নভেরা হোসেনের গল্প ‘অন্তর্গত করবী’
প্রকাশিত : জুন ০৩, ২০২০
কাল মৃগী আসিবে ফিরিয়া;
সকালে আলোয় তারে দেখা যাবে
পাশে তার মৃত সব প্রেমিকেরা পড়ে আছে
মানুষেরা শিখায়ে দিয়েছে তারে এইসব
জীবনানন্দ দাশ
ঝড়ো হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে শুকনো পাতারা। আশ্বিনের এই উদ্বেলিত হাওয়ার চনমনে রূপটি তরুণ শিক্ষকের মনে দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হয়ে আছে। দীর্ঘ আড়াই মাস যাবৎ কলেজের চাকরি নিয়ে বাগেরহাটের রামপালে এসেছে সে। এর মধ্যে একবারও ঢাকায় যাওয়া হয়নি। ঢাকার কথা ভাবলে একটা অস্থিরতা এসে ভর করে মনে, কিছুতেই সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা রিকশা, গাড়ির দৃশ্যমানতাকে মন থেকে সরিয়ে দেয়া যায় না। শহর ছেড়ে, চেনাজানা মানুষজন ছেড়ে শুধু যে পেটের দায়ে এই বাদা এলাকায় এসেছে সে, তা সত্য নয়, বরঞ্চ এর মধ্যে আরও একটা সত্য আছে—আর সে নিজেও তা মনে করতে চায় না।
এই এলাকায় একসময় প্রচুর ধানের আবাদ হতো এখন সেখানে বাঁধ দিয়ে গলদা চিংড়ি, বাগদা চিংড়ির চাষ হয়। স্থানীয় জমির মালিক ছাড়াও দূর অঞ্চল থেকে লোকজন এসে জমি লিজ নিয়ে মাছের চাষ করছে। কলেজটির চারপাশেও বাঁধ দিয়ে ঘেরা বহু জমি রয়েছে। বাদার নতুন এলাকায় ছাত্রছাত্রীদের কোলাহল, তারুণ্যের উচ্ছ্বাস তাকে দিনরাত ব্যস্ত রাখছে। ক্লাসের পরে বাকি সময়টুকু সে বই, পত্রিকা পড়ে কাটায়। কলেজের কাছাকাছি একখণ্ড খোলা জমির ওপর একটা বেশ বড়সড় টিনের ঘর আছে, মেঝে পাকা। কলেজের চারজন শিক্ষক এবং একজন চিংড়ি ব্যবসায়ী ওই ঘরে ভাড়া থাকে।
রামপালে আসার পর বাড়ির মালিক তাকে বড় ঘরটির একটা অংশে থাকার জন্য অনুরোধ করে। এত লোকের সাথে পাশাপাশি ঘরে থাকার ইচ্ছা ছিল না তার, কিন্তু কাছাকাছি ভালো ঘর পাওয়াটা কষ্টকর হবে জেনে সুযোগটা হাতছাড়া করা হয়নি। যদিও লম্বা টানা ঘরটিকে হার্ডবোর্ড দিয়ে পাঁচ-ছয়টি আলাদা কক্ষ তৈরি করা হয়েছে কিন্তু বাথরুম, ল্যাট্রিন সব কমন। এতে অবশ্য খুব অসুবিধা হচ্ছে না, সমস্যাটা অন্য জায়গায়। নিজের মতো একা থাকার জন্য এই বাদা এলাকায় চাকরি নিয়ে এলেও সে সুযোগ খুব কম ঘটে। পাশের ঘরের প্রতিবেশীরা যখন তখন ঘরে এসে ঢোকে। সাবান, তোয়ালে না বলে নিয়ে যায়, এমনকি রাতবিরাতে মেসের মতো তাসের হুল্লোড় শুরু হয়। মদটদও চলে বোধহয়। মেয়েদের আনা হয় নাকি এখনও বোঝা যায়নি, তবে বউ-সংসার ছেড়ে এতদূরে এসে আনন্দে মেতে থাকার উৎসটা শুধু যে চাকরি নয়, তা বোঝা যায়।
চাকরির প্রায় দুই মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। এর মধ্যে পাশের ঘরের দর্শনের প্রফেসর একদিন তার ঘরে এসে দীর্ঘক্ষণ ছিলেন। সৌজন্যমূলক কথা শেষ হলে তিনি হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, ঢাকা ছেড়ে যে এই বাদার দেশে আসলেন, টিকবেন তো? আর আপনার ফ্যামিলির কথা কিছু জানা হলো না। আপনার ওয়াইফ কী ঢাকায় নাকি অন্যত্র?
এসব প্রশ্নের জন্য সে একদম প্রস্তুত ছিল না, চমকে উঠল। তার ওয়াইফ আছে এমন কথা তো কাউকে বলেনি, চাকরির সিভিতে সিঙ্গেল উল্লেখ আছে। তরুণ শিক্ষক মৃদু হেসে বলল, সবে তো আসলাম, কাজকর্ম আগে বুঝে নিই। শিক্ষকতা যদিও নতুন নয় কিন্তু কলেজে প্রথম। সব সেটেল হলে বোঝা যাবে টিকব নাকি চলে যাব।
প্রফেসর তার কথায় সন্তুষ্ট হতে না পেরে জানতে চাইল, বিয়ে-শাদি করেছিলেন এমনই তো শুনলাম, তারপর কী কোনো সমস্যা... তরুণ শিক্ষক এই প্রসঙ্গে কোনো কথা না বলে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর হঠাৎ বলল, চা খাবেন নাকি কফি? আমার কাছে ভালো কফি আছে, চিনি, দুধ সবই আছে। প্রফেসর সাহেব কথা না জমাতে কিছু না খেয়েই চলে গেলেন।
ওই রাতে প্রফেসরের সাথে কথা বলার পর তরুণ শিক্ষকের ঘুম আসছিল না। বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করতে করতে সিগারেটের তীব্র নেশা জাগে। সকালের আনা সিগারেট ফুরিয়ে যাওয়াতে শেষ পর্যন্ত প্রফেসরের ঘরে যেতে হয় সিগারেট আনতে। প্রফেসর সাহেব দরজাটা খোলা রেখেই শুয়ে ছিলেন, গরমে ঘুম আসছিল না। হঠাৎ দরজায় তার ডাক শুনে হুড়মুড়িয়ে বিছানার ওপর উঠে বসেন।
কোনো সমস্যা?
