নরেন্দ্র দেবের গল্প ‘আমার কথাটি ফুরোলো’
প্রকাশিত : জুলাই ০৭, ২০২০
কবি নরেন্দ্র দেবের আজ জন্মদিন। ১৮৮৮ সালের ৭ জুলাই কলকাতায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম নগেন্দ্রচন্দ্র দেব। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার লেখা গল্প ‘আমার কথাটি ফুরোলো’ পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
একটি ছেলে ছিল। রূপে যেন রাজপুত্ত্বর। মা আদর করে নাম রেখেছিলেন রাজকুমার। ছেলেটি এই পনরো-ষোলো বছর বয়সেই বেশ জোয়ান হয়ে উঠেছে। লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে তার বাবার কাছে শিখেছে ঘোড়ায় চড়া, তলোয়ার চালনা, তীর ধনুক লক্ষ্যভেদ, দ্বন্দ্বযুদ্ধ প্রভৃতি সব রকম রণকৌশল ও যুদ্ধবিদ্যা। কারণ, ছেলেটির বাবা ছিলেন এক রাজ্যের প্রধান সেনাপতি। দুঃসাহসী যোদ্ধা বলেও তার সুনাম ছিল। এ পর্যন্ত তিনি যতো যুদ্ধে গেছেন সবগুলিতেই জয়ী হয়ে রাজার হাত থেকে জয়মাল্য পেয়েছেন।
রাজা তাকে খুবই স্নেহ করতেন। বীর বলে শ্রদ্ধাও করতেন। অনেক সময় মন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ না করে তিনি তার এই প্রিয় সেনাপতির সঙ্গে পরামর্শ করে চলতেন। এর ফলে সেনাপতির প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে তারা ষড়যন্ত্র করে রাজ্য থেকে তাকে তাড়াবার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু কিছুতেই সেনাপতির কোনো দোষ বার করতে না পেরে শেষে সেনাপতির বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার এক মিথ্যা অভিযোগ নিয়ে এলেন তারা।
রাজার কাছে সেনাপতির বিচার হ’ল। সেনাপতি বীরপুরুষ। সাদাসিধে সরল মানুষ। মন্ত্রীদের মতো অতো শতো কূটবুদ্ধি আর ঘোরপ্যাচ জানেন না। তিনি নির্ভীক। তিনি সত্যবাদী। কিন্তু হলে কি হবে ? মন্ত্রীরা গোপনে প্রচুর ঘুষ দিয়ে অনেক জাল মিথ্যা সাক্ষী হাজির করে রাজার কাছে প্রমাণ করে দিল যে, সেনাপতি রাজার রাজ্য ও সিংহাসন দখল করবার জন্য গোপনে শক্রদের সঙ্গে পরামর্শ করছিলেন।
এ ধরনের রাজনৈতিক অপরাধের জন্য সাধারণতঃ দোষীর প্রাণদণ্ডই হয়। কিন্তু রাজা তার এই বীর সেনাপতিকে খুবই ভালবাসতেন বলে তার প্রাণদণ্ড না দিয়ে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের দণ্ড দিয়ে রাজ্য থেকে নির্বাসিত করলেন। সেনাপতি সংগ্রামসিংহ এই দণ্ডাদেশে মর্মাহত হয়ে সে রাজ্য পরিত্যাগ করে অনেক দূর দেশে চলে গেলেন, সঙ্গে গেলেন তার সুযোগ্য সহধর্মিণী, পুত্র রাজকুমার আর কন্যা ইন্দিরা।
অপরূপ সুন্দরী ও গুণবতী ছিলো তার এই কন্যা ইন্দিরা। রাজকুমারের চেয়ে মাত্র ছ`বছরের ছোট। কিন্তু বুদ্ধি-বিবেচনায় সে ছিলো দাদার চেয়েও অগ্রসর। যারাই দেখতো মেয়েটিকে, তারাই তাকে ভাল না বেসে থাকতে পারতো না। নির্বাসন দণ্ডে দণ্ডিত সেনাপতি সংগ্রামসিংহ মনের দুঃখে দেশ ছেড়ে এই অনেক দূরে এক গ্রামে এসে চাষবাসের কাজে মন দিয়েছিলেন। মনে মনে তার নিজের উপরই ঘৃণা এসে গেল। বহু যুদ্ধে বহু লোকের প্রাণহানি করার অপরাধেই বোধহয় তার আজ এই কঠিন নিষ্ঠুর সাজা হ’ল। এই ভেবে তিনি যুদ্ধ করা ছেড়ে দিলেন।
ছেলে রাজকুমার ও মেয়ে ইন্দিরাকে নিয়ে তাঁর প্রতিব্রতা পত্নীও রাজ্য ছেড়ে স্বামীর অনুগামিনী হলেন। শ্রীরামচন্দ্রের বনবাসের সময় জনকদুহিতা সীতা যেমন রাজ্যসুখ তুচ্ছ করে দেবতুল্য পতির অনুগমন করেছিলেন, তেমনি তিনিও স্বামীর সঙ্গে দুঃখ বরণ করবার জন্য প্রস্তুত হয়েই দেশ ছেড়ে চলে এলেন। নতুন দেশে এসে সুখে-দুঃখে তাদের দিন কেটে যাচ্ছিল এক রকম। কিন্তু মানুষের দুঃসময় যখন আসে তখন পর পর নানা অতর্কিত বিপদ ঘটে যায়। হঠাৎ একদিন ক্ষেতে চাষের কাজ করতে করতে অপাঘাতে সংগ্রামসিংহ ইহলোক ত্যাগ করলেন। পুত্র রাজকুমার ও কন্যা ইন্দিরাকে নিয়ে তাদের জননী শোকে-দুঃখে ও দুর্ভাবনায় অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়লেন।
