তুহিন খানের গদ্য ‘বরিশালের আঞ্চলিক ভাষার বৈশিষ্ট্য’

প্রকাশিত : মার্চ ২২, ২০২৩

বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলের ভাষা নানাদিক থেকে পুব অঞ্চলের বাঙলাভাষার একদম র ভার্শন। বাঙলা ভাষার শব্দ বা বর্ণগুলা উচ্চারণের ক্ষেত্রে পুববাঙলার মানুশের সাধারণ রীতি, ঝোঁক ও স্বভাবের একটা বড় অংশই সম্ভবত ধরা আছে বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায়। কোলকাতার মুভিগুলায় পুববাঙলার কোন চরিত্রের মুখে সাধারণত যে ভাষাটা ওরা তুইলা দ্যায় (পুববাঙলার ভাষা হিশাবে), তার সাথেও বরিশালের ভাষার সাদৃশ্য ব্যাপক। বরিশালের ভাষার কিছু বৈশিষ্ট্য আছে এমন, যেগুলা সাধারণভাবে পুববাঙলার মানুশের উচ্চারণরীতিরই বৈশিষ্ট্য, যা বিশেষভাবে বরিশালের ভাষারীতি থেকে উদ্ভুত হইছে মর্মে আমার ধারণা। এখানে তেমন কিছু বৈশিষ্ট্য দিলাম:


১. ই,উ স্বরধ্বনির ক্ষেত্রে অপিনিহিতির ব্যবহার। যেমন: রাখিয়া>রাইখ্যা, আজি>আইজ।
২. “এ” কারের উচ্চারণ অনেক সময় “এ্যা” হয়। যেমন: বেল>ব্যাল, মেঘ>ম্যাগ, দেশ>দ্যাশ।
৩. কখনাে কখনাে অনুনাসিক স্বরধ্বনিতে অর্ধঅনুনাসিকের ব্যবহার পাওয়া যায়। যথা: চাঁদা>চান্দা, আঁধার>আন্ধার।
৪. অনুনাসিক স্বরধ্বনির পরবর্তী বর্ণ লুপ্ত হয়; অনুনাসিক ধ্বনিটি `ন` বর্ণে বদল হয়ে সেই শূন্যস্থানে বসে। যথা: চাঁদ>চান, ফাঁদ>ফান, পোঁদ>পোন।
৫. মহাপ্রাণ ঘােষ ধ্বনি অল্পপ্রাণ ঘােষ ধ্বনি হয়। যথা: দুধ>দুদ, ভাত>বাত, মেঘ>মেগ।
৬. পদের আদ্যাক্ষর “শ” “ষ” “স” ধ্বনি “হ” ধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়। যথা: শালিক>হালিক, শামুক>হামুক, সকাল>হকাল, শৌল>হৌল, শালা>হালা, শশুর>হৌর, শাড়ী>হাড়ী ইত্যাদি।
৭. অন্ত “ক” ও “খ” ধ্বনি “হ” ধ্বনি হয়। যথা: টাকা>টাহা, দেখা>দেহা, লেখা>লেহা।
৮. অনেক সময় “র” ধ্বনি “ল” হয়। যথা: শরীর>শরীল।
৯. কখনাে কখনাে “ল” এর উচ্চারণ “ন” হয়। যথা: লাঙ্গল>নাঙ্গল, লােনা>নােনা ইত্যাদি।
১০. কর্মসম্প্রদানের একবচন বা বহুবচনে “রে” বিভক্তি। যথা: হ্যারে কও (তাকে বল), হগলডিরে ডাকো (সবাইকে ডাকো)।
১১. কর্তৃকারকে এক বচনে “এ্যা” বিভক্তি। যথা: সফিজ্যা বাড়ী গ্যাছে, করিম্যা এদিগে আয় ।
১২. করণকারকে `দিয়া` বিভক্তি মূলশব্দের সাথে যুক্ত হয়ে `দ্যা` বা `অ্যা` বিভক্তিতে পরিণত হওয়া। যথা: লাডিদ্যা পিডাও।
১৩. সাধারণত করণকারকে `দিয়া` বিভক্তি হয়। কিন্তু বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় অপাদান কারকেও `দিয়া` বিভক্তি ব্যবহৃত হয়। যথা: গাছ দিয়া নাহোইল পার, নদী দিয়া মাছ ধরমু।
১৪. ভবিষ্যতকালের উত্তম পুরুষের ক্রিয়া পদে `মু` বিভক্তি। যথা: করমু, খামু, যামু, মারমু ইত্যাদি।


