দ্বীনু সাহেবের চেয়ারম্যানগিরি
আসিফ ইকবাল আরিফপ্রকাশিত : জুন ০৯, ২০২০
দ্বীনু সাহেব একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। পুরো রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ সরকার বা প্রশাসনের হাতে থাকলেও পুতুলপুর ইউনিয়নের প্রধান কর্তা কিন্তু এই দ্বীনু সাহেবই। পুতুলপুর ইউনিয়নে পাক্কা চৌদ্দটি গ্রাম আছে। গ্রামগুলোর মধ্যে মদনতলা আর পানিড্যাঙ্গা গ্রাম দুটো সব থেকে আয়তনে বড় এবং লোক সংখ্যা বেশি। এই গ্রাম দু`খানা এতই বড় যে, পুতুলপুর ইউনিয়নের বাকি বারোটি গ্রাম দুইভাগ করে গিলে খাওয়ার পরেও কিছু জায়গা খালি থাকার কথা। পুতুলপুর ইউনিয়ন পরিষদ এমন জায়গায় অবস্থিত যেখান থেকে চৌদ্দ গ্রামের সবাই কমবেশি যোগাযোগ করতে পারে। পুতুলপুর বাজার সবচেয়ে বড় বাজার এই চৌদ্দ গ্রামের জনবসতির জন্য। আর বাজারের উত্তর দিকের গ্রাম মদনতলা আর দক্ষিন দিকের পানিড্যাঙ্গা গ্রাম দুটি থেকে প্রায় প্রতিবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। একবার মদনতলা থেকে তো পরের বার পানিড্যাঙ্গা থেকে। ১৯৭৩ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত শুধুমাত্রা ভাঁদালপুর গ্রাম থেকে একবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিল।
দ্বীনু সাহেবের তিন পুরুষের কপাল হয়েছিল পুতুলপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ার। তার বাপ ছিলেন একবারের চেয়ারম্যান আর তার বাপের বাপ মানে তার দাদা ছিলেন দুইবারের আর দ্বীনু সাহেব তো আছেনই। দ্বীনু সাহেবের বর্তমান যে বয়স তাতে করে ভোটে নির্বাচিত হলে সে আরও দুই বা ততোধিক মেয়াদে চেয়ারম্যান হতে পারবেন। দ্বীনু সাহেবের বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই। ঘরে তার একখানা বিবি আছে। বউয়ের বয়স নেহাৎ পয়তাল্লিশ বছরের বেশি নয়। তার দুইটি ছেলে সন্তান আছে। যাদের একজনের বয়স তিরিশ বছর আর একজনের বয়স সাতাশ বছর। তার একমাত্র কন্যার বয়স পনেরো বছর মাত্র। এই তিন সন্তান ব্যতীত আইনানুগ তার আর কোনো সন্তান নেই। তবে অনেকেই গোপনে তার নামে বলাবলি করে যে এর বাইরেও তার বীর্য থেকে উৎপন্ন দু`য়েকটা সন্তান সন্ততি পাতালপুর ইউনিয়নের যেকোনো গ্রামে থাকতে পারে। কেননা লোকে তার সম্পর্কে এখনো ধারণা করে যে, যেখানে সেখানে বীর্যপাত করা নাকি তার মস্ত বড় বদ অভ্যাস।
তার নজরে যে আসে সে যদি একান্ত তার নিকট আত্মীয় না হয় তাকেই সে শয্যাসঙ্গী বানাতে চায় বিশেষ করে হতদরিদ্র কোনো নারী তার নজরে আসলে এড়িয়ে যায় না। এই যেমন নওহর গ্রামের কালু মুন্সীর ছোট ছেলে নাকি একেবারেই দ্বীনু চেয়ারম্যানের ফটোকপি। তবে এটি নিতান্তই গ্রামবাসীর পর্যবেক্ষণের কথা। এটা গুজব না সত্য তা কেউ সঠিকভাবে বলতে পারে না। তবে লোকে বলাবলি করে, কালু মুন্সীর ছোট ছেলে জন্মের আগে নাকি তার