দেবলোকে যৌনজীবন মূলত রূপকধর্মী মানবীয় জগৎ
নয়ন মাহমুদপ্রকাশিত : নভেম্বর ২০, ২০২০
ড. অতুল সুরের লেখা `দেবলোকের যৌনজীবন` গ্রন্থের নির্যাস নিজস্ব চিন্তায় ও লেখনিতে বলার কিম্বা প্রকাশ করার চেষ্টায় ব্রতী হয়েছি। যৌনতা আপাত অর্থে যদিও সরল, তবে সামাজিক বিধিনিষেধ ও মানসিক বৃত্তাবদ্ধতা আর রাখঢাক বিষয়টিকে অনেকটা জটিল ও কূটিল করে রেখেছে। একুশ শতকে গ্লোবালাইজেশন ও বিজ্ঞানের যুগে যে সকল হোমো সেপিয়েন্স মনে করে, `পৌরাণিক উপাখ্যানের নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ফলে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা সম্ভব, যেখানে মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হবে নিরলস অধ্যবসায় ও গবেষণা`— তাদের এই চিন্তার সঙ্গে আমি পুরোপুরি একমত। ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর অগাধ শ্রদ্ধা রেখে বলা যায়, দেবলোকের যৌনজীবনের সন্ধান মর্ত্য থেকে সুদূর অলৌকিক কোনো জাদু বাস্তবতার জগতে নেই, বরং মনুষ্য যৌনতার সঙ্গেই আছে এর অবিচ্ছেদ্য মিল, সাদৃশ্য ও শিকড়।
কাজেই এ কথা অনস্বীকার্য যে, মানুষের কল্পনাপ্রসূত সৃষ্ট পৌরাণিক উপাখ্যানজুড়ে থাকা দেব-দানব-অপ্সরাদের আধিভৌতিক দুনিয়া মূলত এক প্রকার রূপকধর্মী আমাদের এই মানবীয় জগৎই। অপার আকাশে বিক্ষিপ্ত নক্ষত্রের মতো দুনিয়ার সকল পুরাণে ব্যভিচার ও যৌনাচার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। পিতা-কন্যা ও মাতা-পুত্রের যৌনমিলনের কথা দেশ-বিদেশের অনেক পুরাণে বিবৃত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ব্রহ্মা তার নিজ কন্যা শতরূপাকে বিয়ে করে মনুর জন্ম দ্যান। অপরদিকে গ্রীকপুরাণে দ্যাখা যায়, ইডিপাস নিজের মাকে বিবাহ করে মায়ের গর্ভে চারটি সন্তান উৎপাদন করেন। ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলে বিধবা বিমাতা ও বিধবা শাশুড়িকে বিয়ে করা বৈধ। আবার দাক্ষিণাত্যে মামা-ভাগ্নী ও ফুফাতো-মামাতো ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে হওয়ার ব্যাপারে সমাজের অনুমোদন আছে।
বৌদ্ধ জাতক গ্রন্থ থেকে জানা যায়, নিজ সহোদরাকে বিবাহ করা প্রাচীন ভারতে প্রচলিত ছিল। অথর্ববেদে নহূষ তার পিতৃকন্যা বিরজাকে বিবাহ করে ছয়টি সন্তান জন্ম দ্যান। অজাচার ক্ষেত্র ও স্থানবিশেষে আপেক্ষিক। খেয়াল করুন, `ইনসেন্ট অ্যাক্ট ১৯০৮` এ বলা হয়েছে, `যদি কোনো পুরুষ তার নাতনি, মেয়ে, বোন বা মায়ের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়, তবে তা অজাচার বলে গণ্য হবে এবং তাকে দণ্ড ভোগ করতে হবে।` এক্ষেত্রে মানুষ ও দেব সমাজের সঙ্গে অদ্ভুত মিল দেখা যায়। আবার স্বর্গের স্বাধীন অপ্সরা অর্থাৎ উর্বশী, মেনকা, রম্ভা, তিলোত্তমা, বিদ্যুৎপর্ণা, সুপ্রিয়া নৃত্যে-সৌন্দর্যে-দেহ সৌষ্ঠবে যেমন অপরূপা ও অতুলনীয়া— তেমনি মোঘল বাদশাহদের দরবারে বা রাজা রামমোহন রায়ের মানিকতলা বাগান বাড়িতে নৃত্যরতা বারযোষিতদের সঙ্গে উল্লিখিত অপ্সরাদের বিন্দুমাত্র প্রভেদ দেখতে পাওয়া যায় না।
আদিত্য যজ্ঞে মিত্র ও বরুণ উর্বশীকে দেখে, অগ্নি সপ্তর্ষীদের স্ত্রীদের দেখে এবং ইন্দ্র ও সূর্য ঋক্ষরজাকে দেখে শুক্র বা বীর্যপাত ঘটান। এক্ষেত্রে মানুষও একই নিয়মের অধীন। গুরুপত্নীর সঙ্গে ব্যভিচার প্রাচীন ভারতে আখসার ঘটতো। নারীহরণ ও পরকীয়া দেবসমাজের মতো মনুষ্যসমাজেও বিদ্যমান। শ্রী কৃষ্ণের ষোলো হাজার একশো পত্নী। সকলেই নানা দেশ থেকে ছিল কোনো না কোনোভাবে অপহৃতা। সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা বিষ্ণু পরস্ত্রী বৃন্দা ও তুলসীর সতীত্ব নাশ করেন, একইভাবে বৈদিক অন্যতম প্রধান দেবতা ইন্দ্র গৌতম মুনির অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রী অহল্যার সতীত্ব নাশ করেন। ব্যতিক্রম হিসাবে দেবতাদের মধ্যে আত্মসংযমের পরিচয় দ্যান একমাত্র শিব। অপরের রমণক্রিয়া দ্যাখার প্রতি যেমন মানুষের কৌতূহল থাকে, তেমনি কৌতূহল ছিল দেবতাদেরও। উমার সঙ্গে মহাদেবের রমণক্রিয়া পারাবতাকারে দেখে ফেলেন অগ্নিদেব।
আঠারো শতকের পর্যটক আবে দুবোয়া তার গ্রন্থে বিবৃত করেন, দক্ষিণ ভারতে কামাচারী ব্রাহ্মণ পুরোহিত বন্ধ্যাত্ব মোচনের প্রচার প্রচারণা চালান। ফলে ভেনকাটেশ্বর দেবতার কাছে অনেকেই আসতো সন্তান কামনায়। ভক্তিতে প্রীত হয়ে দেবতা রাতে সেই নারীর সঙ্গে মিলিত হতেন। বাস্তবে পুরোহিতের আশ্রয়ে থাকা নারীর সঙ্গে কি ঘটতো তা পাঠকমাত্রই অবগত। এদিক বিবেচনায়, কর্ণাটক দেশের তিরুপতির মন্দির বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। যদি প্রশ্ন করা হয়, স্বর্গ কি অপার্থিব কোনো ভূখণ্ডে অবস্থিত? পুরাণ ও মহাভারত পাঠ ও বিশ্লেষণের প্রেক্ষিতে দ্যাখা যায়, স্বর্গ দেবলোক বা অন্তরীক্ষের কোনো জায়গায় নেই, বরং হিমালয়ের উত্তরাংশে স্বর্গের অবস্থান ও স্থিতি। `দেবলোকের যৌনজীবন` গ্রন্থের পরতে পরতে আছে কচ ও দেবযানী, পুরুরবা ও উর্বশীসহ বিভিন্ন অপ্সরা, দেবদেবীর অজাচার ও ব্যভিচার, রাজমহিষীদের অশ্বসঙ্গম, হিন্দুমন্দিরে মিথুনমূর্তি, আদিবাসী সমাজে বিবাহ প্রথা, মুনি ঋষিদের যৌন সঙ্গমসহ বেদ পুরাণের ইতিবৃত্ত ইত্যাকার প্রসঙ্গে সহজ, সরল ও সাবলীল আলোচনা।
এখন শ্বেতকেতুর পৌরাণিক উপাখ্যানের মধ্য দিয়ে প্রবন্ধের ইতি টানা যাক। একদিন মহর্ষি উদ্দালকের ছেলে শ্বেতকেতু দ্যাখেন, তার মাকে ধরে নিয়ে গিয়ে এক ব্রাহ্মণ জোরপূর্বক যৌনমিলনে প্রবৃত্ত হচ্ছে। এই দেখে শ্বেতকেতু ক্রুদ্ধ হওয়ায় উদ্দালক তাকে ক্রোধ সংবরণ করতে বলেন এবং জানান, `স্ত্রীলোকেরা গাভীদের মতো স্বাধীন। সহস্র পুরুষে আসক্ত হলেও তাদের অধর্ম হয় না— এটিই সনাতন ধর্ম`। তখন শ্বেতকেতু বলেন, `যে স্ত্রী স্বামী ভিন্ন অপর পুরুষে উপগত হবে, সে হবে মহাপাপী`। সেই থেকে শ্বেতকেতু মনুষ্য সমাজে বিবাহ প্রথার প্রচলন ঘটান।