সংগৃহীত
তৃতীয় ব্যক্তি
সুলতানা পারভীনপ্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৮, ২০১৮
আজ নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। হবে নাই বা কেন? আজ মেঘা বাড়ি আসছে।অনেক দিন পরে ওকে দেখতে পাব মন ভরে, দুচোখ জুড়িয়ে। মনে মনে সাত-পাঁচ ভেবে কূল কিনারা করতে পারছি না।
মেঘা, আমার হৃদয় রাজ্যের একচ্ছত্র মহারাণী। সেখানে অন্য কারো স্থান নেই। যত দিন যাচ্ছে ওর ছবি হৃদয়ে ততটাই গভীরভাবে ছেঁয়ে যাচ্ছে। ঠিকঠাক উপমা দিতে পারছি না। আজ যে আমি অনেক অনেক অনেক খুশি।
ওহো! নিজের পরিচয়টা দিতেই মনে নেই। আমি জাহিন। মেঘার ফুফাতো ভাই। মামার বাড়ি অনেকটা দূরেই। তাই খুব একটা যাওয়া হতো না। এখনও তেমন একটা যাওয়া হয় না। কেবল মেঘা বাড়িতে আসলেই ওকে একনজর দেখার জন্য ছুটে যাই। মহারাণী শহরে পড়াশোনা করেন কিনা। সেই ছোটবেলা থেকেই ওকে পাগলের মতো ভালোবাসলেও কখনো বলা হয়নি। আসলে ইচ্ছে করেই বলিনি। ও যদি কখনো আর কথাই না বলে এই ভেবে। দিন শেষ-মাস শেষ--গেল কতো বছরও। মহারাণী ভার্সিটিতে পড়ছেন। আর আমি বেশ ভালোই চাকরি করছি। তাই মা-বাবা বিয়ের জন্য তোড়জোড় করছেন। ছোট ভাইটার মুখে শুনলাম মেঘাকে তাদের দুজনেরই খুব পছন্দ। মামা খুবই অসুস্থ বিধায় মা চাইছেন বিয়েটা তাড়াতাড়ি হয়ে যাক। মা মরা একমাত্র মেয়ে মেঘা। বাবার কিছু হয়ে গেলে কি করে সামলাবে নিজেকে, তাই জন্য এতোটা তড়িঘড়ি।
আমার ছোট ভাই--জুনায়েদ। বদের হাঁড়ি। তবে এবার মেঘাদের বাড়ি গিয়ে চুপচাপ হয়ে ফিরে এল। হাজার বার জানতে চাইলেও বলছে না যে কি হয়েছে। মুখের সেই দুষ্টু হাসিটাও আজ তার কোথায় মিলিয়ে গেছে!
শেষে বহুকষ্টে ও আমাকে শুধু একটা কথাই বলল,
-মেঘা আপুকে তুই এখানে নিয়ে আসিস না ভাইয়া।
-কেন রে?
-মেঘা আপু খুব কাঁদছে ।
-কেন?
-সে আমি কি জানি, তবে?
-তবে কি?
-শুধু ও নয় ।ফোনের অপর প্রান্তে অন্য একটা মানুষও কাঁদছিল।
হঠাৎ মনে হল হৃদস্পন্দনটাই হয়ত বন্ধ হয়ে যাবে। কি বলছে জুনায়েদ? কে কাঁদছে? আর কেন?
-কে কাঁদছে ফোনে?
-আবীর বলে কেউ একজন ।
-তুই জানলি?
-আমি কিছু জানি না। তুই খুবি খারাপ ।কেন কাঁদাচ্ছিস ওদের?
ছোট ভাইটাকে কি করে বোঝাব, আমি তো নিজের ভাগ্যের কাছেই হেরে গেছি। ওরা তো ওদের কষ্টটা চোখের জলে বুঝাতে পারছে। আর আমি? আমি তো এতোটাই হতভাগ্য যে তা করাও সম্ভব না।
-তুই মন খারাপ করিস না ভাই।তোর পচা ভাইটা সব ঠিক করে দিবে। যাতে আর কারো কাঁদতে না হয়।
দিনের শুরুটা যতটা খুশির ছিল-শেষটা ঠিক ততটাই কষ্টের হল। জুনায়েদ ঠিকই বলে
-আমি আসলেই খুবই খারাপ। আমার স্বপ্নের রাণী, মেঘা। ওর চোখে জলটা সহ্য হচ্ছে না। সহ্য হচ্ছে না ওর জীবনে অন্য কোনো মানুষের উপস্থিতি।
কিন্তু কি করব?
