তিন লেখকের তিনটে খুদে গল্প

প্রকাশিত : এপ্রিল ০৮, ২০২০

রহমান মুফিজ

গন্ধবেণী

ভোররাতে ঘুমের মধ্যে নাকের ওপর দিয়ে যে গন্ধটা ডানা ঝাপটে উড়ে গেল, এর বয়স বিশ বছর। হ্যাঁ, পাক্কা বিশ বছর। ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে মুঈন আবিষ্কার করল, বিশ বছর আগে অস্তাচলের দিকে হেলে পড়া এক বিকেল, একটা বিষণ্ণ হলরুম, তার জানালা দিয়ে সোনালি আলো ঠিকরে পড়ছিল একটা কিশোরীর গায়ে, যার ইষৎ গোলাপি বর্ণের মুখ ছিল, মাথার দু’পাশে দুটো বেণীতে বাঁধা ছিল লাল দুটো ফিতে। সেই লালফিতের বেণী দুলিয়ে, আলতামাখা হাতের করতলে সমস্ত দুঃখকে মুদ্রাসিক্ত করে কিশোরী নাচছিল একটা লোকজ বিরহের বিষাদলাগা গানে—  ওরে কর্ণফুলীরে, সাক্ষী রাখিলাম তোরে...

যে গন্ধটা মুঈনকে জাগিয়ে দিয়ে গেল, এই হলো তার রূপ। গন্ধেরও যে রূপ থাকে, এটা হলো সেটা। কিম্বা বলা যায়, এই আবহে যুগের পর যুগ কেবল এই গন্ধটাই জন্ম নিতে পারে, আর কোনো গন্ধ নয়। অথবা এই গন্ধে এই আবহ ছাড়া অন্য কোনও আবহ কোনোভাবেই সৃষ্টি হতে পারে না, কোনো কালেই না। আর এই গন্ধ ও আবহের উৎকৃষ্ট রূপক হতে পারে সেই ইষৎ গোলাপি বর্ণের মুখ আর লাল ফিতের বেণীই।

মুঈন ভোররাতে নিজের বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে ভাবে, বিশটা বছর... একটা মুহূর্তের জন্যও এ গন্ধ উঁকি দেয়নি। সেই কিশোরী, যার নাম ধরা যাক— ‘ঋতু’, তার মুখ কখনো মনে পড়েনি কোনো অবসরেই। তবে জীবনের যখন চল্লিশ, প্রথম যৌবনের স্মৃতি যখন অবলুপ্ত প্রায়, তখন কেন, কোন খাদ থেকে জীবন্ত উঠে আসছে এ গন্ধ? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে আবার ঘুমিয়ে পড়ে মুঈন। সেই ঘুম তার ভাঙে আরো বিশ বছর পর; একটা জাহাজের ডেকে। কীর্তনখোলা হয়ে জাহাজটি চলছিল মোরেলগঞ্জের দিকে। সূর্যাস্তের বিষণ্ণ আলোয় জাহাজের রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মুঈনের মগজ তোলপাড় করে জীবনে তৃতীয়বারের মতো সেই গন্ধ এসে লাগে নাকে।

কী তড়িৎ আর উলটপালট করা গন্ধ! মুঈন ঘোরগ্রস্থের মতো পেছনে ফিরে দেখে, ডেকের বিপরীত দিকের রেলিংয়ে অস্তাচলের বিকেল মুখে মেখে দাঁড়িয়ে আছে এক নারী। উড়ছে তার খোলা চুল। তারই অনতি দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকজন নারী তাকে ডাকছে, এই ঋতু, ওইদিক থেকে সরে আয়, কী উৎকট গন্ধরে বাবা!

প্রমা ইসরাত

গো করোনা গো

থালার মধ্যে ধানদূর্বা দিয়ে চাল দিয়ে গো করোনা গো লিখে দরজায় রেখে দিয়েছে শেফালী। গতকাল ঝুমুরের কাছ থেকে সে জেনেছে, এইরকম করে রাখলে নাকি ওই বাড়িতে করোনা ঢুকতে পারবে না।

ঝুমুরের বর সুজয়, বাড়িতে থাকে এখন। সুজয় বেশ চিন্তায় আছে। কিন্তু বাড়িতে থাকতে পারছে দেখে সুজয়ের মা অনুরাধা খুব চিন্তামুক্ত এবং আনন্দিত। যাক, এইবার নাতিপুতির মুখ দেখার সুযোগ হবে হয়তো। এখন বউটা যদি সব সামলে সুমলে নিতে পারে, তাহলেই হলো।

এদিকে শেফালীর বর শাহেদ, বাড়িতে বসে চানাচুর খায় আর পেপার পড়ে। সারাদিন টিভি চালানোই থাকে। ফেসবুকে বাড়িতে থাকা স্বামীদের বেগতিক অবস্থা নিয়ে করা জোকস পড়তে পড়তে হাসিতে ফেটে পড়ে শাহেদ। কিছুক্ষণ পরপর শেফালীকে ডাকে, কী গো, কী দিবা দাও।

শেফালী কখনো পেয়ারা কাটে, কখনো চানাচুর ঢালে, কখনো বিস্কিট এগিয়ে দেয় চাসহ। আগে দিনের আর সন্ধ্যার চা শুধু করতে হতো। মাঝে মাঝে সন্ধ্যার চা খেতে শাহেদ বাইরে যেত। করোনা পরিস্থিতিতে সরকারি নির্দেশ না আসার আগপর্যন্ত প্রায় প্রতিদিন এই নিয়ে শেফালীর সাথে তর্ক হয়েছে।

