নভেরা হোসেনের গল্প ‘বেহালার একাঙ্কিকা’
প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৮, ২০১৯
গত কয় মাস ধরে মাইগ্রেনের ব্যথাটা চরম আকার ধারণ করেছে, লেখার জন্য সারানা কলম পর্যন্ত ধরতে পারছে না, কিন্তু মাথায় আঘাত করছে এলোমেলো কথারা। তাদেরকে একটা রূপ না দিয়ে উপায় নাই। করো করো করো। এছাড়া আর কোনো পথ নাই; মানে আছে হাজারটা পথ কিন্তু সবাইতো সব কিছু পারে না। ফরিদা হতে পারে না আরিয়ানা, আরিয়ানা হতে পারে না রেবেকা, রেবেকা হতে পারে না কৃষ্ণা। এ-তো চক দিয়ে ঘর কেটে দেয়া, তোমার ঘরে তুমি, আমার ঘরে আমি। বন্ধু বন্ধু বন্ধু। ফ্রেন্ড সার্চ দিয়ে ফেসবুকে হাজার জন চলে আসছে। একের ভেতরে অনেক, বহুজন। জালের মতো বিছানো। নেটওয়ার্কিং। চ্যাট লাইন অন করলেই ছেঁকে ধরে সব। কেমন আছেন? কেমন আছো? কেমন আছিস? হাই! হাই! হাই! ইদানীং ফেক্ একাউন্ট খুলেও বন্ধুরা আসছে; ঝাঁকে ঝাঁকে, ঝাঁকে ঝাঁকে। কিন্তু যেই তুমি একাউন্ট ডি-একটিভেট করে দিলে সব হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ভেরি ইন্টারেস্টিং। মানুষ দ্রুত জীবনকে গতিশীল করে তুলেছে, কমিউনিকেটিভ করে তুলেছে। এটা সত্যি আকর্ষক! একেই বলে উত্তরাধুনিকতা। মানে হিম যুগ, জুরাসিক যুগ, মেসোজয়িক যুগ, সামন্ত যুগ, আধুনিক যুগ সব পার হয়ে উত্তরাধুনিক কাল। সেদিন কোনো একটা নাটকে দেখা গেল প্রত্যরাধুনিক কালও চলে এসেছে। এ যুগে কথা হবে মেসেজে, মেইলে, ভয়েস এসএমএস বা স্কাইপিতে। হাজবেন্ড দিনরাত অন লাইনে কাজ করবে, ওয়াইফ মাঠে মাঠে মেটাফিজিক্যাল বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাবে, কিন্তু মাইগ্রেনের ব্যথায় সারানার প্রায় অক্কা পাওয়ার দশা। ডাক্তার ব্যথানাশক দিতে দিতে নাভিশ্বাস কিন্তু রেজাল্ট জিরো। বড় ছেলেটা ইউএসএ থেকে বারবার ফোন করছে মা টাকা পাঠাও, এবারের সেমিস্টারে এক্সট্রা দু-একটা কোর্স নিতে হবে। সময় কম। কোন দুঃখে না সুখে যে ছেলেটাকে মার্কিন মুল্লুকে পাঠিয়েছিল সারানা, আল্লাহ-ই জানে! এ-তো কোর্সের নামে ঘটিবাটি সব বিক্রি করাবে মনে হয়। আর স্বামী প্রবরটি তো শ্রমজীবী, শ্রম বিক্রি করে খায়। তার শ্রমে আবার ডালপালা গজায়। ডালপালা ছড়াতে ছড়াতে মহীরুহতে পরিণত হয়। মহীরুহের ছায়াতলে পঙ্গপালের মতো আশ্রয় নেয় পরিবার পরিজন। হ্যাঁ এখানে এটাই নিয়ম। নিয়ম করা হয়েছে অনেক অনেক দিন আগে। কত বছর আগে? কত হাজার বছর আগে? কৌম সমাজ ছেড়ে গোত্র, পরিবার, কৃষিকাজ। না না একদিনে তা হয় নি। একটু একটু করে আদম আর ঈভ শৃঙ্খলিত হয়ে গেছে নিজেদের বোনা জালে। নিজের ঘর সেটা কোনোকালে কারো ছিল বলে মনে হয় না। আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে সারানা খাটের এপাশ থেকে ওপাশ ফিরে শোয়।
কী গ্রন্থকীট ভেবে সব শেষ করছ, নাকি লেখার জন্য কিছু অবশিষ্ট আছে?
