দিব্যেন্দু পালিতের গল্প ‘হিন্দু’

প্রকাশিত : মার্চ ০৫, ২০২১

কথাসাহিত্যিক দিব্যেন্দু পালিতের আজ জন্মদিন। ১৯৩৯ সালের ৫ মার্চ বিহারের ভাগলপুর শহরে তার জন্ম। ১৯৫৮ সালে পিতৃবিয়োগের পর চলে আসেন কলকাতায়। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে জন্মদিনে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিশেবে তার লেখা ‘হিন্দু’ গল্পটি পুনর্মদ্রণ করা হচ্ছে:


প্রতিদিনের মতো আজও ভোরবেলায় গঙ্গাস্নান সেরে দ্রুত হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন মথুরানাথ। খালি পা, পরনে ধুতি, গায়ে নামাবলি, কপালে তিলক, হাতে তামার পাত্রে গঙ্গাজল। সুগৌর পায়ের পাতায় জল শুকিয়ে গেলেও মাটি লেগে আছে এখনও। মুখে অস্ফুট গীতার শ্লোক। প্রতিদিনের এই নৈষ্ঠিকতা শীতে বাতাসের ছোবল থেকে বাঁচায় তাকে, গ্ৰীষ্মে হয়ে ওঠে ক্লান্তিহর। নিতান্তই অসুস্থ না হয়ে পড়লে গত তিরিশ বছরে এই অভ্যাসে ছেদ পড়েনি কখনও।

দশ বারো বছর আগে ভোরের স্নানযাত্রায় সঙ্গী পেতেন কাউকে কাউকে। তাঁদের কেউ মারা গেছেন, কেউ অথর্ব, কেউ বা রামপুর ছেড়ে চলে গেছেন অন্যত্র। শেষ সঙ্গী বনোয়ারিলাল মারা যাবার পর এখন তিনি একা। নতুন কেউ আসেনি। মথুরানাথ জানেন দিনকাল পালটে গেছে, আরও পালটে যাচ্ছে ক্রমশ। শুদ্ধাচার বিনষ্ট হবার মুখে। মানুষ এখন ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করে, রাজনীতি করে; কিন্তু ধাৰ্মিকতা মানে না। এই যে এখন একা একাই গঙ্গাস্নান করতে যান তিনি—একাই স্পর্শ করেন প্রত্যুষের নদীজল, এক বিচিত্ৰ উপলব্ধি স্পর্শ করে যায় তাঁকে। মনে হয় তিনি যেমন গঙ্গার, তেমনি প্রতি ভোরে গঙ্গাও অপেক্ষায় থাকেন তাঁর—তাঁকে সংস্পর্শ দেবার জন্যে থেমে থাকেন কিছুক্ষণ। তিনি যখন থাকবেন না তখন নদী অন্যমনস্ক হবে।

দশ বারো বছর আগে অবশ্য নদী এতটা দূরে সরে যায়নি। তখন মাইল দুয়েক দূরে খঞ্জরপুর ঘাটে গেলেই হত। মূল স্রোত ক্রমশ বাঁক বদল করতে শুরু করায় চড়া পড়তে শুরু করে খঞ্জরপুরে। নদী আর নদী থাকেনি। পাক, আগাছা আর সর্ষে গাছের মধ্যে দিয়ে ক্ষীণ যে জলধারা এখন বহে যায় ওখান দিয়ে তাতে পায়ের পাতা ভেজে না। সুতরাং যেতে হয় অনেকটা দূরের পীরপুর ঘাটে—যেখানে গঙ্গা আজও নদী, বেশ চওড়া ও গভীর, সারাক্ষণ টলটল করে জলের গতিতে।

বাষট্টি বছরের মথুরানাথ পাণ্ডের এই খেয়াল পছন্দ করে না তার বাড়ির লোকজন—স্ত্রী কৌশল্যা, মেয়ে বিন্দিয়া, ছেলে বিপিন এবং পুত্রবধু নীতা। এমনকী কাজের লোক গয়ারাম, লছমিও। দিনকাল খারাপ। ইদানীং কোথাও তেমন কিছু না ঘটলেও গত দাঙ্গার পর থেকে একটা চাপা আশঙ্কা যে ছুয়ে থাকে রামপুর ও তার আশপাশের মানুষজনকে, কেউই একা হতে চায় না—সেটা কে না বোঝে!

মথুরানাথের ছেলে বিপিন আইন পাশ করেছে পাটনা থেকে। প্র্যাকটিস করে পাটনা, রামপুর দু’জায়গাতেই। ভোর রাতে উঠে বুড়ো বাপের গঙ্গাস্নানে যাওয়া নিয়ে মা কৌশল্যার অনুযোগ শুনে কিছুদিন আগে তাকে বোঝাবার চেষ্টায় বলেছিল, ‘বাবুজি, সুবহ ঘর মে আস্নান করনে সে আপকা ধরম ঝুটা হো যায়গা কেয়া? বুড়াপে মে কুছ শোচ বিচার চিন্তা আনা চাহিয়ে। আখির হামলোগো কে ঔর ভি তো দেখিয়ে! মা কিতনি রোতি হ্যায়!’

শুনে হেসেছিলেন মথুরানাথ। যেমন হাসেন, স্বচ্ছন্দে।

‘দেখো বেটা, মেরে লিয়ে চিন্তা নেহি করো। ধরমকে চিন্তা মনুষ্যকে আপনা আপনা হোতা হ্যায়। যেইসে তুমারা আঁখে দিখাত হ্যায় হম তুমারা পিতা হু—ঔর মে দেখতে হাঁ তু মেরা পুত্র হ্যায়। হম হিন্দু হু—অগর মেরা আত্মা শুদ্ধ রহে, বিশওয়াস ঠিক রহে, তো মেরা কাজকাম ভি ঠিকই রহেগা। লাগাতার তিশ বত্তিশ সাল আস্নান মে গিয়া, লীট ভি তো আয়া অবতক! কুছ অনিষ্ট তো নেহি হুয়া!’