না, আমার সিগারেট ফুরিয়ে গেছে। ভাবলাম আপনার কাছে যদি থাকে। খুব আড়ষ্ট হয়ে বলল তরুণ শিক্ষক।
আরে এইজন্য এত লজ্জা পাওয়ার কী আছে? আপনাদের বয়সে আমরা চেইন স্মোকার ছিলাম। ভালো লাগত ক্যাপস্টান আর মাঝে মাঝে পট্টি-টট্টিতে ঢুঁ মারা, এখনও চান্স পেলে ট্রাই করে দেখি। প্রফেসরের এই ধরনের খোলামেলা কথায় সে অনভ্যস্ত, তাছাড়া প্রায় বাবার বয়সি একজনের মুখে এসব শুনতে ভালো লাগছিল না। সিগারেটের প্যাকেট থেকে দুটো গোল্ডলিফ তুলে নিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালে বয়োজ্যেষ্ঠ হাত ধরে জোর করে তাকে বিছানায় বসায়।
আজ রাতে না হলে নাই ঘুমালেন, আসেন তাস খেলি। হাসতে হাসতে বলল প্রফেসর সাহেব।
না। কার্ড খেলা আমি পছন্দ করি না।
তাহলে কী পছন্দ করেন সেইটা বলেন শুনি। মদটদ চলে? আরে ইয়াং জেনারেশন কী দুধ মুখে দিয়া থাকে নাকি?
হা হা হাসতে হাসতে প্রফেসর ভিন্ন প্রসঙ্গে যেতে চাইলে তরুণ শিক্ষক বলল, খাব না কেন? ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় সপ্তাহে একবার কেরু না হলে বাংলা চলত। মাঝে-সাঝে বিদেশি ভদকা, জিনটিনও জুটে যেত। আপনার কাছে কী আছে?
ওই তো যা বললেন, কেরুর হুইস্কির বেশি তো সম্ভব না। তবে মংলা পোর্ট থেকে দু-এক সময় বিয়ারের কেস, বিদেশি জিনিসও আসে। মাত্র তো আসলেন সব বুঝে যাবেন, সময় লাগবে না। খাবেন নাকি? চকচকে চোখে জানতে চাইল প্রফেসর।
সারাদিনের ক্লান্তি আর মনের ভেতরের চাপটাকে সরাবার জন্য তরুণ শিক্ষক রাজি হলো খেতে। এরপর প্রফেসর সাহেব মাঝরাতে বোতল-টোতল বের করে, গেলাস সাজিয়ে, প্লেটে চানাচুর সহযোগে ভালো আতিথেয়তা করল। খাওয়া শুরু হলে প্রফেসর সাহেব বলতে শুরু করে, শোনেন, এত চুপচাপ থাকবেন না। নতুন জায়গা ঘুরে দেখেন, ইংরেজির মারুফকে বলবেন আপনাকে মংলায় নিয়ে যাবে। ঐখান থেকে ছোট লঞ্চে বা নৌকায় সুন্দরবনে ঘুরে আসতে পারেন। হরিণের মাংসের রোস্ট না খেলে তো সুন্দরবনে যাওয়াটাই বৃথা।
মদ্যপানের পুরো সময়টা সে মুখ গুঁজে বসে থাকল। কতক্ষণ হবে—একঘণ্টা, দেড়ঘণ্টা হয়তো তার চেয়েও বেশি সময়। রাতের মিশমিশে অন্ধকার আর ঝড়ো বাতাস তাকে আবেগাপ্লুত করে তোলে, মনটা ক্রমশ ভারি হয়ে ওঠে, দীর্ঘদিন কারো সাথে প্রাণ খুলে কথা বলতে না পারার ভার পাথরের মতো তার বুকে চেপে বসেছে, এ থেকে উদ্ধারের কোনো পথ তার জানা নেই। জীবনে কখনো কখনো এমন সব মুহূর্ত এসে উপস্থিত হয় যখন আর বলবার কিছু থাকে না, কাউকে কিছু বলবার তাগিদটাই নষ্ট হয়ে যায়। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার দিনগুলোতে মনের মধ্যে যে চনমনে ভাবটি ছিল তা আজ নিরুদ্দেশ। মনে ভীষণ এক ঝড় বয়ে যাচ্ছে কিন্তু এ কথা সে কাউকে বলতে পারছে না, কিন্তু না বলেও শান্তি পাচ্ছে না।
নেশার ঝাঁজে চোখ বুজে এলে প্রফেসর বলতে শুরু করে, আপনি এত মনমরা হয়ে থাকেন কেন? বাড়িতে কী কোনো সমস্যা হয়েছে? আমাকে আপন ভেবে বলতে পারেন। এই চিজ সারা জীবনে বহু মানুষের কাহিনি শুনেছে। না এটা ঠিক, কারো জন্য কিছু করতে পারিনি, তেমন ক্ষমতাও আমার নাই কিন্তু মানুষ যদি মনের কথাটা খুলে বলতে পারে সেইটাই তো বড় লাভ। আমাদের এক দার্শনিক তো সারা জীবন গ্রিসের পথে পথে ঘুরে মানুষের কথা শুনতেন আর তার উত্তর খুঁজে বেড়াতেন।
রাত ঘন হয়ে এলে নেশাটা পেঁচিয়ে ধরে। এ সময় প্রফেসরের কথা সত্যি ভীষণ স্বতঃস্ফূর্ত লাগে। রাতের দ্বিপ্রহর শেষ হয়ে এলে প্রফেসরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে ঘরের বাইরে বের হয়। রাত তখন ঝিম ধরে আছে, একটানা ঝিঁঝিঁর ডাক আর নানা বিচিত্র পোকার শব্দ কানে এসে বাজছে। উঠোন ছেড়ে বাঁধের ওপর এসে দাঁড়ালে মিষ্টি একটা মোলায়েম বাতাস শরীরকে স্পর্শ করে। মদটা ভালোই ছিল, বেশ নেশা ধরে গেছে। দক্ষিণের এই বাদায় এসে সত্যি এতদিন পর আজ ভালো লাগছে, মনে হচ্ছে অতীত জীবনটাকে ভুলে থেকেও দিব্যি দিন কাটিয়ে দেয়া যায়; কত ঘটনাই তো জীবনে ঘটবে, ঘটেছে তার জন্য নিজেকে দোষী ভাবার কোনো মানে হয় না। প্রফেসরের রাতের কথাগুলো মাথায় টোকা দিতে থাকে। বাঁধের কোদালি মাটিতে বসে জলের মধ্যে মাছেদের সরাৎ সরাৎ শুনতে শুনতে তরুণ শিক্ষক রাকিব স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে। স্মৃতিতে ভেসে ওঠে শ্যামলকান্তি, ঝকঝকে চোখের এক মেয়ের চেহারা।
ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর এক বছর পর্যন্ত কারো সাথেই রাকিবের তেমন বন্ধুত্ব হয়নি। বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরি, পাবলিক লাইব্রেরিতে। বহুবছর ধরেই তারা মোহাম্মদপুরে বসবাস করছে। রাজিয়া সুলতানা রোডের পুরানো তিনতলা বাড়িটা একাত্তরের মাঝামাঝি সময়ে বিহারীদের থেকে নামমাত্র মূল্যে কেনা হয়েছিল। মা, বাবা আর সামাদ এরাই ছিল বাড়ির স্থায়ী বাসিন্দা। সামাদকে ফরিদপুর থেকে আনা হয়েছিল কাজের জন্য। তাদের বাড়িটা সব সময় বিদেশি জিনিস দিয়ে ভর্তি হয়ে থাকত। ছোটবেলা থেকেই সে দেখেছে বাবা বিমানের চাকরির সূত্রে দেশের গেলে আসার সময় গাদা গাদা ক্রিম, পাউডার, চিজ, মায়ের জন্য প্রসাধনী, ছেলের জন্য রাজ্যের খেলনা নিয়ে আসত। আর কোনো ভাইবোন না থাকায় বাড়িতে সামাদের সাথেই তার খুব বন্ধুত্ব ছিল, দুজনে বিকালে মোহাম্মদপুরের গোরস্তানের পাশের মাঠে খেলতে যেত।
তার মা প্রায়ই বলত, তুমি সারাক্ষণ সামাদের সাথে খেলো কেন? পাড়ার অন্য ছেলেদের সাথে খেলতে পার না? এ বিষয়ে মা ভীষণ রাগ করত, মাঝে মাঝে সামাদকে দেশে পাঠিয়ে দেবার হুমকিও দিত। কিন্তু এত বিশ্বস্ত লোক তার ওপরে বাজার, সওদা, ঘর-বাড়ি দেখাশোনা সব করতে পারে, এমন ছেলেকে ইচ্ছা থাকলেও কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিতে পারত না। মাঠে খেলতে গিয়ে ঐ বয়সে অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, সবার নামও আজ মনে নেই। এর মধ্যে রুমি নামে খুব লম্বা কাল একটা মেয়েও ছিল, তাদের চেহারা এখন ঝাপসা হয়ে এসেছে। বাবা বিদেশে গেলে মা সামাদের সাথে তাকে কলাবাগানে ছোটখালার বাসায় পাঠিয়ে দিত। প্রতিবার ছোটখালার বাসায় যেতে ভালো না লাগলেও মায়ের কথার অবাধ্য হওয়ার সাহস তার ছিল না। একবার ছোটখালা খুব অসুস্থ হয়ে পড়লে সামাদকে নিয়ে সে বাসায় চলে আসে। সেই দিন বাড়িতে ফেরা এবং তারপরের সব ঘটনা তার মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। সামাদের সাথে বাড়ির গেটের কাছে পৌঁছাতেই ভেতর হতে উঁচু ভল্যুয়মে গান শুনতে পেয়েছিল। কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে মার চিৎকার শোনা গেল। মা কাকে যেন জোরে জোরে বলছে, এই যাওনা দরজাটা খুলে দেখো কে এসেছে। ঝি হলে ঘরে ঢুকতে দেবে।
মার এরকম অদ্ভুত গলা সে আগে কখনো শোনেনি। অনেকক্ষণ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যথা হয়ে গেলে ফর্সা, লম্বা খুব মিষ্টি চেহারার এক ভদ্রলোক এসে দরজা খুলে দিয়েছিল। ভদ্রলোক বুঝতে পারেনি সে এই বাড়ির ছেলে, দরজায় দুজন অল্প বয়সি ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি দ্রুত দরজা লাগিয়ে দিতে গেলে সে চিৎকার করতে শুরু করে এবং এক পর্যায়ে ভদ্রলোককে ঠেলে দৌঁড়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে। এরপর এক দৌড়ে মার শোয়ার ঘরে চলে যায়, সেখানে গিয়ে মাকে দেখতে পায় খাটের উপর আধশোয়া অবস্থায়, পরনে শুধু পেটিকোট আর নীল ধনেখালি শাড়িটা গায়ে জড়ানো।
মা তাকে ঘরের মধ্যে দেখে একেবারে আঁৎকে ওঠে, কী ব্যাপার তুমি? তোমাকে পাঠাল কে? ঢুকলে কীভাবে? মায়ের সেদিনের সেই ভয়ার্ত আর হিংস্রতা মেশানো গলা একবারের জন্যও সে ভুলতে পারেনি, ধীরে ধীরে সে নিজের ঘরে গিয়ে খাটে শুয়ে পড়েছিল। ওই সময়ে কী কী ভেবেছিল, সবকিছু আজ স্পষ্ট মনে নেই। কিন্তু ওই বয়সে মনে খুব আঘাত পেয়েছিল। এরপর হতে মার সাথে তার সম্পর্কটা কেমন যেন হয়ে গেল। মাও তাকে তেমন কাছে ডাকত না, সে নিজেও আগ বাড়িয়ে মাকে কিছু বলতে যেত না। আর বাবার সাথে তো দেখাই হতো খুব কম। রবিবারের ছুটিতে বাবা সাত সকালে তাসের আড্ডায় চলে যেত, ফিরত মাঝরাতে। তাকে লুকিয়ে মার অন্য সম্পর্কটা ঠিকই চলছিল। এই সম্পর্কের বিষয়ে ছেলে ছাড়া অন্য কারো ব্যাপারে মার তেমন কোনো অস্বস্তি ছিল না। বাবা তো মার তেমন কোনো খবরই রাখত না। দেশের বাইরে গেলে দশ, পনেরো দিন কাটিয়ে আসত। সেই দিনগুলোর কথা মনে হলে মার উপর একটা ক্রোধ এসে ভর করে মনে, কিছুতেই সে স্থির থাকতে পারে না।
স্কুলে পড়ার সময় থেকেই মতিয়ূর নামে তার এক বন্ধু ছিল, খুবই ঘনিষ্ঠ। ঢাকা কলেজে দুজনে একসাথে পড়েছে। মতিয়ূরের অবশ্য আর লেখাপড়া হয়নি। আইএসসির পর পড়া ছেড়ে দিয়েছে। অল্প বয়সেই সংসারের প্রয়োজনে মতিয়ূর নীলক্ষেতের বাকুশাহ মার্কেটে বইয়ের ব্যবসা শুরু করে। মা আর ছোট বোনদের নিয়ে মতিয়ূর হাজারিবাগে ট্যানারির কাছাকাছি এক বাড়িতে থাকত। রাকিব ইউনিভার্সিটির ক্লাস শেষ হলে প্রায়ই ওই বাড়িতে যেত। খালার হাতে ভাত খাওয়ার জন্য মনটা আনচান করত। অবশ্য অন্য আকর্ষণও ছিল। মতিয়ূর এসময় বাসায় থাকত না। ওদের টিনের শেড দিয়ে ঘেরা বাড়িটায় ছোট একটা উঠোন মতো ছিল। উঠোনে গোলাপ, টগর, বেলি নানান জাতের ফুলের গাছ ছিল। রাকিব মতিয়ূরদের বাসায় গিয়েই করবী, শিউলি, পাপিয়াদের খোঁজ করত। ওরা তিন বোন ছিল পিঠাপিঠি। করবী বড়, সে ছিল খুব শান্ত, বুদ্ধিমতী একটি মেয়ে। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার সময় থেকেই করবীর প্রতি তার একটা তীব্র আকর্ষণ জন্মায়। করবী প্রথমে বেশ লজ্জা পেত কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে সারাদিন ধরে ঘোরাঘুরি শুরু হলে ওর মধ্যেও দারুন স্বতস্ফূর্ততা আসে। একদিন দেখা না হলে করবী অস্থির হয়ে পড়ত। ওকে খুঁজতে খুঁজতে দু-এক সময় বাসায়ও চলে আসত। ছোট বয়স থেকেই করবীর গল্প লেখার একটা ঝোঁক ছিল।
সে সময়ে দুটো পত্রিকায় করবীর গল্প ছাপা হয়েছিল। তার সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর হতে করবী এত অস্থির থাকত যে, তার লেখার মনোযোগ কমে যায়, অবশ্য সে খুব সুন্দর চিঠি লিখত, চিঠিগুলো জুড়ে থাকত স্বপ্নের মতো একটা আচ্ছন্নতা যা তাকে মাতাল করে রাখত। সে অবশ্য কখনও করবীকে লেখেনি। ওর সাথে বিয়ে হওয়ার পর লেখাটা পুরোপুরি ছেড়ে দেয় করবী। মাঝে মাঝে তার মনে হয় করবীর সাথে বুঝি সম্পর্কটা না হলেই ভালো হতো। ওর সাথে সম্পর্ক হওয়ার পর হতে মেয়েটার জীবনের যত উদ্দামতা, উচ্ছ্বাস, ক্রিয়েটিভিটি সব কিছু ধীরে ধীরে কেমন যেন মিলিয়ে যেতে থাকে, তার জীবনের অন্ধকার দিকটিকে সে করবীর উপর চাপিয়ে দিতে শুরু করে। প্রথমে অবশ্য সম্পর্ক খুব রিদমিক ছিল। দুজনে ইউনিভার্সিটি এলাকায় সারাদিন ঘুরে বেড়াত, মাঝে মাঝে নৌকায় বুড়িগঙ্গা বা শীতলক্ষ্যায়ও ভেসে বেড়িয়েছে। সে সময়ে করবীর প্রতি তার টানটা ছিল মারাত্মক। থার্ড ইয়ার থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত পুরোটা সময় প্রতিদিন দেখা হওয়া চাই। করবী ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়াতে সুবিধাও হয়েছিল, খালার হাতে ভাত খাওয়ার অজুহাতে হাজারিবাগে ছুটে যেতে হতো না, করবীও তার ধীমান রূপটিতে মজে ছিল। করবীকে নিয়ে প্রায়ই দুপুরে সে মোহাম্মদপুরের বাসায় চলে আসত। মা দেখেও না দেখার ভান করত। এসময় তিনি নিজের ঘর থেকে একবারও বের হতেন না।
একবার শুধু ছেলেকে ডেকে বলেছিলেন, যে মেয়েটিকে তোমার এত পছন্দ তাকে বিয়ে করে ফেললেই পার, বাড়িতে ফিরে যেতে দাও কেন? তোমার বাবাকে বলতে হলে আমি বলব।
মায়ের এই কথায় সে খুশি হতে পারেনি। রোজ রোজ করবীকে নিয়ে নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে দুই তিন ঘণ্টা কাটানোর মধ্যে যে নিষিদ্ধ কোনো বিষয় রয়েছে, মা যেন তারই ইঙ্গিত করছিল। সে অবশ্য ছয় মাসের মাথায় করবীকে বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে আসে। বিয়ের পরে করবীর প্রতি মার ব্যবহার ছিল শীতল। খুব দরকার না পড়লে করবীর সাথে কথা বলত না, ছেলের ঘরেও কখনো যেত না। ছেলের সাথে দূরত্ব ছিল বলে করবীর সাথে কখনোই তিনি সহজ হতে পারেননি। খাওয়াটাও পৃথক করে নিয়েছিলেন। বিয়ের সময়ে তার কোনো চাকরি ছিল না, সবে মাস্টার্সের রেজাল্ট বেরিয়েছে। বিয়ের প্রথম প্রথম কয়েক সপ্তাহ দুজনে প্রায় সারাদিনই বাড়িতে থাকত, বিকালের দিকে মাঝে মাঝে ধানমন্ডি লেকে বেড়াতে যেত। সময়গুলো ছিল অদ্ভুত স্বপ্নে জড়ানো, করবী অবশ্য দুসপ্তাহ পর হতেই ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস করতে শুরু করে।
প্রায়ই করবী ক্লাসের পরে হুটহাট করে মায়ের বাসায় চলে যেত। সে সময় সে সারাদিন ধরে করবীর জন্য অপেক্ষা করত, করবী দেরি করলে তার মন ভারি হয়ে থাকত, কথা বলতে ইচ্ছা করত না। বাড়িতে ফিরে করবী এটা-সেটা কাজ শুরু করলে বিরক্ত লাগত। ও চাইত করবী সারাক্ষণ ওকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। করবীর লেখালেখিকেও তখন উপদ্রব মনে হতো। বিয়ের কিছুদিন পর রাকিবের মধ্যে একটা বিষণ্ণতা এসে ভর করে। সে সময় সে খুব চুপচাপ হয়ে বারান্দায় বসে থাকত, সারাদিন একটার পর একটা সিগারেট খেত। করবী এসব খুব একটা পছন্দ করত না। তার চাকরি নিয়ে করবীর টেনশন শুরু হয়। চাকরি নিয়ে করবীর বাড়াবাড়ি রকম চিন্তাটা তাকে খুব ডিস্টার্ব করত। এসব নিয়ে কিছু বললে করবী খুব মন খারাপ করত। বিয়ের কয়েক মাস যাওয়ার পর হতে করবীর চোখে মুখে একটা ক্লান্তির ছাপ দেখা দেয়। ওর চেহারায় আগের স্নিগ্ধতাটা খুঁজে পাওয়া যেত না, কেমন যেন দমবন্ধ অবস্থা, বাসি ফুলের মতো ন্যাতানো, রসহীন।
এভাবে দিনের পর দিন চলছিল। দুজনের সেই অন্তরঙ্গ সম্পর্কটি কেমন যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল, বাইরেও যাওয়া হতো না। বিয়ের প্রায় পাঁচ মাস পরে এক সন্ধ্যায় রাকিব অনেক সাদা সাদা ফুল নিয়ে বাড়ি এলো। তার চোখমুখে একটা চাপা আনন্দের ছাপ। করবী সেই সন্ধ্যায় বহু দিন আগে শুরু করা একটা অসমাপ্ত গল্পকে শেষ করার চেষ্টা করছিল। অনেকদিন পর হলুদাভ সেই সন্ধ্যায় ওর হাতে ফুল দেখে করবীর মনে আনন্দের ছোঁয়া লাগে। করবীর টেবিলের সামনে এসে সে বলেছিল, করবী বলো তো কী খবর শুনলে তুমি সবচেয়ে বেশি খুশি হবে? এ কথায় আনন্দে করবীর চোখ ঝকমক করে ওঠে।
তোমার এ রকম হাসিমাখা কথা শুনলেই আমি খুশি, আর কিছু চাই না। আজ এতদিন পর তুমি কেমন হাসছ।
না, তুমি আমার প্রফুল্ল মনটাকেই শুধু চাও না সেই সাথে আমার একটা শক্তপোক্ত ঘাড়ও চাও, আমি জানি। সে ব্যবস্থা হয়েছে। আমি একটা রিসার্চ অর্গানিজেশনে কাজ পেয়েছি। স্যালারি খারাপ না, প্রথমে সাত দেবে, পরে হয়তো বাড়বে। অবশ্য এটা দুই বছরের কনট্রাক্ট।
খবরটা শুনে করবী সেদিন ভীষণ খুশি হয়েছিল, আনন্দে ওকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে ভীষণ আদুরে চুমু দিয়েছিল।
এতদিন পর এই বাদায় রাতের বাতাসে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে রাকিবের মনটা করবীর জন্য গাঢ় বেদনায় ছেয়ে থাকে। চাকরিটা হওয়ার পর কয়েক মাস খুব ব্যস্ততা গেল। সকাল সাতটায় বাসা থেকে বের হয়ে গাজীপুর চলে যেতে হতো, আসতে আসতে সাতটা-আটটা। ঐসময়ে করবীর জন্য খুব চিন্তা হতো, ও সারাদিন কী করছে, কোথায় যাচ্ছে—এসব। তিন সাড়ে তিন মাস অফিস করার পর তার আর যেতে ইচ্ছা করত না, কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করত না। কয়েকদিন পর সে অফিসে যাওয়া কমিয়ে দিল, একদিন গেলে দুদিন বাসায় বসে থাকত। করবী সারাদিন কী করে, ইউনিভার্সিটি থেকে কোথায় যায় এসব নিয়ে তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি চলত। করবীর বাইরে যাওয়ার বিষয়টাকে সে স্বাভবিকভাবে নিতে পারত না। একটা অনিশ্চয়তা এসে ভর করত মনে। সারাক্ষণ মনে হতো ইউনিভার্সিটিতে ওর অন্য কোনো সম্পর্ক নেই তো? ওর চেহারার দিকে তাকিয়ে রাকিব কিছু বুঝতে পারত না।
করবী একদিন খুব রেগে বলে, তুমি তো আগে এমন ছিলে না। অফিসে যেতে চাও না কেন?
সেটা আমার ব্যাপার। তুমি তোমার কাজ নিয়ে থাকো।
কেন? তোমার খোঁজ-খবর রাখাটা আমার কাজ না?
না কখনোই না। তুমি যে ইউনিভার্সিটির নাম করে সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াও সে খবর কি আমি রাখতে যাই?
যাও না কেন? গেলেই তো পার।
করবী তুমি কিন্তু খুব অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছ।
অসহিষ্ণু, আমি না তুমি? সত্যি করে বলো তো চাকরিটা কি ছেড়ে দিয়েছ?
করবীর সেই প্রশ্নে দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থাকার পর ধীরে ধীরে সে দোতলা হতে নেমে রাস্তায় বেড়িয়ে পড়ে। সেদিন বহু রাত পর্যন্ত পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছিল। রাস্তার পিচ এত গরম ছিল পা পুড়ে যাবার দশা, সারা গা ঘেমে নেয়ে শেষে রমনা পার্কে গিয়ে শুয়ে ছিল। রমনার ছোট ছোট ঘাসগুলোর স্পর্শ পেয়ে তার মন খুব আর্দ্র হয়ে ওঠে। করবীকে সে ঠিক বুঝতে পারে না, ওকে কেমন যেন দূরের মনে হয়, অচেনা লাগে। ওকে ঠিক ছোঁয়া যায় না। বিয়ের আগে ওর মধ্যে যে চনমনে ভাব ছিল তাও আজ উধাও। তার মনে হতে থাকে করবী হয়তো তাকে বিয়ে করে ঠিক করে নি। তাহলে কি সে করবীকে ভালো রাখতে পারছে না? করবী তো তার সবটা জানে না, ছোট বয়স থেকে বাড়িতে যে পরিবেশে সে বড় হয়েছে—মা-বাবার অসুখী দাম্পত্য জীবন, তাদের স্বেচ্ছাচারিতা এসব কিছু তার মনকে বিষিয়ে দিয়েছে। এসব কথা তো ও জানে না। পার্কের সবুজ ঘাসে শুয়ে একটার পর একটা সিগারেট খেতে খেতে হঠাৎ তার মনে পড়ে কলেজে পড়ার সময় করবী যে কয়েকটা গল্প লিখেছিল সেই গল্পগুলোতে ভীষণ রোমান্টিক এক চরিত্র ছিল, যে লম্বা লম্বা চুলে ঢাকা পড়ে সারাদিন তার প্রেমিকার পোট্রেট করত। সে তো এ চরিত্র নয়। এই চরিত্রের আইডিয়া করবী কোথায় পেল? কিছুদিন আগে করবী মায়ের বাসায় গেলে ওর লেখার খাতা, পুরানো ডায়েরি সব বের করে পড়েছিল। লেখাগুলোতে কেমন যেন অন্যরকম এক করবীর দেখা পেয়েছিল—যে খুব রোমান্টিক, স্বাপ্নিক আর তার প্রেমিক খুব পোয়েটিক এক আর্টিস্ট। ওর যে গল্পটা প্রথম ছাপা হয়েছিল সেখানেও এই চরিত্র ছিল। এত বছর পরও করবীর লেখায় সেই ক্যারেকটারটাই কেন ঘুরে ফিরে আসে? তার মনে একটা অস্থিরতা এসে ভর করেছিল সেদিন। ভীষণ অনিশ্চয়তা আর টেনশনে সে ঘামতে থাকে। গত কয়েকদিন অফিসে না গিয়ে সে এটা বুঝতে পেরেছিল করবী যেন দায় রক্ষার তাগিদেই এই পরিবারে আছে; ওর কোনো কিছুতেই মন নেই, সব সময় একটা ঘোরে আচ্ছন্ন। সারারাত পার্কের সবুজ নরম ঘাসে শুয়ে শুয়ে মনে একটা আশঙ্কা এসে ভর করে। আকাশে একটু একটু করে আলো ফুটে উঠলে সে ভোরের স্নিগ্ধ বাতাসে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরে আসে। সারা পাড়া তখন ঘুমিয়ে। ওদের নীলরঙা বাড়িটা যেন পদ্ম ফুলের মতো বুজে আছে। ভোরের মৃদুমন্দ হাওয়া, শহরের নিঃশব্দতা সবকিছু সেদিন বড্ড অচেনা লাগছিল। বাড়িতে ঢোকার সময় হঠাৎ চোখে পড়ে মেইন গেটের পাশের এক চিলতে জমিতে মার হাতে লাগানো দোলনচাঁপা, বেলির চারাগুলোতে ফুল এসেছে। দোলনচাঁপার গন্ধে সেই সকালটা ভীষণ সতেজ হয়ে উঠেছিল। জীবনের এসব সবুজাভ স্নিগ্ধতা কিছুক্ষণের জন্য তার মনে উঁকি দিয়ে আবার মিলিয়ে যেত, দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হতো না। কৈশোরে দেখা মার সেই ক্রুদ্ধ চেহারাটি সে কখনোই ভুলতে পারে না। একজন ক্ষুধার্ত মানুষের চকচকে চোখ, চিৎকার—তুমি? তোমাকে কে পাঠাল? না। এসব আর সে ভাবতে চায় না কিন্তু ঘুরে ফিরে কেন শুধু সেসব কথাই মনে হয়? মাথায় এত যন্ত্রণা হয় কেন?
