নভেরা হোসেনের কলাম ‘ভাষার আগ্রাসন ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য’
প্রকাশিত : জুলাই ২২, ২০২০
ভাষা গঠনের ইতিহাস
ভাষা এমন একটি মাধ্যম যাকে আশ্রয় করে মানুষ তার চিন্তা ও অনুভূতি প্রকাশ করে থাকে কথা ও কলমের মাধ্যমে। আজকাল তা বদলে কীবোর্ড হয়ে পড়েছে প্রকাশের গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম। স্বভাবতই এক সময়ে ইশারার মাধ্যমে যে ভাষার সূচনা, তা-ই একসময় বিবর্তিত হতে হতে মুখের ভাষায় পরিণত হয়েছে। আর লেখ্য ভাষার সূচনাও হয়েছে অনেক আগে, মূলত পশু বা খাদ্যের হিসাব রাখতে গিয়ে চিহ্নের ব্যবহার হতো আর তা থেকেই সূচনা হয়েছে লিখিত ভাষার। এরপরে চিন্তা ও মুখের ভাষা একত্রে লিখিত রূপে প্রকাশিত হতে থাকে। এটা অনেকটা স্বতস্ফূর্তভাবে ঘটেছে প্রথমদিকে। পৃথিবীতে অনেক ভাষা রয়েছে। আঞ্চলিকভাবে প্রতি দুই কিলোমিটার অন্তর বদলে যেতে থাকে ভাষা। বাংলা ভাষারও রয়েছে তেমনি নানা ইতিহাস, চড়াই-উতরাই। বাংলাভাষা মুলত ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষামূল থেকে সৃষ্ট। খ্রিস্টের জন্মের প্রায় হাজার দেড়েক বছর আগে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষী আর্য জাতি ইরান ছেড়ে ভারতের পশ্চিম-পাঞ্জাবে আসে এবং তারপর পূর্ব-ভারতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এদের ভাষাকে আদি ভারতীয় আর্যভাষা বলা হয়। বৈদিক ও সংস্কৃত ভাষাও এই ভাষা থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে।
খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দ পর্যন্ত এই ভাষা বিকশিত হতে থাকে। এরপরে প্রাকৃতজনের মুখের উচ্চারণে তৎসম (সংস্কৃত) শব্দের পরিবর্তন হয়। এই পর্বের নাম ’প্রাকৃত ভাষা’। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টীয় ৬০০ অব্দ পর্যন্ত এই প্রাকৃত ভাষার সময়কাল। এই পর্যায়ের প্রথম ভাষার নাম পলিভাষা, দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রাকৃত। পালিভাষা বুদ্ধদেবের সময়েই তৈরি হয়। প্রাকৃত ভাষায় কিছু সাহিত্য রচিত হয়েছে। অঞ্চলভেদে প্রাকৃতের চারটি রূপ: শৌরসেনী প্রাকৃত, মাহারাস্টী প্রাকৃত, মাগধী প্রাকৃত, অধমাগধী বা জৈন মাগধী প্রাকৃত। মাগধী প্রাকৃত ভাষায় লিখিত নাটকে নিকৃষ্টজনের ভাষা হসিাবে ব্যবহৃত হয়েছে, যা পূর্বভারতের প্রতি বৈয়াকরণদের তাচ্ছিল্যের দৃষ্টান্ত। আমাদের বাংলা ভাষা এই মাগধীরই উত্তরপুরুষ। প্রাকৃত ভাষারও ব্যকরন ছিল। ক্রমে ভাষা পরিবর্তিত হতে থাকে একে অপভ্রংশ বলা হয়। মাগধী প্রাকৃত থেকে মাগধী অপভ্রংশের আবির্ভাব হয়েছে। এই ভাষার অন্য অপভ্রংশগুলোর নাম মৈথিলী, মগহী, ভোজপুরিয়া, অসমীয়া ও ওড়িয়া। মাগধী অপভ্রংশ থেকে বাংলা ভাষার জন্ম হয় খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীতে। এরপর থেকে বাংলা ভাষা আধুনিককাল পর্যন্ত অনৈক বিবর্তিত হয়েছে সময়ের সাথে সাথে।
আদি যুগের বাংলা ভাষা বা প্রাচীন বাংলা ভাষার সীমা খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত। চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ে ওই সময়কার ভাষার পরিচয় পওয়া যায়। এরপর মধ্যযুগের বাংলা ভাষা প্রচলিত ছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীর সময়কালের ভাষায় তেমন কোনো দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতাব্দীতে বাংলা কাব্যে যে ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে তাকে মধ্যযুগীয় বাংলা ভাষার প্রথম পর্যায় হিসাবে অভিহিত করা হয়। বড়ু চণ্ডিদাসের ’শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন এই সময়ে রচিত। চর্যাপদের পর শ’দুয়েক বছরের মধ্যে বাংলা ভাষায় আরও