তুহিন খানের কলাম ‘ফিলিস্তিনি তরুণদের নয়া সশস্ত্র ঐক্য’

প্রকাশিত : অক্টোবর ২৮, ২০২৩

লায়নস ডেন Lion’s Den নামের একটা মিলিট্যান্ট গ্রুপ আছে ফিলিস্তিনে। ওয়েস্ট ব্যাংকের পুরাতন নাবলুস শহর হইল এদের বেজ। অফিশিয়ালি গ্রুপটার জন্ম হইছে ২০২২ সালে। ২০২১ সালের শেখ জাররার ঘটনায় যে মাস প্রস্টেস্ট হয় ওয়েস্ট ব্যাংকে, সেখান থেকেই আরবান তরুণদের বেশকিছু সশস্ত্র গ্রুপ তৈরি হইছে, প্রধানত জেনিন ক্যাম্প ও পুরানা নাবলুসে। এরমধ্যে একটা হইল জেনিন ব্রিগেড, যেটা ২০২১ সালে গঠিত হয়। ওয়েস্ট ব্যাংকের তুবাস শহরে এরকম আরেকটা গ্রুপ তৈরি হইছে, তুবাস ব্রিগেড নামে।

২.
ওয়েস্ট ব্যাংকে এমন কিছু সশস্ত্র গ্রুপ আছে, ফাতাহ-অ্যাফিলিয়েটেড হইলেও, যাদের সাথে ফাতাহর নানারকম রাজনৈতিক দূরত্ব আছে। এসব দল পুরাপুরি ফাতাহর রাজনৈতিক কমান্ডের আওতায় অপারেট করে না। ‘আল আকসা ব্রিগেড’ এরকমই একটা দল। এই ব্রিগেডেরই কমান্ডার ছিলেন ইবরাহিম নাবলুসি (২০০৩-২০২২)। ২০২২ সালে ইজরাইলি ফোর্স যখন প্রকাশ্য দিবালোকে তার ঘরে রেইড দেয়, এবং তারে খুন করে, তখন তার বয়স মাত্র ১৯ বছর। এর আগে এই টিনেজার কমান্ডাররে একাধিকবার খুনের চেষ্টা কইরা ব্যর্থ হইছে ইজরায়েলি ফোর্স।

শহিদ হওয়ার আগে নাবলুসি সোশাল মিডিয়ায় একটা বার্তা দেন ফিলিস্তিনিদের। তারা যেন কখনোই হাতিয়ার ফেলে না দেয়, ইজরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের পথ না ছাড়ে। সোশাল মিডিয়ায় নাবলুসির বার্তা মুহূর্তের মধ্যে পুরা ফিলিস্তিনে ছড়ায়ে পড়ে; নাবলুসি ফিলিস্তিনের, স্পেশালি ওয়েস্ট ব্যাংকের তরুণদের কাছে রাতারাতি একজন ওয়র হিরো হইয়া ওঠেন। নাবলুসের তরুণরা তার নাম দেয় ‘লায়নস অব নাবলুস’। এই নাবলুসির অনুসারী তরুণরাই গড়ে তুলছেন ‘লায়নস ডেন’।

এ দলের অধিকাংশ সদস্যই আরবান সেক্যুলার তরুণ। এদের রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ডও বিচিত্র। দলের অধিকাংশই আল-আকসা ব্রিগেডের মেম্বার ও এক্স-ফাতাহ সদস্য হইলেও, দলটা রাজনৈতিক বা মতাদর্শিক বিভেদরে দূরে রাইখা, ফিলিস্তিনি তরুণদের সশস্ত্র ঐক্যের কথা কয়। ফলে এখানে হামাস, পিএফএলপি ও ইসলামি জিহাদের সাথে যুক্ত অনেক তরুণও আছে। ইয়াসির আরাফাত, শেখ ইয়াসিন, আবু আলি মোস্তফা বা ফাতহি শাকাকি— ফিলিস্তিনের প্রধান চার রাজনৈতিক ধারার চারজন লিডাররেই এরা শ্রদ্ধা ও সম্মানের চোখে দেখে।

এদের মটো হইল সশস্ত্র ঐক্য। রঙ বা রাজনীতির বিভেদ ভুইলা এক হওয়া, এবং ফিলিস্তিনি তরুণদের মধ্যে ইজরায়েলি ফোর্স ও স্যাটেলারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের মনোভাব তৈরি করাই এদের লক্ষ্য। টেলিগ্রাম ও টিকটকে নিজেদের হামলার  ভিডিও শেয়ার কইরা পুরা ওয়েস্ট ব্যাংকে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এরা; গড়ে তুলছে ইফেক্টিভ সোশাল মিডিয়া নেটওয়ার্ক। গত বছর অক্টোবরে এদের টিকটক একাউন্ট সাসপেন্ড করা হয়। আত্মপ্রকাশের পর থেকে ইজরায়েলি অকুপেশন ফোর্সের ওপর বেশ কয়েকটা হামলা চালাইছে দলটা। এমনকি প্যালেস্টিনিয়ান অথরিটির সাথেও ক্ল্যাশ হইছে এদের।

৩.
তরুণদের এই দলগুলা (লায়ন`স ডেন বা জেনিন ব্রিগেড) ট্রাডিশনাল মিলিট্যান্ট গ্রুপগুলার মত না। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে অ্যাফিলিয়েশন থাকলেও এরা কোন সেন্ট্রাল পলিটিকাল কমান্ডের আওতাধীন না। এই তরুণেরা মিশ্র ইডিওলজির। এদের অধিকাংশই সেক্যুলার মাইন্ডের; এদের রাজনৈতিক অবস্থানও বিভিন্ন। ঐক্যবদ্ধ সশস্ত্র আন্দোলনই এদের লক্ষ্য। আরেকটা ব্যাপার হইল, গ্রুপগুলা পপুলার পাব্লিক প্রোটেস্টের মধ্য দিয়া তৈরি হইছে। লায়নস ডেন যেমন ইবরাহিম নাবলুসির খুনের প্রতিবাদে তৈরি হইছে, তেমনি জেনিন ব্রিগেড তৈরি হইছে ইজরায়েলি জেল থেকে পালানো জেনিনের ৬ ফিলিস্তিনি বন্দির সুরক্ষার দাবিতে। সোশাল মিডিয়ায় এদের ফ্যান-ফলোয়ার প্রচুর। এসব দল নিয়মিত ইজরাইলি চেকপোস্ট ও বিভিন্ন সেটলার কলোনিতে হামলা চালাইতেছে। এরা ইজরায়েলের জন্য এতটাই খতরনাক হয়ে উঠছে যে, এদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য ২০২২ সাল থেকে ‘ব্রেক দ্য ওয়েভ’ নামক অপারেশনের আওতায় ইজরায়েল জেনিন ও নাবলুসে লাগাতার রেইড দিতেছে, অবরোধ বসাইতেছে এবং নির্বিচারে খুন ও গণ-গ্রেফতার চালাইতেছে।

রাজনৈতিক বিভেদ ভুইলা সশস্ত্র ঐক্যের পথ কেন বাইছা নিল ওয়েস্ট ব্যাংকের এই তরুণেরা? এরা তো এমনকি ইসলামি আদর্শেও উদ্বুদ্ধ না। এদের অনেকেরই সোশাল মিডিয়া ঘাঁটলে বোঝা যায় যে, এরা ফিলিস্তিনের একদমই নতুন প্রজন্ম, জেন-জেড। আর ওয়েস্ট ব্যাংকে থাকার সুবাদে সেক্যুলার ওয়ার্ল্ড অর্ডারের সাথে এদের জীবন নানাভাবে কানেক্টেডও বটে। তাহলে কেন এই আরবান তরুণেরা গেরিলা হইতেছে? সমঝোতামূলক সুন্দর জীবন বাদ দিয়া কেন তারা অস্ত্র হাতে তুলতেছে? কেন মাস প্রোটেস্ট থেকে জন্ম নিতেছে সশস্ত্র সংগ্রাম? কেন এই আরবান তরুণেরা বলতেছে: হাইয়া আলাল জিহাদ?

৪.
ওয়েস্ট ব্যাংকের পলিটিক্সে ফাতাহই সর্বেসর্বা। হামাসের ক্ষমতা সেখানে খুবই সীমিত। সেখানকার আরবান তরুণরা মোটামুটি সেক্যুলার মাইন্ডেড, ফাতাহ-ওরিয়েন্টেড। তবে দ্বিতীয় ইন্তেফাদার (২০০০-২০০৫) পর থেকেই ওয়েস্ট ব্যাংকের তরুণ প্রজন্ম ক্রমে সশস্ত্র সংগ্রামের দিকেই ঝুঁকছে। ফাতাহর কয়েক দশকের নমনীয় ও সমঝোতার নীতি ফিলিস্তিনের অবস্থার বিন্দুমাত্র উন্নতি ঘটাইতে পারে নাই; বরং ওয়েস্ট ব্যাংকের অবস্থা দিন দিন আরো খারাপ হইছে। এইটা মারাত্মকভাবে ক্ষুব্ধ করছে সেখানকার আরবান তরুণদের। ২০২১-এ শেখ জাররা কাণ্ডের পর এই দীর্ঘ ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটছে মূলত।

রাস্তার ম্যাস প্রটেস্টে নির্বিচার গুলি চললে, সেখান থেকে পালটা সশস্ত্রতাই তৈরি হয়। ওয়েস্ট ব্যাংকের ফিলিস্তিনিরা ফাতাহর ব্যর্থ প্রজেক্টের গিনিপিগ হইছে কয়েক দশক। আর আরবান তরুণদের এই সশস্ত্রতা এরই প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়া।

৫.
দ্বিতীয় ইন্তেফাদার পর থেকেই ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সংগ্রামে ‘সশস্ত্রতা’ আবার কেন্দ্রীয় হয়ে উঠছে। এই শতকের তৃতীয় দশকে আইসা তারই চূড়ান্ত রূপ আমরা দেখলাম হামাসের ‘অপারেশন আল আকসা ফ্লাড’ এবং তার জেরে চালু হওয়া যুদ্ধে। অন্যান্যবারের তুলনায় এবারের এই যুদ্ধের ইউনিকনেস হইল, এবার ‘মৌলবাদী টেররিস্ট’ বইলা কেবল হামাসরে দায় দিয়া পার পাওয়া যাচ্ছে না; বরং এই সশস্ত্র সংগ্রামে ফিলিস্তিনের বামপন্থী ও সেক্যুলার তরুণেরাও জড়ায়ে গেছে। তারা এই হামলারে পুরাপুরি সাপোর্ট করতেছে; হামাসের সাথে একত্রে লড়াইয়েরও ঘোষণা দিছে। সশস্ত্রতার প্রতি ইতিবাচক মনোভাবই তাদের হামাসের কাছাকাছি নিয়া আসছে। ফিলিস্তিনের এই নয়া ‘সশস্ত্র রাজনৈতিক ঐক্য’ই এবারের যুদ্ধের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দিক।

ফিলিস্তিনের তরুণ প্রজন্ম ফাতাহর ‘শান্তিপূর্ণ মীমাংসা’র আশ্বাসে এখন আর বিশ্বাসী না মোটেই। ধুঁকে ধুঁকে ইজরাইলি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাইকা নির্ঝঞ্ঝাট জীবনের চাইতে তারা চায় মর্যাদার মরন। ফলে, রাজনৈতিক বিভেদ ভুইলা নয়া জামানার এই ফিলিস্তিনি তরুণেরা চায় ঐক্যবদ্ধ সশস্ত্র প্রতিরোধ। আর এই তরুণদের মনোভাবেরই প্রতিফলন ঘটছে এবারের অপারেশন আল আকসা ফ্লাডে।

৬.
গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাংকে ইজরাইলের এবারের হামলা ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলনে সশস্ত্রতারে আরো কেন্দ্রীয় কইরা তুলবে নিশ্চিত। রাজনৈতিক বিভাজন কমায়া ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ‘সশস্ত্র ঐক্য’রে আরো দৃঢ় করার উস্কানি দেবে। নতুন প্রজন্ম ব্যাপকভাবে জিহাদ তথা সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে আকৃষ্ট হবে। আর সবচাইতে অ্যাক্টিভ সশস্ত্র গ্রুপ হিশাবে হামাস থাকবে এই সশস্ত্রতার কেন্দ্রে। অন্যদিকে পিএলওভিত্তিক গতানুগতিক পলিটিকাল দলগুলা ব্যাপকভাবে গুরুত্ব হারাবে জনমানসে।

ইজরায়েল এইটা জানে। ওয়েস্ট ব্যাংকে ফিলিস্তিনি তরুণদের সশস্ত্র ঐক্যের মনোভাব তার সিক্যুরিটির জন্য কেমন হুমকি, সেটাও সে বোঝে। এজন্যেই ৭ অক্টোবরের আগে তার ফোর্সের বিশাল একটা অংশ ছিল ওয়েস্ট ব্যাংকে। ওয়েস্ট ব্যাংকের এই নয়া সশস্ত্রতারে রুখতে হইলে হামাসরে প্রাক্টিকালি দুর্বল করা জরুরি। হামাস ও তার অর্থনৈতিক নেটওয়ার্করে দুর্বল করতে না পারলে, ফিলিস্তিনের এই নয়া সশস্ত্রতারে মোকাবেলা করা কঠিন। সেজন্যেই ইজরায়েল এবার এত ভয়ানক মরনকামড় বসাইছে গাজায়।

গাজায় এই মুহূর্তে জল, স্থল ও আকাশ— তিন দিক দিয়াই হামলা চালাইতেছে ইজরায়েল। হামাস তাদের সাধ্যমতো প্রতিরোধ করতেছে। এটা এখন একটা অল-আউট ওয়রে রুপ নিতেছে। লায়নস ডেন বলতেছে: আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, হাইয়া আলাল জিহাদ (জিহাদের পথে আসো)। ফিলিস্তিনের এই নয়া সশস্ত্রতারে আর দমানো যাবে না সম্ভবত। রাজনৈতিক মতাদর্শ ভুইলা বাম-ডান-মধ্যপন্থী, সব ঘরানার তরুণেরা যখন সশস্ত্র ঐক্য গইড়া তোলে, তার মধ্য দিয়া নতুন দিনের রাজনীতি ও রাজনৈতিক ডায়নামিক্সও তৈরি হয়। এই নয়া সশস্ত্রতা যদি সব ঘরানার ফিলিস্তিনি তরুণদের রাজনৈতিক সহাবস্থান ও জাতীয় ঐক্যের গুরুত্ব বুঝতে সাহায্য করে, ভবিষ্যতের জন্য সেইটাই হবে সম্ভবত এই আন্দোলনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও অর্জন।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক