নাকি দেশের নাট্যাঙ্গন আক্রান্ত হবে! অথচ নাটক বন্ধের জন্য কোনো আন্দোলনই হয়নি। হ্যাঁ, এটা ঠিক- নাটক বন্ধের আওয়াজ যে কেউ কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তোলেননি, তা নয়। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কোনো দর্শক এমন কথা বলতেও পারেন, এমনকি সমাবেশেও কোনো ব্যক্তি এমন বক্তব্য রাখতে পারেন। এটা অবশ্যই ওই ব্যক্তির অবস্থান। সমাবেশের বেশিরভাগ বক্তাই এ সাম্রাজ্যবাদী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। যে কথিত প্রগতিশীলরা এ প্রতিবাদকে নাট্যাঙ্গনের পরিবেশ ও গণতন্ত্রের জন্য ‘হুমকি’ বলে উত্থাপন করছেন, তারা এখানে ক্ষমতাসীন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কোনো উচ্চবাচ্য করেন না। তাদের এ অবস্থান মৃদু সমালোচনার মধ্যদিয়ে কার্যত সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদ ও শাসকশ্রেণীর ক্ষমতাকেই পোক্ত করে। যেকোনো প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, আন্দোলন-সংগ্রামকে কথিত অরাজনৈতিক আখ্যায় তারা শোষকের হাতকেই শক্তিশালী করে চলেছেন।

কথিত প্রগতিশীলরা প্রশ্ন তোলেন, বামপন্থীদের নাকি শিল্পের রসবোধ নেই। তারা নাকি নাটক বোঝেন না! কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছে বামপন্থীরা নাটক দিয়ে কেন নাটকের বিরোধিতা করছেন না? অথচ ওই প্রগতিশীল নামধারীরা এ বিষয়টা সচেতনভাবেই এড়িয়ে যান যে, এ সময়ের কথিত মূলধারায় শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির মান তলানিতে নেমে এসেছে। যা কার্যত গণবিচ্ছিন্ন, আর সাধারণের জীবন-সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো সংস্কৃতি নিশ্চয় জনগণের সংস্কৃতি নয়, ওই কথিত মূলধারার সংস্কৃতি চর্চায় আত্মপ্রতিষ্ঠা পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু এতে গণসংস্কৃতির নির্মাণ সম্ভব হয় না। আর এ কারণেই কমিউনিস্ট, বামপন্থী বা গণতান্ত্রিক চেতনার মানুষ ওই গণবিচ্ছিন্ন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে নিজেকে খুঁজে পান না। তারা এর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারেন না।

এ সময়ে দেশের সবচেয়ে আলোচিত ও উদ্বেগ সৃষ্টিকারী ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে, রাষ্ট্রীয় কৃষকবিরোধী অবস্থান, ফসলের ন্যূনতম পাওনাটুকুও না দেওয়া; শ্রমিক ছাঁটাই, মজুরি না দেওয়া, শ্রমদাস সৃষ্টি; নারী নির্যাতন এবং সমাজ-রাষ্ট্রে বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিকতা; জাতীয় সম্পদ পাচার ও ধ্বংস করা; মত প্রকাশের স্বাধীনতাহীনতা প্রভৃতি। অথচ এসব নিয়ে কোনো নাটক শিল্পকলায় আয়োজিত হতে দেখা যায় না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তীরন্দাজ নাট্যদলের ‘বাহাস’ নাটকটির কথা। ২০১৬ সালের ২০ জুলাই নাটকটি শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় মঞ্চস্থ হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু যেহেতু নাটকে সুন্দরবন বিনষ্টকারী রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে বাহাস বা বিতর্ক উপস্থাপন করার কথা, তাই শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেয়, তারা ওই নাটক মঞ্চস্থ করতে দেবে না। এখানে শাসকশ্রেণীর গণবিরোধী যেমন ফুটে ওঠে, তেমনি নাট্যাঙ্গনের কথিত প্রথিতযশারা যে অগণতান্ত্রিক সে বিষয়টিও পরিষ্কারভাবেই ফুটে ওঠে। উল্লেখ্য, সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করার সময়ে কমরেডদের এমন বিভ্রান্ত নামধারী প্রগতিশীলদের সম্পর্কে অবগত থাকতে হবে। তাদের সমালোচনাও করতে হবে। তাদের সঙ্গে সংগ্রামহীন কোনো ঐক্য কার্যত আপোষকামিতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। তবে সেটা হবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সাধারণ অবস্থানকে সামনে রেখেই।

পাঁচ.
বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিপরীতে রয়েছে সর্বহারা শ্রেণি এবং অন্যান্য নিপীড়িত শ্রেণি ও জাতিসমূহের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংস্কৃতি। এদেশের বর্তমান সংস্কৃতি হলো, নয়া-উপনিবেশিক বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালাল শাসকশ্রেণির শাসনের প্রতিফলন- কর্পোরেট সংস্কৃতি, যার ভিত্তিমূলে রয়েছে সামন্ত চেতনা, পুরুষতন্ত্র। পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, নয়া-উপনিবেশবাদ এবং তার মধ্যস্বত্ব ও সুবিধাভোগীদের অবহেলার শিকার হচ্ছে আমাদের লালিত সম্ভাবনাগুলো, ফলে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে শ্রমিক-কৃষকসহ আমাদের ব্যাপক নিপীড়িত জনগণের জীবন-সংগ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সর্বোপরি আমাদের সংগ্রামী সংস্কৃতি। সেখানে আমাদের সংস্কৃতি বলে যা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তা হলো, পোষাকী আনুষ্ঠানিকতা। কিন্তু সংস্কৃতির মানে কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়, পুরো জীবনাচার ধরে তার ব্যাপ্তি।

নয়া-উপনিবেশিক বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদ ও তার দেশীয় শোষকরা জনগণের ওপর যে নিপীড়ন চাপিয়ে দিয়েছে, তাতে করে এখানকার সংস্কৃতি ভীষণভাবে আক্রান্ত হয়েছে। প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো এবং সংস্কৃতিকর্মীবৃন্দ ও বিভিন্ন পেশাজীবীরাই বিশেষ করে দুর্ভোগে ভুগছেন। সাম্রাজ্যবাদী নয়াউপনিবেশিক শাসন-শোষণে নিষ্পেষিত হতে হতে আমাদের দেশের মধ্যশ্রেণীর জনগণের বৃহদাংশের চিন্তা-চেতনায় আপোষকামিতা, আত্মসমর্পণবাদিতা, আত্মকেন্দ্রিক ভোগবাদী ভাবধারা প্রবলভাবে আধিপত্য করছে। ফলে শাসন-শোষণ নির্যাতনের মাত্রা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। আমাদের দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস ঐতিহ্যকে ভুলিয়ে দিতে প্রতিনিয়ত কর্পোরেট সংস্কৃতির চর্চা করা হচ্ছে। গণ-অধিকার সচেতনতাকে আচ্ছন্ন করে রাখা হচ্ছে আত্মকেন্দ্রিক ভোগবাদী চর্চার মাধ্যমে। শ্রেণি চেতনাকে ভোঁতা করতে উগ্র জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় ও জাতিগত সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। রাষ্ট্র ধর্ম আর উগ্র-বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতি। ক্ষমতাসীনদের ফ্যাসিবাদী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের সবচেয়ে নগ্ন রূপটি ফুটে উঠে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রশ্নে। ওই আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসে বামপন্থী ও বিপ্লবী কমিউনিস্টদের গৌরবোজ্জ্বল অবদানকে খারিজ করে, আবার কখনো বা ন্যাক্কারজনকভাবে উপস্থাপন করে ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতি এক মনগড়া ইতিহাস তুলে ধরে। গত কয়েক বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক যেসব নাটক-চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, সেখানে এ বিষয়টি ছিলো খুবই স্পষ্ট। বিকৃত ইতিহাস চাপিয়ে দিয়ে, তাকে রক্ষার জন্য আইন করা হয়েছে। এর বিপরীতে কিছু বলা বা লেখাও যাবে না! কিন্তু এসব অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কথা না বলে কথিত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের বৃহৎ অংশটিই মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছে।