পাড়া প্রতিবেশীরা অনেকেই এসে সান্তনা দিলেনঃ ভাবছো কেন মা ? এ-রকম অঘটন তো পৃথিবীতে অনেক ঘটে থাকে। ভগবান আছেন। তিনি তোমাদের রক্ষা করবেন। তুমি এমন অশান্ত হয়ে পড়লে ছেলে-মেয়ে দুটিকে সান্তনা দেবে কে? রাজকুমার চোখের জল মুছতে মুছতে বললো, মা, চুপ করো তুমি। আর কোঁদো না। আমি তো বড় হয়েছি। বাবা আমাকে নিজের হাতে সব বিদ্যা শিখিয়ে গেছেন। আমি তোমার দুঃখ দূর করবো। তোমাদের কোনো কষ্ট হবে না।
মেয়ে ইন্দিরা কাঁদতে কাঁদতে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বললো, মা, তুমি ভেবো না। সংসারের সব ভার আজ থেকে আমি নিজের হাতে তুলে নিলুম। তোমাকে কিছু দেখতে হবে না। আমি এখানে গ্রামের ছোট-ছোট ছেলে-মেয়েদের জন্য যে মুক্তাঙ্গন-পাঠশালা খুলেছি তাতে ছেলেমেয়েরা দলে দলে আসছে লেখাপড়া শিখতে। টাকা-পয়সা তারা দিতে পারে না বটে, কিন্তু চাল, ডাল, তরিতরকারি, ফল-মূল, দুধ, দই কতো কি আমাকে দিতে চায়। আমি এতদিন নিইনি, তবে এবার থেকে নেবো। গায়ের মেয়েরা হাতের কাজ যা শিখছে কী বলবো! ভারী সুন্দর। সেলাই-বোনাটা ওরা কেউ কেউ মোটামুটি আগেই জানতো, এখন আমার কাছ থেকে সূক্ষ্ম কাজ সব শিখছে।
মা বললেন, তুমি কারোর কাছে কিছু চেয়ো না কিন্তু ইন্দিরা। কেউ যদি স্বেচ্ছায় তোমাকে ওদের ক্ষেত-খামারের আর সবজি বাগানের ফসল কিছু দিতে চায়, তুমি নিয়ো, নইলে তাদের মনে কষ্ট হবে। সংসারের লোকে নেওয়ার চেয়ে দেওয়াতেই আনন্দ পায় বেশী, তাদের সে আনন্দ থেকে বঞ্চিত ক’রো না।
রাজকুমারও একটা কাজ পেয়েছিল গ্রামের মোড়লের দয়ায়। সে চৌকিদারদের সর্দার হয়েছিল, কিন্তু ছেলেমানুষ ছোকরা দেখে তাকে কেউ সর্দার বলে মানতে চায়নি প্রথমটা। শুনে মোড়ল একদিন গ্রাম পঞ্চায়েত ডেকে চৌকিদারদের বললেন, তোমাদের মধ্যে যে এই ছোকরার সঙ্গে লাঠি খেলায়, তলোয়ার খেলায় বা সড়কি চালনায় আর তীর ছোড়ায় জিততে পারবে, তাকেই আমি সর্দার করে দেবো।
গ্রামে হৈ-হৈ পড়ে গেল। সবাই ছুটে এলো সেই বাজিখেলা দেখতে। কিন্তু সেই ছোকরা নতুন সর্দারের সঙ্গে কোনো বাজিতেই পাল্লা দিয়ে কেউ জিততে পারলো না। সবাই হেরে গিয়ে মাথা হেঁট করলো। আর রাজকুমারকে সর্দার বলে মেনে নিলো।
এইভাবে তাদের দিন চলছিল এক রকম। কিন্তু ভাগ্য যখন বিরূপ হয় তখন কোথা দিয়ে যে বিপদ আসে কেউ জানতে পারে না। রাজকুমার আর ইন্দিরার দুঃখিনী মা একদিন জল তুলতে গিয়ে টাল সামলাতে না পেরে কুয়োর মধ্যে পড়ে গেলেন। তখন তার ছেলে-মেয়ে দু’জনের কেউই বাড়িতে ছিল না। তারা যখন ফিরে এসে মাকে দেখতে না পেয়ে চারিদিকে খোজাখুঁজি করতে করতে দুর্ঘটনার ব্যাপারটা জানতে পারলো, তাদের সতী-লক্ষ্মী মা তখন আর নেই। কুয়োর ভিতর থেকে তার মৃতদেহ তুলে যথারীতি সৎকার কথা হ’ল।
শ্রাদ্ধশান্তি চুকে যাবার পর ইন্দিরা একদিন কাঁদতে কাঁদতে রাজকুমারকে বললো, দাদা, এই শূন্য ঘরে থাকতে পারছিনে। রাজকুমার বললো, ঠিক ওই কথাই আমিও তোকে বলবো-বলবো মনে করছিলুম ক`দিন ধরে। আমার কেবলই ইচ্ছে এখান থেকে পালিয়ে কোনো দূর দেশে চলে যাই। কিন্তু মা-বাবার স্মৃতিজড়ানো এ-কুটারখানি ছেড়ে তুই হয়তো অন্য কোথাও যেতে চাইবিনে ভেবে কিছু বলিনি। ইন্দিরা বললো, চলো দাদা, দূরে কোথাও চলে যাই। রাজকুমার একটু ভেবে বললো, কিন্তু একটা কথা ভুলে যাচ্ছিস বোন, যে, এখানে আমরা যা হোক দুমুঠো খেতে পাচ্ছি। অন্য জায়গায় গেলে অন্ন জুটবে কি করে?