সারানা চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকে, এখন শুরু হবে প্রশ্ন-উত্তর খেলা। এসব খেলা খেলতে খেলতে সারানা ক্লান্ত হয়ে গেছে আর ভালো লাগে না।
কায়সার নতুন কোনো পাজল থাকলে খেলো, না হলে কথা বন্ধ, মাথা ধরেছে।
তাহলে মাথা টিপে দিই?
নাহ্, ঝটকা মেরে সারানা খাট থেকে নেমে যায়।
বুঝি না কথায় কথায় তোমার এত রাগ উঠে যায় কেন? দু-পাতা লিখে নিজেকে মস্ত কিছু ভাবছ কেন? আর তোমাদের এসব লেখা কারা পড়ে?
সারানা কোনো কথা না বলে সরাসরি রান্নাঘরে চলে যায়। ছোট একটা মেয়ে দিয়ে এত বড় বাসার কাজ চলে না। বাজার করো, গোছগাছ করো, মেয়েকে রেডি করে কলেজে পাঠাও। মেয়ের সব কাজ করে দিতে হয়... এখন তো আর কেউ ছোট নাই অথচ মুখে ভাত তুলে খাওয়াতে হয়। এসবের জন্য অবশ্য সারানাই দায়ী। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে পড়ার সময়ে বিয়ে হয়ে যায়, তারপর পা ঘষটাতে ঘষটাতে এই এতদূর! চট্টগ্রামের পাহাড়তলির জীবন ছেড়ে কোলাহলের ঢাকা শহর। বাচ্চাদের জন্য সারানা অনেক করেছে। ওরা হয়তো পারত কিন্তু সারানার ভেতরে একটা আকাশচারীর বাস, যে নিজের ডানায় করে শিশুদের নিয়ে উড়ে চলতে ভালোবাসে। তা সে চাওয়া একেবারে ব্যর্থ হয়ে যায় নি। ছেলে-মেয়ে দুটো একেবারে মা-ন্যাওটা, মায়ের শরীরের গন্ধ পেলেই ডানা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে সারানা ভাবতে থাকে বিয়াঙ্কা সে তো আস্ত এক রাশান মেয়ে, গভীর কালো চোখের মধ্যে সতেজ একটা হাতছানি। উড়ছে উড়ছে, তার কুন্তলিত কেশরাশি। লাভিং বার্ড। এ ভালোবাসা রক্তে, মগজে। দেয়, হ্যাঁ অনেক কিছু দেয় তা সারানাকে। বাচ্চাদের শরীরের গন্ধ ওদের শিশুকাল থেকে পাচ্ছে সারানা, পায়ের কাছে কেমন একটা মিষ্টি গন্ধ। সারানা কখনো নেশা করে নি কিন্তু বাচ্চারা ওর অব্সেশ্ন্। ওদের ছাড়া চলে না। গত বছর ছেলেটা মার্কিন স্কলারশিপ নিয়ে চলে গেল। প্রথমে খুব কষ্ট হয়েছে এখন ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসছে। মেয়েটা মেধাবী যদিও খুব একরোখা! মাঝে মাঝে আরামে সারানার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। কী কষ্টই না হয়েছে সিঁড়ি দিয়ে ওদের বয়ে নিয়ে চলতে আর সেজন্যই লেখাটা তেমন হলো না। অথচ সারানা সারাক্ষণ কল্পনায় বুঁদ হয়ে থাকে, মনের মধ্যে কিছু একটা বলার তীব্র আকাক্সক্ষা। মাঝে মাঝে মনে হয় নিজের জীবনের কিছু ভুল সিদ্ধান্তের জন্য আজ তাকে হতাশায় ডুবে থাকতে হচ্ছে। আর ভুলই বা সে বলে কী করে! এসব তো চক্রাকারে ঘুরছিল। সারানা সে চক্রে চক্রে এখানে। বাচ্চাদের সময় না দিলে ওরা হয়তো ওদের মতো হতো বা কায়সারের ছাপটা বেশি পড়ত। তাতে সারানাও খুব খুশি হতে পারত না কিন্তু আজ যে হতাশা, নৈঃসঙ্গতা সেটা সারানাকে একেবারে বিধ্বস্ত বানিয়ে ফেলেছে, কাবাব মে হাড্ডি মনে হচ্ছে নিজেকে। ইদানীং সারানার সবকিছুতে অনীহা। ছেলের ফোন না এলেও মনে থাকে না, কোথায় কী হচ্ছে কিছুই মনে করতে পারছে না, জরুরি কাগজপত্র ময়লার বাস্কেটে চলে যাচ্ছে। হঠাৎ সেদিন বুয়া পাসপোর্ট রিনিউর সিøপটা তার হাতে এনে দিল। সারানা ঘুমের মধ্যে দেখতে পায়; একটা প্রান্তর হু হু বাতাস, দিগন্তরেখায় কালো-সবুজ হিবিজিবি আঁকা। সে দ্রুত দৌড়াতে থাকে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, জল তেষ্টা পায়। নাহ্ যত দৌড়াতে থাকে দিগন্তরেখাটা তত যেন সরে সরে যায়।
