তুষার চক্রবর্তীর গল্প ‘শয়তানের হাসি’

প্রকাশিত : জুন ২৩, ২০২৪

সুবীরের সাথে অনিতার পরিচয় সাত বছর আগে। পিকলিকে ক্লাস ফাইভে ভর্তি করতে গিয়েছিল অনিতা স্টুডেন্ট কেয়ার স্কুলে। ভর্তির ফর্মে কয়েকটা কলম ফিল আপ করতে গিয়ে অনিতার একটু ডাউট হচ্ছিল। সে হেড মিস্ট্রেসের ঘরে ঢুকে, হেড মিস্ট্রেসকে জিজ্ঞেস করছিল। হেড মিস্ট্রেসের সামনেই বসেছিলেন এক তরুণ শিক্ষক। হেড মিস্ট্রেস, অনিতার ডাউটগুলো শুনে সামনে বসা সেই তরুণ শিক্ষককে বললেন,`সুবীর, ওনার মেয়ের ফর্মটা ফিল আপ করতে ওনাকে একটু হেল্প করে দাও।` সেই তরুণ শিক্ষক একটা মিষ্টি হাসি মুখে নিয়ে অনিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, `আপনি টিচার রুমে ওয়েট করুন, আমি আসছি।` অনিতা হেড মিস্ট্রেসের রুম থেকে বেরিয়ে এসে টিচার রুমের একটা বেঞ্চে, পিকলিকে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো।

একটু পরেই সেই শিক্ষক টিচার রুমের একটি চেয়ারে বসে ইশারায় অনিতাকে ডাকলো। অনিতা ভর্তির ফর্মটা সেই শিক্ষকের হাতে দিয়ে বলল, `পাঁচ, সাত আর আট নম্বর কলমটাতে ঠিক কি লিখবো বুঝে উঠতে পারছি না। আসলে আমার স্বামী রিসেন্টলি ট্রান্সফার হয়ে বাইরে চলে গেছেন। সরকারি চাকরি করেন। মাসে একবার করে আসেন। তাও দুতিন দিনের জন্য। তাই গার্জেন হিসাবে কি আমার নাম লিখবো? আমার নাম লিখলে কি বাৎসরিক আয় আর অফিসের ঠিকানা, আমার বাৎসরিক আয় এবং আমার অফিসের ঠিকানাই লিখতে হবে?`

সুবীর নামের সেই তরুণ শিক্ষক হেসে অনিতাকে পাশের চেয়ার দেখিয়ে বললেন, `বসুন।` তারপর ফর্মটার ওপর চোখ বুলিয়ে বললেন, `হ্যাঁ, আপনি নিজের নাম লিখতে পারেন। সেক্ষেত্রে আপনার অফিসের ঠিকানা আর আপনার বাৎসরিক আয় লিখবেন।` এরপর ভর্তির ফর্মটা অনিতার হাতে দিয়ে বললেন, `নিন, ফিল আপ করে, ক্যাশে গিয়ে টাকা আর ফর্মটা জমা করে দিন।` অনিতা ফর্মটা ফিল্যাপ করে উঠে দাঁড়িয়ে সেই তরুণ শিক্ষককে হাত জোড় করে নমস্কার করে বলল, `অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।` তরুণ শিক্ষকটি বললেন, `আমাকে আপনি করে বলবেন না। তুমি বলবেন। আর হ্যাঁ, আমার নাম সুবীর।` অনিতা হাসতেই তিনি আবার বললেন, `আপনার নাম? ও হ্যাঁ, এই মাত্র তো দেখলাম আপনি লিখলেন ফর্মে। অনিতা মিত্র। দরকার পড়লে যখন ইচ্ছে আসবেন। কেমন!` অনিতা মুখে একটা ভালোলাগা অনুভূতি মেশানো হাসি নিয়ে বলেছিল, `আসছি।` এই কথা বলে অনিতা পিকলির হাতটা ধরে ক্যাশ অফিসের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। সুবীরের সাথে মেলামেশার সেই শুরু।

পিকলিকে ভর্তি করার পর সুবীরের সাথে অনিতার আবার দেখা হয়েছিল দিন পনের পর। সেদিন ছিল রবিবার। অনিতার স্বামী অমিতাভ বাইরে থাকায়, অনিতা রবিবার, রবিবার নিজেই বাজার যেত। চেষ্টা করতো সারা সপ্তাহের বাজার মানে সবজির বাজার করে নিতে। সপ্তাহের শেষের দিকে অবশ্য প্রায়ই তাকে অফিস ফেরত সবজির বাজার হয়ে ফিরতে হতো। সবজির বাজার নিয়ে সে রিকশা স্ট্যান্ডের দিকে এগোচ্ছিল। হটাৎ সামনে এসে দাঁড়ালো সুবীর। হেসে বলল, `এত ভারী ভারী দুটো ব্যাগ নিয়ে আপনি হাঁটছেন কি করে? দিন আমায় দিন।` এই কথা বলেই সুবীর, অনিতার হাত থেকে বড় ব্যাগটা নিজের হাতে নিয়ে নিল। তার অন্য হাতে নিজের বাজারের ব্যাগ। তারপর বলল, `আসুন আমার সঙ্গে।` এই কথা বলে সে এগোতে লাগলো। অনিতা কি আর করে! সে তার পেছন পেছন এগোতে লাগলো।

একটু এগিয়েই, রাস্তার পাশে রাখা একটা মোটর সাইকেলের হ্যান্ডেলে ব্যাগ দুটো ঝুলিয়ে, অনিতার হাতের ব্যাগটাও নিয়ে হ্যান্ডেলে ঝোলাতে ঝোলাতে সুবীর বলল, `চলুন, আপনাকে আপনার বাড়িতে ছেড়ে দিয়ে তারপর আমি বাড়ি যাবো। আপনার বাড়িটা ঠিক কোথায়?` অনিতা কেন যেন মনে মনে খুশি হলো। তাও মুখে বলল, `আরে তুমি শুধু শুধু আমার জন্য কষ্ট করছো কেন? আমি তো রিকশায় চলে যেতে পারতাম।` সুবীর বলল, `একদিন না হয় আমার মোটর সাইকেলেই গেলেন। নিন, নিন বসুন।` এই কথা বলেই সে নিজে মোটর সাইকেলে বসে পড়লো। অনিতার মোটর সাইকেলে বসার অভিজ্ঞতা নেই। সে কোনোক্রমে উঠে বসলো। একটা হাত সুবীরের কাঁধের ওপর রাখলো। সুবীর মোটর সাইকেল স্টার্ট করে বাজারের বাইরে এসে মেন রোডে উঠেই বলল, `বলুন, আপনার বাড়িটা ঠিক কোথায়?` অনিতা বলল, `বকুলতলা মোড়ে যে বড় দশ তলা ফ্ল্যাটটা আছে, ওতেই চার তলায় আমার ফ্ল্যাট।` মোটর সাইকেল এগিয়ে চলল। মেন রোডে উঠেই, সুবীরের মোটর সাইকেলের গতি বেড়ে গেল। অনিতার বেশ ভয় ভয় লাগছিল। তার মনে হচ্ছিল সে যেন পড়ে যাবে। তাই সে ভয়ে দু হাত দিয়ে সুবীরের গলা জড়িয়ে ধরলো। সুবীর বলল, `ভয় নেই, পড়বেন না।`

ফ্ল্যাটের নীচে মোটর সাইকেলটা স্ট্যান্ড করে, সুবীর অনিতার বাজারের ব্যাগ দুটো আর নিজের ব্যাগটা নিজের হাতে নিয়ে বলল, `চলুন, আমি আপনার ফ্ল্যাটে ব্যাগ দুটো ছেড়ে দিয়ে আসি আর সেই সুযোগে আমার ছাত্রীর সাথেও দেখা হবে।` অনিতা আর আপত্তি করেনি। লিফট দিয়ে উঠে সুবীর অনিতার সাথে অনিতার ফ্ল্যাটের দরজায় পৌছালো। কলিং বেল বাজাতেই, অনিতার কাজের দিদি দরজা খুলে দিল। সুবীর দরজার নীচে ব্যাগ দুটো রেখে বলল,` এবার আমি আসি।` অনিতা বলল, `সেকি! চলে যাবে কি! আমার ফ্ল্যাটের দরজায় এসে ফিরে যাবে? তা কি হয়! এসেছো যখন, একটু চা খেয়ে যাও। এসো ভেতরে এসো।` অনিতা, সুবীরকে ফ্ল্যাটের ড্রইং রুমের সোফায় বসিয়ে বলল, `পিকলি, দ্যাখ কে এসেছে?` পিকলি ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে, তার স্যারকে দেখে খুব খুশি। অনিতা সুবীরকে বলল, `একটু বসো। আমি চা বানিয়ে নিয়ে আসছি।`