‘আপকা বাত সহি হ্যায়৷’ বিপিন বলেছিল, ‘লেকিন আচানক কুছ হো যায় তো! অনিষ্ট আশমান সে হি ঝুঁকতা হ্যায়—‘

‘পরন্তু ইয়ে অনিষ্টকে বাত ভি নেহি হ্যায়৷’ ছেলেকে এইভাবে আশ্বস্ত করে স্বভাব্যবশত গীতা থেকে উচ্চারণ করেছিলেন মথুরানাথ, ‘ভবত্যত্যাগিনাং প্ৰেত্য ন তু সন্ন্যাসিনাং ক্কচিৎ। বেফিকির রহো৷’

মথুরানাথের চাপে পড়ে একদা সংস্কৃতচর্চা করার সময় গীতা পড়েছিল বিপিন, সে জানে এই শ্লোকাংশের অর্থ কী। মথুরানাথ কর্মফলে বিশ্বাস করেন না, গাৰ্হস্থ্য জীবনযাপন করলেও সন্ন্যাসীর শুভচারিতা তার রক্তে—মোক্ষলাভের প্রত্যাশা নেই। জ্ঞান হবার পর থেকেই বিপিন দেখছে মানুষটা ধাৰ্মিক, ন্যায় অন্যায় মানেন, শ্রদ্ধা করেন নিজের হিন্দুত্ব ও পৈতেকে। এ অঞ্চলের হিন্দু, মুসলমান, অন্ত্যজ সব মানুষই চেনে তাকে, সম্মান করে। আগে যখন চারদিকে সব মানুষের মধ্যে সদ্ভাব, সম্প্রীতি ছিল তখন বহু লোক আসত তার কাছে। ঘনিষ্ঠরা বসত, শরবত খেত, কথা শুনত তার। এখন কানহাইয়ালালজি, দয়াচরণ মিশ্র, জানকীনাথ চৌধুরী এবং এমনই প্ৰবীণ দু’চারজন ছাড়া নিয়মিত আসেন না কেউ। নতুনদের সঙ্গে বয়সের ব্যবধান, রুচির ব্যবধান, একটু আধটু ভাষারও ব্যবধান। তবে সম্মানটা পান।

বাপকে নিয়ে বিপিনের চিন্তার কারণও ও-ই, বয়স। আগের মতো সবল, সমর্থ নেই। ঠিকঠাক অ্যাটাক না হলেও বছর তিনেক আগে হার্টের অসুখে ভুগেছিলেন বেশ কিছুদিন। চিনচিনে ব্যথা হত বুকে, বাঁ হাতে। চিকিৎসা করাতে হয়েছিল পাটনায় নিয়ে গিয়ে। ডাক্তার স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে বললেও বেশি পরিশ্রম করতে মানা করেছিল। কে শোনে! রোজ ভোরে এই গঙ্গাস্নান করতে যাওয়া এবং ফিরে আসাটাকে মথুরানাথ নিজে স্বাভাবিক মনে করলেও অন্যরা করে না। একা একা যাতায়াত, সাঁতার জানেন না—কোনও দিন হঠাৎ কিছু ঘটলে টেরই পাবে না কেউ। অন্য ধরনের ভয় ছাড়াও রাস্তাঘাট খারাপ, যখন বেরোন তখন ঘুটফুট করে অন্ধকার। হোঁচট খেতে পারেন, বা পাটনা, মোকামা, ভাগলপুর, সাহেবগঞ্জ থেকে আসা যাওয়া করে যেসব লরি আর ট্রাক, অসাবধানে চাপাও পড়তে পারেন সেগুলোর কোনওটায়।

ওদের আশঙ্কায় ভুল নেই কোনও। কোতোয়ালিতে তাদের বাড়ি থেকে পীরপুর ঘাটের দূরত্ব কম নয়। এদিক ওদিক ছ’ক্রোশ তো বটেই। এতটা রাস্তা পায়ে হেঁটে কেউই পার হয় না আজকাল। দরকারও পড়ে না। রামপুরের যে অংশটুকু শহর হতে হতেও পুরোপুরি হয়ে ওঠেনি এখনও, তার একদিকে কোতোয়ালি থানা, রেলস্টেশন, হনুমান মন্দির, বাজার; অন্যদিকে পোস্টাপিস, হাসপাতাল, রামমন্দির আর কাছারি—মোটামুটি দেড় দু’মাইলের মধ্যেই অঞ্চল সীমাবদ্ধ। তাও বসতি মাঝখানে যত ঘন আশপাশে তা নয়। রামপুরের ওপর দিয়ে বিহার স্টেট ট্রান্সপোর্টের বাস যায় এক দেড়ঘণ্টা অন্তর; শহরের মধ্যে সাইকেল চলে, সাইকেল রিকশা আছে বেশ কয়েকটা, মোটর আছে দু’চারজনের। আর বাহন বলতে ঘোড়ায় টানা এক্কা আর গোরুর গাড়ি। সেগুলি যাতায়াত করে রামপুরের আগের বসতি নাথচৌক থেকে পরের বসতি ছান্দেরি পর্যন্ত। বাকি পথের খবর রামপুরের মানুষ রাখে না। বছর দুয়েক আগে দাঙ্গার পর থেকে এটা হিন্দুদেরই জায়গা। আগে কংগ্রেসের দাপট ছিল, এখন বিধানসভা নির্বাচনে অধিকাংশ লোক ভোট দেয় বি জে পি-কে। যে কয়েক ঘর মুসলমান অবশিষ্ট ছিল তারা আস্তে আস্তে সরে গেছে ছান্দোরির দিকে। ওদিক থেকেও কিছু হিন্দু চলে এসেছে এদিকে। নিতান্তই দায়ে না পড়লে এখন কেউই আর এদিক ওদিক করে না।

