তুহিন খানের গদ্য ‘জঙ্গিদমনের গল্প’
পর্ব ২
প্রকাশিত : মে ০৯, ২০২১
ফাহিমের লাশ যেদিন তার বাপ-মা`র কাছে হস্তান্তর করা হয়, ঠিক ওইদিনই ১৯ জুন সকালে, আরেকটি ক্রসফায়ারের খবর দেয় পুলিশ। গোয়েন্দা পুলিশের ভাষ্যমতে, রাতে ঢাকার মেরাদিয়া থেকে ডেমরা যাওয়ার সড়কে একটি মোটরসাইকেলে তিনজন আরোহীকে ধাওয়া করে তাদের একটি দল। পুলিশের দিকে তারা গুলি ছুড়লে পুলিশও পাল্টা গুলি ছোড়ে। এতে একজন নিহত হয়।
পুলিশ খুন হওয়া লোকটারে আনসার আল ইসলামের শীর্ষ সংগঠক দাবি করে। এমনকি তারে বলা হয় ব্লগার হত্যার `মাস্টারমাইন্ড`। পুলিশের ভাষ্যমতে, অভিজিৎ রায় ছাড়াও ব্লগার নীলাদ্রি নিলয়, ওয়াশিকুর রহমান, জগন্নাথ ভার্সিটির ছাত্র নাজমুদ্দিন সামাদ, প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন ও জুলহায মান্নান হত্যাকাণ্ডের সাথেও সরাসরি জড়িত ছিল এই লোক। পুলিশ তারে অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার প্রধান সন্দেহভাজন হিশাবে আখ্যায়িত করে।
ক্রসফায়ারে খুন হওয়া লোকটার নাম শরিফ। পুলিশের ভাষ্যমতে, সে আরো অন্তত পাঁচটা ছদ্মনাম ব্যবহার করত। পুলিশ তার পরিচয় দেয় এইভাবে: শরিফুল ওরফে সাকিব ওরফে শরিফ ওরফে সালেহ ওরফে আরিফ ওরফে হাদী। অবশ্য, পুলিশের এই দাবি মানতে পারেন নাই খোদ অভিজিৎ রায়ের বাবা অজয় রায়। বিবিসিরে দেওয়া এক ইন্টারভিউতে অজয় রায় বলেন, `এই কিছুদিন আগে ডিএমপি কমিশনার বলেছিলেন, অভিজিতের হত্যাকারী তিনজনই দেশের বাইরে চলে গেছে। দেশের বাইরে চলে গেলে হঠাৎ করে এই হত্যাকারী আবির্ভূত হলো কী করে?`
ডয়েচে ভ্যালেরে দেওয়া এক ইন্টারভিউতে অজয় রায় বলেন, `তদন্তের ব্যাপারে পুলিশ এখন আমার সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখে না। এমনকি তারা কাউকে চিহ্নিত করতে পারল কি পারল না, তাও আমাকে জানায় না। সন্দেহভাজন শরিফুলের বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনাও আমি সংবাদমাধ্যম থেকেই জেনেছি।` তাইলে এবার প্রশ্ন আসে, হু ইজ শরিফ ওরফে হাদি? একটু পেছনে যাই। ডেটলাইন ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৬। অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে যশোর থেকে `হাদি` নামের একজনকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। তবে ডিএমপির উপ-কমিশনার সাংবাদিকদের বলেন, `এ ঘটনায় সম্প্রতি কেউ গ্রেফতার হয়েছে বলে আমার জানা নেই।`
ডেটলাইন ২০ মে, ২০১৬। হাদিসহ আরো ৫ জনরে ধরায়ে দেওয়ার জন্য ১৮ লাখ টাকা পুরষ্কার ঘোষণা করে পুলিশ। অথচ ৪ মাস আগেই হাদিরে গ্রেফতার করছিল পুলিশ। পরে ১৯ জুন সেই হাদিই পুলিশের ক্রসফায়ারে খুন হয়। হাদি যে পুলিশ হেফাজতেই ছিল এতদিন, এ ব্যাপারে মিডিয়ায় কিছুই বলে নাই পুলিশ। ঘটনা প্যাঁচ খায় শরিফুল ওরফে হাদি খুন হওয়ার পর। ২১ জুন ঢামেকের মর্গে শরিফুলের লাশ নিতে আসেন তার দুলাভাই হেদায়েতুল ইসলাম ও চাচাত ভাই রহমত আলী। টিভিতে শরিফুলের খুনের খবর দেইখা তারা তারে চিনতে পারেন। কিন্তু তাদের দাবি মতে, নিহতের নাম শরিফুল বা হাদি না, তার নাম `মুকুল রানা`। তারা তার এনআইডি কার্ডও শো করেন।
তাদের ভাষ্যমতে, মুকুলের বাড়ি সাতক্ষীরার বালুইগাছায়। তার বাপের নাম আবুল কালাম আজাদ। তারা আরো জানান, মুকুল ছিলেন সাতক্ষীরা গভমেন্ট কলেজের ইংরাজি বিভাগের ৪র্থ বর্ষের ছাত্র। এরপর মুকুলের বউ মহুয়া সুলতানা পিয়ারি জানান, তার চোখের সামনেই ২৩ ফেব্রুয়ারি মুকুলরে `শাদা পোশাকের পুলিশ` তুইলা নিয়া যায়। ওই ঘটনার মাত্র ৪ দিন আগেই বিয়া হইছিল মুকুল ও মহুয়ার।
পড়েন মহুয়ার ভাষ্য, `সেদিন ছিলো ২৩ ফেব্রুয়ারি। এর চারদিন আগেই মুকুল রানার সঙ্গে বিয়ে হয় আমার। উনি বললেন, তার বাড়িতে (শ্বশুরবাড়ি) নিয়ে যাবেন। আমরা তৈরি হয়ে একটা ইঞ্জিনভ্যানে চড়ে জগন্নাথপুর থেকে যশোর শহরের বসুন্দিয়া বাজারে যাই। সেখানে নামা মাত্র কয়েকজন লোক ‘এই যে মুকুল’ বলে ওনার শার্টের কলার চেপে ধরে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে যায়। আমি দৌড়ে বাজারের একপাশে এসে একটা মোবাইল ফোনের দোকানে ঢুকি। সেখান থেকে ফোন করে বাড়িতে ঘটনাটা জানাই। সেই শেষ দেখা আমাদের। আর তার খোঁজ পাইনি। চার মাস পর খোঁজ পাইলাম তার লাশের।’
মুকুলরে তুইলা নেওয়ার পরে মহুয়ার ভাই আমির যশোরের কোতয়ালি থানায় জিডি করেন। এরপর যশোর, সাতক্ষীরার বিভিন্ন জায়গায় মুকুলরে খুঁইজাও পান নাই তারা। মুকুলরে পুলিশ তুইলা নেওয়ার ১৭ দিন পরে মহুয়ার ছোটভাই মুজিবর ব্যক্তিগত কাজে ঢাকায় গেলে তারেও আটক করে পুলিশ। কেন তাদের আটক করা হইল, এ বিষয়ে দুই পরিবারের কেউই কিছু জানেন না বইলা জানান। মুজিব ছিল মহুয়া পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি। তার গ্রেফতারের পরে ফ্যামিলি অর্থনৈতিক দুর্দশায় তো পড়েই, এমনকি প্রচণ্ড ভয়ে ও টাকার অভাবে মহুয়ার ফ্যামিলি তাদের জামাইয়ের লাশ পর্যন্ত দেখতে যাইতে পারেন নাই।
রূপবান পত্রিকার সম্পাদক জুলহাস মান্নান খুন হন ২৫ এপ্রিল। (কমেন্ট-৮) জগন্নাথ ভার্সিটির ছাত্র নাজমুদ্দিন সামাদও খুন হন এপ্রিলের ফার্স্ট উইকে। উপরের তথ্য মোতাবেক, শরিফুল ওরফে হাদি ওরফে মুকুল রানা সেসময় পুলিশের হাতে বন্দী। অথচ সেই শরিফুল এই দুই খুনের অন্যতম প্রধান আসামী!
মুকুল রানার বাবা জানান, তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন, অন্য কোন রাজনীতি মানেন না। তিনি ধুলিহর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের একজন কাউন্সিলর। তার ছেলে এরকম কোন দোষ করতে পারে তা তিনি বিশ্বাস করেন না। আর করলেও, প্রচলিত আইনে যেকোন বিচার তিনি মাইনা লইতেন। বাট এইভানে তুইলা নিয়া ক্রসফায়ার তিনি মানতে পারেন না।
ওদিকে, মুকুল রানা কেসে বেকায়দায় পইড়া পুলিশ ও মিডিয়া নানা ধরনের তথ্য সামনে আনতে থাকে। মুকুল কলেজে শিবির করত এবং তার বউ কওমি মাদ্রাসার ছাত্রী ছিল— এই খবর বেশ জোরেশোরে প্রচার করা হয়। এবং এতকিছুর পরেও পুলিশের দাবি ছিল এই যে, মুকুলের আসল নাম তারা জানতেন না, কিন্তু সেই অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দিছিল।
আসলে কে এই মুকুল রানা? কেন তারে ধরা হইল? কেন খুন করা হইল? আজ কেমন আছে মুকুলের ফ্যামিলি? এই ঘটনার পরে কী কেয়ামত গেছে তাদের উপর? পুলিশের হাতে বন্দী থাকা অবস্থায়ই মুকুল কীভাবে জুলহাস ও সামাদ হত্যাকাণ্ডে অংশ নিল? এসব প্রশ্নের উত্তর, সম্ভবত আর কোনদিন জানা যাবে না। চলবে