বাড়িতে রাত বেরাতে দ্বীনু চেয়ারম্যান আসা-যাওয়া করত। তবে এই গ্রামীণ পরিবেশে কালু মুন্সীর ছেলের ডিএনএ পরীক্ষা করে তার পিতা কে, এটা সনাক্ত করা একটা অসম্ভব ব্যাপার। আর তাছাড়া কালু মুন্সী তো রীতিমত ওই সন্তানকে তার পরিচয়েই পেলে চলেছেন। তবে হ্যাঁ, সন্দেহ যদি মুন্সীর নিজের মনে থাকতো তখন এই ডিএনএ পরীক্ষার কথা আসতো। যদি ঘটনাটা সন্দেহেরই হয় তার উত্তর দুটো জায়গা থেকে পাওয়া যায়; এক স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা যিনি সবকিছু জানেন। আর অন্যটি হলো কালু মুন্সীর বউ।
সৃষ্টিকর্তা থেকে সরাসরি জানার সুযোগ নেই কেননা সে আমাদের মতো মানুষ নয় যে কথা বলা যাবে, জেরা করা যাবে বা তার থেকে সরাসরি সাক্ষ্য নেয়া যাবে। আর কালু মুন্সীর বউ সমাজের কলঙ্কের ভয়ে বা চাপে পড়ে কালু মুন্সীর কথাই যে বলবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই পাড়ার অনেকেই গোপনে বা পেছনে কালু মুন্সীর ছেলেকে নিয়ে মশকরা করে। এ এক অদ্ভূত রহস্য প্রকৃতি জগতে। সন্তানের মাতা যিনি তাকে সহজেই নির্ণয় করা যায়। আর পিতার পরিচয় কেবল জানেন ঐ সন্তানের জননী আর উপরওয়ালা। যাই হোক, দ্বীনু চেয়ারম্যান সম্পর্কে প্রচলিত এইসব কীর্তি লিখতে গেলে মোটামুটি দু`য়েক বস্তা সাদা কাগজ লেগে যাবে। অতএব, তার কুকর্মের পাল্লা যে অনেক ভারী তা কোনো রকম সন্দেহ ছাড়াই বলা যায়। দ্বীনু সাহেব এই নিয়ে তিন তিনবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। প্রথমবার নির্বাচিত হয় আজ থেকে বছর কুড়ি আগে যখন তার পিতা রোশন চেয়ারম্যান একেবারেই মৃত শয্যায়। মূলত ঐ নির্বাচনে রোশন চেয়ারম্যানরই প্রার্থী হওয়ার কথা ছিল।
রোশন চেয়ারম্যান অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলেন। অনেকেই তাকে গরীবের চেয়ারম্যান বলে জানতো। পুতুলপুর ইউনিয়নের যতগুলো ইতিবাচক উন্নয়ন রয়েছে প্রায়ই সবগুলোতেই রোশন চেয়ারম্যানের ছোঁয়া আছে। ভালো মানুষ হিসেবে দ্বীনু সাহেবের দাদারও বেশ সুনাম ছিল। কিন্তু দ্বীনু সাহেব তাদের সবার চরিত্রের উল্টো কিছিমের মানুষ। সেই সময়ের নির্বাচনের ঠিক দুইমাস আগে রোশন চেয়ারম্যান বয়সের ভারে পুরোপুরি অসুস্থ হয়ে পড়ে। কোনোভাবে তাকে নির্বাচনের প্রার্থী করা যায়নি। বাড়ির বড় ছেলে হিসেবে প্রার্থী হন দ্বীনু সাহেব। দ্বীনু সাহেবের থেকে অনেক যোগ্য প্রার্থী তাদের দলের পুতুলপুর ইউনিয়নের চৌদ্দ গ্রামে ছিলো। তবে রোশন চেয়ারম্যান যে গ্রামের অধিবাসী ছিলো সেই গ্রামের লোক চেয়েছিলো পুতুলপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদ তাদের গ্রামেই থাক। আর রোশন সাহেবদের বংশের লোক দাবি করে বসলো তারা তাদের বংশ থেকে চেয়ারম্যান পদ রাখবে। আর বংশ থেকে রাখতে হলে রোশন চেয়ারম্যানের একেবারে নিকট রক্ত যদি ধরা হয় তাহলে তার ভাই অথবা ভাতিজা থেকে তাঁর নিজের সন্তানদের নামই আগে আসবে।
যাই হোক, নানান হিসেব নিকেশ কষেই দ্বীনু সাহেবকে চেয়ারম্যান করা হয়। যেহেতু দ্বীনু সাহেবের বাবার সুনাম ছিলো ভালো মানুষ হিসেবে সেই সুনামের জোরেই পাশ করে যায় দ্বীনু সাহেব। আর তখন থেকেই দ্বীনু সাহেব চেয়ারম্যানের পোলা থেকে পুতুলপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হন। এর পরে বর্তমান পর্যন্ত আরও দুইবার তার চেয়ারম্যান হওয়ার সুযোগ হয়েছে। পুতুলপুর ইউনিয়নের মূল কেন্দ্র হচ্ছে পুতুলপুর বাজার। আর পুতুলপুর বাজারই হচ্ছে এই ইউনিয়নের সবচেয়ে বড়বাজার। চেয়ারম্যানের ক্ষমতা চর্চার বড় মাধ্যম হলো এই বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা। বিশেষ করে বাজার নিলামে তোলা, খাজনা আদায় করা ইত্যাদি ইত্যাদি। সপ্তাহের দুইদিনে এই বাজারে বিশাল হাট বসে। এই খাজনার প্রায় ষোলোয়ানা যায় চেয়ারম্যানের পকেটে। এছাড়াও পুতুলপুর বাজারে রয়েছে একটি গার্লস হাইস্কুল এবং একটি বয়েজ হাইস্কুল যেখানে দুই স্কুলেরই ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হচ্ছেন দ্বীনু চেয়ারম্যান। আর আছে আর একটি মাদ্রাসা যেখানে সে প্রতিবছরের দুই ঈদে বড় অংকের লোক দেখানো দান খয়রাত করে থাকে। তাছাড়া প্রতি বছর হিন্দু এবং সনাতন সম্প্রদায়ের যে দুর্গাপূজা হয় সেখানেও সে সবার আগে আগে থাকে। আর নিতান্তই তার শত্রুর না হলে পুতুলপুত ইউনিয়নের কোনো বিয়ে বাড়িতে বা মৃতব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া তার বাদ থাকে না। এছাড়া পুতুলপুর ইউনিয়নের ইউনিয়ন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের অবস্থানও এই পুতুলপুর বাজারে। সুতরাং পুতুলপুর বাজারই যে পুতুলপুর ইউনিয়নের রাজধানী তা বলা যায় কোনো রকম দ্বিধা ছাড়াই।
প্রথমবার চেয়ারম্যান হয়েই পুতুলপুর বাজারের আয়তন প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি করে ফেলেন দ্বীনু চেয়ারম্যান। নিজের নামে চেয়ারম্যান মার্কেট নামে একটি বিশাল লম্বা আর চওড়া বিল্ডিং তোলে সে। এখানে তার ছাব্বিশ-সাতাশ’টার মত দোকান আছে। আর তার এই দোকানগুলোতে আলপিন থেকে শুরু করে খাট আর পালংক সবই পাওয়া যায়। দোকানগুলো সে নিজে চালায়না। সাতাশটে দোকানের মধ্যে চৌদ্দটি দোকান চালায় তার গোষ্ঠীর একেবারেই বিশ্বস্ত মানুষগুলো। বাকী তেরোটি দোকান সে বাকী তের গ্রামের তেরোজনকে দিয়ে চালায়। ঐ তেরো গ্রামের তেরোজন তার বিশেষকর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। দ্বীনু সাহেবের কাজ খালি মাস শেষে ভাড়া বুঝে নেওয়া। একদিকে তার নিজের গোষ্ঠী আর বংশের লোকদের হাতে রেখেছে আর অন্যদিকে তার সোস্যাল নেটওয়ার্কের লোকদেরকে হাতে রেখেছে। দ্বীনু সাহেবের মূল লক্ষ্য ছিলো তার ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে পুরো বাজারের অর্ধেক নিজের সপত্তিতে পরিণত করা। দ্বীনু সাহেবের যে ব্যবসায়িক জ্ঞান তার জন্য তাকে বিকম পাশ করা লাগে নাই।