প্রায় ছ’মাইল রাস্তা হেঁটে এসে মথুরানাথ যখন বাড়ির কাছাকাছি, তখন আর ভোর নেই, সূৰ্য উঠে গেছে, নরম রোদ ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে চারদিকে। পথ হাঁটার পরিশ্রমে ঘাম ফুটেছে তাঁর কপালে। ঘাম অনুভব করছেন নামাবলির নীচে, পিঠে ও বুকে। গরম পড়তে শুরু করেছে, দুপুরের দিকে ছোটখাটো ধুলোর ঝড় বয় মাঝে মাঝে। এরপর বাড়িতে পৌঁছে দরজার শিকল নাড়লেই দরজা খুলবে। বেশির ভাগ দিনই ছুটে আসে মেয়ে বিন্দিয়া কিংবা পুত্রবধূ নীতা, যে সেদিন রাজস্বলা নয়। গঙ্গাজলের পাত্ৰটি হাতে নিয়ে পৌঁছে দেয় পুজোর ঘরে। নিশ্বাস সহজ করে তারপর উঠোনের টিউবওয়েলের সামনে গিয়ে দাঁড়াবেন মথুরানাথ। অনুগত দয়ারাম জল পাম্প করলে সেই জলে পা ধোবেন তিনি, আচমন করবেন। গা থেকে নামাবলি খুলে পরিষ্কার গামছায় গা হাত পা মুছে চলে যাবেন পুজোর ঘরে। মিনিট দশেক চোখ বন্ধ করে চুপ করে বসে থাকবেন শ্বেতপাথরের রাম ও কৃষ্ণের মূর্তির সামনে। বেলপাতায় গঙ্গাজল ও চন্দন নিয়ে ছিঁটোবেন তাদের পায়ের কাছে, দু এক ফোটা জল মুখে ঠেকিয়ে উঠে পড়বেন। এখন তাঁর বারান্দার খাটিয়ায় গিয়ে বসবার সময়। পিতলের গ্লাসে ঠাণ্ডা দুধ নিয়ে আসবে কৌশল্যা। খাবেন। তারপরই ক্রমশ মিশে যাবেন গাৰ্হস্থ্য জীবনে।

কিন্তু, প্রতিদিনের অভ্যস্ত জীবনযাত্রায় বাধা পড়ল আজ।

মথুরানাথ লক্ষ করলেন প্রায় তাঁদের বাড়ির কাছে বড় বটগাছের সামনে জটলা করছে সাত-আটজন লোক৷ একজন দাঁড়িয়ে আছে সাইকেল নিয়ে৷ আর কিছু দেখবার আগেই দ্রুত এগিয়ে আসা সুলতানগঞ্জ-ছান্দেরি বাসের ধুলোয় দৃষ্টি আচ্ছন্ন হল তাঁর৷ বাসটা চলে যেতে জটলার সামনে এসে থেমে দাঁড়ালেন তিনি৷ সঙ্গে সঙ্গে ভাঁজ পড়ল কপালে৷

অল্প চওড়া পিচের রাস্তার পাশে ধুলোয় পড়ে আছে একটা উলঙ্গ লোক৷ দেখে মনে হয় মাঝবয়সি৷ কোমরে ময়লা ফিতের গিঁট বাঁধা; কিন্তু সেটার সঙ্গে জড়ানো পাজামাটা ছিঁড়ে খসে যেতে যেতে এমন আকার ধারণ করেছে যে, শরীর আড়াল হয় না৷ গায়ে জামার মতো একটা কিছু আছে বটে, কিন্তু সেটাও এমন ছিন্ন যে, বাঁ হাতের ওপর দিকে একটা অংশ লটকে থেকে বাকিটা চলে গেছে লম্বালম্বি শুয়ে থাকা শরীরের নীচে৷ ছিন্ন কাপড় এবং নগ্ন শরীর, সমস্তই কাদা মাখা৷ যেন পাশের নর্দমায় শুয়ে ছিল বেঁহুস হয়ে সেখান থেকে তুলে এনে কেউ শুইয়ে দিয়ে গেছে রাস্তায়৷ এমনও হতে পারে লোকটা নিজেই যাচ্ছিল কোথাও—এগোতে পারেনি৷

সেজন্যে নয়৷ লোকটা চোখে পড়ছে অন্য কারণে৷ মুখের খানিকটা ও শরীরের কিছু অংশ বাদে তার গোটা শরীরে ঘা৷ মাথায়, গলায়, বুকে, হাতে, কোমরে, তলপেটের নীচে, হাঁটু ও পায়ের পাতা—সর্বত্র৷ কোনওটা আকারে ছোট, কোনওটা শুকোতে গিয়েও শুকোয়নি, কোনওটা চামড়া উঠে, পুঁজ জমে বেশ দগদগে৷ বিশেষত অণ্ডকোষ ও লিঙ্গের যা চেহারা, চোখ খুলে দেখা যায় না৷

অভিজ্ঞ মথুরানাথ চোখ ফেরালেন না তবু৷ খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করলেন লোকটার ডান চোখ পুরোপুরি বন্ধ থাকলেও বাঁ চোখ সামান্য খোলা৷ এভাবে অচেতন শুয়ে থাকা সত্ত্বেও লোকটা যে মরে যায়নি তা বোঝা যায় তার গর্তে ঢোকা পেট, পাঁজরা বেরুনো বুক ও কণ্ঠনালীর ওঠানামা দেখে; মুখ ও গায়ের ঘায়ে মাছি বসলে হঠাৎ কখনও কেঁপে ওঠা দেখে৷

মথুরানাথকে দেখে সেখানে জড়ো হওয়া লোকগুলির আলোচনা থেমেক গিয়েছিল৷ পথ-চলতি আরও দু’একজন এসে দাঁড়িয়েছে ইতিমধ্যে৷ সামান্য ঝুঁকে-দেখা অবস্থা থেকে সোজা দাঁড়িয়ে হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন মথুরানাথ৷ এই রাস্তা দিয়েই ভোরে গঙ্গাস্নানে গিয়েছিলেন তিনি, তখন চোখে পড়েনি! তারপরেই তাঁর মনে হল কৃষ্ণপক্ষ চলছে, যে-সময় তিনি গিয়েছিলেন তখন চারদিকে ঘন অন্ধকার, নিজেকেই হাঁটতে হয়েছিল সাবধানে৷ এমনও হতে পারে, দেহটা তখনও এইভাবেই পড়েছিল এখানে৷

আশপাশের লোকগুলির মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে মথুরানাথ জিজ্ঞেস করলেন, ‘কব সে গিরা হ্যায় ইহাঁ পর?’

‘কেয়া মালুম, পণ্ডিতজি!’ একজন বলল, ‘হম তো ব্যস অভি অভি দেখা৷’

আর একজন বলল, ‘বিচারা! করিব মরণে বালা হ্যায়৷’

‘এই সে মত বোলো, বাবুয়া৷’ দ্বিতীয় ব্যক্তিকে বললেন মথুরানাথ, ‘শ্বাস ঠিক হ্যায়৷ জীবিত হ্যায়৷ অভি আসপাতাল মে লে যানা চাহিয়ে—বাঁচ যায় গা—’

তখন প্রায় সকলেই মাথা নাড়ল গুঞ্জন তুলে৷

যে-যুবকটি সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, এবার তার দিকে তাকালেন মথুরানাথ৷

‘কী নাম ছে?’

‘জি, গিরধারি৷’

‘তো এইসে করো গিরধারি বাবুয়া, পুলিশ চৌকি মে যা কর বোলো এক বেহুঁশ মরিচ গিরা হুয়া হ্যায় ইধর—জেরা আসপাতাল লে যানে কি বন্দোপস্ত করে—’

‘জি হম তো স্টিশন যায়েঙ্গে৷ ট্রেন পাকাড়না হ্যায়—’

‘একহি তো রাস্তা—ব্যস খবরহি না দেনা হ্যায়! দো মিনিট কা বাত! যাও বেটা, ফুর্তি সে যাও৷’

সাইকেল নিয়ে গিরিধারী চলে যাবার পর খানিক অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলেন মথুরানাথ৷ লোকটাকে দেখলেন আবার৷ রোদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে মাছির সংখ্যা৷ সাধারণ মাছির সঙ্গে একটা দুটো নীল মাছিও চোখে পড়ল৷ ডান চোখের পাতায় ঠোঁটের পাশে, বুক, হাত, পেট, অণ্ডকোষ—এখন তাদের বিচরণ সর্বত্র৷ মুহূর্তের জন্য শরীর কেঁপে উঠেই স্থির হয়ে গেল আবার, ঠোঁটদুটো ফাঁক হতে হতেও হল না। লোকটা কি পিপাসার্ত? কণ্ঠনালীর স্থিরতা দেখে সেরকম কিছু অনুমান করা গেল না।

গাঢ় নিশ্বাস পড়ল মথুরানাথের। আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করলেন যেন। হে রাম, হে কৃষ্ণ, মুমূর্ষুর এই নিয়তি সজীব মানুষকে দেখতে হয় কেন! চারদিকে এত মানুষের মধ্যে এই হতভাগ্যের কি কেউই নেই, যে ওর নিজের! এভাবে পড়ে থেকে কোনও শান্তি পাবে! তারপর ভাবলেন, তাঁর নাম বললে চৌক থেকে নিশ্চয়ই ছুটে আসবে পুলিশ, গোরুর গাড়ি বা মাল-টানা রিকশা, যাতেই হোক তুলে, একটা ব্যবস্থা করে নিয়ে যাবে হাসপাতালে। আশা করা যাক হয় সুস্থ হবে, না হয় মৃত্যুই গ্রহণ করবে ওকে। জীবন এর বাইরে চলে না।

এরপর বাড়িতে ফিরলেও মনটা বিমর্ষ হয়ে থাকল মথুরানাথের। অন্যদিন বাড়ি ফিরে যা যা করেন ও যেভাবে, আজও সেইসব সেইভাবে করলেও চিড় খেল একাগ্রতা। টিউবকলের সামনে দাঁড়িয়ে শুদ্ধ গামছায় হাত পা মুছতে মুছতে দয়ারামকে বললেন, ‘শুনো জি, রাস্তা মে বড়ে পেড় কে পাশ এক বেহুস আদমি গিরা হুয়া হ্যায়। পুলিশ চৌকিমে খবর ভেজা গিয়া আসপাতাল লে যানে কে লিয়ে। যাও, দেখো জেরা। অগর উসে পিয়াস লাগ হ্যায় তো হালকা সে এক দো বুন্দ পানি দে না মুমে। আভি আভি যানা।’

দয়ারাম মথুরানাথের অনুগত, কখনও অবাধ্য হয় না। তবু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কোন জাত হ্যায়, মালিক?’

মথুরানাথ চলেই যাচ্ছিলেন, ফিরে দাঁড়ালেন। সামান্য বিরক্তি ফুটল কোমল মুখে।

‘মরিচ কে ভি জাত হোতা হ্যায় কেয়া! এক বেচারা মনুষ্য—উসে পানি পিলানা ধরম হ্যায়৷’

খড়ম ঠুকতে ঠুকতে পুজোর ঘরের দিকে চলে গেলেন মথুরানাথ। ধ্যানস্থ হতে।

জন্ম ও মৃত্যু সম্পর্কে কৌতূহল আছে রামপুরের মানুষের, কিন্তু আগ্রহ নেই কোনও। সেই দাঙ্গার সময় চারদিনে দু’পক্ষ মিলিয়ে তেত্ৰিশটা লাশ পড়ার পর এবং আঠারো জন জখম হবার পর একটু ভয় ভাবনা আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, তারপর আবার যে কে সেই। কলেরা কি ধরা-না-পড়া অন্য কোনও অসুখে, কি ফোতা ভগন্দর সেপটিক হয়ে, বা নিতান্তই বাৰ্ধক্যজনিত রোগে নিয়মিত কিছু মানুষ না মরলে ‘রাম নাম সত হয়’ ধ্বনি ভুলে যাবে লোকে, যেন সেইজন্যেই মানুষের মৃত্যু হয় এখানে। উদ্বেগহীন সহজে। জমি বা রাণ্ডি নিয়েও খুনোখুনি হয়, তবে কাচিৎ। রামজি ভরসা।

পুলিশ কাজে দম পায় না—চোরের চুরির বাখরা নেয়, গা ডলায় পা টেপায় তাকে দিয়ে, জল তোলায় কুয়ো থেকে, বেগড়বাই না করলে ছেড়ে দেয় দু’দিন পরে। দাঙ্গার প্রথম দু’দিনেই খুন হয়েছিল উনত্ৰিশ জন, পাটনা থেকে রিজার্ভ পুলিশ এসে অবস্থা সামাল দিয়েছিল, সেই থেকে কাজ না করার ব্যাপারে তারা আরও নিশ্চিন্ত।

হাসপাতালও তেমনি। সুপারিনটেনডেন্ট ডাক্তারের সাইকেলের টায়ার পাংচার বলে সেটা না সারানো পর্যন্ত গালাগালি দেয় সরকারকে, তখন তার ও তার অ্যাসিস্ট্যান্টের ফুরসত হয় না রোগী দেখার। যে কুড়ি বাইশটা বেড আছে সেগুলো রোগীর চিকিৎসার জন্যে যত না, তার চেয়ে বেশি শুয়ে থাকার জন্যে। ডাগদারবাবুর আত্মীয়স্বজন এলে ও কোয়াটার্সে জায়গা অকুলান হলে হাসপাতালের দু’একটা বেড খালি করে শূতে পাঠানো হয় তাদের। ছোটখাটো অসুখের চিকিৎসা হয় বটে, কিন্তু কেস একটু জটিল মনে হলেই চোখ বন্ধ করে চালান কেটে দেওয়া হয় ভাগলপুরে সদর হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্যে।

পুজোর ঘর থেকে বেরিয়ে খাটিয়ায় বসে দুধ খেতে খেতে দয়ারামের খোঁজ করলেন মথুরানাথ। সে এসে খবর দিল লোকটার মুখে কয়েক ফোটা জল সে দিয়েছে বটে, কিন্তু তার বেশিটাই গড়িয়ে পড়েছে দু’ঠোঁটের পাশ দিয়ে। মুখে নেয়নি। বলল, গিরিধারী জানিয়ে গেছে পুলিশের আসতে দেরি হবে।

‘কিউ?’ চিন্তিত দৃষ্টিতে প্রশ্ন করলেন মথুরানাথ।

‘কেয়া মালুম, মালিক৷’ দয়ারাম বলল, ‘এই সেহি বোলা। উয়ো হাবিলদার সাব কো বহুৎ টাট্টি হোঁ রাহা হ্যায় কাল রাত সে। চৌকিমে পুলিশ কম ছে৷’

‘হু৷’ দু’পাশে দু’হাত ছড়ানো, কিছুক্ষণ মাথা ঝুঁকিয়ে বসে থাকলেন মথুরানাথ। তারপর বললেন, ‘কেয়া দেখা তুম? উয়ো জিন্দা হ্যায় না?’

‘জি, মালিক। জিন্দা তো হ্যায়। এই সে লাগা কি মুণ্ডু ভি হিলায়া। ঔর—’

‘ঔর কেয়া?’

‘জি, উয়ে খৈনিবালা রঘুনাথ কহা, আপ ঘর আনে কে বাদ পিসাব ভি কিয়া। ঔর লোগ ভি কহা৷’

দয়ারামের কথায় চিন্তা বাড়ল মথুরানাথের। মুখে জল নিল না, অথচ বলছে পেচ্ছাপ করেছে— সমস্তই লোকটার সম্পূর্ণ অচেতন অবস্থা প্রতিপন্ন করে। যেটা আরও ভয়ের, যে ধরনের ঘায়ে সর্বাঙ্গ ছেয়ে গেছে লোকটার, তার ওপর ক্রমাগত মাছি বসলে, রাস্তার ধুলো পড়লে রোগ আরও জাঁকাবে। এসব শরীরের ভিতরের আরও বিষাক্ত কোনও অসুখের প্রভাব কিনা কে বলবে! দয়ারামের কথা শুনে মনে হল বেশ কিছু লোক ভিড় করে আছে ওখানে। কী দেখছে ওরা—এরকম ধুঁকতে ধুঁকতে কখন মরে যায় অপরিচিত মানুষটা! এভাবে কি মরতে দেওয়া যায় মানুষকে!

বিপিন নেই এখানে। মামলা লড়তে গেছে পাটনায়, আজ কালের মধ্যেই ফেরার কথা। ও থাকলে পরামর্শ করে একটা উপায় বের করা যেত। তাহলে কি জানকীনাথ চৌধুরীকে খবর দেবেন? রামপুরের এম এল এ-র ঘনিষ্ঠ, জানকীনাথ ইচ্ছে করলেই একটা ব্যবস্থা করতে পারে। কিন্তু সে থাকে নাথচৌকের দিকে—বিকেলে যদিও নিজের সাইকেল রিকশায় চড়ে রোজই আসে এদিকে, টু মেরে যায়; এখন অতটা দূরে কে খবর দেবে তাকে! গয়ারামকে দিয়ে খবর পাঠালেও জানকীনাথ যে বাড়িতেই থাকবে তার নিশ্চয়তা কি?

একটা অধৈৰ্য ভাব দেখা দিল মথুরানাথের মধ্যে। ঘাম এল শরীরে। খাটিয়ার ওপর পড়ে থাকা হাতপাখাটা তুলে নাড়তে গিয়েও নাড়লেন না। হঠাৎ চেঁচিয়ে মেয়েকে ডাকলেন, বিন্দিয়া—ও বিন্দিয়া—’

বিন্দিয়া স্নানঘরে। পিছনের বাগানে ভিজে কাপড় মেলতে গেছে নীতা। জাঁতায় কলাই পিষছে লছমি, বস্তা থেকে কুলোয় কলাই বের করতে করতে স্বামীর ব্যস্ত হাঁকডাক শুনে নিজেই বেরিয়ে এল কৌশল্যা।

‘কেয়া বাত হ্যায়! কুছ চাহিয়ে কেয়া?’

দরজার পাশে দাঁড়ানো স্ত্রীকে দেখতে দেখতে চিন্তাটা গুছিয়ে নিলেন মথুরানাথ।

‘দু’ গো রুপেয়া জেরা লা দেও। দয়ারাম কো আসপাতাল ভেজনা হ্যায়—রিকশামে যায় গা৷’

‘আসপাতাল!’

‘হঁ। বাহার পেড় কে পাশ এক বেঁহুস মরিচ গিরা হুয়া হ্যায়। আখির কোই তো খেয়াল করে গা!’

ঘটনাটা লছমির মুখে আগেই শুনেছে ওরা। স্বামীকে চেনে, সুতরাং কথা না বাড়িয়ে টাকা আনতে ভিতরে গেল কৌশল্যা। দয়ারামকে হাসপাতালে খবর দিতে পাঠিয়ে ফতুয়া চড়িয়ে, কাঁধে গামছা নিয়ে নিজেও রাস্তায় বেরিয়ে এলেন মথুরানাথ।

অন্তত জন কুড়ি বিভিন্ন লোক তখনও জড়ো হয়ে আছে ওখানে। তাদের মধ্যে দিয়ে ঝুকে, গনগনে রোদের মধ্যে, সেই ভয়াবহ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে সর্বাঙ্গে কম্পন অনুভব করলেন মথুরানাথ। সেই একই ভঙ্গি; কিন্তু অসংখ্য মাছিতে ছেয়ে গেছে লোকটা। বিশেষত বুকে ও অণ্ডকোষের দিগদগে জায়গাগুলো যেন মৌমাছির চাক, মাছিতে প্ৰায় ঢেকে ফেলেছে ক্ষতিগুলো। জমে আছে, উড়ছে, আবার এসে বসছে। মাছি চোখের পাতায়, পাঁজরের খাঁজে খাঁজে, ঠোঁটের ওপর। ওরই মধ্যে চোখে পড়ল বুকের অল্প ওঠানামা। দেখতে দেখতে চোখের পাতা ভিজে এল মথুরানাথের। ওইভাবে দাঁড়িয়ে থেকেই কাঁধের গামছাটা টেনে নিয়ে ব্যস্ত হলেন মাছি তাড়াতে।

গামছার হাওয়ার ঝাপটায় মাছিগুলো ওড়াউড়ি শুরু করতে ছোয়া বাঁচানোর ভয়ে তাড়াহুড়ো করে পিছিয়ে গেল লোকগুলো। মনে হল আরাম পেয়ে লোকটা কেঁপে উঠল একটু। মাথাটাও কাত করল সামান্য৷

মথুরানাথ উঠে দাঁড়াতে ভিড়ের মধ্যে থেকেই একটি লোক মন্তব্য করল, ‘অব তো ফিন আপকো গঙ্গা মে যানে পড়ে গা, পণ্ডিতজি!’

‘কিউ!’ মথুরানাথকে বিরক্ত দেখে যে মন্তব্য করেছিল সে ভয়ে ভয়ে বলল, ‘দেখিয়ে না, অব পুরা মাছছি তো। আপহি কা বদন মে গিয়া! রাম জানে কৌন জাত!’

কথাটা ঠিকই। মথুরানাথ লক্ষ করলেন উড়ে যাওয়া মাছির অনেকগুলোই এখন এসে বসেছে তার ফতুয়া ও ধুতিতে। আবার ফিরে যাচ্ছে লোকটার গায়ে। কোনও জবাব না দিয়ে থমথমে মুখে বাড়ির দিকে এগোলেন তিনি।

হাসপাতালে পাঠিয়ে কাজ হয়নি। দয়ারাম ফিরে এসে বলল, ‘ডাগদারবাবু আভি নাহি আয়া, মালিক। ডেপটিবাবু ভিতর থা, ভেট নেহি হুয়া। উয়ো চৌকিদার কহা কি, আনে সে খবর দেগা—’

মথুরানাথ জবাব দিলেন না। মুখটা আরও একটু চিন্তিত হয়ে উঠল শুধু। নিশ্বাস পড়ল ঘন হয়ে।

এরপরেই একটা অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন মথুরানাথ। বাড়ির মেয়েদের ডাকলেন। গয়ারামের পাশের ঘরটা খালি পড়ে আছে। ঘরটা বেঁটিয়ে দিক লছমি। খাটিয়া পাতুক। লোকটাকে রাস্তা থেকে ঘরে নিয়ে আসবেন তিনি।

মৃদু আপত্তি তুলল কৌশল্যা।

‘শুনিয়ে জি, আপ ব্ৰাহ্মণ হ্যায়—’

অন্যরকম দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকালেন মথুরানাথ।

‘অগর মনুষ্যকে সেবা ব্ৰাহ্মণকে কাম নেহি হ্যায়, তো আজ সে হম শূদ্র হি বনেঙ্গে৷’

এ কথায় হিচকচিয়ে গেল সকলে। মথুরানাথের এমন মূর্তি, এমন চোখমুখ কেউ দেখেনি আগে। যেটা আরও আশ্চর্যের, হঠাৎই এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল তার চোখের কোল বেয়ে। বিষন্ন হাতের উল্টেপিঠে সেটা মুছে নিয়ে তিনি উচ্চারণ করলেন, ‘হে রাম, হে কৃষ্ণ!’

নীতা কৌশল্যার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বিন্দিয়া বলল, ‘আপকা বিচার সহি হ্যায়, বাবুজি। আখির উয়ো তো এক মরিচই হ্যায়! যাও দয়ারাম, বাবুজিকে সাথ যাও। হম ইধর বন্দোবস্ত করতে হেঁ৷’

অনুগত দয়ারাম, দ্বিধা থাকলেও নিঃশব্দে অনুসরণ করল মথুরানাথকে।

রামপুরের মানুষ এমন ঘটনা প্রত্যক্ষ করেনি আগে। ঘেয়ো, অচৈতন্য, জাতপাত না-জানা একটি রাস্তার মানুষকে বুকে কোলে করে বাড়িতে তুলে নিয়ে যাচ্ছে দুজন মানুষ। তার একজন কিনা মথুরানাথ!

দৃশ্যটা দেখে কেউ ভয় পেল, কেউ নাক কেঁচকাল ঘৃণায়। সংখ্যায় অল্প হলেও, মাথাও নাড়ল কেউ কেউ। খবরটা চাউর হয়ে গেল চারদিকে।

লোকটাকে বাড়িতে এনে, খাটিয়ার বিছানায় শুইয়ে দিয়ে স্বস্তি বোধ করলেন মথুরানাথ। তিনি চিকিৎসক নন, কিন্তু শুশ্রুষা জানেন। ক্ষতস্থানগুলো সাবধানে মুছে বাঁটা চন্দনের প্রলেপ দিলেন সেখানে! জুরের হোমিওপ্যাথি ওষুধ দিলেন; তারপর চামচে করে দুধ খাওয়ালেন যতটা পারেন। স্নেহের হাত বোলালেন মাথায়। লোকটার উলঙ্গ দেহের ওপর ঢাকা পড়ল পরিষ্কার চাদরের। নাকের কাছে হাত এনে অনুভব করলেন নিশ্বাস সহজ হয়েছে অনেকটা। তখন নিশ্চিন্ত হয়ে টিউবকলের জলে স্নান করতে গেলেন তিনি।

দুপুরে আর এক দফা ওষুধ আর দুধ খাইয়ে মনে হল কিছুটা তেজ এসেছে লোকটার শরীরে। তখন নিশ্চিন্তে ঘুমোতে গেলেন তিনি।

বিকেলে কানহাইয়ালালজি, জানকীনাথরা এসে সব দেখেশুনে মাথা নাড়ল। যে যাই বলুক, কাজটা ঠিকই করেছেন মথুরানাথ। রামপুরের পুলিশ আর হাসপাতাল নিয়ে কিছু করা দরকার, বললেন জানকীনাথ। এমন অব্যবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। যাক, লোকটার জ্ঞান ফিরুক, তারপর তিনি হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন।

বিপিন ফিরল সন্ধের পরে। মামলায় জিতে খুশি, কিন্তু, মথুরানাথের কাণ্ড দেখে খুশি হয়েছে মনে হল না। প্ৰায় ঠাট্টার গলায় বলল, ‘ইয়ে সন্দেশ রাষ্ট্রপতিকে পাস জানা চাহিয়ে—’

ছেলের মুখে এমন কথা আশা করেননি মথুরানাথ। ব্যথিত চিত্তে হাসলেন তিনি।

‘তো তুম হামারা পুত্র নেহি হো!’

‘আপ কা পুত্ৰ হুঁ। লেকিন রামপুরকে আম জানতা আপকা পুত্র নেহি হ্যায়। অগর হোতা তো, পিছলে বালা দাঙ্গা নেহি হোতা!’

মথুরানাথ চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর আত্মবিশ্বাসে ঋজু গলায় বললেন, ‘সায়দ—। লেকিন হামারা ধরম হমে হি পালন করনে হোগা৷’

পরের দিন ভোরে যথারীতি গঙ্গা স্নানে গেলেন মথুরানাথ। ফিরেও এলেন।

কিন্তু বাড়ির কাছে এসেই থমকে দাঁড়ালেন তিনি। গতকাল যেমন দেখেছিলেন তেমনই, দেখলেন বেশ কিছু লোক জড়ো হয়েছে বাড়ির সামনে। সকালের রোদ তখন উজ্জ্বল হচ্ছে ক্রমশ। সেই আলোয়, দেখলেন, একটা মোটরও দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। কী ব্যাপার, বুঝলেন না। কিছুটা বিস্মিত, কিছুটা চিন্তিত হয়ে ধীর পায়ে বাড়ি ফিরলেন তিনি। যারা দাঁড়িয়েছিল, তারা কিছুই বলল না।

খোলা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে অবাক হলেন মথুরানাথ। জানকীনাথ, কথা বলছেন বিপিন আর বিন্দিয়ার সঙ্গে। তাকে দেখেই ওরা চুপ করে গেল।

‘কেয়া বাত হ্যায়! জানকীনাথজি আপ? এতনা সুবহ!’
গঙ্গাজলের পাত্রটি মথুরানাথের হাত থেকে নিয়ে ভিতরে চলে গেল বিন্দিয়া।
‘জি। আনেহি পড়া৷’ জানকীনাথ তাকালেন বিপিনের দিকে, ‘তুমহি বোলো, বিপিন। আপ বৈঠিয়ে না, পণ্ডিতজি!’