পরের সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবারে সে চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিল। তারপর বহুরাত পর্যন্ত বাইরে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ করবীর সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছা করলে সে দ্রুত বাড়ি ফিরে আসে। বাড়িতে এসে দেখে মা বাগানের পাশে ইজি চেয়ারে বসে আছে, ছেলেকে দেখে চোখটা নামিয়ে নেয়। মায়ের এই দমবন্ধ চেহারাটি তাকে ক্রমশ পাগল করে তুলেছিল, সে কিছুতেই মাকে সহ্য করতে পারত না। সে তখন দোতলায় গিয়ে দেখতে পায় ঘর অন্ধকার, সেখানে কেউ নেই, তারপর বারান্দার ইজি চেয়ারে বসে বহুরাত পর্যন্ত করবীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে কিন্তু করবী বাড়ি ফিরে আসে না। রাত বাড়তে থাকলে অস্থিরতা কানা উপচে পড়তে থাকে; মা খাওয়ার জন্য ডেকে পাঠালেও নিচে নামে না। শেষে বেশ রাত হয়ে গেলে ধীরে ধীরে নিচে নামে, মেইন গেট খুলে বাইরে বের হয়। রাতটা ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢাকা, বেশ কয়েক ঘণ্টা যাবৎ লোড শেডিং চলছিল। অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে সেদিন সে বহু পথ চলে গিয়েছিল, হাঁটার সময় তেমন হুঁশ ছিল না। ঘোরে পড়ে কতক্ষণ যে হেঁটেছে মনে ছিল না, হঠাৎ নিজেকে আবিষ্কার করে ঝিকাতলা ট্যানারি মোড়ে। সম্বিত ফিরে পেলে বুঝতে পেরেছিল করবীর প্রতি অবসেশন তাকে অতদূরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। ঐ রাতে আবার মোহাম্মদপুরে ফিরে যাওয়াটা অসম্ভব ছিল, ক্লান্তিতে চোখমুখ বুজে আসছিল। তারপর খুব দ্রুত হেঁটে সে করবীদের টিনের গেটের সামনে উপস্থিত হয়, গেটে অনেকক্ষণ জোরে জোরে শব্দ করার পর মতিয়ূর এসে জানতে চায়, কে?
প্রথমে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সে বলে, আমি। করবী কী এখানে এসেছে?
মতিয়ূর কোনো কথা না বলে চুপচাপ দরজা খুলে দেয়। রাকিব ঘরে ঢুকে দেখে ভেতরে আলো জ্বলছে, খাটের ওপরে করবী বসে আছে, মুখ পাথরের মতো শক্ত। ঐ রাতে তারা দুজন কেউ কারো সাথে কথা বলেনি, ভোর হওয়ার জন্য অপেক্ষা করে বসেছিল। খুব সকালে করবী জানতে চায়, তুমি কি এখন বাসায় যাবে নাকি অফিসে?
বাসায়।
তারপর দুজন রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে, রাস্তায় তখন একটা দুটো রিকশা বের হয়েছে। সে বুঝতে পারে করবী কেমন কঠিন হয়ে আছে, একটা কথা বলছে না। রিকশা বাড়ির কাছে পৌঁছালে করবীকে সে চাকরি ছেড়ে দেয়ার কথা জানায়। করবী শুনে বলেছিল, আমি আগেই জানতাম তুমি চাকরিটা করবে না। একটা বিষয় আমি বুঝতে পারছি না আমার জন্য তোমার কী কোনো সমস্যা হচ্ছে? হলে বলো কী করতে হবে?
সেদিন রাকিব করবীর কথার কোনো উত্তর না দিয়ে রিকশা ভাড়া মিটিয়ে দোতলায় উঠে গিয়েছিল।
চাকরি ছেড়ে দেয়ার পর থেকে সারাদিন সে বাসায় থাকতে শুরু করে। অবশ্য করবী ক্লাস করার জন্য রেডি হলে তাকে পৌঁছে দেয়ার জন্য তার ইচ্ছা হতো। প্রথম প্রথম করবী বলত, আমি যেতে পারব, এতদিন যাচ্ছি। তুমি শুধু শুধু কষ্ট করবে কেন? করবী ক্লাসে চলে গেলে সারাদিন সে কলাভবনের মাঠে বসে থাকত, করবীকে চোখে চোখে রাখত। করবী এসে একদিন জানতে চায়, তুমি এখানে সারাদিন বসে থাকো কেন? নতুন চাকরি-বাকরি খুঁজবে না? সে খুব কাষ্ঠহাসি দিয়ে বলেছিল, আমি সারাদিন অফিস করলে তোমাকে দেখবে কে?
মানে?