বাজারে দ্বীনু সাহেবের দোকান ছাড়া অন্যান্য যে দোকানগুলো রয়েছে সেই দোকানগুলোতে দ্বীনু চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত চাহিদা থাকে না। সে শুধুমাত্র মোটের উপর দশ থেকে বিশ টাকা খাজনা বেশি তোলার নির্দেশ দেয়। এই টাকা দিয়ে প্রতিমাসে সে একান্ত কিছু মানুষের পরিবারের ভরণপোষণ চালায় যাদের মূল কাজই হলো গ্রামে গ্রামে জনে জনে দ্বীনু সাহেবের গুনোকীর্তন গেয়ে বেড়ানো।
সমগ্র পুতুলপুরের মূল কেন্দ্রবিন্দু যে এই পুতুলপুর বাজার তা আগেই বলা হয়েছে। উৎপাদিত পণ্য এবং নিত্য পণ্যের কেনা-বেচা থেকে শুরু করে সবই এখানে হয়। অর্থনৈতিক গুরুত্বের সাথে সাথে এখানে আরও রয়েছে সামাজিক আর রাজনৈতিক রাজনৈতিক গুরুত্ব। বিবাহ যোগ্য কন্যা-পুত্রদের অধিকাংশেরই বিয়ের প্রাথমিক পর্যায়ের কথা এবং পাকা কথা এখানকার বিভিন্ন চায়ের দোকান বা কাপড়ের দোকানগুলোতেই হয়ে থাকে কেননা এই ইউনিয়নের চৌদ্দ গ্রামের লোকই এই বাজারে আসে। আর বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যের দ্বন্দ্ব, একগ্রামের বাসিন্দাদের সাথে আরেক গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যকার প্রায় সকল প্রকার দ্বন্দ্বেরই মিটমাট বা সমাধান হয় এই বাজারে। কখনো দ্বীনু চেয়ারম্যানের নিজের বসার পার্টি অফিসে বা ইউনিয়ন পরিষদে তার বসার কক্ষে। তার পার্টি অফিস তার নিজস্ব বিল্ডিংয়ের একটা দোকানের সমান। কয়েকটা চেয়ার আর একটা টেবিল আছে সেখানে। কিছুদিন আগে একটা দামী এসি কিনেছেন সে। লোকে বলাবলি করে কোনো এক সরকারি বরাদ্দের টাকা মেরে দিয়ে সে এটা কিনেছে। সমান তালে একের পর এক সিগারেট টানে এই রুমের মধ্যে আর বিচার কাজ চালিয়ে যায়। হয়তো শীতকালে তার তেমন আর এই এসির প্রয়োজন পড়বেনা। ভাইয়ে ভাইয়ে জমাজমি নিয়ে দ্বন্দ্ব, পিতাপুত্রের দ্বন্দ্ব, স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনের কলহসহ সব দ্বন্দ্বের অবসানের প্রাথমিক জায়গা হলো এই পুতুলপুর বাজার যেখানে বাদী আর বিবাদীরা একত্রিত হয় সুবিচারের আশায় আর দ্বীনু সাহেব থাকেন বিচারক। সাথে সাথে বাদী আর বিবাদী যদি দুইটি ভিন্ন গ্রামের হয় তাহলে সেই গ্রামের নির্বাচিত মেম্বার বা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উকিলের ভূমিকা পালন করে। আর বাদী-বিবাদীরা যদি একই গ্রামের বাসিন্দা হয় তাহলে প্রত্যেকেরই প্রভাবশালী কেউ থাকে যারা বিচারকার্যে উকিলের ভূমিকা পালন করে। আর এদের অধিকাংশই হয় চেয়ারম্যানের খুব কাছের লোক। আর যদি এটা বড় ধরণের মোকদ্দমা হয় সেক্ষেত্রে বড়জোর ফাঁড়ি বা পুলিশ কেন্দ্রের দারগা সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত থাকেন।