ইন্দিরা বললো, সে ভয় ক’রো না দাদা। আমাদের শাস্ত্রে বলে ‘জীব দিয়েছেন যিনি আহার দেবেন তিনি। মা’ও প্রায়ই বাবাকে বলতেন শুনেছি যে উদ্যোগী পুরুষসিংহভূপৈতি লক্ষ্মী! চলো বেরিয়ে পড়ি। কিছু-না-কিছু কাজ কোথাও-না-কোথাও তোমার আমার জুটে যাবেই। নিজের উপর বিশ্বাস হারিও না। পরামর্শমতো ভাই বোন সেই দিনই ভোর রাত্রে দুর্গা বলে পথে বেরিয়ে পড়লো।
ঘুরতে ঘুরতে তারা কিছুদূরে এক বর্ধিষ্ণু নগরে এসে হাজির হল। তখন বেশ বেলা হয়েছে। ভাই বোন দু’জনেই বেশ ক্লান্ত, ক্ষুধাতৃষ্ণায় কাতর। কাছেই একটি দেবমন্দির দেখতে পেয়ে তারা সেই মন্দিরে গিয়ে উঠলো। মন্দিরের পুরোহিত তখন সবে ঠাকুরের মধ্যাহ্ন -ভোগ দিয়ে পূজা সেরে মন্দির থেকে বেরিয়ে আসছিলেন। হঠাৎ সমানে দুটি সুকান্ত সুন্দর ছেলে-মেয়েকে দেখে তিনি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন ? তোমরা কে গো? বিদেশী বলে মনে হচ্ছে!
রাজকুমার আর ইন্দিরা ভক্তিভরে পুরোহিতের চরণে প্রণাম করে তার কাছে নিজেদের দুর্ভাগ্যের কথা সমস্তই প্রকাশ করলো। পুরোহিত শুনে অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে সমবেদনাপূর্ণ কণ্ঠে বললেন, করুণাময় ভগবান দয়া করে তোমাদের আমার কাছে পাঠিয়েছেন। তোমাদের পিতা সংগ্রামসিংহ মহান ব্যক্তি ছিলেন। তারই অনুগ্রহে আমি এই মন্দিরের পুরোহিত-পদে নিযুক্ত হতে পেরে অনাহারে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি। যতদিন না তোমাদের কোনো ব্যবস্থা করতে পারি, ততদিন তোমরা আমার কাছে থাকো। অর্জন নামে আরো একটি উচ্চ বংশের ভাগ্যপীড়িত ছেলে ক’দিন হল আমার কাছে এসে রয়েছে। তার সঙ্গে তোমরাও আমার কাছে থাকো। আমার স্ত্রী পুত্র পরিবার কেউ নেই। ওই মন্দিরের নারায়ণই আমার সব। তোমরাও আমার সঙ্গে ঠাকুরের প্রসাদী ভোগ খাবে। চলো। অনেক বেলা হয়েছে। কিছু জলযোগ করে স্নানে চলে যাও। মন্দিরের পাশেই লক্ষ্মী হ্রদ।
পুরোহিত-ঠাকুরের আদেশমতো স্নান সেরে এসে তারা ঠাকুরের প্রসাদ পেয়ে একটু বিশ্রাম করতে গেল নাটমন্দিরের চত্বরে। সেখানে পুরোহিতের মুখে শোনা সেই অৰ্জুন ছেলেটির সঙ্গেও তাদের আলাপ-পরিচয় হ’ল। অৰ্জুনের বাবা-মা কেউ নেই শুনে ওদের খুব মায়া হ’ল অৰ্জুনের উপর। অর্জনও বেশ বলিষ্ঠ সুন্দর যুবা। রাজকুমারেরই সমবয়সী। সেও যুদ্ধবিদ্যায় ও রণকৌশলে খুব পরাদর্শী শুনে রাজকুমারের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। অর্জন বললো, আমিও তোমাদের মতো কাজ খুঁজতে বেরিয়েছি ভাই। আমার ইচ্ছা কোনো রাজার সৈন্যদলে সেনানির কাজ করবো।
এমন সময় পুরোহিত-ঠাকুর একটি প্রবীণা মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে তাদের কাছে এসে বসলেন। বললেন, ইনি এই কাছেই থাকেন। এঁকে আমরা সবাই অন্নদা-মাসী বলি। ইনি বলছেন, এর বাড়িতে ইন্দিরা-মা এর মেয়ের মতোই থাকবে। সংসারের কাজকর্মে মেয়ের মতোই সাহায্য করবে। এর বয়স হয়েছে, একলা আর সব কাজ করতে পারছেন না। তাই ইন্দিরা মাকে নিতে চাইছেন। মাইনে-করা দাসী হিসারে নয়। এঁদের কন্যার মতোই থাকবে। খেতে পরতে দেবেন, হাত-খরচ কিছু দিতে পারবেন না। ইন্দিরা-মা রাজী হলে এখুনি উনি সঙ্গে করে ওঁর বাড়িতে নিয়ে যাবেন বলছেন।
