নভেরা হোসেনের গল্প ‘একজন উমাপদ’
প্রকাশিত : জুলাই ০৪, ২০১৯
রাতের পর রাত কেটে যায়। শীতের প্রারম্ভে ঝাঁকে ঝাঁকে ছারপোকা। বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তে একটা আস্ত সিগরেট বেরিয়ে এলো। বছর আটেক হলো, উপাপদ খুলনার সোনালী জুট মিলে কাজে যোগ দিয়েছে। পার্চেজ অফিসার, একা মানুষ। সারাদিন মিলের হিসার-নিকাষ নিয়ে ব্যস্ততায় কেটে যায়। সহকারী শরীফ আর উমাপদ একটা পুরানো দোতলা বাড়ির ছাদের ঘরে ভাড়া নিয়েছে। সামনে এক চিলতে ছাদ, নানা ফুলের গাছ, কমলা আর হলুদ রঙের গাদা ফুল। গ্রামের বাড়িতেও উমাপদদের অনেক গাছ। গৌরনদীর বাজার পেরিয়ে পুরানো নাট-মন্দির তারই পেছনে সাহাদের বাড়ি। বাড়ির চারপাশে আম-জাম নানা জাতের গাছ। কাঠের জন্য উমাপদের বড়দা অনেক মেহগনি গাছ লাগিয়েছিল, সেগুলো এখন বাড়ির মাথা ছাড়িয়ে অনেক উঁচুতে উঠে গেছে। সেই সাথে উমাপদদের জ্ঞাতি-গোষ্ঠিরাও ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। একাত্তরের পর মেজো জ্যাঠা, সেজো জ্যাঠা, পিসিমা— সবাই কলিকাতায় চলে গেল। একমাত্র উমাপদের বাবাই ভিটা আগলে বসে থাকল, তিন ছেলেকে গ্রাজুয়েশন করিয়ে চাকরির জন্য তৈরি করল, মেয়েকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠাল। উমাপদ মাঝে মাঝে ভাবে, বাবা যে মানসিক গড়ন নিয়ে তাদেরকে নিয়ে নিজের দেশে থাকল তা সত্যি কঠিন। মেয়ে সবিতার যখন তিন বছর বয়স তখন উচ্চ রক্তচাপ থেকে মাথায় রক্তক্ষরণ হয়, চোখের সামনে মারা গেল উমাপদের মা। উমাপদ জানে তার কোনোদিন বাড়ির লোকদের প্রতি তেমন মায়া-মমতা ছিল না, বাবার কঠোর অনুশাসনের জন্য আরও বিগড়ে গেছে তার মন। তবে তা মনে মনে বাইরে সে একদম শান্ত, ঠিকমতো লেখাপড়া শেষ করে পরীক্ষা দিয়ে চাকরিতে ঢুকেছে।
এসএসসি পরীক্ষা যেদিন শেষ হলো, বন্ধুরা বলল সারারাত বাইরে কাটাবে, নদীর পারে, সঙ্গে বাংলা মদ, একটা আস্ত খাসি ধরে আনা হলো, কেটে কাবাব বানানো হবে, বাজার থেকে পরোটা কিনে আনা হলো। সারারাত জমজমাট। রমিজ বাঁশি বাজিয়ে একদম মুগ্ধ করে দিল। রাতের নদীর তীর সব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে হার মানায় যেন। নদীর ভেতর থেকে একটা গভীর শব্দ ভেতর থেকে এসে ধাক্কা দিচ্ছিল। শেষ রাতের দিকে উমাপদের কিছুটা ঢুলুনির মতো এলো, সে বন্ধুদের আড্ডার হুলোড় ছেড়ে গ্রামের পথ ধরল। অমাবশ্যার রাত, ভালো করে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। বাঁশঝাড় পেরিয়ে কিছুট আগালে পুরানো আম-বাগান। আম-বাগানের অন্ধকার পার হয়ে মন্দিরের এলাকা শুরু। মন্দিরে এখন কোনো লোক থাকে না, পুরানো ভাঙা মন্দির ঝোপ-জঙ্গল হয়ে গেছে। উমাপদ ছোটবেলায় দেখেছে, কালিপূজাতে মন্দিরে কী অপূর্ব আলো জ্বলত। দূর হতে বনের মধ্যেও কমলা-লাল আলো গ্রামটাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেত। বাবার সাথে বহুরাত সে মন্দিরে কাটিয়েছে পূজার সময়। সারারাতের ক্লান্তির পর পা আর চলছিল না, সে মন্দিরের বারান্দার সামনে ধুপ করে বসে পড়ে। চারদিকে নানারকম পোকার শব্দ, ঝিঁঝি, দ্রিত দ্রিত, কুই কুই.., রাতের একটা গন্ধ আছে, অন্ধকারের গন্ধ উমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। কতক্ষণ মনে নেই হয়তো অল্প কয়েক মুহূর্ত, কিন্তু রাতের আবহাওয়ায় সেই কয়েক মুহূর্তকেই কয়েক ঘণ্টার মতো মনে হয়। বারান্দায় থামের সাথে মাথা দিয়ে অল্প ঘুমে আচ্ছন্ন অবস্থায় উমাপদের মনে হয়, একটা পায়ের শব্দ শোনা গেল। চোখ মেলে তাকাতেই ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। অন্ধকারে ঠিক বোঝা যায় না, শাড়িপরা কোনো ছায়ামূর্তি সামনে এসে দাঁড়ায়, হাতে হারিকেন। লালপেড়ে সাদা শাড়িতে এক নারী, মুখটা উজ্জ্বল, হাতদুটো শীর্ণকায়, একগুচ্ছ চুল পিঠের উপর গড়াচ্ছিল। উমাপদ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করে, কে কে? নারীমূর্তি খুব আস্তে বলে, আমি, মন্দিরেই থাকি। দেবতার সেবায় আছি। নারীমূর্তি জিজ্ঞেস করে আপনি কে? এই জঙ্গলের মধ্যে কি করেন? উমাপদ সচেতন হয়ে ওঠে, ভাবে, সত্যি কি কেউ সামনে দাঁড়িয়ে নাকি চোখের বিভ্রম। সে শুনেছে জঙ্গলে অনেক সময় অনেক ঘটনা ঘটে, মানুষ ভুল দেখে, ভুল শোনে। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতার পর তার ঘোর ভাঙে। সে বুঝতে পারে, যা দেখছে তা সত্যি ঘটছে এবং এই রাতের সত্যকে সে কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারে না। নারী শরীরের গন্ধ সে টের পায়, একটা অচেনা বন ফুলের গন্ধ, মাথাটা টলে ওঠে। ঘুটঘুটে অন্ধকারটা তার কাছে আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। মনে হয়, এক দ্রাবিড় মেয়ে যেন তার সামনে দাঁড়ানো। কয়েক মুহূর্তে তার কি হয়, শরীর জেগে ওঠে, ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়তে থাকে, নিজেকে একজন শরীর স্বর্বস্ব ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। মেয়েটা হারিকেন হাতে দ্রুত মন্দিরের ভেতর যেতে চেষ্টা করে। উমাপদ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, মেয়েটির পেছন পেছন যেতে থাকে। হয়তো মেয়েটার সজ্ঞা জেগে ওঠে, সে কিছু বুঝতে পারে। উমাপদ দৌড়ে গিয়ে মেয়েটির হাত ধরে জোড় করে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করে, পা দিয়ে মেয়েটির শরীর আঁকড়ে ধরে। মেয়েটি প্রাণপণে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে, মুখ দিয়ে থুতু ছিটাতে থাকে, রি রি শব্দ করতে থাকে, চিৎকার করতে থাকে কিন্তু সে যেন উন্মাদ, উন্মত্ত হাতির মতো মেয়েটার শরীরে ঝাপিয়ে পড়ে। এতদিনকার যে উমাপদ তার মানস থেকে খসে পড়ল সেই ব্যক্তি। আজকের উমা ভিন্ন এক সত্তা। লালপেড়ে শাড়িপরা মেয়েটিকে ঠাণ্ডা মাটিতে শুইয়ে নিজের কামনাকে চরিতার্থ করল, নতুন, আজকের উমাপদ।
শহর জুড়ে লোড শেডিং। উমাপদ মোমোর আলোতে অফিসের হিসাব মেলায়। বাবা চলে গেল গত বছর, ভাইরা যে যার মতো সংসার-চাকরি নিয়ে ব্যস্ত। উমাপদ আজ এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। কারো সাথে-পাছে নাই, বন্ধু বলেও তেমন কেউ নাই। কলেজ জীবনের অপূর্ব, সোমনাথ, হুমায়ূন সবার সাথেই দূরত্ব হয়ে গেছে। কিছুদিন চিঠিপত্রে যোগাযোগ ছিল, এখন তাও নেই। কোনো কারণ ছাড়াই মানুষে-মানুষে দূরত্ব হয়ে যায় হয়তো কারণও থাকে। মানুষের মন এক অদ্ভুত যন্ত্র, এই যন্ত্রের কাজকর্ম কোনো পরিমাপক দিয়েই মাপা যায় না স্পষ্টভাবে। উমাপদের বাবা বহুবার চেষ্টা করেছেন তাকে বিয়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু কী একটা বাঁধা যেন উমাকে ঘিরে ধরে, কোনো মেয়েকেই সে আর নিজের খুব কাছে পেতে চায় না যেন। যখন একা একা সময় কাটতে চায় না অফিসের কাজের পর, ছুটির দিনগুলোতে ঘরের কাজ সব শেষ করে দুপুরের খাওয়ার পর বালিশে মাথা দিতেই প্রচণ্ড অনিহা কাজ করতে থাকে জীবনের প্রতি, বিষাদগ্রস্থ হয়ে একটার পর একটা সিগারেট শেষ করতে থাকে। মাথার ভেতর অজানা পোকারা কিলবিল করতে থাকে, এই একঘেয়ে মনোটোনাস জীবনটাকে থামিয়ে দিতে ইচ্ছে করে, দেয়ালের ভেতর মাকড়সার জাল বোনাকে একটা ছন্দের মতো মনে হয়। একেকটা প্রাণী, মানুষ, বৃক্ষ, তৃণলতা, বিস্তীর্ণ জললাশি নিজের নিজের ছন্দে ভেসে চলেছে। সারি সারি নক্ষত্র, মেঘরাশি এই বিশাল আর্টপ্রেমে। নিজেকে উমাপদের একটা ধুলোর মতো মনে হয়, যে নিঃশব্দে জল কেটে চলেছে। জলে অনেক মাছ ভেসে চলেছে, কচুরি, মরা শ্যাওলা, পাতাঝাঁঝি, ছিন্নপত্র— উমাপদ তেমনই একটুকরো কাগজের মতো ভেসে চলেছে জলের ভেতর, হঠাৎ হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে তার মনে হয়, সে নির্জন মন্দিরে বসে আছে সেখানে একজন নগ্ন নারী শুয়ে আছে মাটিতে, উমাও নগ্ন, কারো শরীরে প্রাণ নাই। প্রাণহীন দুটি মর্মর মূর্তি অন্ধকারে পরস্পরকে দেখছে। তাদের ভেতরকার মৃত প্রাণ পরস্পরকে দেখছে এবং নারী চোখে ঘৃণা আর যন্ত্রণা। উমাপদের নগ্ন দেহটাকে নারীচোখ চরমভাবে অবজ্ঞা করছে। সেই মৃত নারী; তার চোখ যেন তাকে ভয়ঙ্করভাবে ঘৃণা করছে, মৃত চোখ তাকে পিষে মারছে আর সে একজন মৃত ব্যক্তি হয়েও বার বার চাচ্ছে মাটির সাথে মিশে যেতে। পৃথিবীর সব ধর্ষণ যেন সে একাই করেছে। অসংখ্য মৃত নারী চোখ তার দিকে তীর ছুঁড়ছে, জল ছুঁড়ছে, আগুন। উমাপদ ঘুমের মধ্যে গোঙাতে থাকে, বিছানার এপাশ-ওপাশ করতে করতে ঘুমটা ভেঙে যায়। বাইরে শীতের সকাল, একটু রোদ জানালায় এসে বসেছে। বন্ধ জানালার কাচের ওপাশ থেকে আলোর উদ্ভাসন। উমা এক ঝটকায় বিছানা থেকে নেমে আসে, ঠাণ্ডা মেঝে পেরিয়ে দরজা খুলে উঠানে পা ফেলে, গেরুয়া কালো মিশ্রণের মৃত্তিকা উমাপদকে বিস্মিত করে। একটা নতুন দিন, নতুন পৃথিবী। সকালের শিশিরে ভেজা মাটি, সোঁদা গন্ধ। উঠানের কোণায় ঘাস-ঝোপের মধ্যে নীল রঙের একটা অচেনা ফুল উমাপদকে চুম্বকের মতো টানতে থাকে হয়তো নীলের দিকে নয়তো নীলের অবশেষে।