মথুরানাথ বসলেন না। সন্দেহের চোখে তাকালেন বিপিনের দিকে।
‘বাবুজি—’, ইতস্তত করে বলল বিপিন, উয়ো আদমিকো আভি হাঁটানা হোগা ঘরসে—’
‘কিউ!’
‘কারণ, উয়ো মুসলমান হ্যায়!’
স্তম্ভিত চোখে বিপিনের মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে থাকলেন মথুরানাথ। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেয়া উয়ো হোস মে আয়া হ্যায়?’
‘জি নেই৷’ জানকীনাথ বলল, ‘লেকিন সারে ঔর লোগ এই সে হি কহ রাহা হ্যায়। উয়ো নাঙ্গা থা—বদনমে পহচান ভি থা—’
মথুরানাথের মুখে কথা ফুটল না।
‘ইয়ে সচ হ্যায়, বাবুজি!’ বিপিন বলল, ‘কাল রাত দয়ারাম বোলা থা হমকো-বেহুস মে উয়ো মরিচ ‘হায় আল্লা’ বোলা—’
কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে সচেতন হলেন মথুরানাথ।

‘ঠিক হ্যায়। লেকিন—, উয়ো এক বেঁহুস মনুষ্য ভি তো হ্যায়! আভি আরাম হোনে দেও, ফির চলা যায়ে গা। মেরা ধরম এইসে হি কহতা হ্যায়৷’

‘আপকা ধরম আপহি কে রহনে দিজিয়ে, পণ্ডিতজি৷’ কঠিন গলায় এবার বলল জানকীনাথ, ‘সিচুয়েশন কুছ খারাপ হি লাগতা হ্যায়। কেয়া আপ রামপুরকে নহি জানতে হেঁ। কেয়া আপ চাহতে হেঁ কি ইধর হামলা শুরু হো যায়—ফির এক রায়ট লাগে!’

তখন স্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়ল ঘরে।

জানকীনাথ বলল, উয়ো মরিচকো বন্দোবস্ত হামই করেঙ্গে। আপকো কোই হানি নেহি হোগা। আপ আরাম কিজিয়ে, পূজাপাঠ কিজিয়ে। ইয়ে ছোটসি বাত হ্যায়৷’

সম্ভবত তা-ই। সামান্য ঘটনা এটা। তবু বড় একটা নিশ্বাস সংবরণ করলেন মথুরানাথ। অদ্ভুত শারীরিক অস্বস্তিতে ঘোর লাগল তাঁর। কান গরম, জ্বালা করে উঠল চোখের কোণদুটো। নামাবলির ভিতর দিয়ে পৈতে স্পর্শ করে শিথিল ঠোঁট নেড়ে নিঃশব্দে উচ্চারণ করলেন তিনি, ‘হে রাম! হে কৃষ্ণ!’

তার পরের ঘটনাগুলো ঘটল খুবই স্বাভাবিকভাবে। মথুরানাথ পা ধুলেন, গা মুছলেন, পুজোর ঘরে গেলেন, দুধও খেলেন। কোনও প্রশ্ন করলেন না কাউকে। যেন একটু আগেকার অভিজ্ঞতা ভুলে গেছেন। তিনি, যেন প্রতিদিনের মতো আজও আরও একটা দিন। রোদ আছে, হাওয়াও আছে; সবই প্রকৃতিস্থ। সামান্য গাম্ভীৰ্য আর অন্যমনস্কতা ছাড়া আর কোনও ভাবান্তর ঘটল না তার।

কৌশল্যাকে চিন্তিত দেখে বিপিন বলল, ‘বাবুজি আপনা ধরম পালন কিয়া। বাকি যে সব ঔর লোগ কিয়া। ব্যস, এহি তো হুয়া। কেয়া বাবুজি ভি নেহি সমঝতে হেঁ ইয়ে সব!’

কৌশল্যা ভাবলেন, হয়তো। বিশেষ কোনও পরিবর্তন তো তিনিও লক্ষ করছেন না মথুরানাথের মধ্যে!

পরদিন ভোরের অন্ধকারে প্রতিদিনের মতো গঙ্গাস্নানে বেরোলেন মথুরানাথ। আর ফিরলেন না।

খবরটা রটনা হতে দেরি হল না। বিপিন, দয়ারাম-সহ গোটা রামপুরের মথুরানাথের পরিচিত সব মানুষ ছুটিল পীরপুর ঘাটের দিকে। দেখল একটু বা ঢেউয়ের আলোড়ন তুলে ধীর গতিতে বহে চলেছে গঙ্গা। গভীর টলটলে তার জলে তীরের মানুষের প্রতি কোনও মনস্কতা নেই।

কোথায় চলে গেলেন মথুরানাথ, কীভাবে গেলেন, কেউই জানতে পারল না তা। ক’দিন অপেক্ষা করার পরেও তার দেহ ভেসে উঠল না কোথাও। তখন লোকে বলাবলি করল, প্রকৃত হিন্দু এই মানুষটির ধর্মাচরণে ভুল ছিল না এতটুকু। গঙ্গাই আশ্রয় দিয়েছে তাকে।

কথাটা মনে ধরেছিল জানকীনাথ ও রামপুরের অন্যান্য নামী মানুষদের। নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করে, এম এল এ-কে ধরে পীরপুর ঘাটের নাম পালটে দিল তারা। ঘাটের ভাঙা সিঁড়িগুলো বাঁধানো হল নতুন করে। বড় বোর্ড পড়ল—‘মথুরানাথ ঘাট’। তার নীচে ছোট কিন্তু স্পষ্ট অক্ষরে, ‘কেবল হিন্দুয়ো কে লিয়ে৷’ সংক্ষিপ্ত করার জন্যে কেউ কেউ অবশ্য ওই ঘাটকে হিন্দুঘাটও বলত।
৩১ অক্টোবর, ১৯৯২