দারুল উলুম দেওবন্দ
দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার কারণ ও ফলাফল
সাফিয়্যা নূরপ্রকাশিত : জানুয়ারি ১৪, ২০২১
দারুল উলুম দেওবন্দ উপমহাদেশের সর্বোচ্চ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়। দারুল উলুম দেওবন্দ হলো ভারতের একটি মাদরাসা। এখান থেকে দেওবন্দি আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। ১৮৫৭ সালের বিপ্লব ও যুদ্ধে ইংরেজ বেনিয়াদের জয়ের ফলে এদেশের শত শত স্বাধীনতাকামী মুজাহিদদের ফাঁসিতে ঝুলানো হয় এবং হাজার হাজার যোদ্ধাদের বন্দি করা হয়।
মাওলানা কাসেম নানুতুবী দেওবন্দের একজন বিজ্ঞ আলেম। তিনিও এই বন্দিদের মধ্যে ছিলেন। তিনি থানাভবন ও শামেলির ময়দানে ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করেন। মাওলানা কাসেম নানুতুবীর ওপর ওয়ারেন্ট জারি হলে তিনি প্রায় দুই বছর আত্মগোপনে থাকেন। এরপর ইংরেজ সরকার কর্তৃক সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা হলে তিনি জনসম্মুখে আসেন এবং আবার ব্রিটিশসাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। তবে এবার তিনি তার কৌশল পরিবর্তন করেন।
তিনি এমন সব তরুণ ও যুবক তৈরি করবেন যারা দ্বীনে মোহাম্মাদী সংরক্ষণের পাশাপাশি ইংরেজ বিরোধী লড়াইয়ের প্রশিক্ষণ নেবে। এই লক্ষ্যে তিনি ১৮৬৬ সালে ভারতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি প্রতিষ্ঠান দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্র ছিলেন মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দী। যিনি রেশমি রুমাল আন্দোলন পরিচালনা করেন এবং ভারতের স্বাধীনতায় এক নতুন অধ্যায় সূচনা করেন। মাওলানা মাহমুদ হাসান ছিলেন বিদগ্ধ আলেমে দ্বীন, স্বাধীনতার এক মহান সেনানি এবং রেশমি রুমাল আন্দোলনের পুরোধা।
ভারতের স্বাধীনতায় মাওলানার অবদান এতো বিশাল যে, তার আলোচনা ছাড়া স্বাধীনতার ইতিহাস অপূর্ণ থেকে যাবে। মোহনদাস করোম চাঁদ গান্ধীকে তিনিই সর্বপ্রথম `মহাত্মা‘ উপাধি প্রদান করেন। এই যুগশ্রেষ্ঠ মনিষী আলেম ১৮৫১ সালে ভারতের বেরলবিতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ছিলেন প্রসিদ্ধ আলেম মাওলানা জুলফিকার আলী দেওবন্দী। তিনি নিজ গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে বিখ্যাত দারুল উলূম দেওবন্দে ভর্তি হন।
মাওলানা কাসেম নানুতবী এই লক্ষ্যে দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা করেন যে, এ প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা এমন মুজাহিদ ও সৈনিক হিসেবে গড়ে উঠবে, যারা ভারতের স্বাধীনতায় অনন্য অবদান রাখবে। এখানের প্রথম ছাত্র মাওলানা মাহমুদ হাসান তার লক্ষ্যকে পূর্ণ করে দেখিয়েছেন। তিনি শিক্ষা সমাপন করে এখানেই অধ্যাপনায় নিযুক্ত হন এবং ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সম্মুখ নেতৃত্ব প্রদান করতে থাকেন।
মাওলানা মাহমুদ হাসান সর্বপ্রথম তার উস্তাদ মাওলানা কাসেম নানুতবীর আদেশে `ছামারাতুত তারবিয়া‘ নামের একটি যুবসংঘ প্রতিষ্ঠা করেন এবং যুবকদের ইংরেজ বিরোধী লড়াইয়ের প্রশিক্ষণ প্রদান করতে থাকেন। এর মাধ্যমে অনেক যুবক প্রশিক্ষণ নিয়ে ইংরেজ বিরোধী যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। কিন্তু ইংরেজ গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টের ভিত্তিতে সরকার এই সংগঠনটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