সারাদিন পরে ফ্রি হয়ে লিখতে বসে সারানা। যেকোনোভাবেই হোক নিজের ভেতরের জমে থাকা কথাগুলো বলতে খুব তাড়না বোধ করছে আজকাল। একসাথে দুটো গল্প লেখা চলছে। আলতামোহরের কাহিনি আর নিরুদ্দিষ্ট মন। দুটো জীবন, একজন মানুষই যেন। একজন মানুষের দুটো জীবন। একজীবনে সে আলতামোহর, সংসারের ঘেরাটোপে পাখসাট করতে করতে যার দিন অতিক্রান্ত হয়ে যায়। বুনো মুরগির রাগ নিয়ে, অভিমান নিয়ে একটা কুয়োর মধ্যে জল হাতড়ে বেড়ানো। আর নিরুদ্দিষ্ট মন-এ সেই আলতামোহরই প্রান্তরের হাওয়ায় নিজেকে মেলে ধরে, ডানা দুটো ভেঙে গেলে মেরামত করে নেয়; নিজের শরীরের আবিলতা সরিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠে, উড়তে শেখে। সারানা লেখে আর ভাবে এই দুইজন তো সে নিজে, ভয়ানকভাবে তারই এক্সটেনশন। একবার পাঁকের মধ্যে পাঁকাল মাছ আবার সেই পাঁক-কাদা থেকে সাঁতরে ওঠা মানুষ। এই মানুষ তো আজকের নয়; তার সারা শরীরে উল্কি, গোত্রের টোটেম, হাতে বাজুবন্দ, পায়ে মল। যতদূর যায় আলতামোহর, তার মলের শব্দ শোনা যায়। এটা যেন বৃত্তবদ্ধ ঘরের চাবি; তাকে হারিয়ে ফেললে চলবে না, পুরো অর্থটাই হয়ে পড়বে দ্বিধান্বিত, তো আলতামোহর সেই চাবি নিজের কোমরে গুঁজে চলে। সংসারের একটা চিরন্তন রূপ ধরে আলতামোহর স্নান করতে পুকুর পারে যায়, আলু ক্ষেতে যায় শাক তুলতে, বাঁশঝাড়ের মাথায় জেগে ওঠা শুক্লপক্ষের চাঁদ কখনো কখনো তাকে মাতাল করে কিন্তু এ সব-ই করে সে তিতির পাখির মতো ধুকপুক হৃদয়ে। নিরুদ্দিষ্ট মন-এ লাবন কাঁধে ক্যামেরা ঝুলিয়ে পথে পথে ফটোগ্রাফি করে বেড়ায়, ফ্রি-ল্যান্স কাজ। দিনের শেষে ঘরে ফিরে লেখায় নিমগ্ন হয়ে যায়। ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে লাবন একাই থাকে একটা বাসার অর্ধেকটা ভাড়া নিয়ে বাকি অর্ধেকে পরিচিত একটা পরিবার থাকে। দৈনিক সময়ের রিপোর্টার মিজান ভাই বাসাটার খোঁজ দিয়েছিল। পরিবারটার সাথে মানিয়ে চলতে হয়। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেলে ওদের মুখ থমথম করতে থাকে। লেখালেখির জায়গাটায় সে এত একা যে মাঝে মাঝে খুব বিষণœ হয়ে পড়ে। সব ফেলে দিয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে ইচ্ছে করে, কারো সাথে কোনো বিনিময় হয় না। যোগাযোগহীন। সবাই আলাদা আলাদা দ্বীপ! দূর থেকে ভেসে থাকতে দেখা যায়। সে একটা দ্বীপের মতো জেগে থাকে আশ্বিনের ভোরে। লাবন সব সময় একটা ঘোরের মধ্যে চলে, নিজেকে ভরশূন্য লাগে তার। চলছে, ফিরছে, কাজ করছে অনেকটা নেশার মতো, কোনো পিছুটান নেই। সামনের টানও তেমন অনুভূত হয় না। প্রায়ই দেখা যায় লাবনের আকর্ষণ এমন সব মানুষের প্রতি যারা হয় অন্য শ্রেণীর নয়তো সমাজের চোখে যাকে বলে অসম। তার কাছে যৌনতার অর্থ ভিন্ন, পরিবার ধারণার সাথে তাকে সব সময় মেলাতে পারে না লাবন।