বিবর্তন হয়, অপভ্রংশ-প্রাকৃত শব্দের ব্যবহার কমে এসেছিল। ব্যাকরণ ও ধ্বনীতত্ত্বের বিশেষ পরিবর্তন হয়েছে। কিছু তৎসম শব্দও ব্যবহৃত হতে শুরু করে। খ্রিস্টীয় ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ অর্থাৎ ভারতচন্দ্রের মৃত্যু (১৭৬০) পর্যন্ত মধ্যযুগীয় বাংলা ভাষার অন্ত্য পর্যায় বিস্তৃত। এসময় বৈষ্ণব সাহিত্য ও পৌরানিক অনুবাদ সাহিত্যের দ্বারা প্রচুর তৎসম শব্দ বাংলা ভাষায় প্রবেশ করে। এছাড়া প্রচুর আরবি শব্দও প্রবেশ করতে থাকে। এরপর ইংরেজ আমলে ইংরেজি-ফরাসি-পর্তুগিজ শব্দ বাংলায় প্রবেশ করতে শুরু করে।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে নাগরিক জীবনে সাধু ও চলিত ভাষা সাহিত্যে প্রাধান্য বিস্তার করতে শুরু করে। সাধু ভাষা মধ্যযুগের পয়ার-ত্রিপদীতে ব্যবহৃত হতো। এরপরে এ অঞ্চলে মানুষের মুখের ভাষার ব্যবহৃত রূপ চলিত ভাষা হিসাবে লেখায় স্থান করে নিতে শুরু করে। বর্তমানে সাধু ভাষার লিখিত রূপ প্রায় উঠে গেছে, সেখানে প্রমিত ভাষা নামে মুখের ভাষারই একটি রূপ ব্যবহৃত হচ্ছে।
ভাষার আগ্রাসন
তবে আমার আজকের বিষয়টি অবতারণার কারণ ভিন্ন। প্রতিটি জাতির সংস্কৃতি, ভাষা যুগে যুগে পরিবর্তিত ও বিবর্তিত হয়। নানা নতুন উপকরণ, শব্দ ও চিন্তা প্রবেশ করে ভিন্ন সংস্কৃতির সংস্পর্শে। কিন্তু এই সংস্পর্শ যদি হয় স্বতঃস্ফূর্ত তা নিয়ে বলবার কিছু নাই। তা ঘটবেই এবং তাই স্বাভাবিক। কিন্তু যখন কোনো জাতি-গোষ্ঠী অন্য জাতির উপর রাজত্ব করতে গিয়ে তাদেরকে বাধ্য করে নিজের সংষ্কৃতি ও ভাষাকে বদলে ফেলতে বা তাদেরকে বাধ্য করে মেনে নিতে— তা হচ্ছে চাপিয়ে দেয়া। আমাদের এ অঞ্চলে মোগল-পাঠান-ইংরেজ ও পাকিস্তানিরা শাসন করেছে। তারা আমাদেরকে গোলাম বানিয়েছে। তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। আমরাও তাদের এই চাপানোর বিরুদ্ধে সব সময় সংগ্রাম করেছি। ব্রিটিশ খেদাও, পাকিস্তানি তাড়াও, ৫২`র ভাষা আন্দোলন সাংস্কৃতিক বিপ্লব। অন্য জাতি ভাষার পাশাপাশি বসবাসের ফলে স্বতঃস্ফূর্ত যে আদান-প্রদান তা এক বিষয় আর জোর করে চাপানো অন্য বিষয়। ৭১ পরবর্তী বাংলাদেশে বহুবার এ বিষয়গুলো ঘটেছে।
এখানে নানা মত ও শ্রেনির মানুষ সংস্কৃতিকে না বোঝার ফলে তা ঘটেছে। পাশের দেশের হিন্দি ভাষা এবং তাদের সংস্কৃতি এখন অন্তর্জাল এবং টেলিভিশনের মাধ্যমে এদেশের সংস্কৃতিতে বিরূপ প্রভাব রাখছে। এটা মোটেও স্বতঃস্ফূর্ত সংস্কৃতায়ন নয়। তেমনি জিয়াউর রহমানের আমল থেকে আমাদের আম-জনতার মধ্যপ্রাচ্য গমন এবং সেখান থেকে খুরমা-খেজুরের সাথে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও পোশাক সব এখানে এমন ভাবে চলে আসছে যা আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির জন্য হুমকি স্বরূপ। এই বিষয়টি যদি কেউ বুঝেও না বুঝতে চান, তাদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি এবং আশা থাকলো তারা সংস্কৃতি বিষয়টিকে আরো ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করবেন। এখন যা চলছে তা নয়া সাম্রাজ্যবাদ, নিও-কলোনিয়ালিজম। এটা ঘটে মানুষের মগজ ধোলাইয়ের মাধ্যমে। খুব সূক্ষ্মভাবে। ইউরোপিয়ানরা এক সময় যেমন আমাদেরকে তাদের দাস বানিয়ে ইংরেজি শিক্ষা দিয়েছিল, তেমনি নানা দেশ আমাদেরকে অর্থনৈতিক সুবিধা দিয়ে, সহযোগিতা করে সংস্কৃতির ভেতর প্রবেশ করছে।
এখন আন্তর্জাতিকতা ছাড়া চলবে না। সবার সাথে মিলেমিশেই থাকতে হবে, বাঁচতে হবে। অর্থনীতিকে চালিয়ে নিতে হবে। করোনা নিয়েও সবার মতকে বিবেচনা করতে হবে। কিন্তু অন্য সংস্কৃতি বা দেশের আধিপাত্য, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন কখনোই কাম্য নয়।
লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক