দেশি জেন্ডার রিলেশান এবং বিস্তারিত সাহিত্য কার্টুন
লুবনা ইয়াসমিনপ্রকাশিত : এপ্রিল ১১, ২০১৯
এক অনুষ্ঠানে সামনের অতিথি সারিতে বসা ভঙ্গুর স্বস্থ্যের শওকত আলী। পাশে অন্যদিকে ফিরে কিছুতে ব্যস্ত সংস্কৃতি মন্ত্রী। সংস্কৃতি মন্ত্রীর মুখ ফেরানো বিব্রত, ব্যস্ততার কারণ হতে পারে, শওকত আলীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসা এক মাঝবয়সী উঠতি নারী-লেখক, যার মাথায় শওকত আলীর আশীর্বাদ মাখা হাত। প্যাস্টারিং করে, সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসলে কি আর করা। পায়রাদের যা নাছোড় স্বভাব, আবার কিছু পায়রা ঝোপ বুঝে মারে নাছোড় কোপ। নারী-লেখক পরে ঐ ছবি যথারীতি ফেবুতে দিলেন এবং কারো সৎ পরামর্শে হয়তো পরে লোপাটও করলেন। ছবিটা কি শওকত আলীর আশীর্বাদ দেখাতে না কি সংস্কৃতি মন্ত্রীর কাছাকাছি দেখাতে তা যে দিয়েছে সে বলতে পারবে। ক্যাপশনে শওকত আলীকে বাসায় নিয়ে সেবা করার আন্তরিক ইত্যাদি বাবা সম্বোধন। যাই কৈ!
পরিচিত লেখকদের ভেতর দুজনকে জানি যারা তৃতীয় লিঙ্গের এবং সামাজিক পরিচিতি দেন নারী লেখক হিশেবে। বাংলাদেশে তৃতীয় লিঙ্গকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, হিপোক্রেটিকভাবে সমকামী ও লেসবিয়ানদের বেআইনি করে!আমার পরিচিত দুই লেখক তৃতীয় লিঙ্গ থেকে নারী লেখক হয়েছেন, না কি পুরুষ থেকে নারী হয়েছেন, তা আমরা কেউ জানবো না। এটা ওনাদের প্রাইভেসি। কিন্তু সমকামিতার জন্য যদি পুরুষকে নারী হবার সামাজিক ও মেডিকাল চল তৈরি হয় তা একটা গুমোট, মিথ্যাচারী সমাজ তৈরি করবে, করেছেও। যে সমাজে অবদমিত সমকামীরা শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন চালায়। এটা শুধু সমকামিতার ক্ষেত্রে নয়, যে কোন যৌন অবদমনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
কম্পিউটারের জনক, প্রখ্যাত গণিতবিদ এলান টুরিংকে যখন সমকামীতার জন্য পুরুষ থেকে নারী হবার সার্জারি নেবার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল, তখন তিনি আত্মহত্যা করেন। এখন ইউরোপে এধরনের আত্মহত্যার আর কোন সামাজিক পরিস্থিতি নেই। আমাদের সাহিত্যের একটা বড় হামবড়াই হচ্ছে বাস্তববাদিতা। কিন্তু সেটা হামবড়াই ছাড়া কিছু না। আমাদের সাহিত্যের চরিত্রগুলো অযৌন, যার ফলে এদেরকে তিনমাত্রায় দেখা যায় না। অনেক সময় আবেদনে এবং তিনমাত্রিকতায় আমাদের সাহিত্যের চরিত্রের চেয়ে, বিদেশি দ্বিমাত্রিক রোবটও অনেক বেশি আবেদনময়। যৌনতাকে শুধু হেটেরোসেক্সুয়াল দাম্পত্য নির্ভর করে ফেলাতে আমাদের সমাজ, সাহিত্য বর্তমানে একটি এককোষী বিবর্তনে চলে গেছে। লেখকেরা লিখছে ঘাস, ফুল, লতা, পাতা, ইনবক্স সুড়সুড়ি, গ্রাম্য প্রিটেনশান, কথিত আবৃতিযোগ্য গদগদ ভাষার লেখা। যৌনতার ধর্ষণ বা অপরাধী দিকটি সামনে আনা ঠিক আছে। কিন্তু তা সামনে আনা হচ্ছে যত না বেশি ধর্ষণ প্রতিরোধে, তার চেয়ে বেশি যৌনতার উদযাপনের দিকটাকে আড়াল করতে। একই কারণে, যৌন অপরাধীদের ব্যাপারে গা সওয়া সামাজিক দুর্নীতির চল তৈরি হয়েছে।