দুটি গল্প সমান্তরালভাবে লিখতে লিখতে খেই হারিয়ে ফেলে সারানা। মাঝে মাঝে নিজেকে আলতামোহর মনে হয়, কখনো লাবন কখনো শুধুই সারানা। এমনকি কখনো কখনো এদের কারো সাথেই সে নিজেকে মেলাতে পারে না। একটা প্রচ- ঝড়ের মতো চারদিকের গাছপালা, বাড়ি-ঘর ভেঙে চলতে থাকে। বুনো ঝড় কখনো জল শুষে নিয়ে চলে কখনো মানুষজন, বৃক্ষ, কীট-পতঙ্গ সবকিছুকে নিয়ে। এসব ভাবতে ভাবতে, লিখতে লিখতে বহুরাত হয়ে যায়। বিদ্যুৎ চলে গেছে অনেকক্ষণ; মোমের আলোয় সারানা সোফায় হেলান দিয়ে বসে থাকে নিষ্পলক। তার ইচ্ছে করে সারা শহর হেঁটে বেড়াতে, শহরের নিয়ন আলোয় পথ চলতে চলতে কোনো গহ্বরে ঢুকে পড়তেÑ যেখান থেকে আর ফেরা যায় না।
সারানা এই সারানা তোমার কী হয়েছে, কখন থেকে কলিং বেল দিচ্ছি, শুনতে পাও না? কায়সার ল্যাপটপ নিয়ে ঘরে ঢোকে, পেছন পেছন আধ-ঘুমে সমিরন।
ওদেরকে দেখে সারানা সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায়।
কি তোমার শরীর খারাপ জিজ্ঞেস করে কায়সার।
নাহ্। খুব ক্ষীণ গলায় উত্তর দেয় সারানা।
তাহলে?
তাহলে কী?
বেল শুনেও দরজা খুললে না?
সারানা কী করে বলে সে কোনো বেলই শুনতে পায় নি। একটা গভীর তন্দ্রাচ্ছন্ন অনুভূতি, মানসিক অবস্থা তখন কোন স্তরে ছিল কে জানে? নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। সে সময় ছোট ছোট রঙিন বেলুন আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছিল, শরতের স্নিগ্ধ আকাশে একটা গোলাপি শালিক উড়ছিল মাথার উপর দিয়ে। সারানা তাড়াতাড়ি চোখে-মুখে পানি দেয়। হ্যাঁ বলো কায়সার তোমাদের অফিস ম্যানেজমেন্টে কোনো পরিবর্তন হলো?
কায়সার গুম মেরে কাপড় বদলাতে থাকে।
সারানা বিয়াঙ্কার মিডটার্মের কী খবর?
এই তো ভালো।
এই তো ভালো মানে? আমি জানতে চাইছি ওর রেজাল্ট কী?
তুমি ওর শিট থেকে দেখে নিলেইতো পারো।
কেন তুমি কী করো সারাদিন?
তুমি দেখতে পারবা না? উহু কায়সার তুমি তো অদ্ভুত কথা বললে, বিয়াঙ্কার পুরো ডিপার্টমেন্ট আমার! তোমার কোনো দায়-দায়িত্ব নাই? তুমি নিজে কিছুই জানতে পারবে না?
আহ্ আমার তো নানা ঝামেলা, টেনশন, প্লিজ অফিস থেকে আসছি এখনই মেজাজটা খারাপ করে দিও না।
সারানা দৌড়ে রিডিং রুমে চলে যায়। দ্রুত লিখতে থাকে... আলতামোহর নদীর পারে বিষণ্ণ মনে বসে আছে, নদীর ভাটার টানে মাল বোঝাই নৌকা ভেসে যাচ্ছে। বাতাসে নৌকার পাল ফুলে ফুলে উঠছে। আলতামোহর পায়ের নূপুর খুলে ফেলার চেষ্টা করে, হাত দিয়ে পেঁচিয়ে রূপার মল ভাঙার চেষ্টা করে, রক্তারক্তি অবস্থা, গল গল করে রক্ত পড়তে থাকে পা কেটে।
লাবন তড়িঘড়ি করে হাঁটছে, তাকে দ্রুত পৌঁছাতে হবে এগ্জিবিশন হলে। আজ একজন ক্রেতার আসার কথা কিছু ছবি কেনার জন্য। ক্যামেরার শাটার টিপতে টিপতে লাবনের চোখেমুখে ফুটে ওঠে এক আনন্দ অনুভূতি। তার লেন্সে ধরা পড়ল এক ঝাঁক সাইবেরিয়ান সারস। ক্রেনস আর ফ্লাইং।
সারানা খাবে না?