এখানে বুদ্ধিজীবীর নির্মাণ, প্রশিক্ষণ, এমনকি কোন পেশায় কোথায় নিয়োগ করা হবে, সেটাও নির্ধারণ করে দিচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো। এদের মধ্যে অনেক বুদ্ধিজীবী এমন প্রশিক্ষণ পায়, যাতে তারা সাম্রাজ্যবাদের প্রয়োজন মোতাবেক, বিশ্বের ছবি তুলে ধরতে পারে। বই এবং পত্র-পত্রিকা প্রকাশনা ও বিতরণ এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণও রয়েছে সাম্রাজ্যবাদের হাতে। যার মাধ্যমে নয়া-উপনিবেশগুলো নিয়ন্ত্রিত হয়। আর এর মাধ্যমে সমাজে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ববীক্ষায় দীক্ষিত এক ভাবধারা গড়ে ওঠে। এতদসত্ত্বেও বুদ্ধিজীবীদের একাংশ সর্বদাই জনগণের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করছেন। এদের উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন এবং ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিশ্চিত করাটা জরুরি। সকল দাসত্বমূলক মনোভাবসম্পন্ন সাম্রাজ্যবাদী, কর্পোরেট ও ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য উপযুক্ত ও দৃঢ় বিকল্প সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এমন সংগঠন গড়ে তুলতে হবে, যা সামাজিক শিক্ষার মাধ্যমে জনগণকে শিক্ষিত করে তুলবে। এমতাবস্থায় বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্তভাবে না থেকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রগতিশীল লেখক-বুদ্ধিজীবী- শিল্পী-সাহিত্যিকদের একটি সাংগঠনিক কাঠামোতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া আজ সময়ের জরুরি দাবি। যার ভিত্তি হতে হবে সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা। এই মানদণ্ডকে সামনে রেখেই সংগঠিতভাবে মোকাবিলা করতে হবে ফ্যাসিবাদকে। প্রগতিশীল লেখক-বুদ্ধিজীবী-কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীগণকে এক সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় ব্যাপক নিপীড়িত জনগণের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাস্তব অনুশীলন থেকে সাহিত্যের উপাদান সংগ্রহ করে নতুন ধরনের শিল্প-সাহিত্য রচনা করতে হবে। সেই সঙ্গে সাংস্কৃতিক সংগঠনের কাঠামো গড়ে তুলে ওই প্রতিবাদী-বিপ্লবী শিল্প-সাহিত্য শ্রমিক-কৃষকসহ ব্যাপক নিপীড়িত জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। এর মধ্যদিয়েই বিকশিত হবে জনগণের নয়া-সংস্কৃতি। যা সাম্রাজ্যবাদী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মোকাবিলা করতে অপরিহার্য।

এই নতুন সংস্কৃতি-কর্মীদের জনগণের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন সংস্কৃতির বিকাশ ও বিস্তার সম্ভব নয়। জনগণের প্রয়োজন, চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী কাজ করতে হবে, ব্যক্তিবিশেষের ইচ্ছানুযায়ী নয়। নতুন সংস্কৃতি সৃষ্টি করবে নতুন গণমুখী গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, সিনেমা। যা সাম্রাজ্যবাদ-নির্দেশিত গণবিরোধীদের গণবিচ্ছিন্ন করে বিপ্লবী চেতনার পক্ষে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করবে। নাটক ‘স্তালিন’ মঞ্চস্থ করার মাধ্যমে কামালউদ্দিন নীলুরা যে নতুন কোনো বিষয় সামনে এনেছেন, তা নয়। বরং সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের সাংস্কৃতিক প্রপাগান্ডা মেশিন ব্যবহার করে কমিউনিস্ট নেতৃত্বের বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার ঐতিহাসিকভাবে করে আসছে, এই নাটকটি তারই ধারাবাহিকতা।