অনিতার সেদিন কি হয়েছিল, কে জানে! তার মনের মধ্যে একটা ভালোলাগা খেলে বেড়াচ্ছিল। সে তাড়াতাড়ি শাড়িটা ছেড়ে একটা গাউন পরে রান্না ঘরে গিয়ে চায়ের জলটা বসিয়ে দিল। সদ্য বাজার থেকে আনা বেগুন কেটে কয়েকটা বেগুনি বানিয়ে ফেলল। সোফায় মুখোমুখি বসে আছে সুবীর আর অনিতা। সুবীরের পাশে বসে আছে পিকলি। দুজনের মাঝে সেন্টার টেবিলের ওপর একটা প্লেটে কয়েকটা বেগুনি আর দু কাপ চা। অনিতা প্লেট থেকে একটা বেগুনি তুলে, পিকলির হাতে দিয়ে বলল, `পিকলি, তুমি যাও, ভেতরের ঘরে গিয়ে খেল। আমি তোমার স্যারের সাথে একটু কথা বলি।` পিকলি বেগুনি খেতে খেতে ভেতরের ঘরে চলে যেতেই, অনিতা সুবীরের দিকে তাকিয়ে বলল, `নাও, খাও।` এই কথা বলে সে নিজেও একটা বেগুনি তুলে মুখে দিল। অনিতা চা খেতে খেতে সুবীরকে ভালো করে দেখছিল। কি অপরূপ দেখতে! চোখগুলো কেমন যেন উদাস, ভাসা ভাসা। তার চোখের দিকে তাকালেই যেন মনে একটা ভালোলাগা জন্ম নেয়। হঠাৎই সুবীর বলল, ` একটা কথা আপনাকে না বলে থাকতে পারছি না। আপনার যে দশ বছরের একটি মেয়ে আছে, তা আপনাকে দেখে বোঝা মুশকিল।` অনিতা এই ধরণের তার রূপের প্রশংসা শুনতে সেই কলেজ লাইফ থেকেই অভ্যস্ত। সে নিজেও জানে যে সে অসামান্য সুন্দরী। কলেজ লাইফে তার প্রেমে অনেক ছেলেই পাগল হতো। তার কাছে অগুনতি প্রেম পত্র আসতো। এমনকি অমিতাভর মতো সুদর্শন ব্রিলিয়ান্ট ইঞ্জিনিয়ার, তার পিসির বিয়ের আসরে বর যাত্রীর সাথে আসা, বরের ভাইঝি অনিতাকে দেখেই প্রেমে পাগল হয়ে পড়েছিল। শেষে পিসির মধ্যস্থতায় অমিতাভর সামাজিক বিয়ে হয়েছিল অনিতার সাথে বছর খানেকের মধ্যেই। তাও আজ সুবীরের মুখে রূপের প্রশংসা শুনে, অনিতার মনে একটা অন্যরকম অনুভূতি হলো। সেই অনুভূতি গোপন রেখেই অনিতা বলল, `তোমাকেও তো রাজপুত্রের মতো দেখতে। তোমার হবু স্ত্রীকে এখন থেকেই হিংসে করছি।` এই কথা বলে অনিতা হেসে ফেলল। সুবীরও হেসে ফেলল। সুবীর আবার বলল, `শুধু আপনার মুখশ্রীই নয়, আপনার শরীরের গড়ন, যে কোনো ছেলের মাথা ঘুরিয়ে দিতে যথেষ্ট।’ অনিতা বলল, `তোমার মাথাও কি ঘুরে গেল নাকি?` সুবীর বলল, `কিছুটা। না হলে কি আর আপনাকে বাইকের পেছনে বসিয়ে আপনাকে বাড়িতে ছাড়তে আসতাম।` অনিতা চোখ বড় বড় করে, কপট রাগ দেখিয়ে বলল, `এবার কিন্তু তোমাকে ঘর থেকে বের করে দিতে হবে।` সুবীরও হতাশ সুরে বলল, `বের করে দিলে দিন। তবে আবার আসবো। দেখি কত দিন আমাকে ঢুকতে না দিয়ে থাকতে পারেন।` অনিতা সুবীরের কথা শুনে হেসে ফেলল। তার সুবীরের কথা খুব ভালো লাগছিল। হটাৎ সুবীরের চোখ গেল দেওয়াল ঘড়ির দিকে। সে চমকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, `নটা! আজ আমার কপালে দুঃখ আছে। মা আমার জন্যে বসে আছে। তার মার আজ আর একটাও বাইরে পড়বে না।` সে সোফার পাশে রাখা তার বাজারের ব্যাগ হাতে তুলে নিয়ে বলল, `আজ আসি। আবার অন্যদিন আসবো।` অনিতা দরজা খুলে দিতেই সুবীর লিফটের দিকে এগিয়ে গেল। অনিতা দরজার নীচে দাঁড়িয়ে সেই দিকে তাকিয়ে। লিফটের ভেতরে ঢুকে সুবীর দরজায় দাঁড়ানো অনিতার দিকে তাকিয়ে হাসলো। লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও অনিতা অনেকক্ষণ একদৃষ্টে সেই দিকে তাকিয়ে রইলো। মনের মধ্যে যেন একটা ঝড় বইতে লাগলো। অনিতার সম্বিৎ ফিরলো কাজের দিদির কথায়, `সব ঘরে পোতা লাগানো হয়ে গেছে। বসার ঘরটা কি এখনই লাগিয়ে দেব?` অনিতা বলল, `হ্যাঁ, দিয়ে দাও।

