দেশে প্রোডিউসার নাই, আছে কিছু পার্ভার্ট!

সানাউল কবির সিদ্দিকী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৯

বাংলাদেশ পৃথিবীর এরিয়া-৫১। সংবাদ মাধ্যম আপনাকে এখানে বিস্মিত করতে পারবে না। কী গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা যে এখানে চালানো হচ্ছে, সে বিষয়ে পরিষ্কার বলতে না পারলেও কিছুটা আঁচ করা যায় যে, গিনিপিগ কারা।

মানুষ নৈরাশ্য ও নৈরাজ্যের চরমে, অপরাধীদের মাড়ায় না তবে, সন্দেহজনক কাউকে ছাড়ে না। শিক্ষকদের কথায় না যাই; বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ঘুমের ওষুধ খাওয়ায়া লাইব্রেরিতে ধর্ষণ আর হলে নিজের পিস্তলে নিজে গুলিবিদ্ধ হইতে ব্যস্ত, কেউ কেউ দুর্নীতিচর্চার হাতেখড়ি নিতে প্রশ্নফাঁস করে ‘ভাই-ব্রাদার’ ক্যাম্পাসে ঢুকাচ্ছে। দেশের লাখ লাখ কোটি কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে, যার চাপ নিচ্ছি আমি, আমরা, প্রতিদিন। সব ছেড়েছুড়ে দূরে সরে যাওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অনেকেই পালাতে পারছে না, এতটা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো এই রহস্যময় বদ্বীপ। সেসব নিয়ে আলোচনা করাই যায়।

এসবের সাথে চলচ্চিত্রের জাতীয় সেন্সরবোর্ডের কোনো সম্পৃক্ততা টেনে ডার্ক সারক্যাজম করার ইচ্ছা নাই। সিনেমা, কবিতা বা আর্ট দিয়ে রাতারাতি কিছু পালটে যাওয়ার স্বপ্নও দেখি না। নতুন সিনেমা এবং সিনেমার বাজেট সংক্রান্ত কিছু উড়ো খবর সামনে চলে আসলে হাসি। চলচ্চিত্রের পাল ছিঁড়ে হাল ধরায় ব্যস্ত অল্টারনেটিভ ইন্ডাস্ট্রি, মেইন্সট্রীম ইন্ডাস্ট্রি পালে তালি দেয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত আজ বহুদিন হলো। চলচ্চিত্রকে জাতে ওঠাতে বস্তা বস্তা কালো টাকা নিয়ে ব্যস্ত অনুকরণপ্রিয় মিডিয়া সন্ত্রাসীরা। বিজ্ঞাপন বানায়া সমাজ পাল্টানোর ধারণার অস্পষ্টতা প্রত্যক্ষ। তাই কারো কারো মনোনিবেশ লাল গালিচার ফেস্টিভালে, টিনের টুকরায়। কারণ ঘটক বাবু আর জর্জ মেলিয়ে শেষ জীবনে প্রচণ্ড অভাবে ভুইগা মারা গ্যাছে! চলচ্চিত্রের মতো একটা মাধ্যমের শক্তি নিয়া চিন্তা করার কেউ নাই দেশে। মাধ্যম শুধু ব্যবহার কইরা যাচ্ছে, মাধ্যমের প্রতি কোনো দায়িত্ববোধ নাই, কন্ট্রিবিউশন নাই! মৌলিক গল্পের স্ক্রিপ্ট হাতে কয়েকজোড়া জুতা ক্ষয় হওয়ার পর বোঝা যায়, দেশে কোনো প্রোডিউসার নাই। আছে কিছু পার্ভার্ট!

এ দেশের দর্শকের তেমন কোনো দোষ দেখি না এই সন্ত্রাসী ভরা আকাশ-সংস্কৃতির যুগে। তাদের দেখানো হইছে যা তারা তা-ই চেনে। হলিউডের সিনেমা, বলিউডের সিনেমা, টালিউডের সিনেমা। জনপ্রিয়তা জন্মালে এর মধ্যে থেকেই জন্মায়। সিনেমার মতো করে ভালো সিনেমা দেখার সুযোগ এদেশের মানুষের নাই। ইন্ডাস্ট্রি থেকে রুটির পয়সা জোগাইতে তাই গুটিকয় লোক কতিপয় তামিল, মালায়লাম আর কোরিয়ান ছবি দেইখা তা নকল করতে ব্যস্ত। কেউ কেউ টিভি নাটকের জন্য ইরানি স্ক্রিপ্টের বাংলা। এত এত উপজাতির আবাস এই ভূখণ্ডে অথচ মিক্স ব্রেড মানুষের বাংলাদেশি নামক কোনো অথেন্টিক জাতীয়তাবাদের ধারণা নাই, আছে বরিশাইল্যা, নোয়াখাইল্যা, ইত্যাদি। জাতীয় সিনেমার স্বকীয় ভাষা বহুদূরের বিষয়।

তাই এই দেশের চলচ্চিত্রকে জাতে উঠাইতে হইলে হলিউডের ফাইট ডিরেক্টর লাগে, আমেরিকায় পড়াশোনা করা লোক লাগে, স্ক্রিপ্ট সুপারভাইজ করার জন্য সিআইএ এজেন্ট লাগে, বিদেশি ফান্ড লাগে, দেশি ক্রু সস্তায় লাগে, পাতায়ার সী-বিচ লাগে, পিছনে নাচার জন্য অর্ধনগ্ন ইউরোপিয়ান ব্লন্ড লাগে, চেজিং সীন লাগে, সেই সীনের জন্য বিদেশি গ্রিপ লাগে, সারাবিশ্বে ব্যবসাসফল ছবির ক্যামেরাম্যান লাগে, সাধারণ মানুষের ঘাম বাষ্প হওয়া কোটি কোটি টাকা পাচার করা লাগে, আর লাগে কল্লা, কাটা কল্লা না, জ্যান্ত কল্লার বিসর্জন লাগে!

শিল্প হইলো সৃষ্টিশীল অনুকরণ। অনুকরণে আমার আপত্তি নাই, শিশুরা অনুকরণপ্রিয় না হইলে শিখতে সময় নেয় বেশি। কিন্তু শুধুমাত্র হলিউড আর বলিউড কেন? এর বাইরে কেন চিন্তা করা যায় না? কেন এমন দেশের সিনেমা অনুকরণ করবো যে দেশে স্থিতিশীলতা নাই, শান্তি নাই? যে দেশগুলার প্রধান ব্যক্তিরা সাক্ষাৎ অকাল-কুষ্মাণ্ড? গুম, খুন, শিশুধর্ষণের সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদী দেশ হিসেবে এই দেশকে চিত্রায়িত করার কোনো দায় কি অডিও-ভিজ্যুয়াল ইন্ডাস্ট্রি অস্বীকার করতে পারে?

আমাদের সমস্যাবহুল এই দেশ অনেক ছোট। সমগ্র পৃথিবী এক অদ্ভুত চ্যালেঞ্জিং সময় পার করতেছে। এমন সময় অনুপযোগী উদ্ভট, অবাস্তব, মিথ্যা কল্পকাহিনি না বানায়া দেখেন কোন দেশগুলা সবচেয়ে কম কার্বন এমিশন করে, কোন দেশগুলা পীস ইন্ডেক্সে সবচেয়ে উপরে, কোন দেশে কোনো কয়েদি নাই, কোন দেশ থেকে টাকা পাঠাইতে কোনো ঝক্কি পোহাইতে হয় না, কোন দেশে শিক্ষা ব্যবসা নাই; তাদের সিনেমাগুলা দ্যাখেন। সেখান থেকে অনুকরণ করেন, অনুপ্রাণিত হন, মানুষকে সেসব দেখান, রুচি পাল্টানোর ব্যবস্থা করেন, মানুষ পাল্টাবে। সমাজ পাল্টাবে, দেশ পাল্টাবে, ইন্ডাস্ট্রিটাও পাল্টাবে।