মানে কী? আমি চাকরি-বাকরি করব না। বসে বসে বাবার ঘাড়ে খাব। তোমার এত চিন্তা কেন? তোমার তো কোনোকিছুর অসুবিধা হচ্ছে না।
যত দিন যাচ্ছিল তার মেজাজ তত বেশি একরোখা, খিটখিটে হয়ে উঠছিল, যখন তখন রাগ উঠে যেত, করবীকে নানা বিষয়ে সন্দেহ হতো। করবী একদিন ক্লাস শেষে কেনাকাটা করার জন্য নিউ মার্কেটে গেলে সারাদিন সে করবীর ক্লাসের সামনে বসে ছিল। সন্ধ্যা হয়ে গেলে করবী তাকে খুঁজতে না এলে শেষে ভীষণ অস্থির হয়ে বাড়ি ফিরে আসে। দোতলায় উঠে দেখে করবী বাথরুমে গোসল করছে। প্রায়ই করবী তাকে না জানিয়ে ক্লাস শেষ করে বাড়ি চলে যায়। রাকিব এই নিয়ে ওর সাথে বহু ঝগড়া করেছে। গালিটালি দিতেও তখন তার মুখে আটকাত না। ঐ সময়ে প্রায়ই করবী রাগ করে বাবার বাড়িতে চলে যেতে শুরু করে, এক একবার গিয়ে দুই-তিন দিন থাকত। প্রথম প্রথম সে করবীকে আনার জন্য হাজারিবাগে যেত কিন্তু ধীরে ধীরে করবীর প্রতি তার মনে বিরক্তি ধরে যায়, মনে হতো ও যদি ইচ্ছে করে আসে আসবে, না হলে ওখানেই থাকুক, বারবার আসার জন্য অনুরোধ করতে পারব না। অবশ্য করবী রাগ করে চলে গেলে কখনো কখনো ওর জন্য মনটা আর্দ্র হয়ে উঠত। করবীর খুব বাচ্চার শখ ছিল। একবার বুড়িগঙ্গায় ঘুরতে গিয়ে করবী বলেছিল যদি মেয়ে হয় তার নাম রাখবে নদীর নামে, সেই নিয়ে দুজনে বহুক্ষণ তর্ক হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত নাম ঠিক হল বিয়াস, বিপাশার ইংরেজি উচ্চারণ, নামটা দুজনের খুব মনে ধরেছিল।
ওই সময়ে তার চাকরি নিয়ে একবার দুজনের খুব ঝগড়া হলে করবী বাবার বাড়ি চলে যায়। সেবার গিয়ে করবী ঠিক করেছিল আর ফিরবে না। যতদিন সে চাকরিতে না ঢুকবে ততদিন কিছুতেই ফিরে যাবে না। করবীর এই জেদটাই শেষ পর্যন্ত কাল হয়েছিল। সে আর ভাবতে পারে না। সে সময়ে হাজারিবাগে গিয়ে সে করবীকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে মোহাম্মদপুরের বাসায় নিতে চেষ্টা করল কিন্তু ও কিছুতেই আসবে না। নতুন চাকরিতে না ঢোকা পর্যন্ত করবী ওই বাড়িতে ফিরে যাবে না স্পষ্ট বলে দিল। বাবার বাড়িতেও করবী সারাদিন মনমরা হয়ে থাকত, বোনদের সাথে ভালো করে কথা বলত না, ক্লাস করা প্রায় ছেড়ে দিল। খাওয়া-দাওয়ায় অরুচি এলো। কোনো খাবার মুখে দিলেই বমি পেত। ট্যানারির গন্ধটা করবীর কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। ধীরে ধীরে বমির ধাত দেখা দিল, কিছু খেলেই বমি হয়ে যেত, অনেকটা ক্রনিকের মতো হয়ে গেল, রাকিব করবীর ওই অবস্থায় ভীষণ অস্থির হয়ে পড়ে। জোর করেও করবীকে ডাক্তারের কাছে নেয়া যেত না বলে বাড়িতে ডাক্তার নিয়ে আসা শুরু হয়। ডাক্তাররা বলত, করবীর মধ্যে অনিশ্চয়তা থেকে ভীতি জন্ম নিয়েছে। কারো প্রতিই সে বিশ্বাস রাখতে পারছে না। মনের মধ্যে এক ধরনের ইনসিকিউরিটি দেখা দিয়েছে। মতিয়ূর করবীর অসুখের সময়ে তার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করত, বহুদিন রাকিবকে বাসা থেকে চলে যেতে বলেছে। তখন হাজারিবাগ থেকে বেরিয়ে রাকিব রাস্তায় হেঁটে বেড়াত, প্রায় রাতেই রায়েরবাজারে গিয়ে সস্তা মদ খেয়ে আবার করবীকে দেখতে আসত। দিন দিন করবীর শরীর খুব খারাপ হয়ে পড়ে। প্রায়ই সে মৃগী রোগীর মত বিড়বিড় করতে থাকে।
ওই সময়ে করবী প্রায়ই তাকে চিৎকার করে বলত, তুমি চলে যাও, তোমার মার কাছে চলে যাও। আমি কোনোদিন ওই বাড়িতে ফিরে যাব না। এসব বলে বলে করবী চিৎকার করে কাঁদত। রাকিব তখন সারাদিন বাইরে বাইরে ঘুরে বেশ রাতে হাজারিবাগে যেত। তার মনে তখন খুব অশান্তি, করবীর ভেতরকার বিদ্বেষ তার মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছিল, সত্যি বলতে কী সে নিজেই বুঝত না করবীকে বিয়ে করার পর তার মনটা এত বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ল কেন? করবীকে তো সে ভালোই বাসে তবু কেমন যেন অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা। আহ মাথাটা তখন খারাপ হয়ে গেছিল।
করবীর অসুস্থতার ছয় মাস চলছিল। জুলাই মাস, সকাল থেকে প্রচণ্ড বৃষ্টি, বৃষ্টিতে ঢাকার পথঘাট সব ডুবে গেল। রাস্তায় হাঁটু থেকে বুক সমান পানি। ওই ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যে করবীকে দেখার জন্য সে হাজারিবাগে গিয়েছিল। ওদের বাড়িতে পৌঁছে দেখা গেল ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে বহু লোক বাড়ির সামনে ভিড় করে আছে, তাদের চোখে মুখে একটা চাপা অনুভূতি। অনেক মেয়েরা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে আছে, করবীর এক মামাত বোনকে চোখ মুছতে মুছতে চলে যেতে দেখা গেল। সে তখন কিছুই বুঝতে পারছিল না। এক রাতের মধ্যে কী এমন ঘটল? করবীর কিছু হয়নি তো? হঠাৎ তার বুকের মধ্যে ধক্ করে উঠল। গতকাল যাওয়ার সময় করবী খুব অস্থির ছিল। ডাক্তার ওষুধ দিয়ে ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল। খুব কড়া ওষুধ। মানুষের নার্ভ যখন কোনো ঘটনা বা পরিস্থিতিতে খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ে, চিন্তার সামঞ্জস্য কমে যায় তখন এই ড্রাগস ইঞ্জেকশন আকারে পুশ করা হয়। গত ছয়-সাত দিন যাবৎ এটাই চলছিল। রাকিব বহুক্ষণ গলির মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লোকজনের আসা-যাওয়া দেখছিল। হঠাৎ করবীর ছোট বোন পাপিয়াকে দেখা যায় মাথায় ঘোমটা দিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে আসছে। এলাকার লোকজন থমথমে মুখে বাড়ির আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এর মধ্যে দুটি ছেলে তার দিকে তাকিয়ে কী যেন বলাবলি করছিল। ভিড়ের