Dead Icarus Painting by Laszlo Mathe

Dead Icarus Painting by Laszlo Mathe

দেবদুলাল মুন্নার গল্প ‘ড্রপসিন’

প্রকাশিত : মে ৩০, ২০১৯

যে কোনো রোববার। হতে পারে চাঁদপুর বা আড়াইহাজার। তার মনে আছে সে এক মূকাভিনেত্রীর সঙ্গে শুয়েছিল। তাতে কি? এমনিতেও, যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। মূকাভিনেত্রী কেন ভাবল? সেটি তার মানসিক জটিলতা। প্রেমিকাই তো! নাম মুসফেকা। কেমন আছো মুসফেকা? লাভ ইউ। খুব অল্পদিন আর দেখা হবে আমাদের। এরপর মরে যাব। কোলন ক্যান্সারে মনে হয়। এসিটা আরেকটু বাড়িয়ে দিলো। তবু ক্লেদ, তবু অনেক অনেক দূর থেকে ব্যাকপ্যাক নিয়ে হেটে আসা টুরিস্টের মতো সে ন্যুব্জ। সহকারী এসে জানতে চাইল, আদিল স্যার চা খাবেন? দিবো? সে এই কথাগুলো শুনল যেন নিঃসঙ্গ শেরপা যখন পর্বতের চুড়ো ছুঁই ছুঁই, তখন ৩০০০ হাজার ফিট নিচে থাকা কোনো বেসমেন্টে আটকে পড়া আরেক শেরপার ক্ষীণ হয়ে আসা সন্ধ্য ও কণ্ঠ থেকে নিঃসৃত শব্দমালার মতো। বেশিদিন নয়, পাঁচদিন আগেই সকালবেলা সে যখন কমোডে বসে তখন আবিষ্কার করে প্রথম ব্যথা। মলের সাথে রক্ত যাচ্ছে, পাশে বিষফোড়া। একরাতেই এমন বিপর্যয়!

কিন্তু ব্যাপারটা তখনও শেষ হয়নি, কোনোভাবেই না। সে হয়তো মুসফেকাকে নিয়ে কয়েকদিন আর একবারও ভাবেনি, কিন্তু পরে, রাত্রিবেলা, যখন সে শুতে গেল, তার কেমন একটা যেন মনে হলো। একটা বাক্স। বাক্সটা তার চারদিকে গজিয়ে উঠছিল। সে চোখ বন্ধ করে ঘুমনোর চেষ্টা করল, কিন্তু সমানে তার চোখের পাতার ফাঁক দিয়ে ভেসে উঠতে লাগল বাক্সটা। ওটা যে আছে সেটা জেনে ঘুমিয়ে পড়া খুব মুশকিল। যখন অবশেষে সে একটু ঘুমোতে পারল, কাঁপতে কাঁপতে। তখন সে দেখল, গ্রীন রোডের গ্রীনলাইফ হসপিটাল, স্কয়ার হসপিটালে সে ছুটছে। এপয়েন্টমেন্ট নিচ্ছে আর ডাক্তাররা একটা টিউব অথবা আঙুল তার পায়ুপথে ঢুকিয়ে দিয়ে বলছেন, অপারেশন, জাস্ট অপারেশন আর্লি ইফ ইউ ওয়ান্ট টু এগেইন এ বিউটিফুল লাইফ।

সে বাক্সর দেয়াল ভেদ করতে হাত চালাল। না, বাক্সটা এখনো আছে। সে চাদর সরিয়ে উঠে এক গ্লাস মদ নিয়ে আবার বিছানায় ফিরল; শুয়ে পড়ল বাক্সটার পাশে। কিন্তু না, বাক্সটা কিভাবে যেন আবার তার ওপরে ফিরে এসেছে। সে বিছানায় যেখানেই শুয়ে থাকুক না কেন, বাক্সটা তার ওপর ঠিকই রয়েছে। নিকুচি করেছে! এটা কিচ্ছু না! ভেবে সে আবার ঘুমোনোর চেষ্টা করল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পেরে উঠল না। সে ঠায় বসে বসে ভাবছিল কিভাবে এই অদৃশ্য বাক্সটার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়। এক ঝটকায় উঠে পড়ে সে বাড়িময় ঘুরে বেড়াল খানিক। খানিক বই পড়ল আরামকেদারায় বসে। একটা সিগারেট খেল। তারপর একটু একটু ঘুম পেতে শুরু করল তার। চেয়ারে বসেই ঢুলতে লাগল সে। তারপর চেয়ার থেকে উঠে বেডরুমে পৌঁছল, বিছানায় উঠল। ঠিক এক মুহূর্ত পরেই তার ঘুম পুরোপুরি কেটে গেল। কারণ সে আবার দেখল সে বাক্সটার ভেতরেই শুয়ে আছে। এসব হয় গত কয়েকদিন থেকে রাতে বিছানায় ঘুমুতে গেলে। এখন সে অফিসে।

