তুহিন খাদের গদ্য ‘প্রগতিশীলদের দোকান ও সাফজয়ী দল’
প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২২, ২০২২
সাফজয়ী দলরে (গরিবের) হুডখোলা বাসে দেওয়া সংবর্ধনা ও পরবর্তী সংবাদ সম্মেলন ও বাফুফে সভাপতির নানা মন্তব্য— তিনটাই খুব কাজের হইছে।
প্রথমে হুডখোলা বাসের আলাপে আসি। আপনারা অনেকেই কোশ্চেন করছিলেন— সানজিদার পোস্ট সে নিজে না লেখলে সমস্যা কী? সমস্যা নাই কোনো। কিন্তু হুডখোলা বাস জিনিশটা ওই পোস্ট থেকেই কিন্তু আসছে, খেয়াল করছেন? পরে সবগুলা মিডিয়া মিলা এইটারে হাইপ দিছে। ব্যস। বাফুফে আর কিছু পারুক না পারুক, বিআরটিসির মাথা কাইটা হুডখোলা বাস বানাইছে। সেই বাসে ফুটবলের চাইতেও বিকট হয়ে উঠছে রাজনীতি। হুডখোলা বাসের এমনই ম্যানেজমেন্ট, খেলোয়ার আহত হইছে।
ওইটা ছিল জনতারে খুশি করার ট্রেলার। আশল পিকচার হইল সংবাদ সম্মেলন। সেখানে কোচ আর অধিনায়ক চেয়ার পায় নাই; বাকিদের চেহারাও দেখা যায় নাই। বোর্ড, আমলা আর পুলিশ— এরাই সেগুলা দখল করছে আর নিজেদের গুণকীর্তন করছে। ফিমেল ফুটবল নিয়া আপনি যতই লাফান বস, কাজটা তো বাফুফের আন্ডারেই হয়, তাই না? তো এই হইল আপনার বাফুফে।
এখন ক্যামেরার সামনেই যদি এরা নির্লজ্জ হইতে পারে, ক্যামেরার পিছনে কী অবস্থা? খেলা দিয়া রাজনীতি উদ্ধার ছাড়া এই বাফুফের আর কোনো চেহারা কি আছে? নাই। কেবল বাফুফে না, দেশের সবগুলা প্রতিষ্ঠানেই তো এই লেভেলের রাজনীতিকরণ ঘটছে। এই রাজনীতিকরণের ফলে প্রতিষ্ঠানগুলা যে একদম ভেতর থেকে সিস্টেম্যাটিক্যালি করাপ্টেড হয়ে গেছে, তা খালি চোখেই দেখা যায়। এসব প্রতিষ্ঠানের আন্ডারে, একদম সিস্টেম্যাটিক কারণেই, কোনো কিছুতে লংটার্ম সাফল্য আসা প্রায় অসম্ভব।
মেয়েদের ফুটবল খেলায় সামাজিক বাধা কোন সমাজে ছিল না বা নাই? আপনি ইউরোপের আলাপ করেন তো! সেইখানেও কী পরিমাণ বাধা আছে, হতাশা আছে, জানেন! একদমই ইউনিক হতাশা।
যেমন, ইউরোপে যেসব মেয়ে ফুটবল খেলে, সমাজে তাদের লেসবিয়ান হিশাবে ট্রিট করার একটা প্রচলন আছে। ২০১৫ সালে ইতালির অ্যামেচার ফুটবল এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ফেলিস বেল্লোলি ফিমেল ফুটবলারদের ‘আ বাঞ্চ অব লেসবিয়ান্স’ বলছিলেন; তার পদত্যাগের দাবিও উঠছিল সেসময়। ইউরোপে ফিমেল ফুটবল এলজিবিটি মুভমেন্টের একটা ব্যাটলগ্রাউন্ড হয়ে উঠছে। একদিকে এলজিবিটি মুভমেন্টের অ্যাক্টিভিস্টরা ফিমেল ফুটবলরে তাদের এই কালচারাল ওয়র চালানোর ক্ষেত্র হিশাবে বাইছা লইছেন; অন্যদিকে এর ফলে সোসাইটিতে ফিমেল ফুটবল নিয়া নানা ধরনের পার্সেপশন তৈরি হইতেছে।
গত ওয়ার্ল্ড কাপে ৪১ জন ফিমেল ফুটবলার ছিলেন হোমোসেক্সুয়াল; বিপরীতে পুরুষদের ওয়ার্ল্ড কাপে ওপেনলি হোমোসেক্সুয়াল একজনও ছিলেন না— এইটা ইউরোপে এখন অনেক বড় ডিবেটের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াইছে। ইংল্যান্ডের এত বছরের ফুটবল হিস্ট্রিতে মাত্র দুজন পুরুষ নিজেদের গে দাবি করছেন; এরমধ্যে একজন খুবই রিসেন্টলি, ২০২২-এই দাবিটা করছেন। ফিমেল ফুটবলরে অনেক এলজিবিটি অ্যাক্টিভিস্ট হোমোসেক্সুয়ালিটির জন্য ফায়দাজনক হিশাবে পোট্রে করতেছেন; ম্যান ফুটবলরে শিক্ষা নিতে বলতেছেন ফিমেলদের থেকে। এর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তেছে ফিমেল ফুটবল, জেন্ডার ও সেক্সুয়ালিটি সংক্রান্ত ডিবেট। ফিমেল ফুটবলাররা লেসবিয়ান— এই প্রিজুডিস ইউরোপে এখন তুঙ্গে।
