চিত্রকর্ম: সান্দ্রো বতিচেল্লি
নাটক ও নাট্যকলা: দীর্ঘ পথ চলা
পর্ব ৭
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : জুলাই ২৬, ২০২০
খ্রীস্টীয় চৌদ্দশো তিপ্পান্ন সালে তুরস্কের মুসলিমদের হাতে বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টানটিনোপলের পতন ঘটে। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন আধুনিক যুগের সূচনা ঘটে অন্যদিকে মধ্যযুগের হয় অবসান। মধ্যযুগের অবসানে ইউরোপে এলো নবজাগরণের যুগ। সমস্ত ইউরোপ জুড়ে এই নবজাগরণ ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়ে। মুসলিমদের সঙ্গে যুদ্ধে কনস্টানটিনোপলের পতনের পর খ্রীস্টান পণ্ডিতবর্গ গ্রীকদের জ্ঞানভাণ্ডার নিয়ে ইউরোপে চলে আসে যার সাথে ইউরোপীয়দের পরিচয় ছিলো না। গ্রীকদের জ্ঞানভাণ্ডার ইউরোপে নতুন চেতনা জাগ্রত করে তোলে। ইতালীতে প্রথম এর আবির্ভাব। খ্রীস্টান পণ্ডিতরা যে শুধু গ্রীক ও ল্যাটিন গ্রন্থাদিই নিয়ে এসেছিলেন তা নয়, মুসলমানদের জ্ঞানচর্চা, দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা, অংকশাস্ত্র প্রভৃতিও নিয়ে আসতে ভোলেননি। ফলে চিন্তার জগতে আসে বিপ্লব, শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে দেখা দেয় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। কোনো একটি যুগের সমাপ্তি ও নতুন যুগের সূচনাকে সীমারেখা দ্বারা অংকিত করে দেখানো যায় না; সকলের অলক্ষ্যে যে পরিবর্তন ঘটতে থাকে, সেই ব্যবধান যখন দুস্তর হয় তখন একদিন চমকে উঠে মানুষ দেখে নতুন এক যুগ। সেখানে নতুন নতুন সব চিন্তার সমারোহ। আধুনিক যুগের শুরু হয় ইউরোপীয় রেনেসাঁর মধ্য দিয়ে, যার অর্থ চিন্তার নবজাগরণ বা নবজন্ম। রেনেসাঁস যুগের মূল বৈশিষ্ট্যই মানবতাবাদের প্রতিষ্ঠা। হিউম্যানিস্ট কথাটার আর একটা মানে হলো ‘শিক্ষক’। শিক্ষার সাধারণ উপকরণগুলিকে ব্যবহার করে ‘বহুমুখি মানব’ সৃষ্টির চেষ্টা চালানো হয়েছিল সে যুগে। টমাস মোর মনে করতেন, একজন শিক্ষকের কেবল অধ্যয়নের গজদন্তমিনারে বসে জীবন কাটালে চলবে না, সাধারণের উন্নতির প্রচেষ্টায় রত থাকতে হবে এবং প্রয়োজন হলে প্রতিবাদ জানাতে হবে। তিনি তাঁর গ্রন্থে এরকম বক্তব্য রেখেছিলেন, ‘যে দেশে ব্যক্তিগত সম্পত্তি হবে বিলুপ্ত, যে দেশের নৃপতি হবেন মানবতাবাদী দার্শনিক পুরুষ, সে দেশ চলবে মানবধর্মের নীতি অনুসারে, সবাই হবে সমান, কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। দেখা যাচ্ছে যে, মানবতার ব্যাপারটি আর শিক্ষক শব্দের মধ্যে আটকে ছিল না। বৃহৎ ও ব্যাপক পরিসর লাভ করেছিল।
মধ্যযুগে চার্চের অধীনে মানুষ তার বিচার বিশ্লেষণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। ব্যক্তিসত্তা হারিয়ে সে হয়ে উঠেছিল চার্চের নিয়ম-কানুনের অন্ধ অনুসরণকারী। নবজাগরণ মানুষকে চার্চের বন্ধন থেকে মুক্ত করলো। মানুষ মুক্তির আলোয় সবকিছু দেখতে পেলো। চার্চের নির্ধারিত পথ অনুসরণ করে শেষ বিচারের দিনের জন্য সে আর অপেক্ষা করলো না। নিজেকে মানুষ বলে সম্মান করতে শিখলো। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য নিয়ে সে উঠে দাঁড়ালো। আবির্ভাব ঘটলো যুক্তিবাদের। মানুষ উপলদ্ধি করলো নিজের চেষ্টায়, নিজস্ব বুদ্ধিকে প্রয়োগ করে ভাগ্যকে পাল্টে দেয়া যায়। কোনো স্রষ্টার দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে থাকার দরকার হয় না। নবজাগরণ বা রেনেসাঁই ইউরোপে মানবতার জন্ম দেয়। মানবতাবাদের মূলমন্ত্রই হলো মানুষই সত্য তার সমস্ত দোষগুণ নিয়েই। জাগতিক জীবনই প্রাধান্য পেল এই চেতনায়। মানুষ নিজের শক্তি সম্পর্কে সচেতন হতে থাকলো। অনুধাবন করতে পারলো যে মানুষ তার জ্ঞান দিয়ে পৃথিবীর সবকিছু নিজের আয়ত্তে আনতে পারে। প্রয়োজনে এমনকি স্রষ্টার ভূমিকায়ও সে অবতীর্ণ হতে পারে। মানবতাবাদকে ঘিরে দেখা দিলো যুক্তিবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবোধের। পাশাপাশি চললো ধর্ম সম্পর্কে মানুষের দীর্ঘদিনের চিন্তা-চেতনা সংস্কারের চেষ্টা। নাটকের ক্ষেত্রেও এই পরিবর্তন চোখে পড়ে। চৌদ্দশো পঁয়ষট্টি সালে মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের ফলে প্রাচীন গ্রীক ও প্রাচীন রোমের মহৎ নাটকগুলো দেড়শত বছরের মধ্যেই প্রকাশিত হয়ে যায়। নাটকের উদ্দেশ্য কী, নাটক রচনার কোনো রীতি-কানুন আছে কি না, ব্যঙ্গধর্মী ও বিয়োগান্ত নাটকের মৌল পার্থক্য কোথায় ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তরের জন্য রেনেসাঁ যুগের পণ্ডি তবর্গ য়্যারিস্টটল ও হোরেসের রচনাবলীর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন।
বিভিন্ন ঘটনা পরম্পরায় ষোড়শ শতকে ইউরোপ মধ্যযুগের শৃঙ্খল ভেঙে ফেললে ধর্মীয় নাটক জীবনধর্মী নাটককে পথ ছেড়ে দিলো এবং তার যাত্রা শুরু হলো প্রাচীন গ্রীক ও প্রাচীন রোমের নাটকের পুনরুত্থানের মধ্য দিয়ে। প্রাচীন চিন্তা, নাটক ও শিল্পকলার পুনরুত্থানের কারণেই এই সন্ধিক্ষণটি রেনেসাঁ বা নবজাগরণ নামে পরিচিত। নবজাগরণ বা রেনেসাঁ যুগের পণ্ডিতেরা রাজন্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রীক ও ল্যাটিন নাটক এবং তৎসহ য়্যারিস্টটলের ও অন্যান্যদের দর্শন নিয়ে চর্চা করতে লাগলেন। ল্যাটিন ব্যঙ্গ নাটক ও সেনেকার বিয়োগান্ত নাটকের অভিনয় শুরু হলো। নাটক শুরু হলো রাজন্যদের নাচঘরের মঞ্চে। নগরগুলিতেও বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হতে লাগলো। রাজা ও রাজকুমাররা তাদের সাহায্যে হাত বাড়ালেন। শাসকরা এই সময় ধর্মীয় চিন্তার বিপক্ষে এ ধরনের নাটকের পৃষ্ঠাপোষকতা করতে এলেন কেন? শাসকদের সাথে বা রাজন্যদের সাথে তখন চার্চের চলছে কর্তৃত্বের দ্বন্দ্ব। যেমন ইংল্যাণ্ডের রাজা অষ্টম হেনরী রাজনৈতিক ও বৈবাহিক কারণে পোপের সঙ্গে কলহ করে প্রোটেস্টান্ট ধর্ম গ্রহণ করেন এবং ইংল্যাণ্ডের রাজসভার কার্যক্রম ও ধর্মমতকে পোপের আওতা মুক্ত করেন। তিনি ইংল্যাণ্ডে পৃথকভাবে আর্চবিশপও নিয়োগ দেন যাকে রাজকার্যে কোনো কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা দেননি। হেনরী ধর্মকে ব্যবহার করেছেন নিজের রাজনীতি ও শাসনকার্যের স্বার্থে। তিনি প্রোটেস্টান্ট ধর্ম যে-কারণেই গ্রহণ করেন না কেন, এই ধর্মমত যুগের দাবিকেই পূরণ করেছিল।
রাজা অষ্টম হেনরীর শাসনকালেই ইংল্যাণ্ডে রাজসভায় ক্রমশ জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা বেড়ে যেতে থাকে। পণ্ডিত ও বিদগ্ধজনদের মধ্যে তিনি মুক্তচিন্তার চর্চাকে অব্যাহতভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। সারা ইউরোপ জুড়ে বিশেষ করে ইংল্যান্ডে তখন বাকস্বাধীনতার প্রশ্নটি বারবার সামনে চলে আসছে। ধর্মসংস্কার নিয়ে কথা হচ্ছে। ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার অন্যতম কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায় তাঁর রাজদরবার। হেনরীর রাজসভায় রেনেসাঁস যুগের অন্যান্য রাজসভার মতোই ধ্রুপদী ধারার ল্যাটিন নাটকের অভিনয় হতে থাকে। রোমান ন্যাট্যকার প্লাইতুস, তেরেন্স ও সেনেকার প্রভাব বিস্তৃত হতে থাকে। ল্যাটিন ভাষার প্রাধান্যের কারণেই প্রাচীন রোমের নাট্যকারদের নাটকগুলোই প্রথম জায়গা করে নেয়, প্রাচীন গ্রীক নাটকগুলো তখন পর্যন্ত ছিল অপাংক্তেয়। হেনরীর আমলেই ইংরেজি নাট্যসাহিত্যের সূত্রপাত। ল্যাটিন ভাষায় নাট্যচর্চার পাশাপাশি শুরু হয় মাতৃভাষায় নাটক রচনা। উপরন্তু বিভিন্ন বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অকস্মাৎ যেন নাটক অধ্যয়ন ও মঞ্চস্থ করার সাড়া পড়ে যায়। যদিও হেনরীর আমলে কোনো সাধারণের নাট্যশালা নির্মিত হয়নি, তবে তার জন্য পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল।
রাজা অষ্টম হেনরীর পর ইংল্যান্ডের ক্ষমতায় এলেন রানী এলিজাবেথ। ধর্ম নিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদের উন্মেষ এবং রানী এলিজাবেথের সময়কালের নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি ও যুদ্ধবিরোধী মনোভাব মানুষকে যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী সাহিত্যনুশীলনে উৎসাহী করে। ইতালীয় নবজাগরণের ঢেউ ইংরেজ জাতির জীবনে খুবই প্রণোদনার সৃষ্টি করেছিল। মানবতার জয়গান শুরু হলো। মানবতাবাদ বলতে বর্তমানকালে যে যুক্তিসিদ্ধ মানবমুখি দর্শনের কথা বোঝানো হয়, পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে ইতালীয় নবজাগরণে মানবতাবাদ বলতে তা বুঝাতো না। মানবতার মূল অর্থ ছিল তখন ধ্রুপদী বিদ্যার চর্চা; ল্যাটিন বা গ্রীক ভাষায় রচিত সাহিত্যের পুনরুদ্ধার। স্পিৎস বলেছিলেন, মানবতাবাদ হচ্ছে একটা শিক্ষা দর্শন যা ধ্রুপদী বিদ্যার অনুরাগী। ইতালীর বিদগ্ধজনরা পুরাতন ধ্রুপদী বিদ্যাচর্চার পাশাপাশি মাতৃভাষায় জ্ঞানচর্চা শুরু করে সারা ইউরোপকে নবজাগরণের আলোয় উদ্ভাসিত করেছিলেন। সকলে এটা বুঝতে পেরেছিলেন মাতৃভাষা চর্চার মধ্য দিয়েই শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্রের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব। সাম্রাজ্যবাদের দেয়া বাইবেলের ল্যাটিন ভাষাকে হটিয়ে দিয়ে যদি সর্বস্তরে মাতৃভাষার চর্চা চালু না করা যায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি ঘটবে না। মাতৃভাষাকে দূরে সরিয়ে রাখলে জনগণের চিন্তাভাবনার বিকাশ ঘটবে না। ফলে সর্বস্তরে মাতৃভাষার ব্যাপক প্রচলন আরম্ভ হলো, সেই সঙ্গে প্রয়োজন মতো সকল শিল্প-সাহিত্য আর জ্ঞান-বিজ্ঞানের মানসম্পন্ন গ্রন্থগুলি ইউরোপের প্রতিটি দেশে মাতৃভাষায় অনূদিত হতে থাকলো। সেই যুগের পণ্ডিতরা ধ্রুপদী বিদ্যার রসদ দিয়ে ধর্মের প্রাচীরে বাঁধা গতানুগতিক চিন্তার পৃথিবীকে আঘাত করেছিলেন।
ইতালীয় মানবতাবাদীরা প্রাচীন ধ্রুপদী বিদ্যাকে বিনিয়োগ করেছিলেন নতুন যুগকে অভ্যর্থনা করতে। রানী এলিজাবেথের যুগের ইংল্যান্ড একই লক্ষণ ছিল স্পষ্ট। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকের নবজাগরণের প্রধান শর্ত হলো যুক্তিবাদ আর মাতৃভাষার চর্চা। ফ্রান্স, জার্মানী, স্পেন, পর্তুগাল, গ্রীস, ইতালী, ইংল্যান্ড সহ ইউরোপের প্রতিটি দেশে মাতৃভাষা হয়ে উঠলো শিক্ষার বাহন, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রধান ভাষা। মাতৃভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ভিতর দিয়ে ইউরোপের দীর্ঘদিনের পশ্চাদপদ প্রতিটি দেশ নতুন করে উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে থাকে। চার্চের চিন্তা আর ভাষার বন্ধন মুক্ত হয়ে মুসলমানদের পিছনে ফেলে এবার সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে ইউরোপের দেশগুলি। মাতৃভাষা কেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে স্বাধীন সত্তা গড়ে তোলে রাষ্ট্রগুলি। খ্রিস্টান পরিচয় প্রাধান্য না দিয়ে নিজ নিজ ভাষার পরিচয়ে গড়ে তোলে নিজ নিজ ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। নিজ নিজ ভাষা বাদ দিয়ে খ্রিস্টান ধর্মকে ঘিরে বিরাট রাষ্ট্র গঠনের কথা ভাবেনি ইউরোপের দেশগুলি ভারতবর্ষের মতো। কিন্তু ভারতবর্ষ তথাকথিত জাতীয়তাবাদের নামে ভাষাভিত্তিক বিভিন্ন রাষ্ট্রগঠনকে বাতিল করে, হিন্দু ধর্মের ছত্রছায়ায় বিশাল ভারতরাষ্ট্র গঠনের কথা ভাবে। পরবর্তীতে হিন্দু আর মুসলিম ধর্মের নামে দুটি বিরাট ভূখণ্ড গড়ে তোলে বিভিন্ন ভাষাকে তার মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করে। কিন্তু ভাষার ভিত্তিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্তিশালী স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তোলার কথা ভাবতেই পারে না জাতীয়তাবাদী ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষাভাষী অঞ্চলগুলি। স্বাধীনতা লাভের পর তাই মাতৃভাষার জায়গায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ভাষা হয়ে দাঁড়ায় ইংরেজি। ফলে বিরাট ভারতবর্ষ জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় ইউরোপের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশগুলির মতো অগ্রগতি লাভ করতে পারেনি।
ইউরোপ ভাষার ভিত্তিতে বিভিন্ন রাষ্ট্র গঠনের মধ্য দিয়ে শিক্ষা আর জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে চললো কয়েকশো বছর ধরে। সকল রকম মিথ্যা আবেগ, মিথ্যা ঐতিহ্যের কথা ভুলে গিয়ে বিজ্ঞানসম্মত ধারণাকে সামনে নিয়ে এলো। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকের নবজাগরণে যেসব কর্মকাণ্ড বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলো তার অন্যতম হলো ভৌগলিক আবিষ্কার। ইউরোপের দেশগুলি যখন ভৌগলিক আবিষ্কারের মাধ্যমে নতুন ভুখণ্ড খুঁজে বের করছে, তখন ইংল্যান্ডে টিউডর শাসনকাল শুরু হয়েছে মাত্র। ভৌগলিক আবিষ্কারের প্রতিযোগিতায় দেরিতে যোগ দিলেও শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ডই বিশ্বে স্পেন ও পর্তুগালের আধিপত্য খর্ব করে নিজের শক্তি প্রতিষ্ঠা করে। রানী এলিজাবেথের সময়েই ইংল্যান্ড ইউরোপের শ্রেষ্ঠ নৌশক্তির সম্মান পায়। তাঁর সময়ে বিভিন্ন ভৌগলিক আবিষ্কারকের দেখা পাওয়া যায়। “ভূগোল” রচনায় দিগদর্শন ঘটান নর্ডেন, নোয়েল এবং স্পিড। রানী এলিজাবেথের সময় ফ্রান্সিস ড্রেক, জন ডেভিস, মার্টিন ফ্রোবিশার সমুদ্র অভিযাত্রায় বের হয়ে পড়েন। রিচার্ড গ্রানভিল, টমাস ক্যাভেসডিশ, র্যালের পরামর্শে ব্রিটিশ জাতি বিশ্বের অর্থ-সম্পদ লাভে অধিকতর ব্রতী ও দুঃসাহসী হয়ে ওঠে। মিথ্যা ঐতিহ্যের দম্ভ বাতিল করে দিয়ে নতুনের সন্ধানে পা বাড়ায়। সারা বিশ্বের সঙ্গে নিজেদের যোগাযোগ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখে। মুসলমান শাসকদের সাম্রাজ্য বিস্তার আর নানারকম বিজয়ের কারণে ভূমধ্যসাগরে নিজেদের প্রভাব হারিয়েছিল, ভিন্ন সমূদ্রপথে ইউরোপীয় নাবিকরা এবার ভারত আর আমেরিকা আবিষ্কার করার নেশায় মেতে ওঠে। সমূদ্রপথ আবিষ্কারের ভিতর দিয়ে নতুন নতুন দেশ করার মাধ্যমে নতুন এক মধ্যবিত্তশ্রেণী গড়ে ওঠে সারা ইউরোপে। জীবনকে বাজী রাখার মতো এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী, যারা নতুন কিছু সৃষ্টির পথে হাঁটতে চায়। যারা পুরানো ঐতিহ্যের কথা বলে নিজের পরিচয় দেয় না, নতুন বিশ্বের নতুন মানুষ হতে চায় এই মধ্যবিত্তরা; বাংলা তথা ভারতের বাবুদের মতো সামাজ্যবাদের অনুগ্রহপ্রার্থী দাস বা করণিক মধ্যবিত্ত নয় এরা। বাংলা তথা ভারতের বাবুদের মতো ধর্মীয় কুসংস্কারে আটকে রইলো না তারা, প্রাচীন ধর্মীয় কুসংস্কার আচ্ছন্ন ঐতিহ্যের বড়াই না করে; সকল পুরানো ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিশ্বের নতুন দিগন্তে পা রাখতে চাইলো ইউরোপের মধ্যবিত্তরা।
রাজধানী লন্ডন তখন অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল। রানী এলিজাবেথের রাজসভাও ছিল জ্ঞানী-গুণীদের পীঠস্থান। স্যার রিচার্ড গ্রানভিল, স্যার ফিলিপ সিডনি, স্যার ওয়ালটার র্যালে, জন লিলি প্রমুখের মতো ব্যক্তি ও পণ্ডিত ছিলেন তাঁর সভাসদ। ফ্রান্সিস বেকন ছিলেন সে যুগের এক অন্যন্য সাধারণ প্রতিভা। পুরানো সকল ঐতিহ্যকে বাতিল করে দিয়েছেন এঁরা, রাজদরবার এঁদের কাছে শুনতে চায় নতুন অজানা কথা। পুরানো চিন্তার ধারক-বাহকদের জায়গা নেই নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের রাজসভায়। রানী এলিজাবেথকে নতুন জ্ঞানের কথা শোনাতে পারলেই তাঁর জায়গা হবে রাজসভায়। হেনরীর পর রানী এলিজাবেথও ভীষণভাবে নাটকের পৃষ্ঠপোষক হয়ে ওঠেন। নাটক দেখার ব্যাপারে তাঁর রুচি ছিল হেনরীর চেয়েও উন্নত। রাজ দরবারের নাটকগুলো শুধু রাজ পরিবারের লোক ও অভিজাতরা দেখার সুযোগ পেতো। রাজদরবারে সকল জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, শিল্প-সাহিত্যের আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকবে তা তো হতে পারে না। বুর্জোয়া যুগে মধ্যবিত্তরাও সবকিছুতে তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সেও চায় নাটক দেখতে, নাট্যকলার স্বাদ পেতে। সেজন্যই এলিজাবেথের যুগে রাজ দরবারের পাশাপাশি সাধারণের রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠা হয়ে গেল। নাট্যকলার ইতিহাসে এটা এক বিরাট ঘটনা, এই ঘটনাই নাটকের গতিপ্রকৃতিকে দ্রুত পাল্টে দিতে থাকলো। জন্ম নিলো নতুন ধারার নাট্যকার। নাট্যকার শেক্সপিয়ার ও ক্রিস্টোফার মার্লোরা হচ্ছে সেই সাধারণ নাট্যশালার সৃষ্টি এবং সাধারণ নাট্যশালার সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
বুর্জোয়া লুটপাটের ভাগীদার মধ্যবিত্ত শ্রেণী, যাদের হাতে হঠাৎ জমেছে কাঁচা টাকা। নতুন এক নাট্যধারা গড়ে তুলতে তারাই বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। বিশ্ব ইতিহাসে এরপর থেকে নাটকের মূল দশর্ক হয়ে উঠলো মধ্যবিত্তশ্রেণী। যাদের চাহিদার সামনে দাঁড়িয়ে নাটককে বারবার তার অবস্থান পাল্টাতে হয়েছে। পরবর্তী চারশো বছরের অধিককাল মধ্যবিত্তের দ্বারাই নাট্যশালার গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। মধ্যবিত্তদের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বা স্বার্থের সম্পর্ক বজায় রেখেই শাসকশ্রেণীর অনুকূলে নাট্য প্রযোজনা তার চরিত্র পাল্টেছে। শাসকশ্রেণীর পক্ষে নাট্য রচনা কখনো মধ্যবিত্তকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, কখনো মধ্যবিত্তের আকাঙ্ক্ষা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। এই দ্বান্দ্বিকতার ভিতর দিয়েই নাট্যশিল্পের বিকাশ ঘটেছে। নবজাগৃতি পরবর্তী সময়কার নাট্যকলার ইতিহাস ও রঙ্গালয়ের দর্শকদের দিকে তাকালেই ব্যাপারটা পূর্ণভাবে স্পষ্ট হবে। সেজন্য শেক্সপিয়ারের যুগটাকে গভীরভাবে বোঝা দরকার পরবর্তী আলোচনার সুবিধার জন্যই। বিশ্বখ্যাত জনপ্রিয় নাট্যকার শেক্সপিয়ারের যখন নাট্যজগতে আবির্ভাব তখন ইংল্যান্ডের চেহারাটা কেমন ছিলো, কারা ছিল সেসব নাটকের দর্শক, কাদের মুখ চেয়ে তিনি নাটক লিখতেন; সবকিছুর বিচার বিশ্লেষণ করলে তবেই শেক্সপিয়ারের নাটক রচনার কারসাজি এবং তাঁর প্রতিভার ব্যাপারটা উদ্ভাসিত হবে।
লন্ডন শহরে তখন রাজদরবারের বাইরে সাধারণ দর্শকদের জন্য নাট্য মঞ্চায়ন হতো সরাইখানাগুলোতে। রক্ষণশীলদের কাছ থেকে বহু কষ্টে সেই নাট্য মঞ্চায়নের জন্য আইনী অনুমতি পাওয়া গিয়েছিল রাজা-রানীর সমর্থন থাকায়। নাট্যকার শেক্সপিয়ারের সমকালে লন্ডনে প্রায় ছ-সাতশো সরাইখানা ছিল বলে খবর পাওয়া যায়। সেগুলো ভাড়া নিয়ে নাটক অভিনয় করা হতো। মধ্যযুগের সরাইখানার মাঝের চত্বরগুলি অভিনয়ের পক্ষে ছিল যথেষ্ট উপযোগী। কিন্তু দর্শকরা ছিল উগ্র, তাই অভিজাত সরাইখানাগুলো প্রচণ্ড হট্টগোল, ঝগড়া ইত্যাদির ভয়ে তাদের চত্বরে দলগুলোকে অভিনয়ের অনুমতি দিতে চাইতো না। কিন্তু কয়েকটি বাদ দিয়ে প্রায় সকল সাধারণ সরাইখানাগুলোতেই নিয়মিত অভিনয় চলতো। এইসব অভিনয় বেলা দুটা কি তিনটার দিকে শুরু হতো। নাট্যদলের পক্ষ থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত একজন মূল প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে যারা চত্বরে দাঁড়িয়ে অভিনয় দেখতে আসতেন তাঁদের প্রবেশাধিকারপত্র রয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করতেন । প্রবেশপত্র ক্রয় করেই শুধু ভিতরে ঢোকা যেতো। নাট্যমঞ্চের জন্য কতোগুলো মদের পিপের ওপর কাঠের তক্তা পেতে মঞ্চ তৈরি করা হতো। সমাজের চোখে যাঁরা ইতরজন তাঁরা চত্বরে দাঁড়িয়ে নানারকম হৈ হুল্লোড় করতেন এবং অভিনয় দেখতেন, অর্থশালী অতিথিরা গ্যালারীতে বসতেন বা দাঁড়াতেন। দর্শকরা সবাই উচ্চস্বরে কথা বলতেন। নাটক মঞ্চায়ন হচ্ছে, না হাট বসেছে সেটা বোঝা কষ্টকর ছিল। মঞ্চের কোনো কিছু যদি দর্শকদের একঘেয়ে লাগতো তবে তাঁরা তাস কিংবা পাশা নিয়ে বসতেন। বিভিন্ন রকম ফল, বাদাম প্রভৃতি বিক্রি হতো তারই মধ্যে। নাট্যাভিনয়ের কালেই দর্শকদের মধ্যে চলতে থাকতো গান করা এবং নানারকম দ্রব্য ও ফল আহার করা। নাট্যাভিনয় যদি দর্শকদের মনঃপূত না হতো তাঁরা ঝগড়া-ঝাঁটি মারামারি লাগিয়ে দিতেন এবং তাঁদের ঝগড়া-ঝাঁটি মারামারি শেষ পর্যন্ত রক্তপাতে এসে পৌঁছুতো। মজুর, জাহাজী, দোকানদার ও বাউণ্ডেলে লোকদের আচরণ প্রায় ভাল্লুক যুদ্ধের মতো হয়ে দাঁড়াতো। নাট্যকারদের তাই দর্শক রুচির কথা ভাবতেই হতো। দর্শকদের পছন্দ-অপছন্দের পাশাপাশি বিনোদন দানের চিন্তা নাট্যকারদের মাথায় থাকতো। খেয়ালখুশি মতো নাটক লেখা যেতো না। টিকেট বিক্রিটাই প্রাধান্য পেতো সেখানে, তারপর ভাবতে হতো দর্শকদের কী বলতে চান তিনি। চলবে