কোনটা বেশি কষ্টের?
ভালোবাসার মানুষটির চোখে জল দেখা?
নাকি সেই প্রতিটা অশ্রু বিন্দুতে অন্য কারো উপস্থিতি টের পাওয়াটা কষ্টের?
আমি জানি না। এই প্রশ্নগুলোর উত্তরে কেবল নিকষ কালো অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখছি না।
কিন্তু আমার যে অনেক কাজ বাকি। বাকি কিছু কথা রাখার।
সকাল সকাল মেঘাদের বাড়ি গেলাম। মেয়েটার চোখে মুখে আগের মতো খুশির ঝলকানিটা নেই। নেই সেই দুরন্তপনাও। বড়োজোর অনেকখানি হতাশা আছে। অথবা চেপে রাখা কিছু ঘৃণা। জানি ও খুব সহজেই বুঝে নিবে আমার আসার কারণ। নিজেকে বহু কষ্টে বোঝালাম। জোর করে মানুষটাকে হয়ত পাওয়া যাবে।কিন্তু তার মন থেকে যাবে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
-মেঘা। শুনলাম তুই নাকি বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেছিস?
-হ্যাঁ।
-কেন?
মেঘা ২ মিনিট আমার মুখের দিকে চুপ করে চেয়ে রইল।
-আবিরের কথা কিছু বললি না তো?
-কি বলব?
-কি বলব মানে কি? তুই ওকে ভালোবাসিস না?
-বাসি। অনেক ভালোবাসি। কিন্তু আবিরের কথা আপনি কেন জিজ্ঞেস করছেন?
-আমার উপর এতো খেপেছিস কেন? বিয়েতে তুই তো রাজি হলি। আমি বলেছিলাম নাকি রাজি হতে?
তোকে বিয়ে করলে তুইও কষ্টে থাকবি। আমিও থাকব মহাকষ্টে। তাই এই বিয়েতে ভাই আমি রাজি না।
মেঘা হা করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। বহু ইচ্ছে ছিল ওকে অবাক করে দিয়ে দেখব, অবাক হলে ওকে কেমন লাগে। তবে সেটা যে এই পরিস্থিতিতে হবে, আশাও করিনি কখনো
-হা করে তাকিয়ে আছিস কেন? আমি একজনকে খুব ভালোবাসি। তাই তোকে বিয়ে করতে পারব না। ওকে কষ্ট দেওয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে।।
-আমি।
-তোর আবিরের কথা তো কিছু বললি না? কে propose করেছিল? তুই নাকি ?
আবিরের কথায় মেঘার মুখে সেই হাসি ফুটল আবার।
-কেউ না।
-কেউ না মানে কি?
-বলা হয়নি কখনো। এবার ভেবেছিলাম গিয়ে বলে দিব। কিন্তু ।
-বলে দিস। না বললে পরে হয়ত আর কখনোই বলতে পারবি না।
-হুঁ?
-কিছু না। তো পাগলি রাজি হতে গেলি কেন?
-কি করব? বাবা যখন বলল: "মা রে,খুব বড় একটা ভুল হয়ে গেছে। মাফ করে দিস। তোমার মত ছাড়াই তোর বিয়েটা ঠিক করে ফেলেছি। কোন অন্যায় করিনি তো?" তখন বাবাকে কি করে বলতাম, ভুল করেছ বাবা, অনেক বড় ভুল? মৃত্যু পথযাত্রী বাবাকে কি করে বলতাম যে অন্য কাউকে ভালোবাসি আমি?
-হলো। এখন আর কাঁদিস না। এক কাজ কর। আবীরকে কল করে কথা বল। আমি আসছি।
-তোমার রাজকুমারীর কথা বললে না তো।
-পরে একদিন বলব। এখন আসি।
-হুঁম।
মেঘা হয়ত আবীরকে কল দিয়েছে। হয়ত চোখের জলে আবার কোনো মধুর কাহিনী রচিত হচ্ছে। আমি বেরিয়ে পড়েছি রাস্তায়। হাঁটছি আর ভাবছি। ভাবছি আর হাঁটছি। তুমি আমার রাজকুমারীটার গল্প শুনতে চেয়েছিলে। শোনানো হল না। হবেও না কখনো। কিছু কথা পৃথিবীর অজানাই থেকে যায়। তৃতীয় কোনো ব্যক্তির ভালোবাসা পৃথিবী কখনো জানতে পারেনা। অথচ পৃথিবীতে ভালোবাসার জন্য ভালোবাসাই বলি দেয় এই তৃতীয় ব্যক্তিরা।