দ্বীনু চেয়ারম্যানের বিচারালয়ে সুবিচার আর অবিচার তুলসী ঘাটের জলের মত। যাদের ক্ষমতা আছে এবং যারা প্রভাবশালী তাদের বিচারে দ্বীনু সাহেবের পক্ষপাত পাওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি কেননা দ্বীনু সাহেবকে সন্তুষ্ট করতে হলে যে মাখন লাগে তা তারা সরবরাহ করতে পারে। নিতান্তই দ্বীনু সাহেবের একান্ত কাছের মানুষ না হলে কোনো দরিদ্র মানুষকে সঠিক বিচার পেতে সহায়তা সে করেনা। আবার দ্বীনু সাহেব যে বিচারই করুকনা কেন দুই পক্ষকেই একটা লোক দেখানো খরচা দিতে হয় আর এটা নির্ভর করে বিবাদের ধরণের উপর। তবে এই লোক দেখানো খরচার পরিমাণ এক থেকে দুই হাজারের মধ্যে হয়। আর মামলার গোপন খরচ যা হয় সেটা যারা দ্বীনু সাহেবের সাথে যোগাযোগ করে তারাই জানে কেবল। এই ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দারা একেবারেই নিতান্ত হত্যা মামলা ছাড়া থানা পুলিশের কাছে যায়না। আর জমি কেনা-বেচা করতে গিয়ে যেসব ছোটখাট ঝামেলা হয় সেটাও এই দ্বীনু চেয়ারম্যানের বিচারালয় থেকেই সমাধান হয়। হত্যা মামলার মত বড় বড় জমির মামলা যায় জেলার কোর্টে যেখানে এইসব দেওয়ানী মামলার বিচার হয়। এইক্ষেত্রেও বিভিন্ন সময়ে দ্বীনু চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপ থাকে। পুতুলপুর ইউনিয়নের সবক’টা গ্রামেই দ্বীনু সাহেবের প্রতিনিধি বা একান্ত খাস চামচা আছে যারা গ্রামের বিভিন্ন পক্ষের মধ্যকার চলমান ঝামেলা বা উঠতি ঝামেলা সম্পর্কে দ্বীনু সাহেবকে খবর পৌঁছিয়ে দেয়। দ্বীনু সাহেব কোনোভাবেই তার চৌদ্দ গ্রামের বাসিন্দাদের থানা পুলিশের কাছে যেতে দিতে চাননা। কেননা এই ছোট খাটো বিবাদের জন্য যদি থানা পুলিশের কাছে লোকজন যায় তাহলে থানার পর্যায়ের অন্যান্য নেতাকর্মীদের কাছে তার খবর চলে যায় এবং তাতে এই বিবাদ নিষ্পত্তি না হওয়ার দায়ভার দ্বীনু চেয়ারম্যানের উপরই পড়ে। আর যাই হোক, দ্বীনু চেয়ারম্যান তো ঐ পুতুলপুরবাসীর অভিভাবক। সে অভিভাবক এই অর্থে যে ঐ চৌদ্দ গ্রামে কে মারা যাচ্ছে? কোন শিশুর জন্ম হচ্ছে? তার সব হিসাব নিকাশই তো দ্বীনু সাহেবের সরাসরি হস্তক্ষেপেই হয়। আবার কারোর নাগরিক সনদ বা চারিত্রিক সনদ তো দ্বীনু সাহেবের দস্তখত বা স্বাক্ষর ছাড়া হয় না।
চৌদ্দ গ্রামের বিভিন্ন প্রান্তের বয়স্ক এবং বিধবা ভাতা, সরকারি প্রকল্পের কাজগুলো যেমন কাবিখা (কাজের বিনিময়ে খাদ্য), টিআর ইত্যাদি প্রকল্প তার হাত ধরেই বাস্তবায়িত হয়। এই নয় উপজেলা পর্যায়ের রাজনীতিতেও দ্বীনু সাহেবের ভূমিকা অনেক কেননা যত ভোটার দখলে থাকবে থানা, উপজেলা বা জেলা পর্যায়ের নেতাদের কাছে তার কদর বা আলাদা ভাব বেশি থাকবে। এই ভোটের ভারেই স্থানীয় সংসদ সদস্যদের কাছেও দ্বীনু চেয়ারম্যানের কদর বেশ। অন্যান্য ইউপি চেয়ারম্যানদের সাথে দ্বীনু চেয়ারম্যানের তুলনা হয়না। অন্যদের থেকে এমপি সাহেবের কোনো রাজনৈতিক প্রোগ্রামে দ্বীনু চেয়ারম্যানের লোকই সবচেয়ে বেশি উপস্থিত থাকে। দ্বীনু সাহেব প্রতিনিয়ত তিনটে জায়গায় যোগাযোগ রাখে। প্রথমেই সে উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছে যায়। সন্তানের আনুগত্যে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মাধ্যমে তার দিন শুরু হয়। প্রায়ই প্রতিদিনই যায়। আর যেইদিন যেতে না পারে সেইদিন সে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ সম্পন্ন করে। উপজেলা চেয়ারম্যানের সুপারিশ ছাড়া কোনো বরাদ্দই দ্বীনু সাহেব তুলতে পারবে না। দ্বীনু সাহেবের এর পরের যোগাযোগ হলো তার উপজেলা পরিষদের সাথে। উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে সে সারাদিন তৈল দিতে দিতে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের প্রতি সে এতটাই অনুগত যে সে নিজের বাপ বা দাদার প্রতিও এতটা ছিল না।
জাতীয় রাজনীতির অবস্থা যেদিকেই যাকনা কেন এইসব নিয়ে তার খুব বেশি ভাবনা নেই। তার ভাবনা থাকে উপজেলা অফিস থেকে গ্রামোন্নয়নের জন্য যেসব বরাদ্দ থাকে তা পইপই করে বয়ে নিয়ে যাওয়া। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কক্ষে ঢোকার আগেই সে পিআইও বা প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন অফিসারের কক্ষ হয়ে তার ইউনিয়নের বরাদ্দের খবরবার্তা নিয়ে যায়। নতুন কোনো বরাদ্দ আসলে বা পুরাতন বরাদ্দের তদারকি সে এই কক্ষ থেকেই করে যায়। এরপরে তার যোগাযোগ থানার ওসি সাহেবের সাথে। ওসি সাহেবের গালি আর ঝাড়ি তার কাছে মিঠা শরবতের মত। আর দ্বীনু চেয়ারম্যান এটা নির্দ্বিধায় সহ্য করেন কেননা ওসি সাহেব তার সুপারিশে তার ইউনিয়নের বিভিন্ন বাসিন্দাদের মামলা থেকে রেহাই দেন। আবার যারা দ্বীনু সাহেবের মতামতের বাইরে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তাদের অনেককে জোরপূর্বক মামলা প্রদানে প্রতক্ষ এবং পরোক্ষ মদদ যোগান। ওসি সাহেব যে এসব খালি নুন আর ভাতে করে দেন তা কিন্তু নয়। সেও বড় অংকের টাকা এখান থেকে পান। অর্থাৎ দ্বীনু চেয়ারম্যান আর ওসি সাহেব একে অপরের ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষার্থে সম্পর্ক বজায় রেখে যান। থানায় যে ওসি সাহেবই আসুন না কেন দ্বীনু সাহবে তার সাথে সম্পর্ক পাতিয়ে নেয় বা ভাব জমিয়ে ফেলে। সহকারী পুলিশ সুপার, জেলা পুলিশ সুপার বা জেলা প্রশাসকের সাথে তার যোগাযোগ না হলেও চলে কিন্তু থানার ওসি তার কাছে প্রায়ই আপন বাপের মতই। এছাড়া দ্বীনু সাহেব নিয়মরক্ষার্থে এমপি বা জেলাপ্রশাসকের সাথেও যোগাযোগ রাখে।