রাজকুমার বললো, বেশ তো ঠাকুরমশাই, আপনার পরিচিত ভদ্র পরিবার যখন বলছেন তখন ইন্দিরা ওঁদের কাছেই থাকবে।
ইন্দিরা বললো, না দাদা, তোমাকে এমন অনিশ্চিত অবস্থায় কোথাও রেখে যাবো না। ওঁদের বাড়িতে ওঁরা স্বামী-স্ত্রী ছাড়া আর তো কেউ নেই বলছেন। তবে তুমিও চলো না আমার সঙ্গে। দুজনেই ওঁদের ঘরে ছেলে-মেয়ের মতো থাকবো।
অন্নদা-মাসী এ কথা শুনে বললেন, না বাপু, কর্তা দুজন লোককে পুষতে রাজী হবেন না। তাকে খুব জানি।
রাজকুমার বললো, বেশ তো মাসী, আপনি ইন্দিরা বোনটিকে নিয়ে যান। একটা কাজ আমি ঠিক জুটিয়ে নেবো।
পুরোহিত-ঠাকুর হাসিমুখে বললেন, ঠিক বলেছে বাবা, এই তো আত্মবিশ্বাসী পুরুষের যোগ্য কথা। তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে অন্নদা-মাসীর সঙ্গে যাও মা, এই তো কাছেই। আমি রোজ তোমার খবর নেবো। রাজকুমারও যতদিন না কাজকর্ম পায় মাঝে মাঝে গিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করবে। এটা দেবমন্দির। কতো রকমের লোকজন আসা-যাওয়া করে। এখানে তোমার থাকা উচিত নয়।
ইন্দিরা বুদ্ধিমতী মেয়ে। সে অবস্থা বুঝে, অন্নদা-মাসীর সঙ্গে চলে গেল। যাবার সময় দাদা আর অর্জুনকে প্রণাম করে মিনতি জানিয়ে গেল তারা যেন মাঝে মাঝে ইন্দিরার খোঁজ-খবর নেয়। দু`চোখ তার বিদায়বেলার জলে ভরে উঠেছিল। আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে সে এক-পা এক-পা করে এগুচ্ছে দেখে অন্নদা-মাসী এক রকম জোর করেই তার হাতটি ধরে টেনে নিয়ে চলে গেলেন।
রাজকুমার আর অর্জুন স্নান মুখে ইন্দিরার চলে যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে রইলো। পুরোহিত বললেন, সন্ধ্যারতির সময় হয়ে এলো। আমি চললুম মন্দিরে।
ওরা সে-কথা শুনতেই পেলো না। এতোই অন্যমনা হয়ে পড়েছিল দু’জনেই। অন্নদা-মাসী যখন ইন্দিরাকে নিয়ে বাড়ি ঢুকছেন, সেই সময় ত্ৰৈলোক্যবাবু কি কাজে বাইরে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ স্ত্রীর সঙ্গে একটি সুন্দরী মেয়েকে বাড়ির মধ্যে আসতে দেখে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। অত্যন্ত কর্কশ কণ্ঠে পত্নীকে প্রশ্ন করলেন, সঙ্গে আবার কে ? একে কোথা থেকে জোটালে? মন্দির থেকে কুড়িয়ে এনেছ বুঝি? নাঃ, তোমার দেখছি লজ্জা নেই। সেই যে সে-বার `ফকরে বলে একটা ছোড়াকে মন্দির থেকে ধরে এনেছিলে বাড়ির কাজকর্ম করবে বলে, সে তো তে-রাত্রি পেরোবার আগেই আমাদের অনেক কিছু দামী জিনিসপত্র নিয়ে সরে পড়লো। এ তল্লাটে কোথাও তার সন্ধান পাওয়া গেল না।
অন্নদা-মাসী বললেন, সে ছোড়ার কথা ছেড়ে দাও। সে একটা বাউণ্ডুলে লক্ষ্মীছাড়া ছেলে—নেশাখের ছিচকে চোর। এটি ভদ্রলোকের মেয়ে। চেহারা দেখে বুঝতে পারছে না, বড়ো ঘরের সন্তান। পেট-ভাতায় থাকতে রাজী করিয়ে এনেছি। তোমাকে এক পয়সাও মাইনে দিতে হবে না। দেশসুদ্ধ লোক জানে, তুমি কি রকম কঞ্জস আর কৃপণের জাসু! কিন্তু আমার বয়স বাড়ছে, বুড়ো হয়ে পড়ছি। আমি আর এখন একলা তোমার সংসার চালাতে পারছিনে। একজন লোক আমার চাই।
ত্ৰৈলোক্যবাবু বললেন, বেশ তো। আমি কি আর নিষেধ করছি? রাখো না তুমি যত খুশি লোক। শুধু আমার সেজন্যে এক পয়সা বাড়তি খরচ না হলেই হ`ল। ফকরে ছোড়া তোমার আমার পাতের ভাত খেতো। তার জন্যে আলাদা চালের খরচ ছিল না। বছরে দুখানা ধুতিও দিতে হত না। আমার পুরোনো ছেড়া কাপড়গুলোই সেলাই করে সে পরতো। কিন্তু তুমি যে এই রাজরানীর মতো মেয়েটিকে ধরে এনেছো, এ কি ও ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট হয়ে থাকতে চাইবে ?
অন্নদা-মাসী ঝাঁঝিয়ে উঠে বললেন, সে ভাবনা তোমায় ভাবতে হবে না। ওর ভাল যখন আমি নিয়েছি, তখন ওর যা দরকার হবে সে আমি ব্যবস্থা করবো। তোমাকে এর জন্য কিছু খরচ করতে না হলেই তো হ’ল।
ব্যস, তাই চাই। লোক রাখায় খরচ না বাড়লে আমার আপত্তি নেই। বলে ত্ৰৈলোক্যবাবু বেরিয়ে গেলেন।
ইন্দিরা অন্নদা-মাসীর বাড়িই রয়ে গেল। কিন্তু মনে তার সুখ ছিল না। দু’চারদিনের মধ্যেই ইন্দিরা বুঝতে পারলো, এখানে থাকা তার পক্ষে কতো কষ্টকর। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাকে বাড়ির সব কাজই একলা করতে হয়। রাঁধা, বাসন মাজা, কাপড় কাচা, ঘরদোর ধোয়া-মোছা, আলো বাতি সাজানো, বিছানা করা, বিছানা তোলা, একে একে সব কাজই অন্নদা-মাসী তা ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন। নিজে আর কড়ার কুটোটা নাড়েন না। এদিকে পেটভরে খেতে দেন না ইন্দিরাকে। নিজের পুরোনো ছেড়া কাপড় তাকে পরতে দেন। ইন্দিরা অস্থির হয়ে উঠল। সে তার দাদাকে গিয়ে সব কথা জানাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলো। কিন্তু বাড়ি থেকে বেরুবার সময় পায় কই ? মন্দির তো খুব কাছেই। সেখানে তার দাদা রয়েছে। কিন্তু দাদা তো কই একদিনও এলো না তার খবর নিতে! দাদার বন্ধু সেই অৰ্জুন ছেলেটি এসেছিল বটে। বেশ ছেলেটি, খুব ভালো লেগেছিল তাকে ; কিন্তু সেও তো আর এল না।
একদিন ইন্দিরা মন্দিরে যাবার সুযোগ পেয়ে গেল। ত্ৰৈলোক্যবাবু আর অন্নদা-মাসী সেদিন তাদের কোনো আত্মীয়ের বাড়ি নিমন্ত্রণে গেলেন। সারাদিন থাকবেন, সেই একেবারে রাত্রে ফিরবেন। ইন্দিরা ঠিক করলো আজ সে দাদার খবর নিতে মন্দিরে যাবেই। তাকে সব কথা জানিয়ে আসবে। এখানে সে আর একদিনও থাকতে পারছে না। কিন্তু মন্দিরে গিয়ে ইন্দিরা পুরোহিত-ঠাকুরের কাছে শুনলো যে, তার দাদা আর দাদার বন্ধু আজ রাজবাড়িতে গেছে এক প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে। রাজা রাজ্যে ঢেঁড়া পিটিয়ে দিয়েছিলেন রাজকুমারীকে যে ঘোড়দৌড়ে, লক্ষ্যভেদে, হাতের লেখায় আর অঙ্ক কষায় হারাতে পারবে রাজকুমারী তারই গলায় জয়মাল্য দিয়ে পতিত্বে বরণ করবেন। আর দাদা সে ঘোষণা শুনে বন্ধুকে নিয়ে রাজবাড়িতে গেছে প্রতিযোগিতায় যোগ দেবার জন্য। কাল এই পরীক্ষা শুরু হবে। চারিদিকে হৈ-হৈ পড়ে গেছে। কিন্তু মা, আমার কি দুর্ভাবনা হয় জানো ?.রাজা ঘোষণায় বলেছেন, প্রতিযোগিতায় যে হেরে যাবে, তাকে যাবজজীবন কারাগারে বন্দী রাখা হবে। এসব জেনেও তোমার দাদা প্রতিযোগিতায় গেল!
শুনে ইন্দিরা চমকে উঠলো, কাঁদো-কাঁদো হয়ে বললো, কী হবে ঠাকুর, দাদা যদি হেরে যায়! তারপর চোখ মুছে নিজেই বললো, নাঃ, দাদাই জিতবে। দাদা বীরপুরুষ।
পুরোহিত বললেন, মন্দিরে দেবতার কাছে ভয়ের জয় কামনা করে পুজো দিয়ে যাও। ভগবান যেন তার মঙ্গল করেন।
আজ রাজকুমারী স্বয়ম্বর হবার জন্য প্রতিযোগিতায় নামবেন। রাজ্যের সবাই ভিড় করে এসে দাঁড়িয়েছে রাজপ্রসাদ-সংলগ্ন ক্রীড়া-প্রাঙ্গণে। কোন ভাগ্যবান জয়ী হয়ে কন্ঠে রাজকন্যার বরণমাল্য পাবে অথবা পরাজিত হয়ে শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় যাবজীবনের জন্য কারাগারে নিক্ষিপ্ত হবে। উৎসুকচিত্তে নগর উজাড় করে যেন দর্শকরা এসে জমলো ক্রীড়া-প্রাঙ্গণে।
অর্জুন বললো, এমন দুঃসাহসিক প্রতিযোগিতায় তুমি যোগ দিও না। পরাজয়ের সম্ভাবনাই বেশী। নইলে রাজকুমারী সদম্ভে এমন ঘোষণা করতে সাহসী হতেন না।
রাজকুমার বললো, যদি আমি হেরেই যাই তাহলেও বর্তমান অবস্থার চেয়ে ভালো থাকবো। দেবালয়ের নাটমন্দিরের দালানে ভিক্ষুকের মতো পড়ে থেকে দিনান্তে দুটি প্রসাদ পেয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে আমি তো মনে করি রাজ-কারাগারে পরম সুখে থাকা যাবে। বন্দী-জীবন আমাদের কার নয়, বলো? সবাই যে যার সংসার-শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে বন্দীর জীবনই যাপন করছি ; ওই যে পুরোহিত-ঠাকুর, উনিও তো ওই মন্দিরে দেবতার পুজোর শৃঙ্খলে বন্দী হয়ে রয়েছেন। ওটাকে আমি তার সশ্রম কারাবাস বলেই মনে করি। কিন্তু এ-প্রতিযোগিতায় আমি যদি হারি যাবজীবন বন্দী হয়ে থাকবো এই মাত্র।
কয়েদীদের মতো কঠিন পরিশ্রম তো কিছু করতে হবে না। বেশ নির্জনে ভগবানের নাম ` করে জীবনটা কাটিয়ে দেবো। তুমি রইলে বন্ধু, আমার দুঃখিনী বোন ইন্দিরার ভার তোমার ওপর রইলো।
ঢং ঢং ঢং ঢং করে ঘণ্টা বেজে উঠলো। ঘন ঘন শঙ্খরোল শুরু হ’ল। সময় হয়েছে। তুরী, ভেরী, ঢাকঢোল বেজে উঠে সমবেত জনতাকে সচকিত করে তুললো। রাজকুমার এই সময় রাজার সামনে গিয়ে প্রণামান্তে অভিবাদন জানিয়ে দাঁড়ালো। এই দিব্যকান্তি কিশোর সুকুমার যুবকটিকে দেখে রাজার মনে কেমন একটা বাৎসল্য-ভাবের স্নেহসিক্ত মমতা জেগে উঠলো। তিনি বললেন, তুমি এ প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলাফল সমস্ত জেনেশুনে প্রস্তুত হয়ে এসেছে তো? হেরে গেলে পরিণাম কি হবে সেটা বুঝেই আশা করি এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যোগ দিচ্ছ? এমন তরুণ বয়সে সারাজীবন কারাবাস যে বড় দুঃখের হবে।
রাজকুমার মহারাজকে যথাযোগ্য সম্মান জানিয়ে বললো, পরাজয়ের ভাবনা ভেবে কি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যোগ দেওয়া যায় মহারাজ? আমি জয়ী হবো, এই বিশ্বাস নিয়েই এসেছি। আশীর্বাদ করুন যেন আমি আপনার পণ রক্ষা করতে পারি। ভয়ই তো মানুষকে কাপুরুষ করে তোলে!