থার্ড ওয়ার্ল্ডের অনেক কান্ট্রিতেও এই ডিবেট ছড়ায়ে পড়ছে, স্পেশালি নাইজেরিয়া। নাইজেরিয়ার ফিমেল টিম আফ্রিকার সবচে সাক্সেসফুল ফিমেল ফুটবল টিম। রেকর্ড ১১ বার তারা নেশন্স কাপ জিতছে। ২০১৬ সালে তাদের ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট ‘ফিমেল ফুটবল ঘিরে লেসবিয়ানিজমের ক্যাম্পেইন’রে তার দেশে ফিমেল ফুটবলের প্রসারে সবচে বড় বাধা হিশাবে উল্লেখ করার পর, এ নিয়া তুলকালাম কাণ্ড হইছে ফুটবল বিশ্বে। নেটে সার্চ দিলেই আপনি এই নিয়া বিশাল বিশাল আর্টিকেল, রিসার্চ ও নিউজ ইত্যাদি পাবেন।
আমি জেন্ডার ও সেক্সুয়ালিটি বিশ্লেষক না, এই ফিল্ডে আমার নলেজ জিরো। এলজিবিটির আলাপটা আনলাম এজন্য যে, দেশ ও কালচারভেদে সামাজিক বাধা কত ইউনিক হইতে পারে। আপনার দেশের ফিমেল ফুটবলে তো অ্যাটলিস্ট এই ঝামেলা নাই, এই প্রিজুডিসটা নাই। আপনার ফিমেল ফুটবলারদের সাংবাদিক বা কোনো মোল্লা অ্যাটলিস্ট এইটা বলে না যে, এত এত লেসবিয়ানের মধ্যে একজন স্ট্রেইট হওয়ার ফিলিংস কেমন? (এক জার্মান নারী ফুটবলাররে এক সাংবাদিক এই প্রশ্ন করছিলেন)।
মোল্লাদের বাধা পার হইয়া যে মেয়েরা এই পর্যন্ত আসছে, তারা এই কি এইরকম সিস্টেম্যাটিক্যালি করাপ্ট একটা সিস্টেমে শেষমেশ টিকবে? কী মনে হয় আপনার? মোল্লাদের বাধা পার হইয়া তাও আসা যায়, কারণ মোল্লাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নাই। কিন্তু সালাউদ্দিন, বাফুফে বা বাঙলাদেশের প্রতিটা ইন্সটিটিউশনের এই করাপ্ট সিস্টেম কি পার হওয়া যায়? সানজিদা-সাবিনারা মোল্লাদের বাধা তো পার হইছেন। কিন্তু বাফুফে বা সালাউদ্দিনের বাধা পার হইতে কি আদৌ পারবেন? আমার মনে হয় না।
১০ বছর পর হয়ত দেখবেন, নারী ফুটবল বন্ধ। প্লেয়ার অনেকের বিয়ে হয়ে গেছে, অনেকে রোগেশোকে আক্রান্ত, অনেকে স্রেফ নাই হয়ে গেছে। আপনি বলবেন, এই যে মোল্লাদের প্রচারণার চাপে মেয়েগুলার বিয়ে হয়ে গেছে। নারী স্বাধীনতা ইত্যাদি লইয়া হয়ত কিছু ক্যাম্পেইনও করবেন; দেশরে আফগান হওয়া থেকে বাঁচাইবেন। কিন্তু আপনার এই প্রগতিশীল স্বপ্নের সারথী যারা, তাদের হাতেই ফুটবল নাই হয়ে যাবে। ফুটবল, আইন, বিচার, মানবাধিকার, শিক্ষা, প্রতিষ্ঠান, মেধা, প্রতিভা, আর্ট— সব ধ্বংস হয়েও দেশে যদি খালি প্রগতিশীলতার দোকানটুকু থাকে, আপনি তাতেই খুশি। যেমন কেউ কেউ খুশি এই সবকিছু ধ্বংস হওয়ার বিনিময়ে বেশি বেশি তাহাজ্জুদ ও মদিনা সনদে, বা ফিমেল ফুটবলারদের বিয়াতে।
ফুটবল তো বস আপনারা এই দুই দলই খেলতেছেন। বাকিরা না খেললেও অত ক্ষতি নাই।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক