হিটলারের গ্যাস চেম্বার
দাচাউ, নুরেমবার্গ আর আউশভিৎস পরিদর্শন
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : নভেম্বর ২২, ২০২০
যখন ২০১৪ সালে ইউরোপে যাই, সাতটি দেশ ভ্রমণ করা হয়েছিল। বিশেষভাবে তখন জার্মানি আর পোলান্ডের কয়েকটি স্থান পরিদর্শন করেছিলাম দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কথা মাথায় রেখে, হিটলারের কুকীর্তির সাক্ষ্য বহন করতো যে স্থানগুলি। ইহুদি বিদ্বেষ ছিল হিটলার উত্থানের সঙ্গে বিশেষভাবে জড়িত অনুসঙ্গ। দারিদ্র ও ক্ষুদার দিনগুলিতে ভিয়েনার ইহুদিদের সম্পর্কে যে ঘৃণার জন্ম হয়েছিল হিটলারের মনে, ক্ষমতালাভের পর তা নতুন মাত্রা নিয়েছিল। সিদ্ধান্ত হয়েছিল, গোটা জার্মানি থেকে ইহুদিদের বিতারিত করা হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজও এগোতে থাকে। জার্মানি থেকে সর্বাত্মক ইহুদি বিতরণ কর্মকাণ্ড শুরু হলে বিতারিত গৃহহীন মানুষদের বন্দি করা শুরু হয়। যুদ্ধের শুরু থেকেই তাদের জন্য গড়ে উঠতে থাকে বন্দিশালা। জার্মানি ছাড়াও রাশিয়া এবং পোল্যান্ডে ইহুদিদের বিরুদ্ধে অভিযান সবচেয়ে রক্তাক্ত নৃশংস চেহারা নেয়। বন্দি শিবিরগুলি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প হিসেবে অভিহিত হতো। প্রথম যে তিনটি ক্যাম্প স্থাপিত হয়েছিল তার প্রত্যেকটি ছিল জার্মানির অভ্যন্তরে। তার মধ্যে মিউনিখের কাছে দাচাউ ছিল এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত।
কনসেনট্র্রেশন ক্যাম্পগুলির দায়িত্ব হিটলার নাৎসি গুণ্ডাবাহিনীর হাতে সঁপে দেয়। বলাবাহুল্য গুণ্ডাবাহিনী নৃশংস হাতে চরম অত্যাচার চালাতে থাকে। ক্যাম্পগুলির পাহারাদার নিযুক্ত করা হতো বিভিন্ন কারাগারে কমপক্ষে বারো বছর কয়েদখাটা দাগি অপরাধীদের। সংখ্যাগরিষ্ঠ বন্দী ছিল সেখানে ইহুদি আর কমিউনিষ্টরা। বন্দীদের জন্য সামান্য রক্ষাকবচ ছিল না। মানবিক অধিকারের ন্যূনতম মর্যাদা দেওয়া হতো না। কারাগারে আসার পথেই ক্লান্তি আর অনাহারে বা দমবন্ধ হয়ে অনেকে মারা পড়তো, শিশু বৃদ্ধ নারী বাছবিচার ছিল না। নির্মম অত্যাচার চলতো বন্দীদের উপরে, হিটলারের যুদ্ধে বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে ইহুদি নিধনের মাত্রা বাড়তে থাকে। দাচাউ ক্যাম্পের প্রথম কমান্ডার থিয়োডর এক্ককে সমস্ত ক্যাম্পের ভার দেওয়া হয়। নিজের সুবিধার জন্য তখন ছোট ছোট ক্যাম্পগুলিকে গুটিয়ে ফেলে বড় ক্যাম্প তৈরি শুরু করে। বাকি দুটি ক্যাম্পকে গুটিয়ে নিয়ে ভাইমার সাক্সশেন হাউঝেনের দাচাউতে বিশাল ক্যাম্প গড়ে তোলে। দাচাউয়ের এই ক্যাম্পটি আমরা পরিদর্শন করেছিলাম ইউরোপ ভ্রমণকালে।