রাজকুমারের এই বীরোচিত কথা শুনে মহারাজ খুব খুশী হলেন। বললেন, বেশ। তোমাকে আমার খুব ভালো লাগলো। জগদীশ্বরের নিকট কায়মনে কামনা করি, তুমি জয়ী হও, বৎস।
দ্বিতীয় ঘণ্টা বাজলো। জনতার মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা গেল। সুসজ্জিত অশ্বপৃষ্ঠে সুবেশা সুন্দরী রাজকন্যা কদমে কদমে ঘোড়া ছুটিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য ক্রীড়াক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন। সমগ্র জনতা করতালি দিয়ে হর্ষোৎফুল্ল কণ্ঠে জয়ধ্বনি করে রাজকুমারীকে সম্বর্ধনা জানালো।
মহারাজ কুমারকে বললেন, কোন ঘোড়া তুমি নিতে চাও, তোমার পছন্দমতো বেছে নিয়ে সওয়ার হও। তৃতীয় ঘণ্টা বাজলেই ছুটতে হবে। মনে রেখো।
সারি সারি ঘোড়া দাঁড়িয়ে ছিল। অশ্বরক্ষীরা ঘোড়ার মুখ ধরে অপেক্ষা করছে। রাজকুমার তার মধ্যে সবচেয়ে তেজী দেখে একটি পঞ্চকল্যাণ অশ্ব বেছে নিয়ে পলকের মধ্যে তার পিঠের উপর উঠে সওয়ার হ’ল। আরো একাধিক প্রতিদ্বন্দ্বী উপস্থিত ছিলেন। তারাও একে একে অশ্বপৃষ্ঠে সওয়ার হলেন।
ঢং ঢং ঢং ঢং করে তৃতীয় ঘণ্টা বেজে উঠলো। মহারাজের ইঙ্গিত মাত্র সব অশ্বারোহী তীরবেগে ছুটতে শুরু করলো। রাজকুমারীর ঘোড়া সবাইকে ছাড়িয়ে এগিয়ে চললো।
চারদিকে আনন্দ-করতালি শোনা যেতে লাগল। রাজকুমার সেটা লক্ষ্য করে ঘোড়ার পিঠে পা ঠুকে একটু ইঙ্গিত করলো। মুহুর্তের মধ্যে রাজকুমারীকে বহু পশ্চাতে ফেলে রেখে বিদ্যুদ্বেগে রাজকুমারের পঞ্চকল্যাণ ঘোড়াটি বিজয়স্তম্ভ পার হয়ে গেল।
ক্রীড়া-প্রাঙ্গণে সে কী বিপুল জয়ধ্বনি! দশ মিনিট ধরে লক্ষ লোকের আনন্দ-করতালি যেন আর থামে না, জনসমুদ্রে যেন উত্তাল তরঙ্গ উঠলো।
মহারাজ তখন বিজয়ী রাজকুমারকে কাছে ডেকে মহানন্দে তার কণ্ঠে জয়মাল্য পরিয়ে দিয়ে বললেন, জয় হোক তোমার, বিজয়ী বীর! আজ তুমি বিশ্রাম করো বৎস। কাল আবার ঠিক এই সময়ে ক্রীড়া-প্রাঙ্গণে এসো। লক্ষ্যভেদের পরীক্ষা হবে। তোমার ধনুর্বাণ আছে তো?
আমার আশৈশবের সঙ্গী। বাবা আমাকে ধনুর্ধর বলেই ডাকতেন।
সেদিনের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতা শেষ হ’ল। লোকমুখে চারিদিকে রটে গেল, কে এক অজ্ঞাতকুলশীল অপরিচিত সুদর্শন যুবক রাজকুমারীকে ঘোড়দৌড়ের প্রতিযোগিতায় দারুনভাবে পরাস্ত করে দিয়েছে। ফলে পরের দিন লক্ষ্যভেদের প্রতিযোগিতা দেখবার জন্য ক্রীড়া-প্রাঙ্গণে দ্বিগুণ দর্শকের প্রচণ্ড জনতা সমবেত হ’ল।
বর্মচর্ম পরিহিত রাজকুমার ধনুর্বাণ নিয়ে আজ যথাসময়ে উপস্থিত হয়েছিল সেখানে। রাজকন্যা আগের দিন ঘোড়দৌড়ের প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে বেশ একটু লজ্জিত ও কুষ্ঠিত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি একটু পরে প্রবেশ করে তার ধনুকে বাণ সংযোজন করে ক্রীড়া-প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়ালেন।
ঘণ্টা পড়লো। মহারাজ ইঙ্গিত করলেন। লক্ষ্যভেদ করতে গিয়ে রাজকন্যার হাত যেন একটু কেঁপে উঠলো। রাজকুমারের ধনুকের নিক্ষিপ্ত তীর ততক্ষণে লক্ষ্য বিদ্ধ করে সেখানে যেন থর-থর করে আনন্দে কঁপিছিল। রাজকুমারীর নিক্ষিপ্ত শর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে বেশ একটু তফাতে গিয়ে বিদ্ধ হ’ল।
