তুহিন খানের গদ্য ‘নোট অন বাঙলাদেশি জাতিবাদ’

প্রকাশিত : জুলাই ১৬, ২০২৩

মাহমুদুর রহমান তার ‘পলিটিকাল হিস্ট্রি অব মুসলিম বেঙ্গল’ বইতে জিয়া প্রবর্তিত ‘বাঙলাদেশি জাতিবাদ’রে ‘মুসলিম জাতিবাদ’ বলতে চাইছেন। মাহমুদুরের আগে ও পরে আরও অনেক লেখক ও অ্যাকাডেমিশিয়ান— যাদের মধ্যে সেক্যুলার ও বাঙালি জাতিবাদিরাও আছেন— বাঙলাদেশি জাতিবাদরে ‘ধর্মভিত্তিক’ বা ‘মুসলিম জাতিবাদ’ বলতে চাইছেন। আমি মনে করি, এইটা এক ধরনের প্রোপাগাণ্ডা এবং তৎকালীন রাজনীতির ডামাডোলে ‘বাঙলাদেশি জাতিবাদ’ আইডিয়াটা অবজেক্টিভলি বিকশিত না হওয়ার ফল।

 

বাঙলাদেশি জাতিবাদ আশলে কী? লেখক ও গবেষক হাসান মাহমুদ ভাইয়ের এক পোস্টে তা নিয়া আমার আইডিয়াটা ছোট করে জানাইছি। এখানে ওই কমেন্টটারই আরেকটু পরিমার্জিত রূপ প্রকাশ করলাম:

 

বাঙলাদেশি জাতিবাদের কোন সর্বজনমান্য আর্টিকুলেশন নাই। যদিও রাজনৈতিক কারণে বাঙালি জাতিবাদিদের অনেকেই এটারে ‘মুসলিম জাতিবাদ’র অপভ্রংশ বলছেন; আর মুসলিম জাতিবাদিরা স্বাভাবিক কারণেই সেটারে লুফে নিছেন। কিন্তু এইটারে আমি প্রোপাগাণ্ডা, বা আরেকটু ভদ্র ভাষায় বললে, ভুল আর্টিকুলেশন হিশাবেই দেখতে চাই।

 

জিয়াউর রহমানের ‘আমার রাজনীতির রুপরেখা’য় বাঙলাদেশি জাতিবাদের যে সংজ্ঞা ও বর্ণনা দেওয়া হইছে, তা আরো বিগার দ্যান ‘ইসলামভিত্তিক’। জিয়া পাকিস্তান আমলের মুসলিম জাতিবাদের ক্রিটিক করছেন। জিয়া তার এই জাতিবাদরে বলছেন ‘সার্বিক জাতিবাদ’, যেখানে ভাষা, কালচার, ধর্ম, বর্ণ— কোন উপাদানই ফেলনা না। সবগুলা উপাদানের মিশ্রণটাই এর কোর উপাদান; কোন একটা নির্দিষ্ট উপাদান এর কোর না। ফলে, এই জাতিবাদ অনেক ফ্লুইড; এর ইলাস্টিসিটি অনেক বেশি।

 

আদতে ক্ল্যাসিক সেন্সে এইটা কোন জাতিবাদও না। এইটা মূলত ফেডারেল স্টেটগুলার আদলে বানানো এক ধরনের রাষ্ট্রবাদ। এই জাতিবাদের মধ্যে মডার্ন সিটিজেনশিপ ও ওয়েলফেয়ার স্টেটের আইডিয়া আছে। সোশাল ও ইকোনমিক জাস্টিসের আইডিয়াও আছে, খুব প্রকাশ্যেই। জিয়া বারবার লেখছেন যে, এই জাতিবাদের উদ্দেশ্য হইল শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিপ্লব। আর বিপ্লব মানে হইল সোশাল ও ইকোনমিক জাস্টিস। এটা এক ধরনের সোশাল ডেমোক্রেটিক অবস্থানও।

 

জিয়া দূরদর্শী ছিলেন। তাই যেকোন মডার্ন স্টেটের মত জিয়া বহুদলীয় গণতন্ত্ররে এই ধরনের জাতিবাদ চর্চার জন্য গুরুতর ভাবছেন। একাত্তরের সাপ্রেসড গ্রুপটারে ফলে উনি রাজনীতিতে আসতে দিছেন। সমস্যা হইল, আওয়ামিপন্থী ও বামদের একাংশের তৎকালীন সংকীর্ণ বাঙালি জাতিবাদি দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তারা এইটারে ‘মৌলবাদ’র নামে অ্যাটাক করতে চাইছে৷ তারা এইটারে পাকিস্তানের ফিরা আসা হিশাবে ব্যাখ্যা করতে চাইছে। বিপরীতে মুসলিম জাতিবাদিরা সেই অ্যাটাকরে নিজেদের ন্যারেটিভ নির্মাণের জন্য ফায়দাজনক ভাইবা জাস্টিফাই করছে।

 

সাংস্কৃতিক রাজনীতির জগতে এই বাইনারি এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, বিএনপি বাঙলাদেশি জাতিবাদরে আর ফারদার এক্সপ্লোর করতে পারে নাই; রাজনীতির প্রয়োজনে আগের ওই বাইনারিতেই সাবস্ক্রাইব করছে। আর একাত্তর বা তারও আগ থেকে নির্মিত এই বাইনারির কবলে পইড়া, বাঙলাদেশি জাতিবাদের আইডিয়াটা বিকশিতই হইতে পারে নাই; বরং ‘বাঙালি জাতিবাদ’ বনাম ‘মুসলিম জাতিবাদ’র পুরান বৃত্তেই হারায়ে গেছে। মোহাম্মদ আজম তার ‘সাংস্কৃতিক রাজনীতি ও বাংলাদেশ’ বইয়ের ভূমিকায় এই ব্যাপারটাই আরো বিশদে ব্যাখ্যা করছেন।

 

কিন্তু বাঙলাদেশি জাতিবাদ মূলত ‘সার্বিক জাতিবাদ’ই, ‘ইসলামভিত্তিক’ না। এটা জিয়ার আমলে এবং নব্বই-পরবর্তী বিএনপির রাজনীতিতেও পষ্টই ফুটে উঠছে। ফলে অ্যাকাডেমিকেলি এর যেসব আর্টিকুলেশন বাজারে চালু আছে, সেগুলারে রিভাইজ কইরা অ্যাকাডেমিক স্ক্রুটিনির মধ্যে আনা জরুরি বইলাই মনে করি।