দেবদুলাল মুন্নার গল্প ‘করোনা হলোকাস্ট’
পর্ব ২
প্রকাশিত : নভেম্বর ১২, ২০২০
ফিলিপের এ মেইলটা পড়েই মূলত আমার সোফিয়ার চোখের কথা মনে পড়ে। ব্লাইন্ডনেসের চোখ! সোফিয়া যখন ঢাকায় ছিল তখন পিজি হাসপাতালে কিছুদিন চিকিৎসক হিসেবে ছিল। পরে বার্লিন যায় মুভি বানানো শিখতে। খেয়াল কত রকমের মানুষের!
মুভিটি দেখা শেষ হওয়ার পর সোফিয়াকে আমি বলি, এইরকম পারভারশন আমাকে দেখানোর জন্য না ডাকলেও পারতে এই লকডাউনের কালে। এটি কেন দেখিয়েছ?
সোফিয়া হাসে। ওয়াইনে চুমুক দিয়ে চুরুটে টান দেয়। বলে, সেক্সুয়াল একসাইটমেন্ট ইমিউন সিস্টেমকে সবল রাখে।
ওইদিন এরপর চলে আসি। এরপর আরও কয়েকদিন সোফিয়া আমাকে ফোন দিয়ে যেতে বলেছে, কিন্তু আমি যাইনি। বড় কারণ, আমাদের ডিভোর্সের পর আমি ওর সাথে যোগাযোগ রাখতে চাইনি। সোফিয়া আসলে কেমন বা তার সাথে কেন আমার ডিভোর্স হলো, সেটি বলা দরকার।
আমরা তখন ঢাকায়। সোফিয়ার আমার সাথে বিয়ে হওয়ার আগে আরেকটি বিয়ে হয়েছিল। সেই পরিবারে তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। সোফিয়ার আগের স্বামীর নাম জাভেদ পিরজাদা। তার মাধ্যমেই সোফিয়ার সঙ্গে আমার পরিচয়। আমার তখন চেম্বার কলবাগান মাঠের উল্টোদিকে ল্যাবএইড ভবনের পাশের ভবনে তিনতলায়। রাত সাড়ে দশটার দিকে জাভেদ পিরজাদা এলেন। ওহ, আচ্ছা বলা হয়নি। আমি একজন সাইকিয়াট্রিক। জাভেদ আমার মুখোমুখি বসলেন। কিছু জানতে চাওয়ার আগেই বললেন, বলা শুরু করি?
পেশেন্ট কে? জানতে চাইলাম।
জাভেদ বললেন, মনে হয় আমার বউ। তার নাম সোফিয়া। বা আমিও হতে পারি। আমি কনফিউসড।
এমন কথায় কৌতূহল জন্মালো। জাভেদ বলা শুরু করলেন, সোফিয়াকে বাইরে থেকে দেখলে বেশ স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। সিঁথি কেটে, পাট করে আঁচড়ানো চুল, পরিপাটি পোশাক-আশাক। চোখের চাহনিতেও কোনো অসুস্থতার চিহ্ন নেই। ভালো করে নজর করছি দেখে আবার বললেন, বিশ্বাস করুন, আমার স্ত্রী ভিনগ্রহের জীব।
আমি হেসে বললাম, এ আর নতুন কথা কী? মেন আর ফ্রম মার্স, উইমেন আর ফ্রম ভেনাস।
জাভেদ কিঞ্চিৎ রেগে গেলেন, মনে হলো। বললেন হাসির কথা হচ্ছে না। সে সত্যিই অন্য গ্রহের জীব। মানুষ সেজে আমার সঙ্গে ঘর করছে।
আপনি কি একা এসেছেন, না সঙ্গে কেউ আছে?
না-না, সে-ই নিয়ে এসেছে জোর করে। বাইরে বসে আছে, ডাকব?
একটু পরে। আগে আপনার সঙ্গে কথা বলে নিই। কতদিন বিয়ে হয়েছে বললেন আপনাদের?
তা সে অনেক দিন হলো। শেষ যেবার হ্যালির ধূমকেতু দেখা গিয়েছিল। বছর তিরিশ আগে।
কবে থেকে বুঝছেন, সে মানুষ নয়?
মাস ছয়েক… বড় ছেলের বাচ্চা হলো… তখন আমেরিকায় গিয়ে ছেলে-বৌয়ের সাথে ছিল মাস তিনেক। ফেরার পর বুঝলাম, মানুষটা বদলে গেছে।
সাইকিয়াট্রিতে রোগটার একটা নির্দিষ্ট নাম আছে, ক্যাপগ্রাস ডিল্যুশান। এই রোগের পেসেন্টদের মনে হয়, কোনো ভণ্ড তাদের কাছের লোক সেজে বসে আছে, তাদের উঠতে বসতে ঠকাচ্ছে। আসল মানুষটাকে বেমালুম হাপিশ করে দিয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, কী দেখে বুঝলেন বদলে গেছে?
জাভেদ কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। তারপর বললেন, সোফিয়ার চোখের মণির রঙ বদলায়।
কী রকম?
এই ধরুন, বিরক্ত হলে সবুজ, রেগে গেলে কটকটে লাল। আজকাল বেশির ভাগ সময় রেগেই থাকে।
অন্য রঙ দেখেননি?
হ্যাঁ, নীল হতেও দেখেছি, তবে সে খুব কম।
জাভেদের চোখের পাতা পড়ল কয়েকবার। স্বাভাবিকের থেকে বেশি দ্রুত। মনে হলো, সামান্য অস্বস্তিতে পড়েছেন। ঠিক কোন সময় চোখের মণি নীল হয়, জিজ্ঞাসা করে তাকে অপ্রস্তুত করার ইচ্ছা হলো না। প্রসঙ্গান্তরে গেলাম, আর কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন কী?
একটু ইতস্তত করে বললেন, বোঝানো মুশকিল। কাছে গেলে একটা হালকা ফুলের গন্ধ পাই আজকাল। আগে কোনোদিন পাইনি।
ছেলের কাছে আমেরিকায় গিয়েছিল বলছিলেন। হয়তো কোনো বিদেশি পারফিউমের গন্ধ। ছেলে কিনে দিয়েছে মাকে। আজকাল ফ্লোরাল পারফিউম খুব পপুলার। কোনো ফুলের গন্ধ চিনতে পারেন?
জাভেদ অন্যমনস্কভাবে চোখ তুলে তাকালেন, বললেন, কয়েকদিন আগে শাহবাগে ফুলের দোকানগুলোর সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন গন্ধটা পেলাম। একটা ভিজে ভিজে মিষ্টি গন্ধ। দেখলাম, স্তূপ করে নালশুদ্ধ পদ্ম বিক্রি হচ্ছে। গন্ধটা সেখান থেকেই আসছে।
জানতে চাইলাম, এসব নিয়ে আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেননি? তিনি কী বলেন?
আরে, জিজ্ঞাসা করেই তো বিপত্তি! আমার নাকি মাথা খারাপ হয়েছে। মা মেয়ে জোর করে আপনার এখানে টেনে আনল।
আপনার ছেলে মেয়ে ক’টি?
ওই দুজনই। ছেলে বড়, দু’বছর হলো বিয়ে দিয়েছি। বৌ-বাচ্চা নিয়ে আমেরিকায় সেটেল্ড। মেয়ে ইডেনে ইংরিজি অনার্স।
সব বুঝলাম, তাহলে আপনি এখন কী করবেন ডিসিশন নিয়েছেন?
সোফিয়ার সঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। আমি আলাদা থাকতে চাই। ভাবছি, ডিভোর্সের মামলা করব।
আমি মজা করে বললাম, আমার মনে হয় আদালতে আপনার কথা টিকবে না। আপনার স্ত্রী বলবেন, তিনি রঙিন কন্ট্যাক্ট লেন্স ব্যবহার করছেন আজকাল। আর ফুলের গন্ধটা পারফিউমের।
তাহলে কী করি? জাভেদকে অসহায় দেখালো।
আপনাকে প্রমাণ করতে হবে, উনি ভিনগ্রহের জীব। নাহলে চুপচাপ মেনে নিয়ে বাকি জীবনটা ওনার সঙ্গেই কাটিয়ে দিতে হবে।
ক্যাপগ্রাস ডিল্যুশন অনেক সময় সাময়িক হয়। কিছুদিন পর নিজে থেকেই সেরে যায়। এমনিতে জাভেদকে আমার সুস্থ স্বাভাবিকই মনে হচ্ছিল। বললাম, আপনার স্ত্রী আর মেয়ের সঙ্গে একবার কথা বলে দেখি।
ইন্টারকমে হারুনকে বললাম, পেশেন্টের সঙ্গে যারা এসেছেন তাদের নিয়ে এসো। দুই নারী চেম্বারের দরজা ঠেলে ভিতরে এলেন। চোখ ধাঁধানো রূপ। দুজনেরই। জানি বলে বুঝলাম, মা-মেয়ে। নাহলে দুই বোন বলে ভুল হতো। দুজনকে বসতে বললাম। ভদ্রলোককে অনুরোধ করলাম, চেম্বারের বাইরে অপেক্ষা করতে। আমি ওনার স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলতে চাই। ভদ্রলোক নিতান্ত অনিচ্ছাভরে উঠলেন।
হারুন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। বলল, আর কোনও পেশেন্ট নেই স্যার। আমি কি যাব?
সেদিন বৃহস্পতিবার ছিল। কাল ছুটি। হারুন সাভার যাবার জন্য উসখুস করছে। সাভারে ওর বউ-বাচ্চা থাকে। বললাম, ঠিক আছে, যাও। এনাকে ওয়েটিং এরিয়ায় বসিয়ে যাও। আপনি চা বা কফি কিছু নেবেন?
জাভেদ মাথা নেড়ে না বলে বেরিয়ে গেলেন। আমার চোখের ইশারায় হারুন চেম্বারের দরজাটা টেনে দিয়ে গেল। খুব সুন্দর মানুষ-জনের কাছাকাছি এলে একটা দমবন্ধ ভাব হয়। চিন্তা ভাবনা এলোমেলো হয়ে যায়। আমি একটু গুছিয়ে নিলাম। এক্ষেত্রে আক্রমণই আত্মরক্ষার শ্রেষ্ঠ উপায়। মা মেয়ের দিকে ফিরলাম, বললাম, কী মতলব বলুন তো আপনাদের? বয়স্ক মানুষটাকে অযথা ব্যস্ত করছেন কেন? চলবে