১৯০৯ সালে আবার তরুণ ও যুবাদের যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষিত করতে `জমিয়াতুল আনসার‘ নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের দায়িত্ব তার প্রিয় শিষ্য মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধীর হাতে ন্যস্ত করেন। এই সংগঠনে হাজারের অধিক তরুণ নাম লেখায় এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। কিন্তু ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের নজর এই সংগঠনের ওপরও পড়ে এবং এটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
এরপর ১৯১৩ সালে মাওলানা মাহমুদ হাসান `নাজ্জারাতুল মা`আরিফ‘ নামের আরো একটি সংগঠন গড়ে তোলেন এবং এই প্ল্যাটফর্মে কাজ করতে থাকেন। হাকিম আজমল, ভিকারুল মুলক, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, মাওলানা মোহাম্মাদ আলী এবং মাওলানা মঈন মনসুর আনসারী এই সংগঠনে কাজ করেন। মাওলানা মাহমুদ হাসান সশস্ত্র বিপ্লব ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ দখলদার মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। এই লক্ষ্যে তিনি `আজাদ হিন্দ মিশন‘ প্রতিষ্ঠা করেন এবং আফগানিস্তান, শ্রীলংকা, রাশিয়া, জার্মানি এবং তুরস্কে প্রতিনিধি ও ডেলিগেটস প্রেরণ করেন।
এই সশস্ত্র বিপ্লবের লক্ষে দেশের বাইরে বাহিনী প্রস্তুত করেন, গোপনে দেশের ভেতরেও বিশাল বাহিনী তৈরি রাখেন যারা দেশে বিদ্রোহ শুরু করবে এবং বিদেশিদের সহযোগীতা নিয়ে অতর্কিত আক্রমণ করে দিল্লি দখলে নেবেন। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সর্বপ্রথম মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধীকে ১৯১৫ সালে কাবুল প্রেরণ করেন এবং আফগান সরকারের সাহায্য নিয়ে বিশাল এক সেনাবাহিনী গড়ে তোলার দায়িত্ব প্রদান করেন।
মাওলানা সিন্ধী কাবুল পৌছে সেখানে `প্রবাসী ভারত সরকার‘ প্রতিষ্ঠা করেন। যার উপর আফগান, জার্মান, ইরান তুরুস্কের সমর্থন ছিল। এই সরকারে মহেন্দ্র প্রতাপ সিংকে রাষ্ট্রপতি, মাওলানা বরকত উল্লাহ ভূপালীকে প্রধানমন্ত্রী এবং মাওলানা সিন্ধীকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়। এদিকে তুর্কি খেলাফতের সাহায্য নিতে মাওলানা মাহমুদ হাসান হেজাজ সফর করেন এবং হেজাজে তুর্কি গভর্নর গালিব পাশার সঙ্গে সামরিক সহযোগিতার একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয়।
চুক্তি অনুযায়ী তুর্কি বাহিনী বাগদাদ হয়ে বেলুচিস্তান সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করবে। এই পরিকল্পনাটি গোপনে একটি রেশমের রুমালে লিখে ভারতের প্রেরণ করা হয়। ইতিহাসে যা রেশমি রুমাল আন্দোলন Silk Letter Conspiracy নামে বিখ্যাত। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ওই চুক্তিনামা পাঞ্জাবে সিআইডির হাতে ধরা পড়ে। ফলে মাওলানা মাহমুদ হাসানকে মক্কায় হুসাইন আহমদ মাদানী, ওয়াহিদ আহমদ দেওবন্দী, আযীয গুল পেশওয়ারী ও হাকিম নসরত হুসাইনসহ গ্রেফতার করা হয়। মাল্টার দ্বীপে তাদের তিন বছর সাত মাস বন্দি রাখা হয় এবং এই বয়োঃজ্যেষ্ঠ বুযুর্গ আলেমদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন নিপীড়ন চালানো হয়।
৮ জুন ১৯২০ সালে মাল্টার কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বোম্বে বন্দরে পৌঁছালে তাকে অভ্যর্থনা জানাতে ভারতের সব জাতীয় নেতা একত্রিত হন। এসময় কেন্দ্রীয় খেলাফত কমিটি তাকে `শায়খুল হিন্দ‘ উপাধিতে ভূষিত করেন। ভারত পৌঁছে শায়খুল হিন্দ আলেমদের এক জাতীয় প্লাটফর্ম জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সমগ্র ভারতবর্ষ ভ্রমণ করে জনগনকে স্বাধিকার আদায়ের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। অসহযোগ আন্দোলনে ব্রিটিশ বিরোধী তার ঐতিহাসিক ফতোয়া দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। অসহযোগ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সরকারপন্থী মুসলিম বুদ্ধিজীবিদের একটি দল আলীগড় ত্যাগ করে শায়খুল হিন্দদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন।
তিনি তাদের জন্য দিল্লীর জামিয়া মিল্লিয়া প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। ৩০ জুন ১৯২০ সালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এই প্রবাদ পুরুষ দিল্লীতে ইন্তিকাল করেন। শায়খুল হিন্দ স্বাধীনতা আন্দোলনে অবিস্মরণীয় অবদান রাখবার পরও কিছু অমূল্য গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং কোরআনের উর্দু অনুবাদও করেন। ইযাহুল আদিল্লা, আল আদিল্লায়ে কামেলা ছাড়াও তার কোরআনের অনুবাদ পৃথিবীব্যাপী সমাদৃত।
শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দী শুধু স্বাধীনতার বীর সেনানী, অকুতোভয় সিপাহসালারই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন আলেমে রব্বানী, শত শত শাস্ত্রীয় আলেম তৈরির কারিগর। মাওলানা আশরাফ আলী থানবী, সাইয়্যিদ আনোয়ার শাহ কাশমিরী, মাওলানা সাব্বির আহমদ উসমানী, মুফতি কেফায়েত উল্লাহ দেহলবি, মাওলানা আসগর হুসাইন দেওবন্দী, মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধী, মাওলানা ইজাজ আহমদ দেওবন্দী, মাওলানা হাবিবুর রহমান উসমানী এবং সাইয়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তার শিষ্যদের সকলেই ছিলেন তার আদর্শের বীর সেনানী। বিশেষভাবে মুফতি কেফায়েত উল্লাহ এবং সাইয়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানী তার অবর্তমানে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যে, বিশাল অবদান রেখেছেন ইতিহাসে অম্লান হয়ে থাকবে। কিন্তু আজ প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক যে, ভারত কী তার স্বাধীনতার এই মহান মনিষীকে স্মরণীয় করে রাখবে?
দেওবন্দের আদর্শের মূলনীতি
১. অত্যাচারি শাসকের সাহায্য ছাড়া শুধু জনসাধারণের সাহায্যে এই প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হবে। এভাবে জনসাধারণের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা এবং স্বাধীনতাকামী মুজাহিদগণের পক্ষে জনমত গঠন।
২. ব্যাপকহারে ছাত্র ভর্তি করে তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে আধিপত্যবাদী ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ পরিচালনার জন্য সুশিক্ষিত এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাহিনী গঠন।
৩. শুরাতাত্ত্বিক অর্থাৎ পরামর্শের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হবে।
৪. যে কোনো সংগ্রামকে সফলতায় নিয়ে যেতে হলে সমমনাদের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন, তাই এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক এবং কর্মচারীবৃন্দ সমমনা হতে হবে।
৫. প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে শিক্ষা কোর্স সম্পন্ন করে সঠিক দায়িত্ব পালনের উপযোগী হতে হবে।
৬. চাঁদা সংগ্রহের মাধ্যমে গরিবদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে এবং পুঁজিবাদী, ধনী এবং জমিদারদের সাথে সম্পর্ক বিছিন্ন করতে হবে।
৭. অত্যাচারি শাসকের কোনো সাহায্য গ্রহণ করা যাবে না।
৮. মুখলিস/নির্মোহ লোকদের চাঁদাকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
এখলাসের সাথে দ্বীনের খেদমতই যেহেতু একমাত্র লক্ষ্য ছিল, তাই কোনো প্রচার মাধ্যমের আশ্রয় না নিয়ে দেওবন্দের ছোট্র পল্লিতে, ছাত্তা মসজিদের আঙ্গিনায়, একটি ডালিম গাছের ছায়ায়, আবেহায়াতের এই নহর তারা রচনা করেন। দুই বুযুর্গের মাধ্যমে কার্যত প্রতিষ্ঠানটির পদযাত্রা শুরু হয়। প্রথমজন শিক্ষক, হযরত মাওলানা মোল্লা মাহমুদ। দ্বিতীয়জন ছাত্র, দেওবন্দের নওজোয়ান মাহমুদ হাসান; পরবর্তীতে যিনি শায়খুল হিন্দ নামে খ্যাত হন।