তুহিন খান
তুহিন খানের পাঁচটি কবিতা
প্রকাশিত : জানুয়ারি ০১, ২০২১
নরমাল দিনগুলিতেও যেসব অগুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটতে পারে
কিছুই হয়তো না। কিছু না হওয়ার ভিতরেই ঘটনাগুলা ঘটে। সবসময়, দেখবা৷ একটা নরমাল দিনেই বিকালবেলা মুরগির খোঁয়ারে ভাঙা ডিমের কুসুমে মিশা থাকে লালরক্ত। চরাখেত পর্যন্ত খুঁজলে পালক। বাতাসে গোত্তা খাইতে থাকা একটা রোমশ সন্ধ্যা।
এইরকম সন্ধ্যায় সূর্যরে মনে হইতে পারে রক্তেগোলা হাঁসের ডিমের কুসুম। লাল আর কমলার মিশালে একটা রঙ। এই রঙ দেখলে সব মায়ের মনে পড়ে তার বিয়ার রাইতের কথা। বেলা বিস্কুটের গুঁড়ার মতো একটা অস্বস্তি লাইগা থাকে ছোটদের জিভে।
তেমন কিছুই হয়তো না। কিন্তু হরতালের দিনই বৃষ্টি। রুলিং-অপজিশন সবাই চায়ের দোকানে। টিভিতে সাপের ছবি আর ফাটাকেস্ট। এক টাকার শ্যাম্পু দিয়া বানানো বুদ্বুদে লাল-নীল বাবল। ফুটলেই আকাশ লাল, হাসান-হোসেনের তাজা রক্ত!
নরমাল দিনগুলাতেই জীবন থিকা পিছায়ে পড়া লাগতে পারে পাঁচ মিনিট। যদি মেডিকেল মোড় থিকা দেখা যায়, চানখারপুলে দাঁড়ানো আছে একটা সবুজ `মৌমিতা`। তখন নিজের সমস্ত নক্ষত্রের যোগ এক করলেও পাঁচ মিনিট হয় না। গাড়ি চইলা যায় যাত্রাবাড়ি।
গ্রাম থিকা শহরে আসা লোকেরা পরের বাসে ওঠেন। পরের বাস সবসময়ই সেফ অপশন, পরের বাসটাই গন্তব্যে সহি-সালামত পৌঁছার ব্যাপারে বাড়তি নিশ্চয়তা। পরিচিত দৃশ্য, তবু একবার চেক করা। ছোটখাটো চেঞ্জগুলারে মাইনা নিতে পারার নির্মল উত্তেজনা। চেঞ্জ আর কী, যেদিক দিয়াই আসো, সামনে মুরগিপট্টি। হালাল গোশতের লাইনে ছোট্ট একটা গ্যাপ, লাগে যেন আমার জন্যই। প্রত্যেকবারই মনে হয় শীতকাল— শরীরভর্তি শাদা পালকের সুখ। বাতাসে একটা খারাপ গন্ধের দে জা ভ্যু।
হয়তো গুরুতর কিছুই না। কিন্তু, কারুর শাদা পায়জামায় রক্তের দাগ। ক্যালেণ্ডারে ছুটির দিনগুলাই খালি লাল।
ডেথ ইন দ্য টাইম অফ করোনা
লিলিয়াকে
চারিদিকেই মৃত্যু হচ্ছে। তারমধ্যে তুমিও যদি মরো, শোক কীভাবে হবে? ইন্নালিল্লাহ পড়তে গিয়া কার কথা যে ভাবতে গিয়া কার কথা যে ভাইবা বসব, কার খাটিয়ায় কার শরীরের গন্ধ পাব, কার জানাযায় কেমন দোয়া কার শ্মশানে কেমন ধোঁয়া— এইগুলি কি বুঝতে পারব?
সবাই এখন বাসায় থাকবে, নতুন কিছুর আশায় থাকবে— তাই তো, নাকি? একাকিত্বের ডিউরেশন, মেধাও মাপে অটোমেশন— সবখানেই তো বাঁশ! তার ভিতরে আবার তোমার লাশ— বৃষ্টিতে যায় ধুয়ে। মুরব্বিরা হালকাচালে নুয়ে, কয়বরে দেয় মাটি। এমন পরিপাটি একটা গোসল হয়তো প্রত্যেকেই ডিজার্ভ করে, প্রিজার্ভ করে মাথার দিকে ছোট্ট একটা চারা। এমন সময় মরলা লিলি, শোক করবে কারা?
কারো তো শোক করাই লাগে, নাইলে সবার পাপ। শোক তো তেমন কঠিনও না, বছর বছর খুঁজতে একটু কষ্ট হবে তোমার এপিটাফ।
ফুল্লরাকে, মানুষ-পোড়া-দিনে...
কই দেব দাড়ি আর কই দেব কমা
বাকশালে বাক্য শিখে প্রেমের কলমা
কী করে সাজাব আমি?— পেঁয়াজের ঝাঁঝে
তোমারও তো চোখ পোড়ে; করুণ আনাজে
কী করে মিশাও প্রিয়া আনোখা আতর
সঙ্গমে কাযা হয় জরুরি ফজর
উনুনে তোমার জ্বলে দ্বীনের মশাল
মশলাসমেত এই ফাসেক সকাল—
আমাদের বাসনের, বাসনার `পরে
রিযিক রিযিক ধ্বনি হাহাকার করে
এইত চাইছ তুমি: প্রেম আর ভুখ
আল্লাহ আর আমি— দুই ব্যাকুল মাশুক
মিশে আছি এবাদতে, মিশে আছি পাপে
ইতিহাস ফিরে এসে কাঁদে অনুতাপে—
মানুষ পোড়ার দিনে ছায়া, ফুল্লরা
মটরশুঁটির সাথে কুমড়ার বড়া
রানতে রানতে দ্যাও ডালের বাগার
আইএস ফেরত ছেলে আসবে তোমার
জেহাদ জেহাদ বলে ঘন হবে রাত
হাত পাতো ফুল্লরা, করাও বায়াত
সিনা চাক করে দাও রুহের এলাজ
ইমামত নেও সখি, পড়াও নামাজ…
ঊর্মিদের মফস্বলি মন
এমন শীতের দিনে খুলতে চাই উষ্ণ অভিধান
`স্পর্শকাতর` শব্দে কতটুকু স্পর্শ আর
কতটুকু কাতরতা? এই নিয়ে স্টিল ব্যাচেলার
কারো জ্ঞানপিপাসায় বন্ধ হচ্ছে চায়ের দোকান...
বিজ্ঞাপনের বাইরে, ঘুমঘুম ব্লার দুনিয়ায়
কোথাও তো কুয়াশায় ভিজতেছে কোমরের তাগা
ফুল্লরার!—দেখে দেখে মজা নেয় কে যে হতভাগা
মুভিতে দেখছি মেবি: যে কাপল হানিমুনে যায়
তাদের ওখানেও থাকে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ, ঝাপসা বন
আলো অল্পই থাকে— থাকে না তো— এসব স্পটে
হানিমুনে বেসিক্যালি এগুলাই মনে হয় ঘটে
অবশ্য নিজের মতো ভেবে নেয় মূর্খ জনগণ
শীতকালে শহরের সামগ্রিক দৃশ্য-সংকটে
ভেসে ওঠে ডানাকাটা ঊর্মিদের মফস্বলি মন।
শীত ও বসন্তের সন্ধিকালীন কয়েকটি পঙ্ক্তি
১.
ঋতুবিষয়ক সচেতনতা নেই, তাই— কোনোদিনও বুঝতে পারি না তোমার হঠাৎ শাড়ি পরার রহস্য! ঠোঁটে লিপজেলের বদলে গন্দম, কানে কানটুপির বদলে রক্তজবা— ঋতুবিষয়ক অজ্ঞতাহেতু, এসব কিছুই আমি কোনোদিন বুঝতে পারি না।
তবু শীতের কার্ফ্যু ভেঙে, নতুন নন্দনের জন্মলগ্নে আমাদের আবার দেখা হয়ে যায়, কোনো এক আগুনমুখো মেলায়। তুমি ততদিনে রপ্ত করেছ নিজস্ব বাকরীতি। বাড়তি শব্দের টিনএজ প্রগলভতাগুলা ঝেড়ে ফেলে, নাক থেকে ঘামের ঐশ্বর্য মুছে নিয়ে বলো— `এখনো সোয়েটার?!` যতিচিহ্নে নাজেহাল আমি খেয়াল করে দেখি: এখনো আমার গায়ে অসংখ্য অতিথি পাখির পালক লেগে আছে। তুমি সেগুলো ছুঁয়ে দিতেই আমার শীতকালীন জড়তা ভেঙে দিয়ে, শত শত পাখি উড়ে যায় সাইবেরিয়ার দিকে!
২.
বসন্তে নতুন পাতা দেখে তুমি বরাবর খোশদিল। নিশ্বাসে বুকভর্তি ক্লোরোফিল টেনে ন্যাও, শরীরে কচি বাঁশপাতার চাঞ্চল্য, ঋজুতা; জলপাইরঙা শাড়ির ক্যামোফ্লেজে ঢাকা হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো। কলমি-কচুরিপানা-শ্যাওলায় হারানো, আমার মার্বেল আর রাবারের বলগুলি— চোখে-বুকে জমায়ে রাখলা এতদিন! মাঝেমাঝে ভাবি, তুমি বনদেবি। গাছগাছালির ঢালে এক আদিম মফস্বল। হালকা হন্টেড; বাসের জানালা দিয়া দেখার মতোই, দূরে। আমি তো রাস্তা ভুলি, গুগল ম্যাপে ডিরেকশন খুঁজি।
পাতাদের আলাপে তবু, তোমার কোনো ক্লান্তি নাই। ভাবি বুচ্ছ— তুমি এক সবুজ তেঁতুল গাছ। আমি তলায় বসতে বসতে মগজ খুইয়ে ফেলা আঁতেল বালক।