প্রতীকী ছবি
তুহিন খানের গদ্য ‘র্যাগিংয়ের রূপরেখা’
প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২০
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তেমন কোনও র্যাগিংয়ের কালচার নাই। গেস্টরুম আছে, সেইটা অবশ্য `ম্যানার` শেখানোর একটা জায়গা। এছাড়া ডিপার্টমেন্টবিশেষে কিছু ছিঁচকে র্যাগার থাকেন, জুনিয়রদের র্যাগ না দিলে যাদের `সিনিয়রত্ব` অলটাইম হুমকির মুখে থাকে। এছাড়া আরেকটা ফর্ম অবশ্য আছে র্যাগিংয়ের। এইটা পালন করে ক্যাম্পাসের ফার্স্ট ইয়ার। এর নাম দেওয়া যাক— গা গরম করা-মূলক র্যাগিং।
এই র্যাগিংয়ের রূপরেখা কী? ক্যাম্পাসে ফার্স্ট ইয়ার কী করে? নিয়মিত গেস্টরুম করা, প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রোগ্রাম করা, রাতে দলবেন্ধে উদভ্রান্তের মতো ঘোরাঘুরি করা আর মেয়েদের হলের সামনে শ্লোগান দেওয়া, মাঝেমাঝে ক্যাম্পাসের ইধার-উধার গ্যাঞ্জাম লাগিয়ে ভাইদের নজরে আসা আর `কোনও একটি` বা `কতিপয়` ভাইরে তেলের সমুদ্রে ছেড়ে দিয়ে তার পলিটিকাল ক্যারিয়ারের গ্যাস্ট্রিক বাঁধানো— মোটামুটি এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই ক্যাম্পাসে জন্ম নেয় আগামী দিনের দুর্ধর্ষ জাতির কাণ্ডারি নেতাটি/নেত্রীটি (নেত্রীদের অবশ্য এতকিছু করা লাগে কিনা, বা এরচে বাড়তি আরো কিছু করা লাগে কিনা, এ ব্যাপারে লোকমুখে নানা মত প্রচলিত। ভব্যতাবোধে সেগুলা এড়ায়ে যাওয়াই কাম্য)।
এই প্রক্রিয়ার ভেতরেরই একটি ব্যাপার হলো— গা গরম করা-মূলক র্যাগিং। রাজনীতিতে তৃণমূলের রক্ত থাকে সবসময়ই গরম। তারা নরম পলিটিক্স চান না, তাদের দরকার গরম পলিটিক্স। কিন্তু, ভাইদের তেল মেরে মেরে মেদ ঝুলিয়ে নেতার আদল তৈরি করাই যেখানে পলিটিক্সের সর্বস্ব, সেখানে গরম পলিটিক্স করার আর সুযোগ কই! সুযোগ আসলেই কম। ক্যাম্পাসে গ্যাঞ্জাম সবাই করতে পারে না। যারা পারে না, তারা পলিটিক্সেও উন্নতি করতে পারে না। ফলে, এমন একটা কিছু থাকা দরকার, যেখানে সবাই নিজেদের পলিটিকাল সেন্সটিরে একটু ঝালিয়ে নিতে পারে। এইটিই মূলত এই র্যাগিংয়ের উদ্দেশ্য।
এই র্যাগিংয়ের এরিয়া নির্দিষ্ট—ভিসি চত্বর থেকে ফুলার রোড, মল চত্বর থেকে শ্যাডো ঘুরেটুরে সোশাল সাইন্স হয়ে হাকিম। সাইন্সের হলগুলির জন্য কার্জনের অভয়ারণ্য ও তৎসংলগ্ন এলাকা। কাজটি এই—অত্র এরিয়ায় যত `কাপল` আছেন, তাদের বিরুদ্ধে চড়াও হওয়া। প্রক্রিয়াটি অবশ্য যথেষ্টই স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক। প্রথমে জেনে নিতে হবে, কাপলটি ভার্সিটিরই কিনা। এ তর্কের মীমাংসা হবে আইডি কার্ডের উছিলায়। যদি ক্যাম্পাসেরই হয়, তাইলে তাৎক্ষনিকভাবে ব্যাপারটি শ্লীল বলে গণ্য হবে। বিপত্তি হবে, যদি আপনি সেরম না হন। সেইক্ষেত্রে ধমক, ধস্তাধস্তি থেকে শুরু কইরা লাঠির বাড়িও আপনার জুটতে পারে কপালে—ভগবানের মর্জি।
র্যাগিংয়ের এই ধরণটিতে আমার শরিকানা প্রত্যক্ষ ও পৌণঃপুনিক। ব্যাপারটা মজার তো বটেই, সাইকোলজিকালি এইটা একটা রিলিফও বটে। এটি আমি দায়িত্ব নিয়াই বলতেছি। আমাদের সমাজে প্রেম এবং নারীসঙ্গের গুরুত্ব মোটেই কম নয়। রাজনীতিতে তো আরো জরুরি ব্যাপার। ক্যাম্পাসে `ভাই` হয়া ওঠার ক্ষেত্রে এক বা একাধিক সুশ্রী `ভাবি`র বিকল্প বিরল। তো, এই যখন অবস্থা, তখন বাস্তবতা হইলো—সমাজ ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি যেইভাবে নারীবিষয়ক চাহিদাটিরে গুরুত্বপূর্ণ কইরা তুলছে লোকচক্ষে, সেই তুলনায় সাপ্লাই যথেষ্ট নয়। অনেকেরই শতচেষ্টার পরেও প্রেম হয় না। এইটা তার দোষ বা ব্যর্থতা না, এইটা হইলো সমাজব্যবস্থার সমস্যা। ফলাফলে, সমাজে মানুশের মধ্যে জেলাশি তৈরি হয়। রাস্তায় বইসা থাকা যেসব কাপলরে দেখে একদা আপনে হীনমন্যতায় ভুগতেন, তাদেরেই আজ অপমান করার সুযোগ আপনি পাইতেছেন—এরচে ভালো সাইকোলজিক্যাল রিলিফ, এই জেলাশির, আপাতত নাই।
যাহোক, আমার তাজরেবা এই যে, এইসব ঘটনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ছেলেগুলি। নারীরা এইখানে এমপাওয়ারমেন্টের শীর্ষে; ক্যাম্পাসে `নারীকেস` যে কত ভয়াবহ, তা গেস্টরুমের প্রথম কয়েকদিনের সবকেরই গুরুত্বপূর্ণ চ্যাপ্টার। ক্যাম্পাসে পলিটিকাল ফার্স্ট ইয়ারের ৯০% ছেলেপুলেরই নানামেয়াদি শাস্তি হয় কেবল এই একটি অপরাধের কারণেই (শাস্তিগুলি কার্যকর কতটা হয়, এই নিয়া লোকমুখে নানান কথা প্রচলিত। শোনা কথায় কান না দিয়াও বলার ব্যাপারটি এই যে, এই শাস্তি না হওয়াটা ভালোই। সমস্যার গোড়ায় হাত না দিয়া, ফার্স্ট ইয়ারের মফস্বল থিকা আসা একটা ছেলেরে বহিষ্কার বা অন্যান্য শাস্তি দেওয়ার মত ফালতু কাজ আর হয় না)। তো, এইজন্যে নারীটিরে কেউ ঘাঁটায় না। এসব ঘটনায় নারীটি প্রায়শই চঞ্চলচোখে ও চিত্তে চুপটি করে দাঁড়ায়ে থাকেন। আমার অভিজ্ঞতা হইলো, কোন কোন নারী বিপদের গন্ধ পেয়ে মায়াবন বিহারিণী হরিণীর মতন দূরে চলে যান, দূর হইতে ঘটনাটিরে অবলোকন করেন। মানে, আমি দাঁড়াইলাম; ঝামেলা টামেলা মিটায়ে যদি আসতে পারো, তবেই আবার প্রেম-টেম করা যাবে।
আমার বিশ্বাস, এইসব পরিস্থিতিতে মেয়েগুলি যদি তার প্রেমিকের পাশে দাঁড়ায়, তবে ভাল হয়। ক্ষুদে র্যাগারগুলো তখন ভয় পায়, `নারীকেস` যেহেতু। বিপরীতে প্রেমিকটি পায় সাহস। যে পুরুষের হাত ধরে থাকে তার প্রেমিকা, তারে হারানো মুশকিল। আবার, মেয়েটি যদি ঘুরে দাঁড়ায়ে বিপদে পড়েও কোনভাবে, সেক্ষেত্রে এই ঘটনার মীমাংসা করবে বাঙলার দিগবিজয়ী মিডিয়া। তাই, যেকোনভাবেই নারীর ইন্টারফেয়ার এক্ষেত্রে অবশ্য করণীয়টাইপ ব্যাপার।
ফলে, আমার আহ্বান বা আর্তি এই যে, ক্যাম্পাসের এইসব র্যাগারদের—অধুনা যারা `সিঙ্গেল কমিটি`র ব্যানারে `পুঁজিবাদী প্রেম`র বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিপ্লবে অবতীর্ণ—মোকাবেলা করার জন্য নারীদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করা দরকার। আপনার পুরুষটিরে যখন `লুচ্চা` বলা হয়, তখন আপনার এমনভাবে লজ্জাবতী পাতাবৎ চুপসায়ে যাওয়া অনুচিত, যে আপনার পুরুষটির মনে হয়, যেন আসলেই সে একটা লুচ্চা। নারী পুরুষ পরস্পরের ভয় না, বরং তারা একে অন্যের বরাভয়। আপনার প্রেমিকরে লাঞ্চিত হইতে দেখলে ভয়ে সিঁটকে যায়েন না। তার হাত ধরেন, এবং রুখে দাঁড়ান। ভয় নয়, প্রেম হউক বরাভয়। জগতের সকল প্রেমেরই সত্য নিয়তি এইটুকুই।