দেশে যে কী ভয়াবহ অবস্থা, সেটা কি বোঝা যাচ্ছে?
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : মে ০৩, ২০২০
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় যখন জার্মান বাহিনী ব্রিটেন দখল করার প্রথম অভিযান চালায়, তা ছিল বিমান যুদ্ধ। জার্মানরা ভয়াবহ আক্রমণ চালিয়েছিল। ১৯৪০ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই যুদ্ধবিমান থেকে দশ হাজার বোমা ফেলা হয় লন্ডন শহরে। তিনশো পঞ্চাশটি বোমারু বিমান একযোগে আক্রমণ চালায়। চার্চিল তখন প্রধানমন্ত্রী। তিনি জানতেন শত্রুপক্ষের বোমার আঘাতে লন্ডনের বহু নাগরিক হতাহত হবে। তিনি সেজন্য নারী আর শিশুদের আগেই শহরের বাইরে পাঠিয়ে দেন।
শহরের হতাহতের চিকিৎসার জন্য চার্চিল গোড়ার দিকে হাসপাতালে আড়াই লক্ষ মানুষকে চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা নেন। তিনি প্রথম মহাযুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে তা করেছিলেন খুব দ্রুত সময়ে। কিন্তু সেবার তিনমাসে তেরো হাজার মানুষ মারা যায় আর আহত হয় প্রথম মহাযুদ্ধের তুলনায় অনেক কম। তিনমাস পর জার্মানরা হঠাৎ আক্রমণ বন্ধ করে দেয়। ফলে হাসপাতালে আড়াই লাখ মানুষকে চিকিৎসা নিতে হয়নি। কিন্তু চার্চিল ব্যবস্থা রেখেছিলেন। কারণ জার্মান আক্রমণ তিনমাস পর বন্ধ হয়ে যাবে, চার্চিল জানতেন না। চার্চিল যা করেছিলেন, সেই প্রস্তুতি রাখাটাই ছিল যৌক্তিক। মানুষ কম আহত হয়েছে, যদি বেশি হতো তাহলে? প্রস্তুতি নিয়ে রাখাটা বড় কথা।
বাংলাদেশে বর্তমান করোনা ভাইরাসের আক্রমণের প্রস্তুতি হিসেবে এমন কিছু লক্ষ্য করা গেল না। সময় ছিল কিন্তু এ ধরনের প্রস্তুতি নেয়ার প্রয়োজন বোধ করা হয়নি। দেশজুড়ে যখন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের সম্ভাবনা ছিল তখন সেভাবে প্রস্তুত থাকা দরকার ছিল। কিন্তু ঘটেছে ঠিক এখন তার উল্টো। করোনা ভাইরাসের আক্রমণের চিকিৎসা তো পাওয়া যাচ্ছেই না বরং অন্যান্য চিকিৎসা যা কিছুটা পাওয়া যেতো, সেটাও প্রায় বন্ধ। হাসপাতাল বাড়েনি বরং বহু হাসপাতাল বন্ধ হয়ে আছে। করোনা ভাইরাসে সংক্রামিতরা চিকিৎসা পাচ্ছে না এ রকম অভিযোগ প্রতিদিন শোনা যাচ্ছে, ভিন্ন রোগেও চিকিৎসা মিলছে না।
চিকিৎসকরা বড় সংখ্যায় আক্রন্ত। সারাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল খুব দুর্বল, যা এখন দুর্বলতর হয়েছে। ভয়াবহ রকম অব্যবস্থাপনা দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে এখন কেউ নিশ্চিত করে জানে না, চিকিৎসা পেতে হলে তাকে কী করতে হবে। বা আদৌ তার চিকিৎসা জুটবে কিনা। যারা হাসপাতালে জায়গা পাচ্ছে তাদের আত্মীয়রা অনেকে জানাচ্ছে, সঠিক চিকিৎসা তারা পাচ্ছে না। চিকিৎসা ছাড়া মারা পড়ছে। কাকে এর জন্য দায় নিতে হবে, মানুষ তাও জানে না। চিকিৎসকরা চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেছে, সেরকম অভিযোগ পর্যন্ত আছে। বহু হাসপাতালে চিকিৎসকরা ন্যায়সঙ্গত প্রশ্ন তুললে চাকরি চলে যাচ্ছে। কিন্তু এমনটা হওয়া কি উচিত?
বহু উন্নত দেশ করোনা আক্রমণের চিকিৎসা দিতে পারছে না, সেটা ঠিক। কিন্তু কখন সেটা? যখন লাখ লাখ লোক আক্রান্ত। কিন্তু বাংলাদেশে যখন হাজার লোকের কম আক্রান্ত, তখন থেকেই শোনা যাচ্ছে, চিকিৎসা মিলছে না। বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে আর গত চারদিনে বিশ্বের আক্রান্তের তালিকায় বাংলাদেশ বহু দেশকে ছাড়িয়ে উপরে গেছে। বাংলাদেশে এখন অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপারটা হলো, বাংলাদেশে আরোগ্য লাভ করার চেয়ে মৃতের সংখ্যা বেশি সরকারের হিসেবে। মৃত যেখানে ১৬৩ সেখানে আরোগ্য লাভ করেছে মাত্র ১৫০ জন। যতজন আরোগ্য লাভ করছে, মারা যাচ্ছে তার চেয়ে বেশি।
বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর আর কোথাও তা ঘটছে না। সর্বত্র মৃতের সংখ্যা আরোগ্য লাভের সংখ্যার অনেক কম। অস্ট্রেলিয়ায় যখন মৃত ৯৩ তখন আরোগ্য লাভ করেছে চার হাজারের বেশি মানুষ। উন্নত দেশের কথা বাদ দেই, কাছের দেশগুলির উদাহরণ দেয়া যাক। ভারতে যখন মৃত ১০৮৯ তখন আরোগ্য ৮৪৩৭ জন। পাকিস্তানে যখন মৃত ৩৪৯ তখন আরোগ্য লাভ করেছে ৪০৫২ জন। বাংলাদেশ যে কী ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয়েছে, সেটা কি বোঝা যাচ্ছে? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা যে সকল প্রস্তুতির কথা বারবার বলেছেন, এটা কি তার নমুনা? নিজেদের দেয়া পরিসংখ্যান তো আর তারা উল্টাতে পারবে না। এখানে গুজব নেই, পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে কথা বলা হয়েছে।
চার্চিল আজ থেকে প্রায় আশি বছর আগে যে প্রস্তুতি নিতে পেরেছিলেন দুর্যোগ মোকাবেলায়, বাংলাদেশ সে প্রস্তুতি নিতে পারলো না কেন? বাংলাদেশ এখন অস্ট্রেলিয়ার উপরের আরও চারটি দেশকে ছাড়িয়ে ফিলিপিনের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। কালকে দেখা যাবে হয়তো ফিলিপিনকে ছাড়িয়ে গেছি।