দুর্ঘটনা, প্রতিবাদের ট্রেন্ড এবং জনগণের স্বার্থ
হাসান আজারকাতপ্রকাশিত : মার্চ ২০, ২০১৯
গণ বা সমষ্টি বা জনসাধারণ যা বলে তা ভেবে বলে না, যা ভাবে তা তলিয়ে ভাবে না। যেটা ট্রেন্ড হয় তারা শুধু সেই বিষয়ে কথা বলে থাকে এবং তা পরীক্ষিত। উদাহরণ স্বরূপ, অস্ট্রেলিয়ান সিনেটরের মাথায় ডিম ভেঙে ডিমবালক খ্যাতি পাওয়া ছেলেটির সংবাদ যতটা ট্রেন্ড হয়েছে, নিউজিল্যান্ডের মসজিদে হামলার সময় হামলাকারীকে বাধা দিয়ে অনেক মানুষকে বাঁচানোর ব্যক্তিটির মৃত্যু সংবাদ এদেশের গণ বা সমষ্টির কাছে ততটা ট্রেন্ড হতে পারেনি। তাই অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে জীবন দেয়া ওই মৃত ব্যক্তির চেয়ে ডিমবালকের ছবিটাই সবাই বেশি শেয়ার দিয়েছে, ভাইরাল করেছে। কারণ তলিয়ে ভাবতে পারে না বলেই গণ, সমষ্টি বা জনসাধারণের কাছে নিজের জীবনের বিনিময়ে অন্যকে বাঁচানো লোকটির চেয়ে সিনেটরের মাথায় ডিম ভাঙা ব্যক্তিটিই বীরের আসন দখল করেছে।
তদ্রুপ, গতকাল নির্বাচনী সহিংতায় অনেকে মারা গেছে সে খবরটি ট্রেন্ড হতে পারেনি। তাই কারো সে খবর নিয়ে মাথাব্যাথাও ছিল না। আবার আবরার নামক ছেলেটির মৃত্যু সংবাদ ট্রেন্ড হয়েছে বা আগের নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনটি ট্রেন্ড হয়েছিল বিধায় সকলে এ ব্যাপারটি নিয়ে কথা বলছে। গতকাল সারাদিনে সড়কে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু আবরারের মৃত্যুর সংবাদটাই ট্রেন্ড হয়েছে তাই গণ বা সমষ্টি এই নির্দিষ্ট খবরকে কেন্দ্র করেই সোশ্যাল মিডিয়ায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। আবার হ্যাঁ, যদি গণ বা সমষ্টি বা জনসাধারণের কোথাও প্রত্যক্ষভাবে অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িয়ে থাকে তাহলে তারা ট্রেন্ডের বাইরে কথা বলতে বাধ্য। উপমহাদেশীয় গণ বা সমষ্টি বা জনসাধারণের একটা সাধারণ মিল আছে। তা হলো, প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক স্বার্থ ছাড়া তাদের টনক নড়ে না।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সূচনাও কিন্তু অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকেই হয়েছে। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিদের চেয়ে পূর্ববাংলার মানুষ অর্থনৈতিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল। সেই বঞ্চনাকে পুঁজি করেই কিন্তু পূর্ব বাংলার মানুষের মাঝে অর্থনৈতিক স্বার্থসচেতনতা তৈরি করে মুক্তিযুদ্ধের বীজ বপন করা হয়েছিল। যার ফলাফল স্বরূপ আমরা একটা স্বাধীন মানচিত্র পেয়েছি। কিন্তু স্বাধীনতা কতটুকু পেয়েছি আমরা? বর্তমান প্রেক্ষাপটে যেই অর্থনৈতিক স্বার্থের কথা বলছি সেই অর্থনৈতিক স্বার্থ বলতে কোনো কম্যুনিস্ট/সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা বলছি না। ওগুলা ইনফর্মেশন টেকনোলজির যুগে Old Man`s Tale ছাড়া কিছু না।
অর্থনৈতিক স্বার্থ বলতে এমন স্বার্থকে বুঝাচ্ছি যা দ্বারা সকল শ্রেণিই উপকৃত হবে, বিশেষ করে মধ্য ও নিম্নবিত্তরা। যেমন সকলের জন্য অনার্স পর্যন্ত সম্পূর্ণ অবৈতনিক শিক্ষা নিশ্চিত করা, রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্টে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ, কোম্পানি ট্যাক্স বৃদ্ধি, ব্যয়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বেতন ও মজুরি নির্ধারণ করা, আয় অনুযায়ী ট্যাক্সের পরিমাণ নির্ধারণ করা (যার আয় যত বেশি তার ট্যাক্সের হার তত বেশি নির্ধারণ করা), স্কয়ারফিট অনুযায়ী বাড়িভাড়া নির্ধারণ করা, জনগণের প্রয়োজন হওয়া মাত্র তাকে বিনামূল্যে সরকার কর্তৃক সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেয়া, ফ্রীতে রোগ নির্ণয়ের টেস্ট করানো, প্রাইভেট হাসপাতালের লাইসেন্স বন্ধ করে দেয়া, মানসম্মত সরকারি হাসপাতালের সংখ্যাবৃদ্ধি ইত্যাদি। এগুলো সাংবিধানিকভাবেই প্রত্যেক জনগণের মৌলিক অধিকার।
দুঃখের বিষয় হলো, প্রথাগত অর্থনৈতিক কাঠামো বা মডেলের পরিবর্তে উপরে আলোচ্য জনগণের অর্থনৈতিক স্বার্থ নিয়ে রিসার্চ করে একটা নতুন কাঠামো বা মডেল ডেভেলপ করার চিন্তা আমাদের ডান-বাম-রক্ষণশীল-প্রগতিশীল কোনো বুদ্ধিজীবীই করে না। অথচ এধরণের অর্থনৈতিক স্বার্থই জনগণকে একাত্ম করতে যথেষ্ট। জনগণ কিছু নির্দিষ্ট বিন্দুতে একাত্ম হলেই এই মরচে পড়া সিস্টেমটাতে বিশাল পরিবর্তন আনা সম্ভব।
আমাদের বুঝতে হবে, একজন শ্রমিক ও একজন ছাত্রের যদি সমান অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা থাকত তাহলে দুই বাসের বেপোরোয়া পাল্লার শিকার হয়ে কেউ প্রাণ হারাতো না, কেউ কারো বিরুদ্ধে ফাঁসির দাবি নিয়ে রাস্তায় নামতো না। সঠিকভাবে বাস চালানোর শিক্ষা পাওয়া বাসচালক শ্রমিক ভাইটির বেশি যাত্রী নেয়ার তাড়া থাকতো না, সে নিরাপদ গতিতে গাড়ি চালাত এবং ছাত্র ভাইটিও নিশ্চিতে জেব্রাক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হয়ে যেত।