যৌন হ্যারাসমেন্ট ব্যাপারটাও আমাদের সুশীল সমাজ পুরো গুবলেট করে ফেলেছে। ধরা যাক লেখক ডক্টর আকিমুন রহমানের কথা। কিছুদিন পর পর দেখা যাবে একজন পুরুষ ছাত্র ওনাকে ফুল দিচ্ছে এবং আম্মা ইত্যাদি সম্বোধন করছে, তার ফটো তুলে সামাজিক নেটওয়ার্কে দিচ্ছে, তা উনি ফেসবুক ওয়ালে রাখছেন! এটা কি নাইভ স্টুপিডিটি? না কি জেন্ডার রিলেশান না বোঝার ফল? নারী ছাত্র যদি একই ধরনের ছবি একজন পুরুষ শিক্ষকের সাথে দিয়ে তাকে আব্বা, ভালোবাসি ইত্যাদি সম্বোধন করতো, আমাদের কেমন লাগতো? বলছি না যে ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকদের ফুল দেয়ার ব্যাপারে আইন করতে হবে।কিন্তু তার জেন্ডার রিলেশানগত মাত্রাটি শিক্ষকেরা না বুঝলে ছাত্রছাত্রীদের বোঝাবেন কি করে? আরেকটা হতে পারে যে, এসব থেকে ফুল দেয়ানেয়ার নির্বিরোধ আনন্দটুকু উবে গিয়ে, ছাত্রছাত্রীদের মনে গেঁথে গেলো যে পদবীধারীদের ফুল দিতে হয়। যৌন হ্যারাসমেন্টের সাথে, স্বার্থের বিরোধও/conflict of interest এখানে গুবলেট হয়ে পড়ে। তার ওপর দেখা যায় এধরনের শিক্ষকেরা সমকালীন অপর মেধাবীদের কথা না বলে প্রতিটি পর্যায়ে তেলা মাথায় আরো তেল দেয়া বা মেধাবীদের হটাতে অমেধাবীর বিস্ফোরক প্রবণতার কায়েমি কাঠামোটা আরো পোক্ত করেন।
বিপুলভাবে পরিচিত তসলিমা নাসরিন, অল্প পরিচিত শামীমা বিনতে রহমান এ ঝাঁক থেকে ব্যতিক্রম। কিন্তু ব্যতিক্রম দিয়ে যে কাজ হয় না এবং তাকে তার পিয়ার্সরাই আক্রমণ করে, পাল্লা অন্যদিকে ভারি করতে থাকে তার দৃষ্টান্ত পাচ্ছি আমরা তসলিমার উচ্ছেদে, শামীমার অনুল্লেখে। জুলেখা সিরাপের দেয়ালে শামীমার কাজের নিচে তার সমসাময়িক একজন লিখে দিলেন, গল্প কই এখানে? আমি গল্প পেয়েছি। একই ঘটনা ঘটেছিল মুস্তফা আনোয়ারের ক্ষেত্রে। সৈয়দ হক বাঁচোয়া হলেও খেলারাম খেলে যা, অনেক ভাবে নাবোকফের লোলিটার অনুসরণ। সে অনুসরণ নিয়ে স্থানীয় পাঠকের হুলুস্থুলুর বড় কারণ, যৌনতা ওখানে লাম্পট্যের অস্ত্র, উদযাপনটি একজনের অপরিণত বয়স ও বুদ্ধিবৃত্তিক অপরিপক্বতার বিনিময়ে। মুস্তফা থেকে শামীমার পরম্পরায়, সৈয়দ হক শক্তিশালী সেতুবন্ধন হতে পারতেন, কিন্তু সাহিত্যের যৌনায়িত মাত্রাটির দিকে না গিয়ে সৈয়দ হক চলে গেলেন, নৈর্ব্যক্তিক জাতীয়তাবাদী মাত্রায়। আবার মুস্তফা আনোয়ারের প্রবলভাবে যৌনায়িত ক্ষুর নিয়ে আবু রুশদ বিশদআলোচনা করলেও, যখন অন্যদের চুপ করে থাকতে দেখলেন, আর আগ বাড়িয়ে কিছু বলেন নাই।এখানে সরকারি গণমাধ্যম, বিশেষ করে বাংলাদেশ বেতারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিশেবে মুস্তফা নিজে উদ্যগি হয়ে, এ ধরনের কাজগুলোকে শ্রোতাদের কাছে পরিচিত করিয়ে দিতে পারতেন। সেটা করেন নাই।
তসলিমা যাই বলুন, শুধু সামনে এসে হাটু গেড়ে বসে থাকার জন্য সৈয়দ হক কাউকে আশীর্বাদ করে যান নাই। কিন্তু সৈয়দ হক, মুস্তফা আনোয়ারেরা তাদের একটি শক্তিশালী ফ্যাকাল্টি, যা এক অর্থে সবচেয়ে বেশি ডাইমেনশানাল, তাকে সামনে না আনাতে আজকে পরপর শুধু যে তসলিমা, শামীমা অপব্যাখ্যাতে পড়ছে তাই নয়। একজন ইমতিয়ার শামীম আরেকজন চয়ন খায়রুল হাবিবের জেন্ডার ডাইমেনশানযুক্ত কাজগুলোর রিভিউ করলেও সেগুলোকে সময়ের প্রতিকূলতার হিশাব কষে লোকচক্ষু থেকে সরিয়ে ফেলছেন। দেখা যাচ্ছে জেন্ডার রিলেশান, স্বার্থের বিরোধের সাথে এসে মিশছে ভয় ও পিছুটান। সাহিত্যিক নিজে যদি এই পিছুটানের শিকার হন, তাহলে পাঠকের পরিত্রাণ কোথায়?
বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় না যে ব্যাপক বাঙালি পাঠকের পক্ষপাত রসময় গুপ্ত বা কাসেম বিন আবু বকরের প্রতি। জাপানি পর্নোগ্রাফির বিশেষ ধরন শুঙ্গা নিয়ে শুরু থেকে পিকাসো, আনাইস নিন, হানিফ কুরেশি অনুরক্ত। পশ্চিম বঙ্গের যে কজন উপন্যাসিক চলেন বাংলাদেশে বিক্রির ওপরে, তাদের জনপ্রিয়তার মূল কারণ রোমান্টিক সুড়সুড়ি ও রক্ষণশীলতার ফিউশন। রবীন্দ্রানুরাগি বাংলাদেশি যে কারণে হুমায়ুন আহমেদের স্যাকারিন পছন্দ করে, একই কারণে সে পশ্চিম বঙ্গের লেখক পছন্দ করে। তার মননের ক্ষুধা আছে, কিন্তু সে নান্দনিকভাবে ডায়াবেটিক! নিজেদের হীনমন্যতার কারণে পশ্চিম বঙ্গের প্রকাশনা বিতরণে আমরা যে আন্তরিকতা দেখাই, নিজেদের ব্যাপারে সেটা করি না। একটা শাখা বাদ দিয়ে আরেকটা শাখার বিকাশে ভারসাম্য আসে না।
হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামার প্রশংসা করতে গিয়ে বলছেন, ইলিয়াসের কাজে যে রক্ত, মাংস, অস্থি পাওয়া যায়,তা একই নামের এবং আগে লেখা ওমর শামসের লেখা থেকে পাওয়া যায় না। মানলাম। কিন্তু কথা থেকে যায়। রক্ত, মাংস, অস্থি দলা দলা থাকলে যে একটি কাজের মাত্রা বেড়ে যাবে তা নয়। ওমর এবং ইলিয়াসের দুজনের কাজ পড়ে আমার মনে হয়েছে, একটি ভুগছে রক্তস্বল্পতায়, আরেকটা ভুগছে উচ্চ রক্তচাপে। ইলিয়াসের লেখাটি নামের সংক্রমণ ছাড়িয়ে মাটির মানুষের যে যৌন মাত্রা থাকে তা ধরতে পারে নাই, তা অভীষ্ট বলেও মনে হয় নাই। যাদু বাস্তবতা,সামাজিক বাস্তবতা, পরাবাস্তবতা, উদ্ভট বাস্তবতাসহ সবখানে যৌনমাত্রাটি আমাদেরকে এককোষী বিবর্তনের বাইরে নিয়ে আসে। একটা ঝড়ের তাণ্ডবএবং একজন মানুষের মনের তাণ্ডবের পার্থক্যটি তুলে আনা যায় তার যৌন অবসাদ, অবদমন, উদযাপনের নিক্তি পাল্লায়। এখান থেকে হাসান আজিজুল হক গং একজন মুস্তফা আনোয়ারকে নিয়ে কথা বলেন না, তার একসময়ের নির্দেশিত লেখক শিবির মুস্তফা আনোয়ারদের রেওয়াজি ভাবে এড়াতে, এড়াতে নিজেরা পর্যবসিত হয় এককোষী বিবর্তনে।
শুধু যে আমাদের কথাসাহিত্য ব্যাপক পাঠকের বিচিত্র চাহিদার সমর্থনের পর এককোষী অবস্থায় এসেছে তা নয়। নাটকের ক্ষেত্রে সেলিম আল দীন, আব্দুল্লাহ আল মামুন দুই ভিন্ন পটভূমী অর্থাৎ নাগরিক ও গ্রামীন আবহে কাজ করলেও, তাদের চরিত্ররা সম্পর্ক, বিচ্ছেদ, নৃশংসতায় যৌনতাকে ধারন করেছে নাম কা ওয়াস্তে। মামুনের ক্ষেত্রে দ্বন্দের সূত্রপাত কেবল গরিব ও বড়লোকের