আদিল স্যার চা খাবেন? সহকারীর শব্দমালা। খাব, বলে সে মেইল চ্যাক করল। মুশফেকার মেইল, কেমন আছো? কালিজিরা ভর্তা তোমার প্রিয়। ওটি আর খেয় না। ওটি নাকি তোমার শরীরের যে কণ্ডিশন এখন সেটির জন্য ভালো না। অপারেশন কবে করাবে? একজন মেডিসিনের ডাক্তার দেখালে ভাল হতো না? বাই।

মুশফেকা গতকাল সন্ধ্যায় এসেছিল। অফিসের নিচে একটা কফিশপ আছে। বে-ক্যাফে। ওখানে বসেছিল দুজনে। মুশফেকা দুটো আলু পরোটা ও একটা টার্কি ফ্রাই নিয়ে এসেছিল বাসা থেকে। শপ তেকে নিলো পাকা আমের জুশ। খুব যত্ন করে খেতে খেতে আদিল হঠাৎই বলে বসল মুশফেকাকে, তুমি কী জানো, তুমি ৯৮ ভাগ সেলফিশ। ভয়ংকর সেলফিশ। মুশফেকা কখনো বুঝতে পারেনি আদিলকে। সে পাল্টা বলল, আমার তো উল্টোটা তোমাকেই মনে হয়।
বিদায় দেয়ার মুহূর্তে আদিল বলল, আমি তো বেশিদিন বাঁচবো না। তুমি অন্য কারো প্রেমে পড়ো। সে যখন এ কথাগুলো বলল তখন সে এ ও ভাবল এ কথা তার চরিত্রের সাথে যায় না। কে কখন কার প্রেমে পড়বে সে তা বলার কে? মুশফেকা মুখ ঘুরিয়ে কেঁদে ফেলে। মায়া। সব ইল্যুউশন। ইল্যুউশন সেই শ্রীমঙ্গলের বাড়ির ছাদটিও। আহা আমার বাবা, মা। আহা আমার ছাদ।

একটা ছাদ ছিল আমার, জানো? আমাদের বাড়ির ছাদে আমার নিজস্ব ছাদ। চারপাশে গাছের টব। মাঝখানে ঘোরানো সিঁড়ি উঠে গেছে চিলছাদে। জলের ট্যাঙ্ক তারও ওপরে। ওই অত্ত ওপরে উঠলে মনে হয়, এখনো মনে হয়, আমার সবটা শ্রীমঙ্গল দেখা যাচ্ছে। এই তো, এই সবটা আমার। এইসব বাড়িগুলোর একলা ছাদ, উড়ে যাওয়া পায়রা, ঘুড়ি, মেলে দেওয়া শাড়ি, সব্বাই আমাকে ঘিরে আছে। সন্ধ্যে হলে চিলছাদ থেকে শোনা যায় কোথাও না কোথাও শাঁখ বেজে উঠছে। আর বিন্দু বিন্দু আলোয় সেজে উঠছে শহর। অভিসারে যাবে? সেই তখন, চিলছাদে অন্ধকার কাছের মানুষের মত জড়িয়ে ধরে আদর করে। তাকে সব বলে দেওয়া যায়। ঘোরানো সিঁড়ির প্রত্যেক ধাপে মায়া লেগে যায় পায়ের পাতায়। রাতে কখনোবা শবেবরাতের রাতে  ছোটবেলায় এই ছাদে বাজি পোড়াতাম আমরা। আর তারপর অনেক্ষণ চুপচাপ ছাদে বসে থাকতাম আমি আর বাবা। ঝলসে ওঠা আকাশ থেকে আলো খসে পড়ার অপেক্ষায় হাঁ করে। তারও অনেক আগে... বাবা আর একটা ছোট্ট আমি গুটি গুটি পায়ে ছাদে উঠে যেতাম। বাবা আমাকে তারা চেনাত। কোন তারাটার নাম কি। বাবা দেখাত কালপুরুষ। আর গল্প বলত... মাধ্যাকর্ষণ আবিষ্কার হলো কিভাবে, পৃথিবীর কক্ষপথ, কেন ঋতু বদলায়, কেন বৃষ্টি পড়ে, কেন আগুন জ্বলে। বিজ্ঞান। ইতিহাস। আরো কত কি।

কিন্তু আদিল তো এসব ইল্যুউশনকে ইগনোর করে এসেছে এতকাল। সে জানে মৃত্যুর পর কিছুই নেই। নাথিংনেস। সে জানে মানবিক সম্পর্কগুলোও কত কত মুখোশে আবৃত। সে এসবে বহু বহু দিন আগে থেকেই ক্লান্ত। তবু রাহার মুখ ভাসে। রাহা তার মেয়ে। কয়েকদিন আগে সে রাহাকে দেখতে বনানীর বাসায় গিয়েছিল। ওখানে রাহা তার মা রোমেনার সঙ্গে থাকে। রোমেনার সঙ্গে আদিলের ১৮ বছর সংসার করার পর বছর পাঁচেক আগে ডিভোর্স হয়। মাঝে মাঝে মেয়েকে দেখতে যায় সে। সেদিন রাতে আদিল গেলে রাহা ডিনার টেবিলে খাওয়ার সময় বলল, বাবা, তুমি এখনো ভবঘুরে, সারপ্রাইজিং। একটা মুভি দেখেছি ‘আপতক তুম’। দেখবে? আদিলের গলা দিয়ে ভাত ঢুকে না। তবু যেন না চিবিয়েই গিলতে থাকে। এরপর তারা মুভি দেখতে বসে। কুয়াশার ওড়নায় ঢাকা এক সুন্দরী লেক। ডাল লেক। নানা পাটেকর বসে আছে শিকারায়। বেশ ঠাণ্ডা। মেঘলা আকাশে মনকেমনিয়া রং। একফালি সূর্যের আভাস। জলের গন্ধে বুঁদ হয়ে আছে নানা পাটেকর। চোখের সামনে এক আশ্চর্য জলজ নগরী। ভেসে আছে বাড়িঘর, হোটেল, দোকানপাট। সব হাউজবোট। বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ... উড়ে যাওয়া হাঁস। এই দৃশ্যে কল্পনা নানা পাটেকর আর একটা মানুষকে, তার পাশে। হানিমুনে শ্রীনগর যাবে, এরকম একটা শিশুসুলভ কোমল ইচ্ছে ছিল কয়েক বছর আগে ।নানা পাটেকর ঠিক সময়ই পৌঁছে গেছে, কিন্তু যাকে ভালবাসেসে এসে পৌঁছয়নি। ভেবে, হাসছে।

এই শিকারার হাল্কা দুলুনি, জলের গন্ধে বুঁদ হয়ে যাওয়া এই দুপুরবেলা, দূরের পাহাড়ের আর গাছের ছায়া টলটল করছে ডাল লেকের জলে, কুয়াশার আদরে মাখামাখি এই মুহূর্তগুলো বড্ড মধুর। সে অভাব নেই। নৈঃশব্দ্য ডাল লেকের মতই গভীর, মন্থর, প্রাচীন যেন নানা পাটেকর। একা না হতে পারলে আবার তার নাগাল পাওয়া যায় না। সবার জন্যেই রাখা থাকে কিছু না কিছু। ওই জলের গন্ধে নানা পাটেকরের একাকিত্বের নেশা রাখা ছিল । সে হাসে। তখন এক তরুণী এগিয়ে আসে। জানতে চায়, আপনি কাঁদছেন কেন? নানা পাটেকর কিন্তু হাসছিলও। হাসতে হাসতে বলে, আই লস্ট মাই এভরিথিং ম্যম। বাবা ছিল মাওবাদী। ঝাড়খন্দে মারা গেছে। মা ছিল। সে অন্য পুরুষের সাথে পালিয়েছে। আমি ছিলাম সোলজার। এ লট অফ ইনফরমেশন জেনে ফেলেছিলাম বলে আমাদেরই লোকজন পহেলাগ্রামের এক পাহাড়ে এনকাউন্টারে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু বেঁচে যাই। এখন ঘুরে বেড়াই। যা দেখি মনে হয় এখুনি দেখছি। পুরনো রাস্তায় গেলেও নতুন রাস্তা মনে হয়। মুসাফির।

এরপর নানা পাটেকর একটা বাসে চেপে বসে। পরের দৃশ্য, একটা পাহাড়ের চুড়ো, নানা পাটেকর বসা। দুরে কোথাও সাঁওতালি নাচের নূপুর ধ্বনি। ঝুমুর বাজনা। নানা পাটেকর শুয়ে পড়ে। এরপর? আদিল এরকম পাহাড়ের ওপরে তার দাঁড়িয়ে তাকার দৃশ্য বহুদিন এঁকেছে। একটা লাফ। মাত্র ছয় হাজার ফিট ওপর থেকে। তার আগে সেলফোন থেকে সিম খুলতে হবে। মুসফেকার সঙ্গের ছবিগুলো ডিলিট করতে হবে। বাবা, রাহার ডাকে আদিলের তন্ময়তা ভাঙে। বলে, বলো। রাহা বলল, বাবা, তুমি আর আমি একই শহরে থাকি। কিন্তু কত কত দূরে যেন আমরা থাকি। মাসে একদিনবা দেখা হয়। আদিল মেয়েটাকে ভালো করে দেখল। আহা, এই হিরন্ময় মায়াময় মুখটি আর কিছুদিন পর দেখা যাবে না। অন্ধকার।

রমজান মাস। ইফতারির অয়োজন চলছে অফিসে। আদিল রোজা রাখেনি। একটা পোস্ট লিখতে ইচ্ছে করল। লাইনগুলো এমন, আজকাল একটা অদৃশ্য বাক্স আমি প্রায় সময় দেখছি। বাক্স অমর থাকুক। কিন্তু আদিল কিছুই লিখল না। বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। সিগারেট জ্বালায়। আজ কি বার? বুধবার। কাল বৃহস্পতিবার। কাল ফের মুশফেকার আসার কথা। দুটি বাটিকের লুঙ্গি কিনে দেবে। দুটি লুঙি দেখার জন্য আরেক রাত। আরো বহুবার বাক্স দেখা। আদিল হাসলো, নিজেইে নিজেকে বলল, তুই একটা মূকাভিনেতা। তোর অভিনয় শেষ করার জন্য বাক্স তোর পিছু নিয়েছে।

হাসতে হাসতে এত হাসি পায় যা ভৌতিক। যেন থামছে না। যেন এই হাসি সমুদ্রের ঢেউ কুণ্ডুলি পাকিয়ে চক্কর খেতে খেতে মিশে যায় সেরকম। এই হাসি যেন অর্থহীন। সন্ধ্যায় কোনো গ্রামে ধান মাড়াই শেষে ভ্যানে করে নিয়ে যাওয়ার সময় পড়ে যাওয়া কিছু ভেজা ধান। আদিলের হাসির সঙ্গে যেন সেলফোনের রিংটোনের একটা কুহক আছে। বেজে ওঠে। হাসতে হাসতে কল রিসিভ করে আদিল। মুসফেকা একটু চুপ। আদিল বলল, বলো বলো। যেন ভীষণ তাড়াহুড়ো। মুসফেকা বলল, এসব কি হচ্ছে, আমি কী যৌবতি কইন্যার মনের মতো বারবার মৃত মানুষের প্রেমে পড়বো?

কী এর উত্তর? ব্যাখাসমূহ? কারণ তার একটু আগেই দেখি আমরা দেখতে পাই, ইফতারির আগে আগে, রাস্তাঘাট যখন দারুণ সুনসান, যখন মানুষ ভিড় করে দলে দলে কিনছেন ইফতারি, তখন, হ্যাঁ, ঠিক তখন একদল মানুষ একটা বাক্স বহণ করে ফিরছে। আমরা বুঝি আমরা আর আদিল ডাকবো না এখন থেকে। লাশ ডাকবো। বাক্সের ভেতরে যে লাশ, লাশের ভেতরে যে মানুষ সে জাগিবে না আর। এ শহরে, এ জগতে কার মৃত্যুতে কেইবা শোকে কাতর থাকে বহুদিন। তবু তবু আমরা বনানীর রাস্তায় ঠিক তখন দেখি রাহা কেন জানি চোখ মুছে ওড়নায়। আমরা কেন জানি দেখি, এলিফ্যান্ট রোডের এক ডাইনিং রুমে ইফতারির টেবিল থেকে ওঠে মুসফেকা বমি করে, বারান্দায় এসে দাঁড়ায় মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে, উবু হয়ে রাস্তা দেখে। দেখে এক বাক্স যায়। যায় কোনো লাশ। ততক্ষণে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে মানিক। মুসফেকার কাঁধে তার হাত। নাও বক্স কোয়াইট অন দ্য ওয়েস্টর্ন ফ্রন্ট। নাও হ্যাভ টু ডাউনড ইউর ড্রপ সিন।