দাদাবাড়ি নানাবাড়ি
পর্ব ২০
হামিদ কায়সারপ্রকাশিত : এপ্রিল ০৩, ২০১৮
টাঙ্গাইলের খুরশেদ ভাই কাদের বাড়িতে যেন লজিং থেকে পড়তেন। মুসার যেমন ছিল সিনেমা দেখার নেশা, হালকা টিঙটঙে খুরশেদ ভাইয়েরও তেমনি ছিল বিয়েবাড়িতে গিয়ে রাতবিরেতে গান গাইবার বাতিক। চেনা বাড়ি হোক অচেনা বাড়ি, দাওয়াত থাক বা না থাক, রাত নয়টা কী দশটার দিকে খুরশেদ ভাই সে-বাড়িতে গিয়ে হাজির। ছেড়ে দাও তার হাতে মাইক্রোফোন, অমনি দেখো মোহাম্মদ খোরশেদ আলমকে ফেল করে তিনি গেয়ে উঠলেন, ‘আমি এক দুরন্ত যাযাবর। আমি এক দুরন্ত যাযাবর। দিন নেই রাত নেই বসে থাকি গাড়িতে কোথাও যে নেই মোর ঘর।’
ঠিকই তো নিজের ঘর থাকলে কি কেউ বাড়ি বাড়ি গিয়ে যাযাবরের গান গায়! আজ ভাবি, এই গানটি ছাড়া কি আর অন্য কোনো গান জানতেন না খুরশেদ ভাই? চোত হোক বোশেখ হোক আশ্বিন হোক কার্তিক হোক, বৃষ্টি থাক বা না থাক, খুরশেদ ভাইয়ের কণ্ঠে সেই এক গান, আমি এক দুরন্ত যাযাবর... শেষের দিকে যাযাবর বলতে গিয়ে যাযাবরররররররর, বরের র-এ এসে কেমন একটা দীর্ঘ টান দিতেন খুরশেদ ভাই খানিকটা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে, অনেক অনেকক্ষণ ধরে। র-টা মেসির ফ্রিকের গোলের মতো বা শেন ওয়ার্নের গুগলির মতো কেবল ঘুরতো!
তখন ছ্যাঁক খেলেও মানুষ মাইকে গান গেয়ে গেয়ে নিজের দিল-যন্ত্রণা লাঘব করার প্রয়াস পেত। নাম বলব না। কাশিমপুরের সনাতন ধর্মের এক বড় ভাই। হঠাৎ হাতীমারা হাইস্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে, যখন ছোটখাটো একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছিল, কোথা থেকে হনহনিয়ে হেঁটে উদয় হলেন। তারপর স্টেজের সামনে এসে দাঁড়ালেন। উনাকে দেখেই যিনি উপস্থাপনা করছিলেন, জিজ্ঞেস করলেন, গান গাইবা? দাদার মুখে কোনও কথা নাই। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ভেসে উঠলো মাইক্রোফোনে। কে যেন জোরে হাহাকার করে উঠলো, আহারে! দাদা মাইক্রোফোনটা হাতে নিয়ে গভীর কোনও জগতে ডুবে রিক্ত নিঃস্ব এক পরিবেশ তৈরি করে গেয়ে উঠলেন জগন্ময় মিত্র, ‘তুমি আজ কত দূরে... তুমি আজ কত দূরে...’ একটা নিনাদ ছড়িয়ে পড়লো বাতাসে বাতাসে। দাদার চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। চোখের নিচে কালি। মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। গান গাইতে গাইতে চোখ দিয়ে অবিরল পানি গড়াচ্ছে। পুরো অডিয়েন্স নির্বাক, পাথর। দেবদাস হইয়া গেছেরে দেবদাস হইয়া গেছে! কার যেন দরদভরা কণ্ঠ বেজে উঠেছিল। গান শেষে সবাই ওকে সে কী সান্ত্বনা! যা ঘটার ঘটে গেছে দাদা। ওকে ভুলে যাও। ভুলে যাও তুমি। দাদার মুখে কথা নাই। উদাস শূন্য দৃষ্টি। যখন তখন পড়ে যাবে এমন একটা অবস্থা!
বাড়ি ফেরার পথে কারণটা শুনলাম। দাদার ধর্মেরই কোনও এক মেয়ের সঙ্গে গভীর প্রেমের সম্পর্ক হয়েছিল। এত গাঢ় প্রেম যে, দুজন দুজনকে ছাড়া কল্পনা করতে পারত না। যে কোনোভাবে হোক, যে কোনও উছিলায় একবার চোখের দেখাটা তাদের দেখতেই হতো। মেয়ের গতিক ও ভাবসাব টের পেয়ে ওর বাবা-মা প্রতিষ্ঠিত এক ছেলের সঙ্গে বিয়ে শুধু ঠিকই করে ফেললো না, রাতারাতি পাত্রস্থ করার ব্যবস্থা করলো। মেয়েটার সঙ্গে দাদার গোপনে কথা হলো, রাতের অন্ধকারে দুজন কাশিমপুর ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবে। যেখানে একসঙ্গে ঘর করতে পারবে! কিন্তু অন্ধকার ঠিকই এলো, শুধু সেই রাতটুকুই কেবল এলো না। মেয়েটার জন্য অপেক্ষা করতে করতে করতে করতে দাদার জীবনটাই হয়ে উঠলো অন্ধকারময়। জীবন থেকে মরে গেল সব স্বপ্ন। বিস্বাদ লাগে খাবার, আয়নায় মুখ দেখা বন্ধ, গোসল কেউ ঠেলে করালে করে, তা না হলে এমনিই দিন যায়। একবার তো শেষ দেখাটাও দেখিয়ে যেতে পারতো! সে রাতে না হয় নাই-ই এলো, দিনেতো অন্তত একবার বলে যেতে পারতো! কেন এই প্রবঞ্চনা। দাদা মাইক পেলেই হামলে পড়েন। সুউচ্চ কণেঠ যেন তার পোড়া ভস্ম হৃদয় সেই মেয়েটির উদ্দেশে জানতে চায়, তুমি আজ কতো দূরে... তুমি আজ কতো দূরে!
তখন কিন্তু ছ্যাঁকেরও আলাদা একটা মর্যাদা ছিল। লোকজন তাদেরকে সমীহের চোখেই দেখতো। ছ্যাঁক খাওয়াটা কি সোজা কথা? সবাই কি ছ্যাঁক খাওয়া হজম করতে পারে? কেউ কেউ তো ফাঁসই লটকে দিত। আর কেউ কেউ বিয়ে থা সংসার কিচ্ছু করতো না! সারাজীবন মনের মানুষটিকে মনে রোমন্থন করে যেত। ধ্যানী ঋষির মতো বুকের গহনে রাখতো মেয়েটিকে, নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসতো! কোহিনূর হীরের টুকরোর মতোই বড়ো দুর্লভ ছিল সে-প্রেম! বড় খাঁটি!
নানাবাড়িতে আমার এক পরম আত্মীয়েরও ঠিক এ ধরনের একটা অসুখ ছিল, অনেকটাই সেই খুরশেদ ভাইয়ের মতো। তিনি দাদার মতো অবশ্য ছ্যাঁক খাননি, কিন্তু বিয়েবাড়ির মাইক দেখলেই তার মাথাটা গান গাইবার জন্য খারাপ হয়ে যেত! রাতের বেলা হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে গান গাইতেন, ও ললিতে, ওকে আর ও ঘাটেতে জল আনিতে বলিস না। সারাজীবন দেখেছি এই একই গান গাইতে!
মা মা, ললিতে কে, আমি মাকে পরম বিস্ময়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিলাম। মা কী উত্তর দিয়েছিল মনে নেই। তবে খুব হাসাহাসি যে হয়েছিল ললিতকে নিয়ে এটা বেশ মনে আছে। সেদিন ছিল ঝর্ণা খালাম্মার বিয়ের রাত। মার দূর সম্পর্কের চাচাতো বোন। একই বাড়ি। রেলগাড়ির মতো লম্বা সেই বাড়িটার সর্বপূর্বে নানারা থাকেন, সর্বপশ্চিমে থাকেন ঝর্ণা খালাম্মারা। মাঝখানে আরো দুটি শরিকের যথারীতি দুটো করে ঘর। হাফপ্যান্ট পরা বয়সে সেই প্রথম আমি কোনো একটি বিয়েকে জ্ঞান হওয়ার পর প্রথম অতি কাছ থেকে চাক্ষুস করলাম। ঝর্ণা খালাম্মাকে নিয়ে সবাই মেতে আছে দেখে আমার খুব কষ্ট হয়েছিল, আমাকে নিয়েও সবাই মেতে থাকে না কেন? বিয়ে কি শুধু ঝর্ণা খালাম্মারই হবে? আমার হবে না? কোনও স্মৃতিই ভালোভাবে মনে নেই। শুধু মনে আছে ঝর্ণা খালাম্মা আর তার স্বামীকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে মাথায় দূর্বাঘাস দেয়া হয়েছিল। আর সেখানে একটা কুপি জ্বলছিল, বাতাসের সঙ্গে তীব্র লড়াই করে জ্বলছিল কুপিটা। সেই বিয়ের রাতের আগের দিন, মাইকে নয়, গ্রামোফোনে অনেক জোরে জোরে ভাসছিল শচীন কর্তার গান। সেদিনই প্রথম শচীন শুনি, বিরহ বড় ভালো লাগে, বিরহ বড় ভালো লাগে... একের পর এক শচীন কর্তা বেজেই চলছিল, তুমি এসেছিলে পরশু কাল কেনো আসোনি, কে যাস রে ভাটিতে নাও ভাইয়া, আকাশে ছিল না বলে হায় চাঁদের পালকি, তুমি হেঁটে হেঁটে তাই আসোনি কাল কি... আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। ভীষণ বুকচেরা কষ্ট। কেন জানি না। গান শোনলেও কারো মনে কষ্ট হয় তার আগে কখনো টের পাইনি। আমি আর শচীন কর্তার গানের সুর সহ্য করতে পারছিলাম না। মা কোথায়? বিয়ের আসরের মেয়েদের ভেতর হারিয়ে গেছে। আমি একা একা ছুটে গিয়েছিলাম পুকুরের ঘাটপাড়ে। যেখানে গানের শব্দ ঠিক পৌঁছাতে পারছিল না। আর ফিনকি দিয়ে রক্তের মতো জোছনা ঝরছিল!
নানাবাড়ির এই পুকুরটা ছিল পেইন্টিং। আস্ত এক জলরঙ। কুরোসাওয়ার সেই সিনেমার মতো, ড্রিমস-এর কোনো একটা। যেখানে ভ্যানগগের গমক্ষেতে কাক ছবিতে স্বয়ং শিল্পীকেই উপস্থিত করান এবং ভ্যানগগ ছবির সঙ্গে কিছু বাস্তব মুহূর্ত কাটান। আমিও যেন সেই পুকুরের রঙে আমার শৈশবকে গুলিয়ে এসেছি। সেখানে গেলেই ফিরে পাব সেই দিনক্ষণ। আমার একলা কাটার কত মুহূর্তের সিঁড়িঘাট। বৃষ্টিঘোর লাগা দিনগুলোতে সেই পুকুরে গোসল করবার মুহূর্ত কখনোই ভোলবার নয়। যেন একেকটা ক্ল্যাসিক ক্ষণ। সেই অনুভূতি বর্ণনা করবার মতো ক্ষমতা আমার নেই। কালিদাস বা রবীন্দ্রনাথ হলে হয়তো পারতেন। টুপ টুপ করে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা ঝরছে। তাতে তরঙ্গের পর তরঙ্গ সৃষ্টি হয়ে যেন সঙ্গীতের অন্তহীন সিম্ফনী তৈরি করে চলেছে। আর চারপাশটা ঢেকে আছে অথৈ বৃষ্টির নান্দনিক দেয়ালে। মনে হতো সাঙ্গীতিক নির্জনতা মুহূর্তটিকে আলাদা করে রেখেছে পুরো জগত থেকে। আমি পুকুরের সিঁড়িঘাটে বুকজল পর্যন্ত ডোবে আকণ্ঠ পান করেছি সেই স্বর্গীয় মদিরা।
চলবে