ননির পুতুল নয়, চাই লৌহমানব
মু. লাবিব আহসানপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২১
মাও সেতুং বলেছিলেন, ‘সন্তানকে মাছ খেতে না দিয়ে মাছ ধরতে শেখান।’ এ কথার মর্মার্থ কি? এ কথার মর্মার্থ হলো, এতে সে আত্মনির্ভরশীল হতে শিখবে। সত্যি বলতে, ননির পুতুল হয়ে বেড়ে ওঠা সন্তানরা ইতিহাসের মোড় ঘোরাতে পারে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আসিফ নজরুল তার পিএইচডির গল্প নামের আত্মজৈবনিক বইতে একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন।
একদিন তিনি লন্ডনের রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলেন। লক্ষ্য করলেন, ছোট্ট একটি শিশু একা একা হাঁটছে। সামনে অনেক দূরে হাঁটছে তার মা। কিছুক্ষণ হাঁটার পর শিশুটি পড়ে গেল। তার মা নির্বিকার। আসিফ নজরুল দৌড়ে গেলেন শিশুটিকে তুলতে। এরপর যা ঘটলো, তার জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। বাচ্চাটির মা চোখে প্রায় অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে ছুটে এলো। আসিফ নজরুলকে বললো, এই, তুমি ওকে ধরলে কেন?
আসিফ নজরুল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। আমতা আমতা করে বললেন, ও পড়ে গিয়েছিল তো! তাই তুলে দিলাম।
বাচ্চার মা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বললো, পড়ে গেলেই তোমাকে তুলে দিতে হবে? জীবনে তো আরও বহুবার ও পড়ে যাবে। তখন কি তুমি তুলে দেবে?
ড. আসিফ নজরুল সেই নারীর আচরণে সেদিন আহত হয়েছিলেন। রাগে, দুঃখে, অপমানে ওই পথ ত্যাগ করে অন্য পথ ধরে নিজের কক্ষে ফিরেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে আপনমনে ভাবতে বসে উপলব্ধি করেছিলেন, সেদিন ওই নারীই ছিল ঠিক। তিনিই ভুল ছিলেন।
আপনার সন্তান আপনার সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে প্রিয় নিঃসন্দেহে। সে আপনার আনন্দ আর গর্বের অন্যতম কারণ। একটা সময় গিয়ে আপনার জীবনের সব আয়োজন নিশ্চয়ই তাকে ঘিরেই হয়। আর এই সন্তান জীবনে কতটা সফল হবে, তার মধ্যে কতটা ভালো-মন্দের সঞ্চার হবে; সেটা অনেকাংশেই নির্ভর করে আপনার লালন-পালন পদ্ধতির উপর। আসলে সব বাবা মা-ই চান তার সন্তানকে সেরা উপায়ে গড়ে তুলতে। কিন্তু কখনও কখনও এক্ষেত্রে কিছু ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সব সন্তানই সেরা হয়ে উঠে না। এর একটি হচ্ছে সন্তানকে কষ্টসহিষ্ণু ও পরিশ্রমী করে গড়ে না তোলা। তাকে স্বনির্ভর ও শারীরিক শ্রমে অভ্যস্ত হতে না দেয়া।
অধিকাংশ বাবা মায়ের প্রবণতা হচ্ছে, ননির পুতুলের মতো সন্তানকে আগলে রাখা। অতিরিক্ত আরাম আয়েশের মধ্য দিয়ে তাকে বড় করে তোলা। কিন্তু এতে যে তার সন্তান ফার্মের মুরগীরূপী মানুষে পরিণত হচ্ছে, তার পরিপূর্ণ শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে; একথা সেই বাবা-মায়েরা মোটেই ভেবে দেখেন না। এটা এমন একটা বিষয়, যা বাবা মায়েরা জানলেও মানতে চান না। তারা চান ছেলেমেয়েকে সারাক্ষণ লেখাপড়ার জগতে আটকে রাখতে। আর এর ফলে আজকালকার ছেলেমেয়েরা বেড়ে উঠছে বাস্তবজ্ঞানবর্জিত জীবন-জগৎ সম্পর্কে অনভিজ্ঞ একটা আবহে।