দুই.
যেদিন পিকলির ক্লাস ফাইভ থেকে সিক্সে ওঠার রেজাল্ট নিয়ে বাড়ি ফিরলো, সেদিন অনিতা অফিস থেকে ফিরেই পিকলির রেজাল্ট দেখে সুবীরকে ফোন করে নিজের ঘরে ডাকলো। ফোনে বলল, `তোমার সাথে দরকারি কথা আছে। আর হ্যাঁ, কাকিমাকে বলে আসবে আজ তুমি আমার এখানেই রাত্রের খাবার খাবে।` সুবীরের হাতে চায়ের কাপটা ধরিয়ে দিয়ে, নিজের কাপে চুমুক দিতে দিতে অনিতা সোফায় বসলো। বার দুয়েক চায়ে চুমুক দেওয়ার পর অনিতা সুবীরকে বলল, `তোমার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে। রাখবে?` সুবীর হেসে বলল, `আপনার অনুরোধ কি আমি ফেলতে পারি? বলে ফেলুন ম্যাডাম!` অনিতা বলল, `পিকলির রেজাল্টটা দেখলাম। খুব খারাপ নয়, আবার খুব ভালোও বলা যাবে না। আমি ওকে সময় দিতে পারি না। তাই ভাবছিলাম একজন টিউটর রাখবো। আর আমার মনে হয়, পিকলিকে পড়ানোর জন্য তুমি ছাড়া আর কেউ আদর্শ টিউটর হতে পারে না। তাই বলছিলাম, যদি তুমি বিকেলের পর এসে ওকে একটু পড়াও, তো খুব ভালো হয়। আর দক্ষিণাও..` অনিতাকে বলতে না দিয়েই সুবীর বলে উঠলো, `ম্যাডাম! ব্যাস! ব্যাস! আর না, কাল সন্ধ্যে ছটা থেকে আমি পিকলিকে পড়াতে আসছি। তবে একটা শর্ত আছে। পড়িয়ে ফিরবো আপনার হাতের এক কাপ চা খেয়ে।` অনিতা হেসে ফেলে বলল, `ও আচ্ছা! তোমার দক্ষিণা রোজ আমার হাতের এক কাপ চা? ব্যাস! আর কিছু না?` সুবীর হেসে বলল, `আপাতত ওতেই খুশি। পরে যদি ম্যাডামের কৃপা দৃষ্টি আমার ওপর থাকে, হয়তো আরও কিছু পেতে পারি।` অনিতা বলল, `আরও কিছু? আরও কিছুটা কি?` সুবীর বলল, `ক্রমশ প্রকাশ্য!` অনিতা আর সুবীর এক সাথে হেসে উঠলো।

রাত্রে একসাথে বসে সুবীর, অনিতা আর পিকলি রাত্রের খাবার খেলে। খাওয়া শেষে পিকলি নিজের ঘরে ঘুমোতে চলে গেল। অনেকক্ষণ অনিতা আর সুবীর বসে গল্প করলো। রাত এগারোটা নাগাদ সুবীর চলে যেতে অনিতা নিজের ঘরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। কিন্তু কিছুতেই তার ঘুম এলো না। নিজের বিবেকের কাছে সে যেন জবাব দিতে পারছিল না। সে কি পিকলির জন্যই সুবীরকে টিউটর হিসাবে রাখলো না অফিস থেকে ফিরে নিজের একাকীত্ব দূর করতে সুবীরের সঙ্গ পেতে চাইছে। সে এটাও ভেবে পাচ্ছিল না যে অমিতাভ না থাকায় তার মধ্যে যে একাকীত্ব দেখা দিয়েছে, সেই একাকিত্ব দূর করতেই কি সে সুবীরকে কাছে পেতে চাইছে। খুব লজ্জাও লাগছে। সে যেন সুবীরের কাছে ধরা পড়ে গেছে। সুবীর যে ভাবে বলছিল যে, ‘আরো কিছু পেতে পারি!’ অনিতা নিজের মনেও ভাবছিল, সে কি শুধু সুবীরের সঙ্গ টুকুই চায়, না সুবীরের কথা মতো, সেও আরও কিছু পেতে আশা করে। এই সব ভাবতে ভাবতে ভোরের দিকে অনিতা ঘুমিয়ে পড়েছিল।

ছমাস কাটতে না কাটতেই সুবীরের কথা সত্যি হয়ে গেল। সুবীরের সাধনায় অনিতার কৃপাদৃষ্টি হয়তো পড়েছিল! পিকলির স্কুলের পুজোর ছুটি। পিকলি দশমীর দিন তার মামার সাথে অনিতাদের বাড়ি গেল। আগের বছর অমিতাভ ছেড়ে দিয়ে এসেছিল। ভাইফোঁটার পরদিন আবার অনিতার সাথে ফিরে এসেছিল। এবারও সে ফিরবে ভাইফোঁটার পরদিন। পিকলির মামার বাড়ি থাকতে ভালোবাসে। অনিতার বাপের বাড়িতে তখনও যৌথ পরিবার টিকে ছিল। বাবা, মা, দুই ভাই, তাদের বউ, ছেলে মেয়ে। বাড়িতে সব সময় আত্মীয় স্বজনের আনাগোনা। পিকলি তার মামাতো সমবয়সী ভাই বোনদের সাথে খেলে সময় কাটাতে ভালোবাসে।

একাদশীর দিন সন্ধ্যে বেলা। পিকলি নেই। তাই তাকে পড়ানোর প্রশ্নও নেই। তাও অনিতা অফিস থেকে ফিরতেই সুবীর এসে হাজির। অনিতা একটুও অবাক হয়নি। সেও যেন মনে মনে সুবীরকে এক্সপেক্ট করছিল। তাই সে যেন খুব খুশি। সে হেসে মনের কথা বলেই ফেলল, `আমিও ভাবছিলাম, তুমি আসবে। বসো। আমি একটু ফ্রেশ হয়ে নিই।` এই কথা বলে অনিতা সুবীরকে ড্রইং রুমে বসতে বলে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল। সেদিন বাথরুমে ঢুকে জামা কাপড় ছেড়ে শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে অনিতা অনেকক্ষণ ধরে স্নান করলো। স্নান সেরে আয়নায় নিজের শরীরটা বারবার দেখতে লাগলো। মনে মনে ভাবলো, সে অনেকদিন পর নিজেকে এভাবে দেখছে। তার এই শরীরের কত প্রশংসা রাত্রে অমিতাভ করতো। প্রায় আট মাস হয়ে গেল অমিতাভ নেই। মাসে দুদিনের জন্য আসে। সারাদিন কাজের ব্যস্ততা আর কথায় কথায় দিনটা কেটে যায় আর তারপর সে মন খারাপ করে ফিরে যায়। ফিরে যাওয়ার আগে সে অনিতাকে একটু আদর করে যাওয়ার ফুরসৎ টুকু পায় না। এই সব ভাবতে ভাবতে সে গা মুছে টাওয়াল জড়িয়ে নিজের শোবার ঘরে এসে আবার ড্রেসিং রুমের আয়নায় নিজেকে আর একবার দেখলো। তার কি মনে হল, সেদিন খুব সাজতে লাগলো। তার প্রিয় হালকা আকাশী রঙের ফিনফিনে গাউনটা পড়লো। চোখে কাজল টানলো, সারা শরীরে হালকা মিষ্টি গন্ধের প্রসাধনী মাখলো। চুলটা আজ আর বাঁধলো না। এলো চুলেই সে ড্রইং রুমে এসে সুবীরের মুখোমুখি বসলো। সুবীর তার সেই উদাস ভাসা ভাসা চোখে এক দৃষ্টে অনিতার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। অনিতা সুবীরের দিকে তাকিয়ে বলল, `অমন করে কি দেখছো?` সুবীর মুখে আঙ্গুল দিয়ে অনিতাকে চুপ করতে বলল। সুবীর সেই একইভাবে অনিতার দিকে তাকিয়ে আছে। অনিতার অস্বস্তি হচ্ছিল। সে থাকতে না পেরে আবার বলল, `কি হচ্ছে এটা? তুমি বসো, আমি চা বানিয়ে আনছি।` এই কথা বলে অনিতা সোফা থেকে উঠতে যাচ্ছিল। সুবীর অনিতার হাত দুটো ধরে ফিস ফিস করে বলল, `আজ আর আপনি করে বলবো না। বলবো তুমি। না, আর চায়ের দরকার নেই। আজ যেন আমার মনে হচ্ছে, তোমার কৃপাদৃষ্টি আমার ওপর পড়েছে। তাই তোমার রূপের ডালি যেন আজ দেখতে পাচ্ছি। আজ আমি তোমার কাছে কিছু চাইছি। দেবে তো? অনিতা ফিস ফিস করে বলল, `চেয়েই দেখো।` সুবীর নিজের মুখটা অনিতার মুখের কাছে এনে বলল, `তোমার রূপের সাগরে আজ ডুব দিতে ইচ্ছে করছে। দেবে স্নান করতে তোমার রূপ সাগরে?` অনিতার গলা ততক্ষণে আবেগে ধরে গেছে। তার মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এলো, `দাও, আজ আমার আমিটাই তোমায় দিলাম।` অনিতার কথা শেষ হওয়ার আগেই সে বুঝলো যে সুবীরের মুখটা তার বুকের ওপর আর হাত দুটো তার শরীরে খেলতে শুরু করে দিয়েছে। অনিতা যেন নিজেকে সুবীরের কাছে সমর্পণ করে ফেলেছে। অনিতা কিছু বোঝার আগেই, সুবীর অনিতাকে কোলে তুলে নিল। অনিতাকে কোলে নিয়ে সে অনিতার বেড রুমের দিকে এগোতে লাগলো।

এরপর থেকে অনিতার কৃপাদৃষ্টি প্রায়ই সুবীরের ওপর বর্ষাতে লাগলো। কখনো অনিতার ঘরে, কখনো বা বকখালীর সার্কিট হাউসে, কখনো বা দীঘার হোটেলে। এই ভাবেই চলেছে পাঁচ -ছ বছর। সুবীর তার বিধবা মায়ের শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী বিয়েটাও করে নি। অনিতাও তাকে অনেক বার বললেও, সুবীর বিয়ে করে নি। সে যেন নিজের সব কিছু অনিতার কাছেই সমর্পণ করেছিল।

তিন.
বিকেল চারটে বাজে। আজ অনিতার জন্মদিন। অনিতা অফিসে বসে ভাবছিল, কি করে বিয়াল্লিশটা বছর চলে গেল। অমিতাভ, অনিতার জন্মদিনটা খুব ধুমধাম করে সেলিব্রেট করে। এমনকি যে পাঁচ বছর, অমিতাভ চাকরির কারণে কলকাতার বাইরে ছিল, সেই পাঁচ বছরেও, এই দিনটা অমিতাভ কলকাতায় থাকতো। রাত্রে নিজের হাতে রান্না করতো। পাঠার মাংস আর পোলাও। পাঠার মাংস আর পোলাও, অনিতার প্রিয় খাবার।