থাক বাড়িতেই থাকুক, একটু পর র চা, ফুট ফরমায়েশ, নিত্যদিনের নাস্তা খাওয়ার আবদার, আর দিনে বেশ কয়েকবার দরজা বন্ধ করার ডাক আসলেও শেফালী কিছু বলে না। শেফালী রিমোট ছুঁয়ে দেখে না, সিরিয়ালও আর হচ্ছে না, নাটক সিনেমা পাড়ার শ্যুটিং বন্ধ। আগে ঝুমুরদের বাড়িতেই যা একটু যেত, বা বাইরে বের হলে দেখা হতো, সেটাও বন্ধ।

শেফালী রোজ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া শুরু করে। শাহেদ আগে নামাজ পড়তো না, কিন্তু ইদানীং মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ার একটা বেশ তৎপরতা তার ভেতর দেখা যাচ্ছে। এই সময়ে একটু ধর্মকর্মের দিকে মনযোগ দিচ্ছে, এতেই শেফালী খুশি। জায়নামাজে বসে শেফালীর একটাই প্রার্থনা, করোনা যেন চলে যায়।

আজকে অবশ্য শেফালীর মন খুব খারাপ। ঘরের কাজের ছুটা বুয়া না থাকায় বেশ পরিশ্রম করতে হয় তাকে। কাজ করতে গিয়ে তাই ক্লান্ত হয়ে যায়, এর মধ্যে শাহেদ দরজা বন্ধ করতে গেলে সে মানা করে, শাহেদও এ নিয়ে বাইরে গিয়ে করোনা বাঁধিয়ে আসবে বলে শাসিয়ে যায় শেফালীকে।

ঘরে থাকতে থাকতে মেজাজ খিচড়ে গিয়েছিল বলে শেফালীর সঙ্গে বাজে ব্যবহার করে শাহেদ। এখন সেই মেজাজ পুষিয়ে দিতে, ক্লান্ত শরীরেই আবার শেফালী রান্নাঘরে পায়েস বসিয়েছে। পায়েসের জন্য রাখা কিছু চাল দিয়ে আরেকটি থালায় লিখলো, গো করোনা গো। কে জানে, করোনার ধর্ম কী? যদি এই উপায়ে করোনা থেকে বাঁচা যায়!

সমুদ্র সন্তান

হও

কোনও এক দুর্গম এলাকায় থাকেন এক সুফি সাধক। ইবাদত করতে করতে উনি নিজেকে এমন উচ্চতায় নিয়া গেছেন যে, রিউমার এই, উনি এক বিশেষ পাওয়ার পেয়ে গেছেন। উনার যা দরকার উনি শুধু বললেই হয়, হও, তাতেই ঘটনা ঘইটা যায়। কিন্তু এই যে রিউমার, তার মূলে সত্যতা কিছু আছে কিনা বোঝা যায় না, কারণ দরবেশের পোষাক অতীব জীর্ণ, ঘরবাড়ি তার চেয়েও খারাপ আর শরীরে হাড্ডির উপর কেবল চামড়া জড়িয়ে আছে।

তো এই দারিদ্র্য সত্ত্বেও সাধুর শিষ্যের অভাব হয় না। দূর-দূরান্ত থেকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী যুবকেরা এসে ভিড় করে। গোপন সে জ্ঞান শেখার আশায়। কিন্তু সাধু টু শব্দ করেন না। আশ্রমের কঠিন এবং নিরস জীবনে কেউ দু মাস টেকে তো কেউ চার মাস। পরে হাল ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। কিন্তু এক শিষ্য ছিল নাছোড়বান্দা। দশবছর ধরে লেগে আছে দরবেশের আড্ডায়। মনোবল প্রায় যায় যায়, এমন একদিনে শিষ্য একদিন গেলেন স্থানীয় বাজারে। ফেরার পথে দেখলেন, সরু রাস্তা দিয়ে অত্যন্ত বুড়ো একটা লোক মাথায় প্রকাণ্ড একটা ভারি বোঝা নিয়ে যাচ্ছেন। এমন সময় উল্টা দিক থেকে মার্চফাস্ট করে আসছিল রাজার সেনাবাহিনী আর সেনাবাহিনীর অগ্রগামী দল রাস্তা ক্লিয়ার রাখতে বুড়োকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তা থেকে ফেলে দিল।

বুড়ো তার পোটলাসহ গড়াতে গড়াতে গিয়ে পড়লো খাদে। শিষ্যটি দৌড়ে গেল আর বুড়োকে ধরে উঠালো। দেখলো বুড়ো শরীরে তেমন আঘাত পায়নি তবে বড় অপমানে লেগেছে। এই ঘটনা তার মনে গভীর দাগ কেটে গেল। বুড়োকে সে সাহায্য করার পরে রাগে গজগজ করতে করতে আশ্রমের পথ ধরলো। আশ্রমে ফিরে শিষ্য দরবেশের উপর একচোট নিলো, আর কাহাতক, আজ যদি তার সেই বিদ্যার ছিটেফোঁটাও থাকতো তবে কী এত বড় অন্যায় তার সামনে ঘটতে পারতো, না বুড়োকে এভাবে অপমানিত হতে হতো।

দরবেশ শান্ত হয়ে সব শুনলেন। তারপর বললেন, তুমি যার কথা বলছো তাকে আমি চিনি। সত্যিই বড় অন্যায় হয়েছে। অত্যন্ত কষ্ট লাগছে আমার মনেও। কিন্তু তোমাকে তো বললামই যার কথা বলছো তাকে আমি চিনি, উনিই ছিলেন আমার গুরু। যার কাছ থেকে এই জ্ঞান আমি রপ্ত করেছি।