তারা পরিশ্রম করতে জানে না। তারা সেই পরিতৃপ্তি সম্বন্ধে জানতে পারে না, যা কেবল কঠোর পরিশ্রম থেকেই আসে। তারা সেই আত্মবিশ্বাস সর্ম্পকে জানতে পারে না, যা একজন মানুষ সমস্যা মোকাবিলা ও সমাধানের মধ্য দিয়ে অর্জন করে। তারা সেই শারীরিক শ্রম করতে অভ্যস্ত হয় না, যার ফলে সে আত্মনির্ভরশীল হয়ে গড়ে উঠবে। এটা বাবা-মায়ের প্রকৃত দায়িত্ব যে, তার অল্পবয়সী সন্তানকে এমন কাজের সুযোগ করে দেয়া, যা তাকে কষ্টসহিষ্ণু ও পরিশ্রমী করবে। ফলে তার মধ্যে গড়ে উঠবে এমন গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি, যা তার সারা জীবনের জন্যে সুফল নিয়ে আসবে। তাকে পরিচিত করবে ননির পুতুল হিসেবে নয়, লৌহমানব হিসেবে।
আপনার সন্তানকে তাই ছোটবেলা থেকেই পরিশ্রমে অভ্যস্ত করে তুলুন। একটু একটু করে দায়িত্ব দিয়ে তাকে স্বাবলম্বী করে তুলুন। তার কাজ যতটা সম্ভব তাকেই করতে উদ্বুদ্ধ করুন। কীভাবে? সেটা কিন্তু খুব সহজ। আসলে মা-বাবা যা বলেন সেটা নয়, বরং মা-বাবা যা করেন, সন্তান তা-ই শেখে। যেমন, সন্তান যদি ছোটবেলা থেকে দেখে যে ঘর গুছিয়ে রাখা হয়, সে-ও জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে শিখবে। যদি দেখে ঘরে জুতোটাকে সযতনে সাজিয়ে রাখা হয়, সে-ও তাই রাখবে। কিন্তু সে যদি দেখে বাবা হয়ে আপনি ঘরে ঢুকে জুতো একটা একদিকে ছুঁড়ে মারলেন, আরেকটা অন্যদিকে, শার্ট খুলে বিছানায় দলা পাকিয়ে রাখলেন; সে-ও তাই করবে। তাই শুরুতেই আপনি তার রোল মডেল হতে চেষ্টা করুন।
অল্প বয়সে বাচ্চারা ঘরের কাজ করার মতো সমর্থ্য না হলেও এ ব্যাপারে তাদের উৎসাহের কমতি থাকে না। এজন্যে তারা সুযোগ পেলেই মা-বাবার কাছে ঘুরঘুর করতে থাকে তাদের কাজে হাত বাড়িয়ে দেবার আশায়। তাই সন্তানকে আপনার ছোট্ট সহকর্মী হবার সুযোগ দিন। গল্প ও খেলাচ্ছলে তাকে উদ্বুদ্ধ করুন। তাকে বয়স অনুযায়ী কাজ দিন। তার ছোট ছোট কাজগুলো যে পরিবারের জন্যে কতটা গুরুত্ব বহন করে সেটা তাকে অনুভব করতে দিন। এই কাজটা কিন্তু তার কাছে একটা টিকেটের মতো, যে টিকেট দিয়ে সে প্রবেশ করে বেড়ে উঠার জগতে। যেখানে সে দায়িত্ব নিতে শেখে, শেখে কর্মদক্ষতার কৌশল।
আরও শেখে নিজের ও অন্যের প্রতি যত্নশীল হতে। যোগ্যতা প্রমাণের মাধ্যমে সামনে এগুনোর সাহস অর্জন করে। আর ছোটবেলাই এজন্যে উৎকৃষ্ট সময়। ইসলামের নির্দেশনাও এ ব্যাপারে তেমনই। ইসলাম সন্তানদের ছোটবেলাতেই সাঁতার, তীর ছোঁড়া, ঘোড়ায় চড়া শেখাতে উদ্বুদ্ধ করেছে। বর্তমান সময়ে এগুলোকে কারাতে বা ব্যায়াম এবং ড্রাইভিং শেখার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। এছাড়াও বিশুদ্ধ মাতৃভাষা শেখানোর পাশাপাশি শেখাতে হবে কোরআনের ভাষা আরবী এবং আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজি। এ উদ্যোগ ছোটবেলা থেকে নেয়াটাই অধিক ফলপ্রসূ ও কার্যকর।