হিটলার পরে বিভিন্ন দেশে আরো অনেকগুলি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প তৈরি করে। ১৯৪০ সালের পর থেকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের সংখ্যা বাড়ানো হয়। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত ছিল পোলান্ডের নিকটবর্তী আউশভিৎস। রাজধানী ওয়ারশ শহর থেকে একশো ষাট কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি জলাভূমি জলাশয় এবং ঘাস ঘেরা অঞ্চলকে বেছে নেয়া হয়েছিল আউশভিৎস ক্যাম্পের জন্য। ক্যাম্পের সঙ্গে ট্রেন যোগাযোগ ছিল, বন্দীদের সাধারণত ট্রেনে করেই আনা হতো। আউৎভিৎসের খোলামাঠে সরিবদ্ধ ছোট ছোট খুপরি ঘর। চারপাশে কাঁটাতারের দুর্ভেদ্য বেড়া। লক্ষ লক্ষ বন্দীকে সেখানে থাকতে হয়েছিল। বন্দীদের গ্যাস দিয়ে হত্যা করার নিষ্ঠুরতম অভিনব পন্থাটি এখানেই প্রথম আরম্ভ হয়। গুলি করে বা বিষ দিয়ে পঁয়ত্রিশ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করা খুবই কঠিন ব্যাপার। ফলে এই পন্থা আবিষ্কার করা হয়েছিল। দানবাকৃতির চার চারটে গ্যাসচেম্বার এবং মৃতদেহগুলো জ্বালানোর জন্য বসানো হয়েছিল বিরাট চুল্লি। গ্যাসচেম্বারে প্রতিদিন প্রাণ দিতে হতো ছয়শো বন্দীকে রুডলফ হোয়েসের নির্দেশে।
ভারসাউ ঘেটো থেকে ধরে আনা আশি হাজার ইহুদি বন্দীকে হত্যা করা হয় গ্যাসচেম্বারে মনোস্কাইড গ্যাস প্রয়োগে। কিন্তু রুডলফ দেখে মনোস্কাইড গ্যাস দিয়ে বন্দীদের হত্যা করা অত্যন্ত সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। সেই কারণে চটজলদি অনেক বেশি সংখ্যক বন্দীকে হত্যার জন্য আউশভিৎস ক্যাম্পে ব্যবহার করা হয় জাইকোলন বি, জাইকোলন বি হলো প্রুসিক অ্যাসিডের দানা। বন্দীদের গ্যাসচেম্বারে ভরে দানাগুলিকে গ্যাস চেম্বারের একটা ছোট গর্ত দিয়ে ভেতরে ছুঁড়ে দেওয়া হতো। তিন থেকে পনেরো মিনিট সময় লাগতো গ্যাসচেম্বারের ভিতরের মানুষগুলির মৃত্যু ঘটতে। কচি কচি সন্তান সহ মা বাবাকে ঢুকিয়ে দেয়া হতো গ্যাস চেম্বারে। সব বন্দীদেরই যে সোজা নিয়ে গ্যাস চেম্বারে ঢোকানো হতো তা নয়। সুস্থ্য আর বলিষ্ঠ বন্দীদের আগে প্রচুর খাটানো হতো সামান্য খাবারের বিনিময়ে। যখন শরীরের শক্তি নিঃশেষ হয়ে আসতো, তখন ঢুকিয়ে দেয়া হতো গ্যাস চেম্বারে। রুডলফ হোয়েস নুরেমবার্গ বিচারের সময়ে বুক ফুলিয়ে মিত্রশক্তির বিচারপতিদের বলেছিল, নিজে সে পঁচিশ লক্ষ বন্দী হত্যা করেছে। নুরেমবার্গে মিত্রশক্তির বিচারে রুডলফের ফাঁসি হয়, ফাঁসিতে ঝোলানো হয় তাকে আউশভিৎস ক্যাম্পেই। সেই আউশভিৎস ক্যাম্প পোলান্ড ভ্রমণের সময়ে দেখে নিয়েছিলাম। ডাচাউ আর অউশভিৎস ক্যাম্প পরিদর্শনের মাঝখানেই নির্দিষ্ট দিনে নুরেমবার্গ ঘুরে এসেছিলাম সকলে মিলে।