জাতীয় রাজনীতির তেমন কোনো খোঁজ খবর তার না রাখলেও চলে। তবে একেবারে যেসব বিষয় নিয়ে পত্রপত্রিকা আর টেলিভিশনে কথা হয় সে খবরগুলো তাকে রাখতে হয়। কেননা এই খবরগুলো না জানলে সাধারন মানুষের সেন্টিমেন্ট ধরে রাখা যায়না। তাই দ্বীনু সাহেব সরকারী দলের প্রতিনিধি এবং একজন একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবেই নিজের পরিচয় দেন। তাছাড়া পুতুলপুর ইউনিয়নে তার একটা দলীয় পদ আছে, সেটা হলো সে সভাপতি। জাতীয় রাজনৈতিক দলের যে মতাদর্শগত বিত্তি পত্রপত্রিকা বা টেলিভিশনে দেখা যায় পুতুলপুর ইউনিয়নে এসে সেই চিত্র পাল্টে যায়। পুতুলপুর ইউনিয়নের ক্ষমতা কাঠামো এবং এর চর্চা যতটা না মতাদর্শ বা আদর্শ ভিত্তিক তার চেয়ে বেশি গোষ্ঠী বা রক্তের সম্পর্ক বা বৈবাহিক সম্পর্কভিত্তিক। জনসেবা বা জনসভায় প্রদর্শনের জন্য এই সম্পর্ক দলের একজন একনিষ্ঠ এবং বিশ্বস্ত কর্মী থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। দ্বীনু চেয়ারম্যান ভোটে জেতা, শত্রুদের দমন এবং দলীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে তার রক্তের সম্পর্কের লোকদেরকেই বেশি প্রাধান্য দেয়। তবে নিজের রক্তেরর সম্পর্কের লোকদের মধ্যে যেন কেউ গাদ্দারি বা তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে না পারে সেই ব্যাপারেও সে খুব বিচক্ষণ থাকে। দ্বিনু চেয়ারম্যানের চেয়ারম্যান পদবীকে কাজে লাগিয়ে সবাই যে যার মত অধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। আর অন্যান্য যে সকল কাজে তার সম্পৃক্ততা আছে বিশেষ করে বিবাদ নিষ্পত্তি বা বিভিন্ন সরকারী সুবিধা প্রদান করা, সেখানে গুরুত্ব পায় যতটা না দলীয় পরিচয় তার থেকে বেশি আর্থিক লেনদেন।
প্রায় প্রতিবছর ঋতুভিত্তক দুর্যোগের সময় দ্বীনু সাহেব বিভিন্ন গ্রামের মেম্বরদের সাথে নিয়ে একটি তালিকা করে। গ্রীষ্মকালীন সময়ে হালকা বাতাস হলেও উপজেলা চেয়ারম্যানের মাধ্যম হয়ে দ্বীনু সাহেব একদল লোক নিয়ে উপজেলা পরিষদে যায় উপজেলা নির্বাহীর কর্মকর্তার কাছে। ঘর-দুয়োর ভেঙ্গে গেছে, গাছপালা ভেঙে গেছে এবং ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ইত্যাদি গল্প বলে আসে। আর বড় ঝড় যদি হয় তাহলে তার ক্ষয়ক্ষতির ফর্দ বা তালিকা আরও বড় হয় এবং বিশাল অংকের টাকার ক্ষতিপূরণ উপজেলা পরিষদে পেশ করে। আর বর্ষাকালে যদি একটানা সাতদিন বৃষ্টি হয় তাহলেও সে একটা লম্বা তালিকা বানায়। আর তার এই তালিকা বানাতে দক্ষ সহায়তা করে ইউনিয়ন পরিষদের সচিব। এছাড়া বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা ইত্যাদি বরাদ্দ সরকার পুতুলপুরবাসীর জন্য দেয়। এইসব সরকারি বরাদ্দের ত্রাণের উপর দ্বীনু সাহেবের নিয়ন্ত্রণ শতভাগ। সে যেভাবে উপরের মানুষের হাতে পায়ে ধরে আদায় করে নিয়ে আসে ঠিক তার চেয়ে বেশি হাত তার পায়ে পড়লে অন্যদের মাঝে বিতরণ করে। তামাম দুনিয়ার মালিক স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা হলেও এই ত্রাণ বিতরণের মালিক দ্বীনু সাহেবই। দ্বীনু সাহেব রীতিমতই জানে পুতুলপুরের অসহায় মানুষদেরকে নিয়ত্রণ করতে হলে এই ত্রাণ নিয়ন্ত্রণ হল বড় কৌশল। এটা বোঝার জন্য রাজনীতি বিজ্ঞানে কোনো ডিগ্রি নেওয়া লাগেনা বা টাইটেল পাস হওয়া লাগেনা। যে বরাদ্দ তিনি পান তা মনে মনে তিনভাগে ভাগ করে মালামাল বা নগদ অর্থ সরিয়ে ফেলেন। একভাগ চলে যায় উপজেলা চেয়ারম্যান আর উপজেলা অফিসের লোকজনের পকেটে। আর একভাগ তার নিজের পকেটে। আর সর্বশেষ ভাগ জনগণের জন্য। জনগনের জন্য যেভাগ থাকে সেই ভাগ থেকে আবার সে মেম্বরদেরকে বলে দেয় নিজেরটা একটু করে নিতে। মানে জনগণের ঐ ভাগ থেকে কিছু অংশ যেন মেম্বররাও রেখে দেয়। কত পরিমাণ বরাদ্দ হলো বা কী পরিমাণ বরাদ্দ হলো তার সঠিক হিসাব পরিষদের কোনো মেম্বরই ঠিকমত জানেনা বা দ্বীনু সাহেব তা জানতে দেননা। আর এইসব নিয়ে মেম্বররাও খুব বেশি ভাবেননা কেননা দ্বীনু সাহেবের লাইসেন্স নিয়ে অনেকেই তার ব্যবসা বাণিজ্য ভালোই গুছিয়েছেন। জনসেবা করতে এসে যেটা পান সেটা হলো উপরি আয়। যা আসে তাতেই লাভ।
পুতুলপুর ইউনিয়নের প্রতিটি নাগরিকই দ্বীনু সাহেবের কাছে বন্দী। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজে শ্রেনীচেতনা বা অধিকার সচেতনতা খুব বেশি কাজ করেনা। কারণ অতিপ্রাচীন কাল থেকেই তাদের মধ্যে একধরণের স্বয়ংসম্পূর্ণ মনোভাব রয়েছে আর সামন্ততন্ত্রভিত্তিক উৎপাদন পদ্ধতিতে এসে এই মনোভাব আরও বেশি প্রগাড়। এদের রাজনীতির মূল লক্ষ্যবস্তুই হলো নিজের নামে জমি বৃদ্ধি, জমি রক্ষণাবেক্ষণ, ঠিকমত চাষাবাদ ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই এইসব করতে গিয়ে যে বিবাদের সুত্রপাত হয় সেই বিবাদ থেকে উতরিয়ে উঠতেই তাদের চেয়ারম্যান লাগে, মেম্বর লাগে। জাতীয় রাজনীতি তাদের কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ন নয়। সারা রাষ্ট্রের অবস্থা তাদের না ভাবলেও চলে কিন্তু নিজের গৃহ ঠিক থাকলেই হবে। আর জাতীয় নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ যেমনই হোকনা কেন এরা ধুমধাম করে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন করে। একেবারে ছেলে-বুড়ো সবাই নেচে গেয়ে।
দ্বীনু চেয়ারম্যান নিজের ঢংয়ে ছোটোখাটো রাষ্ট্রের আদলে গড়ে নিয়েছেন এখানকার কাঠামোকে। নিজের খেয়াল খুশি এবং নিজের স্বার্থরক্ষার্থেই রাজনীতি করে তার চেয়ারম্যানগিরি টিকিয়ে রাখে সে। জাতীয় বৃহৎ দলের সমর্থন বা কর্মী হিসেবে পরিচয় তার কাজে চকচকে কাগজের মোড়কের মত আর এর অভ্যন্তরে রয়েছে তার নিজের স্বার্থরক্ষা। আর এইভাবেই জাতীয় রাজনীতির আদর্শ ব্যক্তিস্বার্থ হাছিলের উপকরণ হিসেবে কাজ করে যায়। অন্তত পুতুলপুর ইউনিয়নে তো হচ্ছে। এইভাবেই চলছে পুতুলপুরের ইউনিয়ন পরিষদ, দ্বীনু সাহেব আর তার চেয়ারম্যানগিরি দিয়ে।
লেখক: শিক্ষক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়