গত দু বছর ধরে অবশ্য অমিতাভ কলকাতায় বদলি হয়ে এসে গেছে। আজ অনিতার অফিসে একটা বিশেষ মিটিং থাকায়, সে ছুটি নিতে না পারলেও, অমিতাভ আজ ছুটি নিয়েছে। অনিতা জানে যে সে ঘরে ফিরে দেখবে, ড্রইং রুমটা ফুল দিয়ে সাজানো, অর্ডার দিয়ে বানানো কেকটা সেন্টার টেবিলে সাজিয়ে ঢাকা দেওয়া। রান্নাঘর থেকে পাঠার মাংস আর পোলাওয়ের গন্ধ আসবে। আইসক্রিম ফ্রিজে রাখা থাকবে। এই সব ভাবতে ভাবতেও, অনিতার মনটা খুব খারাপ লাগছে। তার কারণ পিকলি। পিকলিও প্রতি বছর অনিতার জন্মদিনে তার বাবার সাথে মিলে খুব হৈচৈ করে। তার প্রিয় ইংলিশ পপ গানগুলো ফুল ভলিউমে চালিয়ে অমিতাভ আর অনিতার হাত ধরে খুব নাচে। কিন্তু পিকলি আজ বাড়িতে নেই। সে তার ক্লাস টুইলভের বন্ধুদের সাথে কাল বেড়াতে গেছে। ফিরবে আগামী কাল। সঙ্গে নাকি টিচার হিসাবে সুবীর ওদের সঙ্গে গেছে।

সুবীরের কথা মনে আসতে, অনিতা সুবীরের কথাও ভাবছিল। দেখতে দেখতে তার বয়েসটাও তো সাইত্রিশ-আট ত্রিশ হয়ে গেল। কেমন একটা ছেলে! সে অনিতার জন্য নিজের জীবনটা কি ভাবে কাটিয়ে দিচ্ছে। আজ কাল সে যেন একটু অন্যরকম হয়ে গেছে। এখনো রোজ পিকলিকে পড়াতে আসে। পড়িয়ে চা খেয়ে চলে যায়। একটু যেন অন্যমনস্ক থাকে। প্রায় দু বছর হয়ে গেল, সুবীরের সাথে অনিতার শারীরিক সম্পর্ক নেই। না থাকার কারণ অনেক। অনিতার বয়েস হয়ে যাওয়ায়, শরীরের খিদে আগের মতো হয়তো নেই, তাছাড়া পিকলি অনেক বড় হয়ে গেছে। গত দু বছর ধরে অমিতাভ ফিরে আসার পর সুবীর যেন আরও বেশি করে অনিতার থেকে দূরে চলে গেছে। অনিতার এই সব ভাবনায় ছেদ পড়লো, টেবিলের ওপর রাখা তার মোবাইলটা বেজে উঠতেই। অনিতা ফোনটা কানে নিয়ে হ্যালো বলতেই, ওপাশ থেকে তার পুরনো বন্ধু সীমার আওয়াজ ভেসে এলো, `অনিতা! আমি সীমা বলছি। তুই এখন কোথায়? অফিসে?` অনিতা একটু অবাক হলো। সীমা ছোট বেলার বন্ধু, এক স্কুলে পড়াশোনা করেছে। লাইফ লাইন নার্সিং হোমের হেড নার্স। ওর সাথে অনিতার যোগাযোগ নেই বললেই চলে। ওর সাথে শেষ কথা বার্তা হয়েছিল সতের বছর আগে পিকলির জন্মের সময়। ওই নার্সিং হোমেই পিকলির জন্ম হয়েছিল। অবশ্য বছর দুয়েক আগে রাস্তায় দেখা হয়েছিল। অনিতা পিকলিকে নিয়ে কিছু কেনা কাটা করতে বেরিয়েছিল। সামান্যই কথা বার্তা। সেই সময় অনিতা সীমার সেল নম্বর নিয়েছিল আর নিজের সেল নম্বরটা সীমাকে দিয়েছিল। এই সব ভাবতে ভাবতেই অনিতা বলল, `হ্যাঁ, অফিসে। কেন বলতো?` সীমা বলল, `তুই এক্ষুনি আমাদের নার্সিং হোমে চলে আয়।` অনিতা ঘাবড়ে গিয়ে বলল, `কিন্তু কেন? হঠাৎ তুই তোদের নার্সিং হোমে আসতে বলছিস কেন?’ সীমা বলল, `ফোনে বলা সম্ভব নয়। ব্যাপারটা গুরুতর। তুই এক্ষুনি চলে আয়।` অনিতা আসছি বলে ফোনটা কেটে দিল। অনিতা তার বসকে বলে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ল।

লাইফ লাইন হসপিটালের নার্সদের রেস্ট রুম। সীমার সামনে বসে আছে অনিতা। সীমা অনিতাকে এক গ্লাস জল এগিয়ে দিয়ে বলল, `নে এটা আগে খেয়ে নে।` অনিতার জল খাওয়া শেষ হতেই সীমা বলতে লাগল, `গতকাল একটি ষোলো-সতের বছরের মেয়ে আমাদের নার্সিং হোমে ভর্তি হয়েছে। সে প্রেগন্যান্ট। সে আর তার স্বামী চায় এবরশন করাতে। তুই জানিস আমাদের নার্সিং হোমে এসব করা হয় না। কিন্তু মেয়েটির স্বামী নাছোড় বান্দা। সে আমাদের নার্সিং হোমের ওপর তলার সাথে কথাবার্তা বলে রাজি করিয়েছে। এসব নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। কিন্তু একটু আগে আমাদের একজন নার্সের মুখে শুনলাম যে মেয়েটির বিয়ে হয়নি। যিনি নিজেকে স্বামী বলে পরিচয় দিচ্ছেন, তিনি মেয়েটির গৃহশিক্ষক। মেয়েটির পাড়ার নাম শুনে আমি চমকে উঠেছিলাম। তুই যে পাড়ায় থাকিস, সেই পাড়ার নাম শুনে কৌতূহল হলো। তুই জানিস ওই পাড়ার প্রায় সবাইকেই আমি চিনি। তাই মেয়েটিকে দেখার জন্য আমি মেয়েটির কেবিনে গিয়েছিলাম। গিয়ে মেয়েটিকে দেখে আমি চমকে উঠলাম। এতো পিকলি! অনিতার মেয়ে! আমি ওকে বছর দুয়েক আগে তোর সাথে দেখেছিলাম। ওর মুখ দেখে বুঝলাম যে ও আমাকে চিনতে পারে নি। তাই কিছু না বলে ফিরে এসে আমার টেবিল থেকে তোকে ফোন করে ডেকেছি। আজ আটটায় ওকে ডাক্তার দেখবে। তুই যা, গিয়ে একবার দ্যাখ! আর একটা কথা, তোর মেয়ে কাল থেকে ঘরে নেই, সেটা কি তুই জানিস না?` অনিতার শরীর তখন কাঁপছে। সে কোনো উত্তর না দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে বুঝলো তার পা কাঁপছে। কোনোক্রমে নিজেকে সামলে নিয়ে সীমাকে জিজ্ঞেস করল, `কত নম্বর কেবিনে আছে?` সীমা উত্তর দিল, `এগারো নম্বর কেবিন।`

এগারো নম্বর কেবিনে অনিতা ঢুকতেই, পিকলি বিছানার ওপর উঠে বসলো। বিছানার পাশের স্টুলে সুবীর বসে ছিল। সেও উঠে দাঁড়ালো। দুজনের মুখে চোখে বিস্ময়! অনিতা প্রথমে পিকলির দিকে তাকালো। কিচ্ছু বললো না। তারপর সুবীরের দিকে তাকিয়ে বলল, `ছিঃ! সুবীর! তুমি এতো নিচ! তোমার বিবেকে বাঁধলো না? সুবীর অনিতার কথার জবাব না দিয়ে শুধু হেসে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। অনিতা দেখলো, সুবীরের চোখে আজ আর সেই উদাস, ভাসা ভাসা দৃষ্টি নেই। যে দৃষ্টি যেন শয়তানের। তার হাসির মধ্যেও দেখলো এক শয়তানের হাসি।