লক্ষ লক্ষ জনতার কণ্ঠে আবার সেই বিপুল জয়ধ্বনি। তাদের সমবেত আনন্দ-কোলাহলের মধ্যে সকলের সঘন করতালি যেন কানে তালা ধরিয়ে দিচ্ছিল। ‘জয়’ ‘জয় রবে চতুর্দিক মুখরিত হয়ে উঠলো।
রাজকন্যা আজকেও পরাজয় বরণ করে লজ্জায় মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে রইলেন। পরের দিন হাতের লেখা ও গণিতের পরীক্ষা। আজ রাজকুমারের মনটা একটু ভারাক্রান্ত ছিল। কারণ, তার হস্তলিপি যে খুব ভালো নয় এটা তার জানা এবং অঙ্কের ব্যাপারেও সে যে খুব ওস্তাদ নয় এটা সে আগের রাত্রে অর্জুনের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে বেশ বুঝেছিল। তবু ভগবানকে স্মরণ করে সে এসেছে। যদি ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়ে তাকে আজো জিতিয়ে দেয় এই ভরসায়।
সবাই উৎসুক হয়ে রাজকন্যার আগমন প্রতীক্ষা করছে। রাজকন্যার তখনো দেখা নেই। সময় প্রায় হয়ে এলো। শেষ ঘণ্টা পড়লো। রাজকুমারী কই?
এমন সময় দেখা গেল নববধূর বেশে সুসজ্জিতা হয়ে রাজকন্যা ক্রীড়া-প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলেন। সঙ্গে তার সখীরা নানা মাঙ্গলিক উপাচার হাতে নিয়ে পিছু-পিছু এলেন। পুরনারীরা হুলুধ্বনি ও শঙ্খধ্বনি করছিলেন।
রাজকন্যা ধীরে-ধীরে রাজকুমারের নিকট এগিয়ে এসে রাজকুমারের গলায় নিজের কষ্ঠের বহুমূল্য বরণমাল্য খুলে পরিয়ে দিয়ে শ্রদ্ধাভরে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করে উঠে সমবেত সকলকে সম্বোধন করে নমস্কার জানিয়ে বললেন, এই অজ্ঞাত বীরের কাছে বার বার পরাজয় স্বীকার করে আমি লজ্জিত হইনি। আমি গর্বিত। আপনাদের সকলের সম্মুখে আমি সকল দেবতাকে আর আমার স্নেহময় পিতা মহারাজকে সাক্ষী রেখে এই বিজয়ী যুবককে আজ পতিত্বে বরণ করলাম। অন্য পরীক্ষা দুটি প্রত্যাহার করে নিলাম।
ক্রীড়া-প্রাঙ্গণের সেই বিরাট জনসমাবেশ তখন আনন্দ-কলেবরে চারিদিক যেন পূর্ণ করে তুললো। সারা প্রাসাদ যেন আনন্দ-উৎসবের হর্ষধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠলো। রাজা সিংহাসন থেকে নেমে এসে বর-বধূকে সাদরে আশীৰ্বাদ করে তাদের দু’জনকে পাশাপাশি বসিয়ে ঘোষণা করলেন, সাতদিন উৎসব হবে। আপনাদের সকলের নিমন্ত্রণ রইলো।
ইতিমধ্যে অর্জুন উর্ধ্বশ্বাসে ঘোড়া ছুটিয়ে ইন্দিরাকে নিয়ে সেখানে হাজির হল। বললো, বন্ধু, তোমার আদেশ পূর্ণ করেছি। রাজকুমার ইন্দিরা আর অর্জুনের পরিচয় করিয়ে দিলেন রাজার সঙ্গে। ইন্দিরা ও রাজকুমার সেনাপতি সংগ্রামসিংহের পুত্র-কন্যা শুনে রাজার আর আনন্দ ধরে না। বললেন, আমরা ছিলাম বাল্যবন্ধু। তোমার পিতা আমাকে সাহায্য না করলে আমি আমার হৃতরাজ্য ফিরে পেতুম না। শ্রীভগবানের অশেষ দয়ায় আজ তোমাদের আমি কাছে পেলুম। আপনজন করে পেলুম।
তারপর? বিবাহ-সভায় সে রাত্রে শুধু রাজকুমারের সঙ্গে রাজকন্যারই বিবাহ হ’ল না, ইন্দিরার সঙ্গে অর্জুনেরও বিবাহ হ’ল রাজকুমারের ইচ্ছানুসারে। মহারাজ রাজকুমারকে সে রাজ্যের যুবরাজ বলে ঘোষণা করলেন আর অর্জুনসিংহকে করে দিলেন তার প্রধান সেনাপতি। রাজ্য জুড়ে সাতদিন ধরে আনন্দ-উৎসব চলতে লাগলো। আমার কথাটি ফুরোলো।