‘নাইট ফলস’ ব্যক্তির স্বপ্নদোষ নয়, জাতির স্বপ্নভঙ্গের আলেখ্য
পলিয়ার ওয়াহিদপ্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২০
শঙ্খচূড় ইমামের কবিতা বুঝি কম, কিন্তু ভালো লাগে বেশি। তাইলে আসলে চমকটা কী? ব্যাপারটা কি মন না মগজের? এই প্রশ্ন বহুবার নিজেকে করেছি। কিন্তু ভালো কেন লাগে? এর উত্তম ব্যাখাও আমি দিতে অপারগ। তবে এটা সন্দেহতীতভাবে সত্য যে, পাঠক হিসেবে আমি মনকে বেশি গুরুত্ব দেই। মগজ মানেই আমার কাছে যুক্তির ও গণিতের ছক। ফলে বিজ্ঞানের সঙ্গে সাহিত্যের একটা চিরকালীন বৈরীতা আমি সত্য বলে স্বীকার করি। তার মানে এই নয় যে, ইমামের কবিতা যুক্তির বা গণিতের। বরং সে যুক্তিকে তার কবিতায় সরলভাবে ও বহুরৈখিকভাবে ডিলিং করে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, শিল্পী শঙ্খচূড়ের তৃতীয় যে চোখটি বিশেষ করে তার কবিতাকে সকলের চেয়ে আলাদা ভঙ্গিমায় উল্টো রথে চড়িয়ে দেয় তার জার্নিটা কিন্তু দারুণ শুধু নয়, আরামদায়কও। কাব্য প্রকাশের যে ভাষাকে সে শিকার করে তা আপতদৃষ্টিতে সহজিয়া। তবু আমি না বুঝেই তার কবিতা পান করি। শুধুমাত্র ভালো লাগে বলেই। এ যেন দুধ দেয়া গরুর চাটি খাওয়ার মতো ঘটনা। আজ বরং তার বলিষ্ট কবিতার সুঠাম দেহ নিয়েই কথা বলব। তারপর ব্যবচ্ছেদ করব মন ও মননের মসলাদার মাংসের।
‘নাইট ফলস’ তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। প্রথমে বলতে চাই এই যে, ‘নাইট ফলস’ মোটেও স্বপ্নদোষ নয় বরং স্বপ্নভঙ্গের আলেখ্য। আয়নার মতো তার কবিতার সামনে দাঁড়িয়ে গেলে আপনি সমূহ ক্ষতির মুখমণ্ডল, বসন্তের দাগসহ বাঁশির মতো নাকের উপমা দৃষ্টি গোচর হবে। দেখতে পাবেন বিরক্তি ও বিবমিষা। বেশিরভাগ কবিতায় স্বপ্নের বদলে স্বপ্নভঙ্গের একটি সংগীত সর্বদা চিকন সুরের মতো আপনাকে আক্রান্ত করবে। আপনি ছটফট করবেন কিন্তু আপনার দুঃখ কষ্ট ক্লেদ যেন কাউকে বোঝাতে ও বলতে পারছেন না। এই যে সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা কাউকে বোঝাতে না পারার ব্যর্থতা— এইসব মূক ও বধির ব্যথার একটা বাগান মূলত শঙ্খ তৈরি করতে চায়। তাই বলে সম্ভাবনা ও স্বপ্ন যে নেই, তা টের পাওয়া যায় তার কবিতা আরো বেশি বেশি পাঠের দ্বারা। কারণ প্রথমে সে পাঠককে সে তিতে অভিজ্ঞতায় ভিজিয়ে নিতে চায়। তারপর যে সব পেলব সিনটেক্স উপহার দেয় তা সত্যি মিষ্টান্নের মতো লাগে।
তার মানে দাঁড়ায়, সে প্রথমে মেধা ও পরিশ্রমের খাঁচায় ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে হাওয়া প্রবাহিত করে। ফলে তার কবিতা হরিতকির মতো লাগে। আবার মাঝে মাঝে আমার কাছে অচেনা কোনো আরব কবির মতো মনে হয়। মনে হয় হঠাৎকরে, খটকা লাগিয়ে, অবুঝভাবে, হঠকারি, খামাখা, বিরক্তি, বাতিল, মন্দ এই ধরণের উদ্বেগ তৈরি করে। একটু পরে আবার মনে হয় নাহ...। ঠিক তা নয়। প্রচুর শ্লেষ্মা, অভিমান, বিদ্রুপ, পরিহাস, উপহাস, প্রহাসন এইসব শব্দগুচ্ছকে সে রূপকের আসনে অধিষ্ঠান করতে চায়। তার প্রতিটি শব্দই যেন উপমা। তার প্রতিটি কবিতা যেন বিদ্রুপ আর উপহাসে ঠাঁসা। প্রশ্ন হলো এই বিদ্রুপ ও উপহাস কাকে উদ্দেশ্য করে? আর হ্যাঁ সেটা জানতে তাকে আরো একটু পাঠ করতে হবে।
তার কবিতার কথা বলতে গিয়ে আমার প্রায় একটি উদহারণ মনে পড়ে। সেটা হলো, কাব্যের হাত তার এত শক্তিশালী ও সবল যে, পুরো একটা ট্রেনকে একটি বাসের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। তাতে আবার ট্রেনের অঙ্গহানি যেমন হয় না, তেমনি সৌন্দর্যহানিও ঘটে না। তাহলে কি সে যাদু জানে? বোধহয়। তা না হলে কীভাবে সে এটা করতে পারে? তাহলে আসুন বাসে বসে তার ট্রেনের মতো একটি কবিতা পাঠ করি—
চীনা হাঁসের মতো মেয়েটির গ্রীবা ঘিরে
গেঁথে আছে লাল টোস্ট বিস্কুট
টোস্ট বিস্কুট মানে—
কাম হারানো বৃদ্ধের সকালবেলা
কাম একটি ইশকুল
সেখানে শিক্ষার্থীরা
ঈশ্বরকে লালন পালন করেন
ঈশ্বর সুন্দর— এবং এক
তিনিই একমাত্র মেয়েটিকে
বাঁচিয়ে রাখার ক্ষমতা রাখেন—
এছাড়া সাদা কান্নার গ্লানি, পশমহীন কল্পনারা, মাংসল ভরশা, সুখ, আনন্দ, ইচ্ছে, ব্যথা, আলো, অন্ধকারসহ সোনালি সাহসের কবিতা, গোপন আহলার গল্প, নিজস্ব ঈশ্বরের উপাখ্যান যেন কবির অগ্নিগ্রামের কাহিনি রচনা করে। সেখানে দহন হচ্ছে তার ইচ্ছের পাখিরা।
কিছু বানান ভুল ছাড়া তার কবিতার পড়তে এতো আরামবোধ করবেন যে নিশ্চিত তেসপাতাসহ সিমাই রান্না না খাইয়ে আপনি পারবেন না। ছোট বেলায় হরিতকি খাওয়ার মতো শঙ্খের কবিতা প্রথমে একটু বিস্বাদ দিলেও খানিক পরে পাবেন পানি পানের মতো আস্বাদ ও অনুভূতি।
বইটি পাবেন ৬০৭ নম্বর চন্দ্রবিন্দুর স্টলে। প্রচ্ছদ কবির নিজেরই করা। কারণ অবসরে চিত্রকলায় তার ধ্যানজ্ঞান। স্বল্পবাক এই কবি বৈরাগ্য বহন করতে প্রস্তুতি গ্রহণ নিচ্ছেন।