মধ্যে পাপিয়া তাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে আসে, ওর মুখ ফোলাফোলা, চোখে-মুখে কান্নার ছাপ। এ সময় তার খুব নার্ভাস লাগতে শুরু করে, পায়ের নিচে শিরশিরে অনুভূতি, খুব তেষ্টা পায়, জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। পাপিয়া কাছে এসে তাকে ডাকলেও সে কিছু শুনতে পায় না, মাথাটা ঘুরে ওঠে। এ সময় পাপিয়ার ঝাঁকুনিতে সম্বিত ফিরে আসে। পাপিয়াই তাকে হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে যায়। সিঁড়ি দিয়ে দুপা ওঠার পরেই সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য। না। এ অসম্ভব। লাল পেড়ে ছাই রঙা শাড়ি পরা করবী মেঝেতে শুয়ে আছে, ওর চোখমুখ ফোলাফোলা, নাক দিয়ে রক্ত বেরিয়ে সারা মুখে খয়েরি আভা ধরেছে, পা দুটো শক্ত টানটান হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে। তার পক্ষে বেশিক্ষণ এই দৃশ্য দেখা সম্ভব হয়নি। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল।
করবীর মা এসে তাকে দেখে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে, আমার মেয়ের কী হইছে? ওরে উঠতে বলো, ওরে উঠতে বলো। তুমি আমার মেয়েরে কী বলছ? করবী, মা, ওঠ, ওঠ।
করবীর মায়ের সাথে ওর বোনেরা, আগত আরও অনেকে কাঁদতে থাকে। রাকিব ধীরে ধীরে ভিড় ঠেলে গেট দিয়ে বের হয়ে আসে। ওই বাড়ি থেকে সেই যে সে বের হয়ে এসেছে আর কখনো যায় নি, করবীকে কবর দেয়ার সময়েও না। এর প্রায় এক মাস পর পাপিয়ার সাথে রাস্তায় দেখা হলে সে বলেছিল, ওই দিন করবী সারারাত হাই ড্রাগসে ঘুমিয়ে ছিল, ভোর রাতের দিকে হঠাৎ বমি শুরু হয়, সেইসাথে মাথায় তীব্র যন্ত্রণা, নাক দিয়ে রক্ত বের হতে শুরু করে। বাড়িতে যখন ডাক্তার আসে তখন করবীর জ্ঞান ছিল না, সে জ্ঞান আর ফেরেনি। ওরা জানে না করবী কী ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় মারা গিয়েছিল নাকি অন্য কিছু? পাড়ার ডাক্তার সাহেব ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ লিখেছিল ‘কার্ডিও রেসপিরেটরি অ্যারেস্ট’। পুলিশের কথা চিন্তা করে ওরা আর এ বিষয়ে কিছু করে নি। ওরা চায়নি এ বিষয়ে আর কোনো কথা উঠুক। করবীর মৃত্যুটা তার কাছে এত আকস্মিক আর অপ্রত্যাশিত ছিল যে, সে কিছুতেই ঘটনাটা মেনে নিতে পারেনি, তার শুধু মনে হয় এই মৃত্যুর জন্য সেই দায়ী। দিনের পর দিন সে অপরাধপ্রবণতায় ভুগতে থাকে, ঘুমাতে পারে না। এই ঘটনার পর মতিয়ূররা আর কোনোদিন তার খোঁজ করে নি, সেও ওদিকে যায় নি। করবীর কবর হয়েছে আজিমপুরে এটুকু শুধু লোকমুখে জেনেছে। এরপর প্রায় রাতেই সে আজিমপুর কবরস্থানে গিয়ে বসে থাকত।
করবীর মৃত্যুর প্রায় পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে সে একটা স্কুলে বছর খানেক শিক্ষকতা করেছিল কিন্তু প্রিন্সিপালের সাথে গণ্ডগোল হয়ে সে চাকরিও চলে যায়। তারপর দীর্ঘ দুই বছর পর রামপালের কলেজটিতে চাকরি হলো। ঢাকা ছেড়ে একটা অচেনা জায়গায় আসার ইচ্ছা হতেও এই চাকরিতে আসা কিন্তু রামপালের বাদা অঞ্চলে আসার পর হতে করবীর খাড়া নাক, উজ্জ্বল চোখের রূপটি তাকে সর্বক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখছে। করবীর নাক-মুখ দিয়ে গলগলিয়ে রক্ত বেরিয়েছিল, তার গন্ধ পায় সে নাকে, রক্তের গন্ধে দিনের পর দিন ঘুমাতে পারে না। বাদার মানুষজনের সাথে তার তেমন কোনো সখ্য হয়নি আর কলিগদেরকে সাবধানে এড়িয়ে চলে। শুধু প্রফেসর সাহেব প্রায় রাতেই তাকে নানা জাতের পানীয় খাওয়ায়, তারপর রাত বেশ গাঢ় হলে একটু নেশা ধরে এলে তরুণ শিক্ষক ধীরে ধীরে বাঁধের ওপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করে। হাঁটতে হাঁটতে দুই একদিন বহু দূরে চলে যায়, সেখানেও শুধু বাঁধ দিয়ে ঘেরা জলরাশি; হঠাৎ দু-একটা মাছ পানির উপর লাফিয়ে আবার সরাৎ শব্দে জলে মিলিয়ে যায়। মাছেদের এই লুকোচুরি খেলা তার মনকে চনমনে করে তোলে, আবার ধীরে ধীরে সব শব্দ থেমে গেলে ঝিঁঝিঁ আর ব্যাঙের ডাকে একঘেয়েমিতে পেয়ে বসে। শহরের ব্যস্ততা ছেড়ে, বাড়ির মানুষদের ছেড়ে, করবীর স্মৃতিকে দূরে সরিয়ে দিয়ে সে আজ নতুন করে বাঁচার জন্য এই জলজল গন্ধমাখা বাদা অঞ্চলে এসেছে কিন্তু মনে কোনো শান্তি নাই। সারাক্ষণ একটা পলায়নপরতা মনকে তাড়িয়ে বেড়ায়, একটা ভয় বুকের মধ্যে চেপে বসে। করবীর মৃত্যুটা তার জীবনকে ভীষণ এলোমেলো করে দিয়েছে, এখন প্রাণে কোনো আনন্দ নেই, গাঢ় বেদনা মনকে ছেয়ে রাখে সর্বক্ষণ আর তেতো স্বাদে পূর্ণ হয়ে থাকে জিভ। তরুণ শিক্ষকের মনে হয় ভীষণ দীর্ঘ আর ক্লান্তিকর এই বেঁচে থাকা। বাঁধের ঘেরা জল যেমন আটকা পড়ে আছে, বদ্ধ হয়ে আছে, তেমন আবদ্ধ হয়ে আছে তার জীবন। কিন্তু পথের যেমন বাঁক আছে, গতি আছে, সুর আছে তেমনি জীবনেরও আছে কিছু বাঁক, সুর। কখনো কখনো গিরিখাদ এসে জীবনের এই ধাবমানতাকে স্তব্ধ করে দিতে চায়, চূর্ণ করে দিতে চায়। অনেকেই এই দুর্গমতাকে অতিক্রম করতে পারে না, ক্রমশ তলিয়ে যেতে থাকে। রাকিবের মনে হয় তাকেও এমন কিছু বাঁকের সম্মুখীন হতে হয়েছিল, কিন্তু সেই বাঁকগুলোকে সে অতিক্রম করতে পারেনি। শৈশবের স্মৃতি তার মনে গভীর ছাপ ফেলেছে, যার ছাঁচে ফেলে সে তার জীবনকে মাপতে গিয়েছিল আর তার কারণেই করবীর মতো চমৎকার মেয়েটিকেও গভীর খাদে তলিয়ে যেতে হলো। আহ্, এই স্মৃতি ভুলে যাবার মতো আর কোনো স্মৃতিই কি তৈরি হবে না? নাকি সারা জীবন এমন তেতো স্বাদ মুখে নিয়ে দিন কাটাতে হবে? তরুণ শিক্ষকের ভাবুক মন বাদার মাছেদের সরাৎ সরাৎ শুনতে শুনতে ক্রমশ আরও গভীর আচ্ছন্নতায় তলিয়ে যেতে থাকে।