নীচে বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলের কিছু শব্দ ও তার অর্থ (একান্ত প্রয়োজনবোধে উদাহরণসহ) দেওয়া হইল:
অজাত— দুষ্ট
আইতনা—দাওয়া, ড্রয়িংরুম
আলুডি— চাষবাস
আদার— হাঁস/মুরগি/মাছের খাবার; বরশির টোপ হিশেবে ব্যবহৃত কেঁচো/খাবার
আইচা— নারিকেলের খোল
আচুক্কা—হঠাৎ
আলামতারার মুনশি— হুজুর অর্থে (তুচ্ছার্থে)
আনাডা—দুষ্টামি
আটখোলা—হাট
আয়জান—আজান
আডু—হাঁটু
উদলা—উদোম
উমাইন্না—উমে বসা মুরগি
একছের—অনেক
ওশ্যাঘর/ওশ্যা— রান্নাঘর
কুহইল—কুয়াশা
কউররা ত্যাল— সরিষার তেল
কোলা— ধানক্ষেত/ধান চাষের নীচু জমি
কদু— লাউ
কেরেস্ত্যাল— কেরোসিন
কেনু— মাইর
কাহোই— চিরুনি/কাকরোল
কোম্মে— কোথায়?
কোম্বা/কোম্ফা— পেঁপে
কইলোম—সতর্কীকরণ অর্থে ব্যবহৃত `কিন্তু` অর্থে (মুই কইলোম খামু না/দুদু কইলোম মাস্টার্স পাশ)
কাউয়া—কাক
ক্যাতকুলি—বগল
খাডাল— ফ্লোর
খামার—গালি
খাতা— কাঁথা
গুরাগারা— বাচ্চা পোলাপান
গুইল—গুইসাপ
গুয়া— সুপারি
গুরমুইড়্যা— পায়ের গোড়ালি
চুলাহাল—রান্নাঘর
চুক্কা—টক
চ্যাংড়ামি—শয়তানি
চার—সাকোঁ
ছোলোম— জাম্বুরা
ছামা— যোনী (গালি অর্থে বহুল ব্যবহৃত)
ছাতি—ছাতা
ছাতা—ময়লা
জিবরা—জিভ
টাহা— টাকা
ট্যাংগা— তেঁতুল
টাগরা—আলজিভ
ঠাডা— বজ্রপাত
ড্যাবরা— বাঁ হাতি
তামাইত—পর্যন্ত
দাউর— লাকড়ি/কড়িকাঠ
দাদো—বড়/ছোট কাউকে শ্রদ্ধা/স্নেহবশত ডাকতে ব্যবহৃত শব্দ
দুহইর/দুহার/দুহাইর‍্যাকাল— দুপুরবেলা
দুদু— চাচা/ভাই/মিয়া অর্থে ব্যবহৃত
দ্যাওই— বৃষ্টি
নামা—মেঝে
ন্যাবাই— মিয়া ভাইয়ের অপভ্রংশ (সম্ভবত)
নাহোইল— নারিকেল
নোমো—হিন্দু
প্যালা— বোল/গামলা/বাটি
পাইলা— পাতিল
পিছা— ঝাড়ু
পুষ্কুনি—পুকুর
পোমা—মোটা/ফোলা
পাতিহাল—খেকশিয়াল
প্যানাপোডা— ফাও কথা বলতে থাকা
বিলোই— বিড়াল
বেইন্নাহাল— সকাল
বিচরানো—খোঁজা
বোলানো—ডাকা
বেমালা—অনেক
বোগদা/ভোগদা— বোকা
বোলে—জিজ্ঞাসাবাচক `নাকি` (তুই বোলে চাকরি পাইছ?)
মুরহা—মুর্গি
মাতারি—মহিলা
মাইজ্জা—মেঝো
লাগড়—নাগাল
লকেট/লকট— জামরুল
শালুন— তরকারি
শেরেজ/শেরেছ/রেন্ডি গাছ— রেইনট্রি
হাক্কা— সাঁকো
হব্রি—পেয়ারা
হুররা— ঝোল
হাতার— সাঁতার
হাপ—সাপ
হলা—শলা
হলক— পরিষ্কার, আলোকিত, উজ্জ্বল
হরা—সরা/ঢাকনা
হোগা—পাছা
হগোলডি—সবাই
হাইজ্জা—সেঝো
হিদলা— শ্যাওলা/স্যাঁতসেঁতে ভাব