দেবেশ রায়ের গল্প ‘মর্তে পা’

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৭, ২০২০

পশ্চিমবঙ্গের কথাসাহিত্যিক দেবেশ রায়ের আজ জন্মদিন। ১৯৩৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের পাবনা জেলার বাগমারা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মদিনে ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার লেখা ‘মর্তের পা’ গল্পটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

মর্তে খ্রিস্টজন্মের প্রায় দুহাজার বছর ও বুদ্ধজন্মের আড়াই হাজার বছরেরও বেশি অতিক্রান্ত হবার পরও রাজনীতিতে পঞ্চশীল, অশোকস্তম্ভ, ক্রিস্টমাস দ্বীপ, খ্রিস্টান ডিমোক্রেটিক পার্টি ইত্যাদি নাম ব্যবহার করে মানবজাতি এই দুই মহামানবের প্রতি আজও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে, এশিয়া-আফ্রিকা বিভিন্ন দেশ স্বাধীনতা পেয়েছে, পৃথিবীর মুক্তি নামক একটা অজ্ঞাত ব্যাপার নিয়ে অন্তরীক্ষে যুদ্ধ চলছে।

স্বর্গরাজ্যে সেদিনও সকাল হয়েছে। অরুণ সূর্যদেবকে তাঁর সাত ঘোড়ার রথে চড়িয়ে দৈনন্দিন সফরে বেরিয়েছেন জয়া-বিজয়া নিজেদের বাড়ি ছেড়ে শিবের আলয়ে এসে পার্বতীকে সাজাবার জন্য ফুল তুলছেন। নন্দী-ভৃঙ্গীর একজন শিবের বলদকে ভূষি খাওয়াচ্ছেন, আর-একজন তাঁর কাঁধ পরিষ্কার করছেন। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বর্গ কর্মমুখর হয়ে উঠবে। তখন শচীর সদ্যনিদ্রোখিত কাজলহীন চোখ ও রক্তিমাহীন অধরোষ্ঠ, ইন্দ্রাণীর লালিমাহীন কপোল ও কুঙ্কুমবিন্দুশূন্য সঙ্গমসব ত্রুটি সংশোধিত হয়ে যবনিকা উত্তোলনের পর মঞ্চের মত দেখাবো তবে কোটি-কোটি বৎসর পূর্বের স্বর্গ থেকে আজকের স্বর্গের কোনো তফাৎ নেই। এখানে সবই অনাদি ও অনন্ত। নিজেদের কাজকর্ম শেষ করার পর দেবদেবীরা মারা যান আবার পরদিন জন্মগ্রহণ করেন। তাই একদিন গতদিনের উপসংহার বা আগামীদিনের উপক্রমণিকা নয়। স্বৰ্গ শুধু সেদিনের, সেইদিনের, বর্তমানের।

যে-সব দেবদূতদের জন্ম ও যমদূতদের মৃত্যু ঘটানোর দায়িত্ব, তারা এসে নির্দিষ্ট ঘরে অপেক্ষা করছে। চিত্রগুপ্ত এইমাত্র এসেছেন। তিনি খাতা খুলে হিসাব-নিকাশ ঠিক করে দিনের ডিউটি ভাগ করে দেবেন। প্রতিদিন একই ডিউটি। কিন্তু প্রতিদিন তাঁদের একবার করে মৃত্যু হয় বলে দেবদেবীর কিছু মনে থাকে না।

যমদূতদের চেহারাই অপেক্ষাকৃত ভাল। তাদের গায়ে আকাশ-রঙের নীল কোর্তা। যখন মর্তে নামবে, তখন আকাশের রঙের সঙ্গে মিশে যেতে পারবে ও মর্তবাসীরা দেখতে পাবে না, এইজন্যই এ সতর্কতা। কলারের দুই কোণায় মহিষের দুই শিঙ আঁকা, যমরাজার প্রতীক। মাথার চুল ঢেউ খেলানো, ঘাড়ের কাছে সমান করে ছাঁটা। দাড়িগোঁফ নির্মল। বয়স বোঝা যায় না। মর্তের হিসাবে সাতাশ-আটাশ মনে হয়। যমদূতরা এমনভাবে হাসিঠাট্টা করছিল যেন। দেবদূতদের চেহারা তারা কেয়ারের মধ্যেই আনে না।

দেবদূতদের চেহারা বালক-বালক। তাদের গায়ে কোনো পোশাক নেই, কিন্তু অভ্রের ওপর রোদ পড়লে যেরূপ দেখায়, তদ্রুপ এক জ্যোতিদ্বারা তারা আবরিতা যখন মর্তে নামবে তখন সূর্যের কিরণের সঙ্গে (ও মেঘলা দিনে কুয়াশার সঙ্গে মিশে যেতে পারবে ও মর্তবাসীরা দেখতে পাবে না এইজন্যই এই সতর্কতা তাদের বুকের ওপরে পদ্মের পাপড়ি আঁকা-ব্রহ্মার প্রতীক। মাথার চুল এলোমেলো। বয়স বোঝা যায় না। মর্তের হিসাবে কাউকেই বার বৎসরের অধিক বলে মনে হয় না। চোখেমুখে দাঙ্গার সময়কার কিশোরদের মত ভাব কথিত আছে, দেবদানব যুদ্ধের সময় বৃত্রাসুরের ভয়ে গর্ভবতী দেবীগণ ভয়ে ঐরূপ বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিলেন বলে তারপর থেকে দেবদূতদের চেহারা ও-রকম পাণ্ডুবর্ণ।

একজনকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল না সে যমদূত না দেবদূতা তার হাবেভাবে একটা ডোন্ট পরোয়া ভাব। স্বর্গের কোনো দেবের ঔরসে, এক মানবীর গর্ভে এর জন্ম। তার দুঃশীলা মানবী মাতা একে স্বর্গে এনে ফেলে দিয়ে গেছে। অভিশাপেও ভয় পায় নি তখন থেকে এর জন্য ‘উপদেব’ নামক একটি নতুন শ্রেণীর পত্তন করতে হয়েছে। জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যে যখন যা বেশী হয়, এ তখন সেই কাজ করে।

‘দেবদূত নাগসেন’—চিত্রগুপ্তের দরজায় দাঁড়িয়ে বেয়ারা হাঁকল। এই বেয়ারাটা মর্তে বহু পাপ করেছিল, কিন্তু নরকে খুব ভাল ব্যবহার করায় তাকে স্বর্গের সীমান্তে হরিজন পল্লীতে থাকতে দেয়া হয়েছে।

একমাত্র ঐ উপদেব আর এই বেয়ারা—এ দুজনেরই স্মৃতি ও মন আছে। স্বর্গে আর সবাই অনাদি ও অনন্ত।
‘এই তোকে ডাকছে—’, সেই জারজ দেবদূত নাগসেনকে ধাক্কা দেয়।
নাগসেন চমকে ‘অ্যাঁ’ বলে উঠে দাঁড়ায় ও দরজার দিকে এগোয়।
কিছুক্ষণ পর বেয়ারা দরজা খুলে দিল—নাগসেন উড়ে বেরিয়ে গেল।
‘যমদূত বিল্বধর’—

‘এই বেলে, যা—’ উপদেব যমদূতদের একজনকে ধাক্কা দিল। জন্মের পরই নাকি এই যমদূত গাছ থেকে পড়া একটি বেল লুফেছিল, তাই তার এই নামা কিছুক্ষণ পর বেয়ারা দরজা খুলে। ধরল, বিল্বধর উঠে বেরিয়ে গেল।

‘দেবপুত্র উদকসম্ভব’—উপদেব একজন দেবদূতকে ধাক্কা দিলা ধাক্কা খাওয়া জায়গার হাত বোলাতে বোলাতে সে ঘরের দিকে চলে গেল। জলক্রীড়ার সময় নাকি কোন দেবীর গর্ভ থেকে উদকসম্ভব পড়ে যায়, তাই তার ঐ নাম।

চিত্রগুপ্তের বেয়ারা একজন করে দেবদূত ও একজন করে যমদূতকে ডেকে নিয়ে যেতে লাগল। দেবদূত ও যমদূতরা চিত্রগুপ্তের কাছ থেকে হুকুম নিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগল পৃথিবীতে জন্মমৃত্যু ঘটাতো নিজেরা জন্মের পর থেকে অবিকৃত ও অমর হয়ে থেকেও পৃথিবীর গতিকে নিয়মিত রাখতে এরাও ব্যস্ত।

ধীরে ধীরে দুদিকের বেঞ্চই খালি হয়ে গেল। বেয়ারা হাঁকল, ‘দেবমানব্যোঙবোপদেব।’
‘সে ত বুঝতেই পারছি, আর যখন কেউ নেই-ই তখন এ নাম আমার না হয়ে আর কার হবে? আচ্ছা বল ত, এই দেবতাগুলোর ত জিভ দিয়ে কথা সরে না, মাথায় কামধেনুর গোবর ভরা, কোন দুঃখে ওরা এত বড় বড় নাম রাখো ভুতুর বদলে যদি বেলে যায়, তবে ঐ চিত্রগুপ্ত বুড়ো ধরতে পারবে?

দেবমানব্যোঙবোপদেব চিত্রগুপ্তের সামনে এসে দাঁড়ালা চিত্রগুপ্তের টেবিলের ওপরে একটি বিরাট মানচিত্র। তার বাঁ হাতের কাছে দুটি বাক্স—একটাতে কালো ব্যাজ আঁটা আর একটাতে শাদা ব্যাজ আঁটা পিন সামনের মানচিত্র অস্ট্রেলিয়ার ম্যাপের মত সরলরেখায় বিভক্ত। চিত্রগুপ্তের ডান হাতে একটি পেন্সিল এক-একজন দেব বা যমদূত ঢুকছে। তাকে কালো (যমদূতদের) বা শাদা দেবদূতদের একটা ব্যাজ দিয়ে, পৃথিবীর মানচিত্রের এক-একটা কোঠায় পেন্সিলের টিক দিচ্ছেন ও রেজিস্টারে সেই দেব বা যমদূতের নামের বিপরীতে কোন অঞ্চলে তাকে পাঠানো হল সেই অঞ্চলের নাম লিখে রাখছেন। সেই উপদেবকে দেখে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে চিত্রগুপ্ত একবার রেজিস্টারের দিকে তাকালেন—কোনো নামের পাশে এন্ট্রি বাকি নেই, একবার পিনের বাক্সের দিকে তাকালেন—কোনো পিন অবশিষ্ট নেই, একবার ভূমণ্ডলের দিকে তাকালেন—কোনো অঞ্চলও বাকি নেই। তবে?
তোমার নাম?’ চিত্রগুপ্ত জিজ্ঞাসা করলেন।
‘বলো।’—উপদেব বেয়ারার দিকে তাকাল।

বেয়ারা নাম বলল। শুনে রিফিউজিদের ক্যাশডোল দেয়া কেরানীর মত মুখ করে, চিত্রগুপ্ত তাক থেকে রাজশেখর বসু-র ‘চলন্তিকা খুলতেই বেয়ারা নতজানু হয়ে বলল, ‘ও আর কী দেখছেন স্যার, সেই মর্তের মেয়েছেলেটা—‘

চিত্রগুপ্তের দুই ভুরুর মাঝখানের রেখাগুলি ভুরুর ওপরে উঠে গেল, তারপর কোর্টের পেশকারের মত চোখ অর্ধেক বুজে বললেন, ‘আর কোনো জায়গা খালি নেই, তোমার আজ অফ।’
উপদেব বলে উঠল, ‘আমি অফ-টফ চাই না।’
চিত্রগুপ্ত খেকিয়ে উঠলেন, ‘মানে?

বেয়ারা এসে চিত্রগুপ্তের পদচুম্বন করে বলল, ‘প্রভু, আপনি বিস্মৃত হয়েছেন যে এই উপদেবকে আপনি সংরক্ষিত রাখেন। বর্তমানে পৃথিবীতে কখনো জন্ম, কখনো মৃত্যু আকস্মিক ভাবে বেড়ে যায়—‘

চিত্রগুপ্ত যাত্রাদলের ঘুম-পাওয়া বালকের মত জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেন?’
‘প্রভু, এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করছে, তা দমনের জন্য ও পরবর্তী মহাযুদ্ধের অস্ত্র পরীক্ষার জন্য—একসঙ্গে সহসা অনেক লোক মারা যাচ্ছে, আর কোনো কোনো দেশে নাকি মৃত্যুভয় এত বেশি বেড়ে গেছে যে, অবৈধ সন্তান উৎপাদনের মধ্য দিয়েই তারা কোনোরকমে বেঁচে থাকতে চাইছে। তাছাড়া নিত্য নৈমিত্তিক মহামারী-দুর্ভিক্ষ ত আছেই। ফলে পৃথিবীতে জন্ম ও মৃত্যুর কোনো ব্যালান্স বর্তমানে নেই। এই উপদেবকে পাঠিয়ে দিন, ইনি জন্ম বেশি দেখলে দেবদূতদের ও মৃত্যু বেশি দেখলে যমদূতদের সাহায্য করবেন।’।

চিত্রগুপ্ত বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তাঁর ফোস করে একটি নিশ্বাস পড়ল। সেই শব্দ শুনে বেয়ারা বলল, ঐ ত ‘তথাস্তু’ বলেছেন, যাও।’ দেবমানব্যোঙবোপদেব কোনো একদিন ইন্দ্রসভায় শোন। মেনকার একটি গান শিস দিতে দিতে বেরিয়ে গেল। চিত্রগুপ্ত ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন, দেবদূত-যমদূতরা ফেরা পর্যন্ত নিদ্রা। বেয়ারা বাসার দিকে রওনা হল।

অন্যান্য দিন এই দুপুর বেলাটায় স্বর্গে একটু মন্থরতা আসে। গাত্ৰকণ্ডুয়নরত মৃগ, প্রেমরত দেবদেবী ও নিরালায় তপস্যারত দু-চারজন সাধুসন্ন্যাসী গোছের দেবদেবী, প্রত্যেকে একটু আধটু ঝিমিয়ে নেয়।

কিন্তু সেদিন হঠাৎ ঘন কালো মেঘে সূর্য আড়ালে চলে গেলেন। একটা বিরাট জীবন্ত বৃক্ষের মত কালো ধোঁয়া মাটিতে শিকড় চাড়িয়ে হু-হু করে স্বর্গের দিকে বাড়তে লাগল। সেই ধোঁয়ার বনস্পতি বিস্তৃততর হয়ে ঊর্ধ্বে উঠতে লাগল। এত বেগে উঠতে লাগল ও এত বেশি বাড়তে লাগল যে মনে হল এই ধোঁয়ার স্কুপের মাথা স্বর্গ ছাড়িয়ে উঠবে। তারপর একমুহূর্ত বিলম্ব না করে সমগ্র পৃথিবী উপড়ে স্বর্গের কাঁধে ভেঙে পড়ে স্বর্গ ও পৃথিবী শুদ্ধ এই ব্রহ্মাণ্ডটাকে নিয়ে অতল শূন্যতার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়বে।

মদনদেবের নেতৃত্বে সাধারণত স্বর্গে অকালবসন্তেরই আবির্ভাব হয়। স্বর্গের সিংহদুয়ারে যে প্রহরী আছে, তার ও সিংহদুয়ারের ঘণ্টার শরীরে যথাক্রমে বাত ও মরচে। একমাত্র সেই প্রহরীই স্বৰ্গমুখী কালো ধোঁয়ার স্তূপকে দেখতে পেয়েছিল, আর-আর সবাই স্বর্গের ভেতর থেকে সেই কালো ধোঁয়ার ফলে অন্ধকারে খানিকটা বিস্মিত হয়েছিল মাত্রা প্রহরী প্রথমে ভেবেছিল দেবদেবীর কোনো নতুন লীলা হয়ত-বা, কিন্তু সেই কালো ধোঁয়ার স্তূপ যে প্রচণ্ড বেগে ওপরে উঠছিল তাতে তাকে দেবতাদের চেয়েও শক্তিশালী বলে মনে হচ্ছিল এবং প্রহরী ভয় পেয়ে সেই বহুদিনের মরচে ধরা ঘণ্টাটা নাড়াতে লাগল। তার ফলে একটা ফাটা বাঁশের মত আওয়াজ উঠল, যেন ঐ ধোঁয়া দেখে ঘন্টাটারও গলা ভেঙে গেছে। শেষে, বিরক্ত হয়ে প্রহরী তার রান্নাঘর থেকে একটা থালা ও শিলনোড়ার নোড়া নিয়ে এসে, নোড়া দিয়ে থালায় ঠুকতে লাগল।

কোকিলের কূজন, মুগের গাত্ৰকয়ন, মৌমাছির গুঞ্জন ও দেবদেবীর যৌবনউদ্ভিন্ন হওয়ার শব্দের মাঝখানে সেই থালার আওয়াজ শুনে পঞ্চশরের মত নিরাপদ শগুলিতেই যাঁরা দিনে একবার করে মুমূর্ষ হয়ে পড়েন তাঁরা মৃত্যুমুখেই পতিত হতেন, কিন্তু তাঁদের বাপঠাকুর্দারা কেউ কেউ অমৃত খেয়েছিলেন বলে তাঁরা বেঁচে রইলেন।

পাগলাঘণ্টির আওয়াজ শুনে সব দেবদেবী সভাগৃহের দিকে ছুটলেন। ব্ৰহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর সস্ত্রীক মঞ্চের ওপর। তাঁদের প্রত্যেকের দুপাশে দুটি অপ্সরী বিরাট পাখা নিয়ে ব্যজন শুরু করলা ইন্দ্র এসে পড়তেই সভার কাজ শুরু হল। এই সভার পরিকল্পনা করেই বিশ্বকর্মার নাম সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল। ব্ৰহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর তিনজন আর ইন্দ্র—এই দুইপক্ষের মধ্যে কে বড় কে ছোট এই প্রশ্নের মীমাংসা না করেও সবাইকে আঁটিয়ে দিয়েছেন। দেবতাদের বাঁ দিকে আর ডান দিকে দুটো মঞ্চ, সমান উঁচু, সমান লম্বা, সমান চওড়া, সমানসংখ্যক অপ্সরীবেষ্টিত।

ইন্দ্র এসে সিংহাসনে বসে বললেন, ‘নাচফাচের ব্যাপার যা আছে সেরে নাও।’
ভরতমুনি বললেন, ‘হে সহস্ৰমার্তণ্ডময় দেবরাজ ইন্দ্র, যাঁর প্রভায়—‘
‘আরে ঐসব বিশেষণগুলো বাদ রেখে ক্রিয়াগুলো আগে করো, দেখছ না কালো ধোঁয়ায়’, শিব খেঁকিয়ে উঠলেন।
ভরত বললেন, এই বিপকালে কোন গন্ধর্ভ বা অপ্সরাই নৃত্যে সম্মত হচ্ছে না, পাছে কোনো দেব বা দেবী তাঁদের অভিশাপ দেন এবং এই প্রলয়কালে তাঁদের আবার মর্তে যেতে হয়।’

ইন্দ্র বললেন, ন্যাকামি! কেন? অভিশাপ দেয়ার পর ত আবার কাটিয়েই দেয়া হয়। যা নিয়ম, মানতেই হবে। যাও শুরু করো তাড়াতাড়ি।’

মুরজ মুরলী মৃদঙ্গ করতাল বীণা সেতার সব একসঙ্গে বেজে উঠল এবং হাস্যবিনিন্দিতবদনে জার-দিয়ে-পাকানো যাত্রাদলের সখীদের মত একদল অপ্সরা এসে নৃত্য করতে লাগল কিন্তু তাদের দৃষ্টি ছিল সভাদ্বারের দিকে। সমস্ত ঐক্যতানের মধ্যেও সেই পাথর দিয়ে থালা বাজানোর আওয়াজ প্রত্যেকের কানে এসে বাজছিল। কে জানে সেই কালো ধোঁয়া এতক্ষণ কতদূর উঠল।

বিষ্ণু শচীর কানে কানে বললেন, নাও, অভিশাপটা দিয়ে দাও।’
শচী ক্রোধে রক্তবর্ণ হবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন, এমন সময় একদল প্রহরী হুড়মুড় করে সভাগৃহে প্রবেশ করল। শচী ‘উঃ মাগো’ বলে বিষ্ণুর কোলে ঢলে পড়লেন। বীজনরত এক অপ্সরা পাখা ফেলে দৌড় দিল, সেই পাখায় ভরতমুনি চাপা পড়লেন নারদ তাঁর বীণা ও খড়ম। নিয়ে বাহনশালার দিকে দৌড়লেন বিষ্ণু ‘প্রাণাধিকে’ ‘প্রাণাধিকে’ বলে শচীকে ডাকতে লাগলেন। বিষ্ণু মহাদেবের কানে কানে বললেন, ‘কী ব্যাপার, স্বর্গ কি আক্রান্ত হল?
মহাদেব বললেন, ‘কিছু একটা নিশ্চয় হয়েছে।’
বিষ্ণু বললেন, ‘চট করে একটা শাড়ি পরে তিলোত্তমা সাজব নাকি?’
মহাদেব বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তুমি আর কিছু চির-খোকাটি নও, তখন দাড়ি ওঠেনি, মানিয়ে গিয়েছিল, এখন সাজলে—’
এমন সময় মহাদেবের গালবাজানোর মত একটা বোম-বোম ধ্বনি উঠতেই বিষ্ণু বলে উঠলেন, ‘ও আবার আপনি কী শুরু করেছেন!’
শিব বললেন, ‘আমি না ত—‘
তবে?
তবে?
সেই গালবাজানোর শব্দ ধীরে ধীরে উচ্চ থেকে উচ্চতর নাদে উঠতে লাগল। এবং শেষ পর্যন্ত সমুদ্রতঙ্গের ভেঙে পড়ার মত শব্দ করে ভেঙে পড়ল সেই সভাগৃহে। এস্ত-বিক্ষিপ্ত-বিপর্যস্ত পলায়নপর অজ্ঞান দেবতারা সেই সভাগৃহে ছড়িয়ে আছেন যত্রতত্র আর অগণ্য অসংখ্য উলঙ্গ মেয়েদের এক শোভাযাত্রা সভাগৃহে প্রবেশ করল। তাদের সামনে একটা লাল ফেস্টুন। তাতে লেখা, ‘বিশ্ব গর্ভিণী সমিতি’। আর তাদের হাতে অসংখ্য পোস্টার। সেই ফেস্টুনের নীচে দেবমানব্যোঙবোপদেব—সেই জারজ উপদেবা আর সেই উলঙ্গ মেয়েদের বিরাট শোভাযাত্রার মাঝখানে নদীর জলে ফেনার মত ভাসছে সেই কয়েকটি দেবদূত। ভয়ে তারা মারাই যেত, কিন্তু নেহাত দেবতা বলে প্রেস্টিজে লাগে। সেই জারজ উপদেব শোভাযাত্ৰিণীদের বলল, তোমরা বসো।’ সঙ্গে সঙ্গে শোভাযাত্রিণীরা বসে পড়ল, পোস্টারগুলো উঁচু করে তুলে ধরে।

তারপর জারজ উপদেব দ্রুত দেবদেবীদের কাছে গিয়ে বলল, ‘এরা সব মর্তের পোয়াতি মেয়ে। আপনাদের কাছে আর্জি নিয়ে এসেছে। শিগগির নিজের নিজের আসনে ঠিক হয়ে বসুন।’

দেবদেবীরা তাড়াতাড়ি নিজ-নিজ আসনে বসলেন শচীকে স্ট্রেচারে করে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। মহাদেবের আদেশানুযায়ী মদনকে সভায় থাকতে দেয়া হল না। তার আবার যখন-তখন শর নিক্ষেপ করার অভ্যাস। শেষে এই পোয়াতি মেয়েদের মধ্যে কাউকে শর নিক্ষেপ করলেই সর্বনাশা

ইন্দ্র বললেন, ‘দেবমানব্যোঙবোপদেব, তুমিও দেবও বটে, মানবও বটে, তুমিই আমাদের মধ্যে দোভাষীর কাজ করো। বল, কেন এই নারীগণ স্বর্গে এসেছে? কেন যুগযুগান্তের নিয়ম ভঙ্গ করে এতগুলো নারী একসঙ্গে সশরীরে স্বর্গে এল?

উপদেব বলল, ‘তপস্যা করলে দর্শন দেবার জন্য আপনাদের কাউকেই আর কোনোদিন মর্তে যেতে হত না।’
‘কেন? কেন?’
‘মর্ত ধ্বংস হয়ে যাবো।’
‘কেন? কেন? কী হয়েছে মর্তের? কোনো প্রলয়? কোনো দানবের অত্যাচার?
‘সেখানে কি স্বর্গের শাসন শিথিল হয়েছে?
‘দেবদ্বিজেকি আর মর্তবাসীর বিশ্বাস নেই?
‘দেবগণ, অসুবিধা এই যে, মর্তে সময় আছে, আপনারা সময় কাকে বলে জানেনই না। সেই ঘটনাসঙ্কুল সময়কে মর্তে ইতিহাস বলে এই ইতিহাসের এক যুগসন্ধি এসেছে।’
‘যুগসন্ধি কাকে বলে?

‘গত প্রায় বিশ বৎসর ধরে পৃথিবীতে যুদ্ধ নেই, অথচ যুদ্ধের আবহাওয়া ক্রিয়াশীল। একবার ভেবে দেখুন দেবগণ, মৃত্যুর কোনো প্রত্যক্ষ কারণ নেই, তবু যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ, কাল সে প্রেতাত্ম হয়ে বাতাসে মিশে গেল। ভেবে দেখুন দেবগণ, তরণীতে বিক্ষুব্ধ বৈতরণী পারাপারের সময় একটা কানায় সব ভার দিয়ে নৌকাটাকে ডোবাবার কিনারায় নিয়ে বিশবছর চলতে থাকলে, একটিও যাত্রী কি অনাগত আশঙ্কিত মৃত্যু থেকে বাঁচার তাগিদে মৃত্যুর মুখে ঝাঁপ দেবে না ? দেবগণ, বিশ বৎসরের অভিজ্ঞতায় যে মায়ের জানা আছে, হয়তবা গর্ভ থেকে শিশুটি মাটিতে এলে হত্যাকারী আকাশ থেকে অসংখ্য অদৃশ্য সব ছাই উড়ে এসে এসে তার সেই শিশুটাকে ছাই করে দেবে, সে মা কি প্রসবের ভূমিগামী বেদনাকে উধ্বগামী করতে চাইবে না? অথবা হে দেবগণ, স্বর্গের দেবশিশু হাওয়া-ঝরা ফুলের মতন, পৃথিবীকে ভালবেসে পৃথিবীরই শিশু হতে যদি পৃথিবীতে নেমে যেতে চান, আর অন্তরীক্ষে যদি থাকে বোমাফাটা ছাইয়ের সাগর, তবে আর-কোনো শিশু পৃথিবীতে কোনোদিন ভালবেসে জন্ম নিতে চায়? দেবগণ, এতদিন মৃত্যু ছিল খিড়কি দোর। কাল অন্ধকারে ফাঁদ পেতে, ওৎ পেতে, লোভ দেখিয়ে জীবনকে মারত, লুঠত। নিশ্চিত তবুও কুণ্ঠিত ইতিহাসে তার কুণ্ঠা কখনো ঘোচেনি। জীবনের সিংহদ্বার ভেঙেচুরে চুরমার, খান খান, ইটের সে ভগ্নস্তূপে ‘জীবন’ আজ প্রত্নের সংবাদ মৃত্যু, মৃত্যু, মৃত্যু খিড়কি দোরের সেই ওৎপাতা গুপ্তঘাতকের করদরাজ্যে জন্ম তাই প্রত্যাখ্যাত, কেউ বাঁচবে না, জন্ম নিতে চায় না।’

হঠাৎ সেই উলঙ্গ নারীদের শোভাযাত্রা উঠে দাঁড়াল। তাদের কেউ একদিন, কেউ দশ মাসের পোয়াতি তাদের কালো নাভিতল উঁচু কিনা বোঝাই যায় না, কারো গর্ভ এত স্ফীত যে মনে হয় সেই গর্ভের ভারে এখুনি হুমড়ি খেয়ে পড়বে কারো-কারো প্রসব বেদনা উঠেছে। তারা দাঁড়িয়ে উঠে দুই হাতে নিজেদের চুল ছিড়ছে। কোনো-কোনো নারীর চোখের মণি প্রায় আড়ালে চলে গেছে। কারো-কারো স্তন ঝুলে পড়েছে, কারো কারো দুধের বোঁটার পাশে ঘন ছাই রঙের ছোপ ধরেছে। আবার কারো-কারো স্তনে দুধ এত বেশি জমেছে যে ফোঁটা ফোঁটা দুধ তার ফোলা পেটের ওপর পড়ে গর্ভের শিশুটিকে ঢেকে রাখা চামড়ার ওপর দিয়ে গড়িয়ে দুই উরুর মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল, যেন গর্ভের শিশুটি জন্মেই যাতে সাঁতার কাটতে পারে সেজন্য রমণী দুধনদী রচনা করছে।

ঠিক সেই সময় চিত্রগুপ্তের সেই বেয়ারার নেতৃত্বে যমদূতরা রাশি রাশি মৃতদেহ নিয়ে সভায় প্রবেশ করল। ইন্দ্ৰ চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘একী, একী, একী, তোমরা মৃতদেহ নিয়ে স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ করেছ কেন? তোমাদের যমপুরীতে কি স্থানাভাব?’

চিত্রগুপ্তের বেয়ারা হাত জোড় করে বলল, হ্যাঁ প্রভু, বড়ই স্থানাভাব। আজ পৃথিবীতে যে পরিমাণ মৃত্যু হবার ছিল, তার তেষট্টিগুণ বেশি মৃত্যু হয়েছে, যমরাজার ভাগ যমরাজা রেখে বাকিটা আপনাদের পাঠিয়ে দিলেন।’
কেন? কেন?হঠাৎ মৃত্যু বাড়ল কেন?

‘প্রশান্ত মহাসাগরে খ্রিস্টমাস নামক দ্বীপখণ্ডে পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে কি কালো ধোঁয়ায় আকাশ আচ্ছন্ন হতে দেখেননি?
‘দেখেছি, দেখেছি।’
‘সেই পরীক্ষার তেজস্ক্রিয় কণাপাতে—
দেখতে দেখতে যমদূতরা রাশি রাশি শবদেহ এনে জমা করতে লাগল। সেই স্তূপ ধীরে ধীরে বড় থেকে বড় হতে লাগল অবশেষে একটা পাহাড়ের মত হল। দেবগণের বাঁ পাশে বাচ্চাভরতি ফোলা পেট ন্যাংটো মেয়েরা, ডান পাশেমৃতের পাহাড় দুই পাহাড়ের গিরিবর্ত্তে দেবগণ।

পোয়াতি মেয়েদের সেই পাহাড়টা নড়ে উঠল। তারপর পিকাসোর আঁকা ‘যৌবন’ ছবির উলঙ্গ পবিত্র ভাস্বর নীলবর্ণ এক চিরকালের স্বপ্নের মত গর্বিত ভাবে দাঁড়ালা তারপর তাদের শিরা ওঠা, ক্ষয়ে-যাওয়া, অসংখ্য কর্মের অভিজ্ঞানে শালীন হাত দুটোকে নিজেদের ফোলা পেটের ওপর রাখল, যেন-বা স্নেহ জানাচ্ছে নিজের গর্ভস্থ সন্তানদের, দুগ্ধবতীদের দুগ্ধধারা দুই উরু ভেঙে, জানু ভেঙে জাহ্নবীর মত ভূমিতে নামল, তারপর সেই বিরাট পাহাড়টা ঠোঁট ফাঁক করল, তারপর তাদের পেটের ভেতর থেকে একদিনের দুদিনের তিনদিনের বীজ, একমাস দুমাস তিনমাসের জ্বণ, চারমাস পাঁচমাস ছমাসের অগঠিত দেহ, আটমাস নমাস দশমাসের পূর্ণদেহ গর্ভস্থ শিশুরা কচি কচি অস্পষ্ট কণ্ঠে তারস্বরে চিৎকার করে উঠল, ‘আমরা জন্ম নেব না।’ এই চিৎকারের শব্দে সেই পোয়াতি মেয়েদের মুখে একরকমের হাসি ফুটে উঠল। সেই অগম্য অসংখ্য নারীরা ধীরে ধীরে একটিমাত্র দেহ, একটিমাত্র চরিত্র হয়ে উঠছিল। তারা তাদের হাড় জিরজিরে, ময়লা, পোকায় কাটা, ঘেয়ো পা বামনাবতারের প্রথম পদক্ষেপের মত দেবতাদের। ওপর দিলা দেবতারা পাটখড়ির পুতুলের মত ভেঙে গেল। তারপর তারা দুনিয়ার সমস্ত অজাত শিশুকে গর্ভে ধারণ করে সিংহবাহিনী দুর্গার মত নতুন অসুর বধ করতে চলল।