দুর্নীতি-দুঃশাসন অপরাধ নয়, অপরাধ কথা বলা
রহমান মুফিজপ্রকাশিত : জুলাই ১২, ২০২৩
১৯৩৮ সাল। স্পেনে চলছে গৃহযুদ্ধ। সেখানকার জাতীয়তাবাদীদের প্ররোচনায় জার্মান ও ইতালীয় ফ্যাসিস্ট বাহিনীর বোমা বর্ষণে বিধ্বস্ত স্পেনীয় গ্রাম গোয়ের্নিকা। বিশ্বখ্যাত চিত্রকর পিকাসো গোয়ের্নিকার সেই নারকীয় চিত্র তুলে এনেছিলেন গোয়ের্নিকা চিত্রকর্মে। ফ্যাসিস্ট বাহিনীর বর্বরতার প্রতিবাদস্বরূপ আঁকা ওই যুদ্ধবিরোধী চিত্রকর্ম সারা পৃথিবীতে তুলেছিল আলোড়ন।
তো, একদিন গোয়ের্নিকার সামনে দাঁড়িয়ে এক জার্মান নাৎসি অফিসার পিকাসোকে জিজ্ঞেস করছেন, এটা কি তুমি করেছো?
পিকাসো জবাবে বলেছিলেন, নাহ, এটা তুমি (তোমরা) করেছো।
আওয়ামী লীগ সরকার তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণের অভিযোগে কয়েক বছরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যত মানুষকে কারাগারে পুরেছে তারা তাদের লেখায়, আঁকায়, বক্তৃতা বা তৎপরতায় মূলত রাষ্ট্র ও সরকারের সেই চিত্রকেই তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন— যা দিবালোকের মতো নিরেট সত্য। ক্ষমতাসীনদের সীমাহীন দুর্নীতি, দুঃশাসন, অর্থ পাচার, লুটপাট, সর্বত্র দলীয় আধিপত্য, পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, এক দল ও এক ব্যক্তির শাসন নির্বিঘ্নকরণ ইত্যাদি তৎপরতা তো আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য। এটাও সত্য যে, এর বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ ও প্রতিবাদকে দমন করার নিয়তেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো জঘন্য নিপীড়নবাদী আইনের জন্ম। কয়েক বছরে এ আইন দিয়ে বিরোধী মত, বিরোধী চিন্তা ও তৎপরতা দমন, মুক্তচিন্তা রুদ্ধ করার যে রাষ্ট্রীয় ও সরকারি প্রকল্প জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে তার সঙ্গে হিটলারের ফ্যাসিবাদী আমলেরই তুলনা করা চলে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেই এ রাষ্ট্রের প্রকৃত নিপীড়নবাদী ‘ভাব’ ও সরকারের অসহিষ্ণু, ফ্যাসিবাদী ‘মূর্তি’ ধরা পড়ে। এ আইনে গ্রেফতার ও নিপীড়নের শিকার লোকজনের অধিকাংশই শুধু এ কথাটাই বলার চেষ্টা করেছেন, রাজা তোমার পোশাক কই? এসব বলতে গিয়ে তো লেখক মুশতাক আহমেদকে রিমান্ডের নামে পিটিয়ে কারারুদ্ধ অবস্থাতেই মেরে ফেলা হলো। কার্টুনিস্ট কিশোরকে পিটিয়ে প্রায় পঙ্গুই করে দেওয়া হয়েছিল। প্রীতম দাস, ঝুমন দাস, রীতা দেওয়ান, শরীয়ত বয়াতীদেরও একই আইনে কারান্তরীণ করা হয়েছিল— ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রের ওই ন্যাংটা ছবি প্রকাশ করে ফেলেছিল বলে।
খেয়াল করে দেখুন, খাদিজাতুল কোবরা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী, যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার আজ ১০ মাসেরও বেশি। এর মধ্যে বহুবার জামিন চেয়েও জামিন পায়নি সে। ৩০ জুন, আরও একবার জামিন আবেদন নাকচ হবার পর আদালতে সাংবাদিকদের সামনে খাদিজাতুল কোবরার মা কান্নায় ভেঙে পড়তে পড়তে বলছিলেন, একটা অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিক্ষার্থী, ভার্সিটিতে পড়ছে। সে কতই বা জানবে। ভুল করে কিছু কথা বলেছে তাই বলে দশ মাস জেলে থাকবে? মানুষ চুরি করে, ডাকাতি করে, খুন করে, আরও কত জঘন্য কাজ করে জামিন পায়, কিন্তু আমার মেয়েটার জামিন হচ্ছে না। একের পর এক শুনানি পেছাচ্ছে।
এই দেশে বোমা মেরে মানুষ উড়িয়ে দিয়েও জামিন মেলে। খুন করে, ধর্ষণ করে, কোটি টাকার মাদক, অস্ত্রসহ ধরা পড়েও রাতারাতি জামিন হয়, অথচ একটা মামুলি ফেসবুক অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করে ১০ মাসেও জামিন মেলে না একজন শিক্ষার্থীর। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারি মাসে হাইকোর্টে জামিন মিলেছিল বটে কিন্তু সোমবার (১০ জুলাই-২০২৩), শুনলাম হাইকোর্টের আপিল বিভাগ খাদিজার ওই জামিনাদেশে চার মাসের স্থগিতাদেশ দিয়েছে। কতবড় দাগি ও ভয়ঙ্কর অপরাধী হলে এমনটা হতে পারে! ভাবা যায়!
মেয়েটার অপরাধ, সে করোনাকালে ফেসবুকে একটা ওয়েবিনার হোস্ট করেছিল। তার উপস্থাপনায় ওই ওয়েবিনারে আমন্ত্রিত এক বক্তা সম্ভবত সরকারের সমালোচনা বা বিরোধিতা করে কথাবার্তা বলেছেন। আমাদের বেসরকারি টেলিভিশন বা বিভিন্ন পত্রিকা ও পোর্টালের টকশোগুলোতে এসব হরহামেশাই ঘটে থাকে, আর কি। কিন্তু খাদিজাকে স্পেশালি আটক করা হয়েছে ‘রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলা করার চেষ্টা’, ‘সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে সাধারণ জনগণকে জড়িত করা’, ‘বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার’ অভিযোগে। অথচ যে কোনো রাজনৈতিক অভিমত বা অবস্থান ঘোষণা, সরকারের বিরুদ্ধে নিজের মত প্রকাশ এবং নিজের যুক্তি ও অবস্থান তুলে ধরার অধিকার, এমন কি তার পক্ষে জনমত গঠনের অধিকারও সংরক্ষিত আছে আমাদের সংবিধানে। সে সাংবিধানিক অধিকারগুলোকেই নানা বাহানায় ক্রিমিনালাইজ করার চেষ্টা হচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকারের তরফ থেকে।
খাদিজাতুল কোবরাকে আটকে রাখা, তার ওপর চালানো ‘আইনি নিপীড়ন’এর মধ্যেই গোটা আইনবিভাগ ও বিচারবিভাগের ‘অমানবিকী প্রবৃত্তি’ প্রতীয়মান হচ্ছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা তো নেই-ই বিচারকদের ন্যূনতম মানবিকতাবোধ, বিবেচনাবোধও আজ প্রশ্নবিদ্ধ হলো। ব্রিটিশ আমলেও দাগি রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধে অভিযুক্ত অনেক স্বাধীনতাকামীর প্রতি, বিশেষ করে তরুণদের প্রতি অনুকম্পা বা বিশেষ সিম্প্যাথি প্রদর্শন করে মুক্তি দেওয়ার নজির আছে। পাকিস্তান আমলেও এই ধারা বলবৎ ছিল। অভিভাবকদের ডেকে নিয়ে বণ্ড সই করিয়ে খালাস দেওয়া হতো অপেক্ষাকৃত তরুণ বা শিক্ষার্থীদের। কিন্তু আজ স্বাধীন দেশে সেটুকু দায়িত্ব বা ন্যূনতম অনুকম্পাও দেখাতে রাজি নয় রাষ্ট্র বা সরকার। ব্রিটিশ-পাকিস্তানের চাইতে বর্বরতম আইন দিয়ে মানুষকে দমিয়ে রাখার নীতিই নিয়েছে ক্ষমতাসীনরা। এমনকি নিজেদের গু (গু শব্দটা খুব অশালীন মনে হলে ‘বিষ্ঠা’ পড়ে নেবেন) সব জায়গায় ছড়িয়ে তার অপরাধ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে জনগণের ওপর। নিজেরা দুনিয়ার সব বজ্জাতিতে লিপ্ত হলে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় না, জনগণ তা মুখে তুললেই বলছে- ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। কি অদ্ভূত!
এমন অদ্ভূত ও উদ্ভট সরকার ও তার নীতি; যারা মনে করছে চুরি-ডাকাতি, খুন, ধর্ষণ, লুটপাট, দুর্নীতি-দুঃশাসন বড় অপরাধ নয়, বড় অপরাধ মন খুলে কথা বলা। মন খুলে সত্য বলা ও লেখাই আজ শাস্তিযোগ্য অপরাধে পরিণত হয়েছে!
যখন সত্য বলার জোয়ার ওঠে, যখন বিবেকের বড় পরীক্ষায় দাঁড়িয়ে মানুষ বলতে শুরু করে ‘রাজা তুমি ন্যাংটা’ তখন অবুঝ শিশুটাও এ ট্রেন্ড থেকে বাদ যায় না। তখন রাজনীতি না বোঝা সাধারণ কিশোর, তরুণ, দিনমজুরটাও এ জোয়ার থেকে দূরে সরে থাকে না। সে-ও চিৎকার করতে চায় মানুষের পক্ষে। আমাদের খাদিজাতুল কোবরা সেরকমই একজন ছাত্রকর্মী। সজ্ঞানে সে এমন তৎপরতায় প্রবেশ করেছে বলে আমাদের মনে হয় না। কিন্তু সরকার ভয় পাচ্ছে, আদালত কাঁপছে খাদিজাকে দেখে। মাত্র ১৭-১৯ বছর বয়সী খাদিজাকে তারা মনে করছে এ যাবৎকালের সব থেকে ভয়ঙ্কর ‘বিদ্রোহী’!
২০২০ সালের অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে সম্ভবত খাদিজা ওয়েবিনারটি হোস্টিং করেন। ওই মাসের ১১ তারিখ ও ১৯ তারিখ যথাক্রমে নিউমার্কেট ও কলাবাগান থানার দুই পুলিশ কর্মকর্তার দৃষ্টিগোচর হয় ওয়েবিনারের ফেসবুক ভিডিও। এরপর প্রথম মামলা হয় নিউমার্কেট থানায় ১১ অক্টোবর সকালে এবং দ্বিতীয় মামলা হয় কলাবাগান থানায় ১৯ অক্টোবর রাতে। খাদিজাতুল কোবরার জাতীয় পরিচয়পত্র এবং অ্যাকাডেমিক নথি অনুযায়ী, ২০২০ সালে তার বয়স ছিল ১৭ বছর। অথচ তাকে প্রাপ্তবয়স্ক দেখিয়ে মামলা করা হয়। এ মামলা দুটির ব্যাপারে কিছুই জানানো হয়নি অভিযুক্ত খাদিজাকে। দুই বছর পর ২০২২ সালের আগস্ট মাসে আদালতে মামলার অভিযোগপত্র দাখিল হবার পর বিষয়টা জানাজানি হয়। খাদিজার বোন মনিরা ওই সময় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘এই খবর শুনে আমরা পুরোপুরি হতবাক হয়ে যাই। আমরা কেউই জানতাম না যে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। পুলিশ ২৭ আগস্ট (২০২২) রাত সাড়ে ৯টায় মিরপুরে আমাদের বাসায় এসে তাকে তুলে নিয়ে যায়।’
তিনি বলেন, ‘মামলা যখন করা হয়েছিল তখন তার বয়স ছিল ১৭ বছর। সেক্ষেত্রে মামলার বিষয়টি তার বাবা-মাকে জানানো দরকার ছিল। কিন্তু পুলিশ তা করেনি।’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অন্য অনেক অভিযুক্তের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় খাদিজার ক্ষেত্রে শুরু থেকেই ভিন্ন আচরণ করেছে পুলিশ বা সরকার। মামলা করেও সেটা খাদিজাকে জানানো হয়নি। জানালে অন্তত আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকতো মেয়েটার। এরপর পুলিশ যখন অভিযোগপত্র জমা দেয়, সেখানে বলা হয়, খাদিজা দু’বছর পলাতক ছিল। অথচ সে নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গেছে, ক্লাস করেছে। মামলার পর অনেক অভিযুক্তের ক্ষেত্রে দু’তিন মাসে অনেকের ক্ষেত্রে আরও আগেই জামিন মিলেছে। কিন্তু টানা দশ মাসেও খাদিজার জামিন মিলল না। উপর্যুপরি পেছানো হয়েছে তার জামিন শুনানি। মেয়েটার প্রতি এ অবিচার কেন তার খোলাসা কোনো জবাব এখনো পর্যন্ত সরকারের তরফ থেকে দেওয়া হয়নি। আদালতই বা কেন এমন ‘অমানবিক’ ও ‘বিবেকহীন’ হয়ে পড়লো, তারও হদিস পাচ্ছি না।
কিন্তু এটুকু বুঝতে পারছি যে, একজন সাধারণ শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কোবরার ওপর রাষ্ট্র ও সরকার যে রোষ নিয়ে হামলে পড়েছে তা কোনো সভ্য রাষ্ট্রে সম্ভব নয়। কোনো সভ্য, গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে ভাবাও যায় না। আওয়ামী লীগ যদি মনে করে থাকে, জনগণকে তার দরকার পড়বে না, জনগণের ভোটের প্রয়োজন তার নেই, তাহলে জনগণের ওপর এমন নির্বিবাদ নিপীড়ন হয়তো তাকে আরও কিছুদিন টিকিয়ে রাখবে। কিন্তু জনগণ কখনোই এর হিস্যা নেবে না— এমনটা যদি মনে করে থাকে, বুঝতে হবে ইতিহাস থেকে তারা কোনো শিক্ষাই নেয়নি।
লেখক: কবি