সারানা ঘোর থেকে চোখ মেলে তাকায়। কায়সারের কণ্ঠস্বর ক্ষীণ শুনতে পায়।
হুঁ।
চল, অনেক রাত হয়ে গেছে।
তুমি যাও আমি আসছি।
না না এখন চলো, ঘুমাব, কাল সাড়ে আটটায় অফিসে পৌঁছাতে হবে।
সারানা দ্রুত লেখার প্যাড, কলম ড্রয়ারে ভরে উঠে দাঁড়ায়, ডাইনিং রুমে বসে নিঃশব্দে ভাত খায়। আলতামোহর ভালোবাসে পাশের গ্রামের গায়েনকে। গায়েন যখন রাতের আসরে গান গাইতে থাকে আলতামোহর ঘরের ভেতর ঘামতে থাকে, গায়েনের সাথে দূর-দূরান্তে ভ্রমণের লোভ জাগে মনে। একবার শুধু একবারই আলতামোহর গায়েনের সান্নিধ্যে এসেছিল। তারপর থেকে তার মনে আর সুখ নাই। স্বামীর জায়নামাজে ফুল তুলতে তুলতে আলতামোহর উন্মনা হয়ে ওঠে, নদীর পানি যেমন ফুঁসতে থাকে বানের সময় আলতামোহরও সংসারের ছন্দে হাঁপিয়ে উঠে ফুঁসতে থাকে, কেউ জানতে পারে না তার মনের খোঁজ। এমনকি আলতামোহর নিজেও সবসময় বুঝতে পারে না নিজেকে। আলতামোহরের মনের মধ্যে বাজতে থাকে করুণ একটা সুর, সে চায় গায়েনের সাথে সুর মেলাতে কিন্তু এ যে অসম্ভব। আলতামোহর নদীর পার ধরে হাঁটে আর মনে মনে গেয়ে চলে আপন সুরটি। স্বামী, শ্বশুরবাড়ির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আলতামোহরের সুর কণ্ঠে আসে না, কেউ কোনোদিন তা শুনতে পায় না। নদীর পারে আলতামোহরের পায়ের একটা নূপুর পড়ে থাকে, নূপুরের গায়ে রক্ত শুকিয়ে কালচে হয়ে গেছে। এরপর আর কোনোদিন আলতামোহরকে নদীর কূলে দেখা যায় না, স্রোতের সাথে ভেসে ভেসে আলতামোহর কোথায় চলে গেছে! তার পায়ের চিহ্ন শুধু পড়ে থাকে নদীর ধার ঘেঁষে।
লাবন দ্রুত পায়ে হল ঘরে ঢোকে। অনেক লোক, ভিড়, ক্যামেরা, আলো। ভিড়ের মধ্যে লাবন পিঙ্গল বর্ণের দুটো চোখ খুঁজতে থাকে আতিপাতি করে।
বাইরে প্রচণ্ড আলো ঝলকাচ্ছে সারা রাতের বৃষ্টির পর কমলা রোদের সকাল, সারানা খালি পায়ে বাগানের ঘাসে পা ফেলে, ঘাসগুলো আলতো করে ছুঁয়ে দেয়, একটা ভীষণ সতেজ অনুভূতি। ভোরের বাতাসটার মধ্যে এমন কিছু আছে, সারানা খাঁচায় বন্দি পাখির মতো ছটফট করতে থাকে। অস্থিরতা কানা উপচে পড়তে থাকে। এক সময় রিডিং রুমে যাওয়ার জন্য সারানা দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে, মনে হয় লিখেই সব কথা আজ প্রকাশ করতে হবে আর কোনো উপায় তার জানা নেই। ভেতরে ঝড়ের তুমুল তাণ্ডব। না এমন নয় যে, সে কথা কাউকে জানাতেই হবে বা কারো জন্যই সে লেখা! নিজের জন্য? কী জানি... সারানা তা জানে না। মনে হয় তা যেন প্রকাশিত হওয়ার জন্য, এইটুকু শুধুমাত্র। রিডিং রুমের জানালাগুলো সারা রাত খোলা ছিল। বৃষ্টি— বইপত্র, কম্পিউটার সবকিছুকে ভিজিয়ে দিয়েছে। দ্রুত রিডিং রুমে ঢুকতে গিয়ে সারানা পায়ে একটু হোঁচট খায়। উহ্ আলতামোহর! আচমকা গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে।