ধূমপানের শরঈ বিধান: মূলনীতি ও বিশ্লেষণ
আলী ওসমান শেফায়েতপ্রকাশিত : জানুয়ারি ১৮, ২০২২
ধূমপান বর্তমান যুগের বড় সমস্যাগুলো একটি। ধূমপায়ীরা ধীরে ধীরে রোগাক্রান্ত হচ্ছে। ধূমপান তাদের অন্তর দুর্বল ও শক্তি ক্ষয় করে দিচ্ছে। ধূমপান যে নীরব ঘাতক, এ ব্যাপারে এখন আর কারো দ্বিমত নেই।
যারা মৃত্যুশ্বাস ধূমপান গ্রহণ করে তাদের অবশ্যই নীরব ঘাতক ধূমপান বা তামাক সম্পর্কে জানা দরকার। কারণ ধূমপান তাদেরকে ধীরে ধীরে কবরে নিয়ে যাচ্ছে বা রোগের দুঃসহ ও অভিশপ্ত জীবন বয়ে আনছে।
অধূমপায়ীদের জন্য শুভ বার্তা যে, আল্লাহ তাদেরকে ধূমপানের বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন। অনেকে বলে, কুরআন ও হাদিসে ধূমপান নিষিদ্ধ হওয়ার কোনো প্রমাণ নেই। অথচ কুরআনের একাধিক আয়াত ও হাদিসের একাধিক ভাষ্য মতে প্রমাণিত হয় যে, ধূমপান নিষিদ্ধ।
কারণ ধূমপানের কারণে নানা প্রাণনাশী রোগ-ব্যাধি সৃষ্টি হয়। এছাড়া বিড়ি ও সিগারেটের প্যাকেটেও লেখা থাকে, ধূমপান মৃত্যু ঘটায়। আল্লাহ বলেন, তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসের সম্মুখীন করো না। সূরা বাকারাহ ১৯৫। সূরা নিসার ২৯ আয়াতে রয়েছে, তোমরা নিজেরাই নিজেদেরকে হত্যা করো না।
উক্ত আয়াতদ্বয়ের মাধ্যমে আল্লাহ আত্মহত্যাকে নিষিদ্ধ করেছেন। আর জেনেশুনে ধূমপান করা মানে এক ধরনের আত্মহত্যা করা। ধূমপান কুরআনে বর্ণিত নিষিদ্ধ খবিস বস্তুর অন্তভুর্ক্ত। ধূমপানে রয়েছে বিভিন্ন রোগের উপাদান। আল্লাহ বান্দার ওপর পবিত্র খাদ্য-পানীয় হালাল করেছেন। অপবিত্র ও খারাপ বস্তু তিনি বান্দার ওপর হারাম করেছেন।
আল্লাহ বলেন, “তারা তোমাকে প্রশ্ন করে, তাদের জন্য কি বৈধ করা হয়েছে। বলো, তোমাদের জন্য বৈধ করা হয়েছে সব ভালো বস্তু। মায়েদাহ ৪ ও ৫। রাসূলের (সা.) গুণাগুণ বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ বলেন, যে তাদেরকে সৎ কাজের আদেশ দেয় ও নিষেধ করে অসৎ কাজ থেকে এবং তাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করে আর অপবিত্র বস্তু হারাম করে। আ‘রাফ ১৫৭
অতএব, সর্বপ্রকার ধূমপান খবিস বস্তুর অন্তভুর্ক্ত। অনুরূপ সকল প্রকার নেশাদ্রব্য বিক্রয় করা খবিস কর্মের অন্তভুর্ক্ত। তাই ধূমপানের ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবসা-বাণিজ্য মদের মতোই হারাম।
তামাকদ্রব্য মাকরুহ নাকি হারাম
আল্লাহ সমস্ত খাদ্যদ্রব্যকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। হালাল ও হারাম। আল্লাহ বলেন, হালাল ও হারাম কখনো এক নয়। মায়েদাহ ১০০। নু`মান বিন বাশীর (রা.) বলেন, আমি রাসূলকে (সা.) বলতে শুনেছি, হালাল স্পষ্ট ও হারামও স্পষ্ট। আর এ দুইয়ের মাঝে রয়েছে সন্দেহজনক কিছু বস্তু।
রাসূল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি সন্দেহজনক বিষয়ে পতিত হলো, সে যেন হারামেই পতিত হলো। সুনানে আবু দাউদ ৩৩৩০ ও সুনানে ইবনে মাজাহ ৩৯৪৮
উল্লেখিত কুরআন ও হাদিসের দলিল দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, বিড়ি, সিগারেট, তামাক, জর্দা হালাল নয়, বরং তা স্পষ্টই হারাম। এ মর্মে মহানবি (সা.) বলেন, যাবতীয় নেশা সৃষ্টিকারী বস্তু মাদক (খামার)। আর যাবতীয় নেশা সৃষ্টিকারী বস্তুই হারাম। মুসলিম ২০০৩, সুনানে ইবনে মাজাহ ৩৩৯০ ও মিশকাত ৩৬৩৮
রাসূল (সা.) আরো বলেন, যা অধিক সেবন করলে নেশার সৃষ্টি হয় তা কম সেবন করাও হারাম। তিরমিযি ১৮৬৫ ও আবু দাঊদ ৩৬৮১
সুতরাং কুরআন ও হাদিসের আলোচনা থেকে বলা যায় যে, ধূমপান কোনোভাবেই হালাল হতে পারে না। এটি হারামের অন্তভুর্ক্ত। তাছাড়া বিড়ি, সিগারেট পুষ্টিকর কিংবা ক্ষুধা নিবারণ করারও কিছুই নয়। জাহান্নামীদের খাবার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে আল্লাহপাক বলেন, এটা তাদের পুষ্টিও যোগাবে না ক্ষুধাও নিবারণ করবে না। গাশিয়াহ ৭
কুরআন ও হাদিসের উৎসারিত মূলনীতির আলোকে ধূমপান যে হারাম, তার মধ্যে থেকে অন্যতম কয়েকটির সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১. নিকৃষ্ট, খারাপ ও অপবিত্র বস্তু মুমিনদের জন্য নিষিদ্ধ। আল্লাহ বলেন, তাদের জন্য উত্তম-উপাদেয় বস্তুগুলো হালাল করা হয়েছে আর হারাম করা হয়েছে নিকৃষ্ট খারাপ বস্তুগুলো। আ‘রাফ ১৫৭
পৃথিবীর কোনো সুস্থ বিবেক সম্পন্ন মানুষ স্বজ্ঞানে বিড়ি-সিগারেটকে উত্তম উপাদেয় বা উপকারী বস্তুর অন্তর্ভুক্ত করবে না। বরং সর্ব সম্মতিক্রমেই এটা নিকৃষ্ট, খারাপ ও অপবিত্র জিনিসের অন্তর্ভুক্ত।
২. ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের ও অন্যের ক্ষতি করা বৈধ নয়। আল্লাহ বলেন, তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসের সম্মুখীন করো না। বাকারাহ ১৯৫। অর্থাৎ ইচ্ছাকৃতভাবে এমন কোনো কাজে লিপ্ত হয়ো না যা তোমাদের ধ্বংস ও ক্ষতির কারণ হয়। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, অন্যের ক্ষতি করা যাবে না এবং নিজেও ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া যাবে না। সুনানে ইবনে মাজাহ ২৩৪১
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি যে ঈমান রাখে সে যেন প্রতিবেশীকে (পার্শ্ববর্তী ব্যক্তিকে) কষ্ট না দেয়। মুসলিম ১৮৩। ধূমপান কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না। বরং এটা ধূমপায়ী ও তার আশপাশের মানুষের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। যে কোনো সচেতন মানুষ মাত্রই এ ব্যাপারে একমত।
৩. অপচয় ও অপব্যয় করা নিষেধ। আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই আর শয়তান তার প্রতিপালকের কুফুরী করেছে। বনি ইসরাইল ২৭। আল্লাহ আরও বলেন, তোমরা নিবোর্ধদের হাতে সম্পত্তি অর্পণ করো না। নিসা ৫। মানে, যাতে করে তাদের নির্বুদ্ধিতার কারণে আল্লাহর দেয়া এই সম্পদের অপচয় ও অপব্যবহার না হয়।
ধূমপানের বিষয়টা আগাগোড়াই অপচয়। এর মাধ্যমে সময়, শারীরিক সক্ষমতা ও টাকা-পয়সার অপচয় অপব্যবহার ছাড়া আর কোনো কল্যাণ নেই। আল্লাহর দেয়া অন্যান্য নেয়ামতের পাশাপাশি শারীরিক সক্ষমতা, টাকা-পয়সার অপচয় ও অপব্যবহার কোরআনের বিভিন্ন আয়াতের আলোকেই নিষিদ্ধ।
আল্লাহ প্রদত্ত শক্তি ও সম্পদকে শুধুমাত্র তার সন্তষ্টির জন্য শরীয়ত অনুমোদিত ক্ষেত্রগুলিতে ইসলাম সম্মত পন্থায় ব্যয় করতে হবে। এর অপব্যবহার করলে আল্লাহ পাকের সামনে কেয়ামতের দিন জবাবদিহি করতে হবে এবং তিনি ক্ষমা না করলে শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। এ সংক্রান্ত আয়াতসমূহ একত্রিত করে বিশ্লেষন করলে একটি নাতিদীর্ঘ পুস্তিকা রচনা করা যায়।
৪. মুমিনদের জন্য দুর্গন্ধযুক্ত বস্তু পরিহার করা বাঞ্ছনীয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কাঁচা পেঁয়াজ, রসূন, কুররাছ (পেঁয়াজ জাতীয় একপ্রকার ফল) আহার করেছে সে যেন আমাদের মসজিদে (মসজিদে নববিতে) প্রবেশ না করে। কারণ যা দ্বারা মানুষের কষ্ট হয় (দুর্গন্ধের কারণে) ফেরেশতাদেরও তা দ্বারা কষ্ট হয়। ইবনে হিব্বান ১৬৪৪
অধিকাংশ ধূমপায়ীদের জামা কাপড়সহ শরীর থেকে যে গন্ধ আসে তা তাদের নিকটস্থ সুস্থ সাধারণ ব্যক্তিদের জন্য পীড়াদায়ক। যে কার্যকারণের ভিত্তিতে কাঁচা পেঁয়াজ ও রসূন খেতে নিষেধ করা হয়েছে তা ধূমপানের ক্ষেত্রেও পূর্ণমাত্রায় উপস্থিত। তাই ইসলামি আইন শাস্ত্রের মূলনীতি অনুযায়ী, ওই একই বিধান অর্থাৎ হারাম হওয়ার বিষয়টা এক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
এবার আপনিই সিদ্ধান্ত নিন, ধূমপান করবেন, নাকি ছাড়বেন?