দ্বন্দ, সেখানে যৌনতার অবস্থান সুপারফিশিয়াল কোলাকোলির বাইরে যায় না। সেলিমের ক্ষেত্রে যৌনতা কখনো আদিরসের মাত্রা ছাড়াতে পারে নাই। নাটকের এক বড় উদ্ধার এসেছে কবি সৈয়দ হকের কাছ থেকে। তার ইর্ষা নাটকটি যতটা ত্রিমুখি প্রতিদ্বন্দিতার আবহে লেখা, ততটা যৌনতাকেন্দ্রীক নয়। এখানেও কবি মুস্তফা আনোয়ারের নাম নেয়া যায়। সাহিত্যের এবং পার্ফর্মেন্সের মুক্ত যোগসূত্র অনেক ভাষাতে এসেছে কবিদের হাত ধরে। এ থেকে বাংলা ভাষা ব্যাতিক্রম নয়। মাল্টাই জনের চরিত্রায়নগত খোলতাই কবিদের হাতে যতটা হয়, শুধু কথাসাহিত্যিক বা শুধু নাট্যকারের হাতে ততটা হয় না। সৈয়দ হক একাই একশ হতে গিয়ে এখানে যেরকম একজন মুস্তফা আনোয়ারের নাটক প্রবর্তনা অন্যদের কাছে আড়াল করেছেন, সেরকম আজকে যখন আরেকজন কবি চয়ন খায়রুল হাবিব নাটকে শৃঙ্গাররস এবং নৃশংসরসের ভারসাম্য ঘটাতে চাইছেন, তার পথে কাটা ছিটিয়ে দিচ্ছে একাই একশ প্রবনতার প্রডাকশান বয়রা। মাল্টাই জায়গা থেকে হুমায়ুন আহমেদ টেলিভিশান, মঞ্চে, চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন। তার কাজগুলো একসময় নিসন্দেহে একাডেমিক রেফারেন্স হিশেবে ব্যাবহৃত হবে, কিম্বা এর ভেতর তা হচ্ছে। বহুল ব্যাবহার যে মাত্রিকতা বৃদ্ধির বড় শর্ত তা যেরকম নয়, আবার কম ব্যাবহৃত আন পপুলারও মাত্রিকতা বাড়িয়ে দেয় না। শূন্যতা আমরা তৈরি করছি সিস্টেমেটিকভাবে, তার ল্যান্ডফিল থেকে কি ফুটবে তার দায়টুকুও আমাদের।
যৌনতা বলতে আমরা বুঝছি সাহিত্যের, সিনেমার বাজে চরিত্র বা পর্নো। এন্টিহিরো এবং মিডিয়োকারেরা কিন্তু এই এককোষী শূন্যতায় জায়গা করে নেবে, নিচ্ছে। নারী লেখকেরা হত্যা দিয়ে পড়ে থাকে আনিসুজ্জামান, আব্দুল্লাহ আবু সাইয়িদ, সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামদের কাছে এবং সমকালীন অন্য লেখক যাদের লেখাতে যৌনায়িত মাত্রাটি আছে তাদের দল বেধে গুম করে। যাদু বাস্তবতা আছে, রাজনিতিক বাস্তবতা আছে, স্যাটায়ার আছে ভুরিভুরি, ধর্মিয় বিধিনিষেধের বাস্তবতা আরো ভুরিভুরি, কিছুটা এবসার্ডও আছে।কিন্তু সবকিছু অযৌন। এক অর্থে যৌনতা বিরোধীও। এ পরিস্থিতিটাকে বলা যায় স্টার ওয়ারের রিভেঞ্জ অব দা সিদের বাস্তবতা। আজকে আমরা এবং আমাদের বইমেলা পড়েছে, অথর্ব বৃদ্ধ অধ্যাপকদের প্রতিশোধের পাল্লায় এবং তাঁদের হাতে ফুল তুলে দেবার গেইসা রমণীর অভাব নেই। সেটি হিজাব পরেও হচ্ছে, হিজাব ছাড়াও হচ্ছে।