তালিবানদের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা মুহাম্মাদ ওমর

তালিবানদের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা মুহাম্মাদ ওমর

তালেবানরা বিরাট সন্ত্রাসী, তাদের যেন আর কোনো পরিচয় নেই

পর্ব ১৬

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২১

লাদেন আফগানিস্তানে এসেই যুদ্ধ আরম্ভ করলেন সোভিয়েতের বিরুদ্ধে। মুজাহিদিনরা তখন জোর লড়াই চালাচ্ছে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে মার্কিন মদতে। জিমি কার্টারের পর যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় এলেন রোনাল্ড রেগান। তার আমলে সাহায্যের পরিমাণ আট গুণের বেশি বেড়ে গেল। তিনি দিয়েছিলেন দুশো পঞ্চাশ মিলিয়ন ডলার। রাশিয়ার সৈন্য সংখ্যাও তখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে পঁচাশি হাজার থেকে একলাখ পনেরো হাজার।

১৯৮৬ সালে বারবাক কারমাল নেই ক্ষমতায়, ক্ষমতায় আসে আরেক সমাজতন্ত্রী নাজিবুল্লাহ। ইনি ছিলেন আফগান গোয়েন্দা পুলিশ প্রধান। ১৯৮৮ সালে মার্কিন সাহায্য কট্টরপন্থীদের প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ছিল, সাতশো মিলিয়ন ডলার। সরাসরি মার্কিন যুদ্ধ জাহাজ টেনেসি আফগান মুজাহিদিনদের জন্য অস্ত্র বয়ে নিয়ে গেল। যুদ্ধকালে একদিকে মুজাহিদিনদের কট্টর আদর্শবাদ আর ভিন্ন দিকে ব্যাপকভাবে মার্কিন অর্থ আর অস্ত্র সাহায্য, রুশ সেনাদের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনলো।

১৯৮৮ সালে দুই শীর্ষশক্তি সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র্রে মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। তাতে ঠিক হয়, রাশিয়া এক বছরের মধ্যে সৈন্য প্রত্যাহার করবে এবং কোনো পক্ষই আর আফগানিস্তানকে অর্থ বা অস্ত্র সাহায্য করবে না। সোভিয়েত রাশিয়া কথা রেখেছিল। ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহার করা হলো। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। যথারীতি মার্কিন অর্থ আর অস্ত্র সাহায্য পৌঁছাতে লাগল মুজাহিদিনদের হাতে।

পুনরায় একটা চুক্তি হলো ১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গরবাচেভ শাসিত রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের। চুক্তির মূল কথা ছিল, দুই শীর্ষ শক্তির কেউ নাক গলাবে না আফগানিস্তানে। কিন্তু আমেরিকা কথা রাখলো না। বারবাক কারমাল তখন নেই, ক্ষমতায় তখন নাজিবুল্লাহ। নাজিবুল্লাহর পিছনে তখন রাশিয়ার মদত নেই,  তবুও সাম্যবাদী দল এবং তার নিজস্ব বাহিনীর সাহায্যে মুজাহিদিনদের বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব ছিল। ভারত সরকার এই সময়ে নাজিবুল্লাহকে যথেষ্ট সাহায্য দিয়েছিল।

১৯৯১-১৯৯২ সালে নাজিবুল্লাহ মুজাহিদিনদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চাইলেন। তিনি চাইলেন শান্তি ফেরাতে কিন্তু মুজাহিদিনরা রাজি হলো না। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘ চেয়েছিল বিভিন্ন গোষ্ঠীগুলিকে নিয়ে একটা ঐক্যমতে পৌঁছাতে কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তাতে সাড়া দিল না। বরং লুকিয়ে অর্থ সাহায্য করতে লাগল মুজাহিদিনদের। ১৯৯২ সালের শুরুতে তাজিক নেতা আহমদ শাহ মাসুদ, উজবেক গোষ্ঠীর শক্তিশালী নেতা জেনারেল আবদুল রশিদ দস্তুম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রপতি নাজিবুল্লাহর সঙ্গে জোট বাঁধেন। এদের সঙ্গে যুক্ত হলো হাজারা উপজাতির হিজব-ই-ওয়াদাত। যার ভিতর দিয়ে গঠিত হলো নর্দার্ন অ্যালায়েন্স বা উত্তরের জোট।

কিছুদিন পরেই ১৯৯২ সালের ১৫ এপ্রিল অ-পশতুন জঙ্গি গোষ্ঠী বিদ্রোহ ঘোষণা করে দখল করে নিল কাবুল বিমানবন্দর। এরা নাজিবুল্লার উত্তরের জোটের সঙ্গেই চার মাস ছিল। কিন্তু তারা বিশ্বাসঘাতকতা করলো। নাজিবুল্লাহ দেশ ছাড়ার চেষ্টা করলেন কিন্তু পারলেন না। নাজিবুল্লাহ আশ্রয় নিলেন জাতিসংঘের দপ্তরে। এখানেই তিনি চার বছর গৃহবন্দী অবস্থায় ছিলেন। ১৯৯২ সালের ১৫ এপ্রিল নাজিবুল্লাহ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার দশ দিন পর আহমেদ শাহ মাসুদ কাবুলে প্রবেশ করলেন। ঠিক তার পরদিন ২৬ এপ্রিল নাজিবুল্লাহবিহীন উত্তরের জোট রাব্বানীকে সঙ্গে নিয়ে একটি জোট সরকার গঠন করে। এই জোট সরকারের নেতৃত্বে এলো পঞ্চাশ জনের একটি দল। এদের মধ্যে ছিলেন রাজনৈতিক নেতারা। কিন্তু তারা নাজিবুল্লাহকে মুক্তি দিলেন না, আবার তার উপরে অত্যাচারও চালালেন না।

এই সরকারে গুলাবউদ্দিন হেকমতিয়ারের জায়গা হলো না। হেকমত ছিলেন মার্কিন-সৌদি আরব ও পাকিস্তানি মদতপুষ্ঠ। হেকমতিয়ার এ জোট সরকারকে মানলেন না। তাঁর বাহিনী মার্কিন-সৌদি আরব ও পাকিস্তানের অস্ত্র, অর্থ ও রসদে পুষ্ট হয়ে কাবুলের উপর লাগাতার রকেট বর্ষণ করে চললো। নাজিবুল্লাহ সরকারের পতনের পর মাসুদ এবং রাব্বানী জোট ক্ষমতায় এলে ১৯৯২ সালের জুন মাসে রাষ্ট্রপতি হলেন জামাত-ই-ইসলামী দলের তাজিক নেতা বুরহানউদ্দিন রাব্বানী। এই সরকারের রাষ্ট্রপতি হলেন রাব্বানী আর প্রতিরক্ষামন্ত্রী হলেন আহমেদ শাহ মাসুদ। দেশের নাম হলো ইসলামিক স্টেট অফ আফগানিস্তান।

দেশে আর সমাজতান্ত্রিক শাসন থাকবে না, ইসলামি শাসন চলবে বলে ঘোষণা দেওয়া হলো। ভিন্নদিকে হেকমতিয়ার কাবুলে গোলাবর্ষণ করেই চলেছে। কাবুলের ক্ষমতায় বসে আছে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের এককালের অধ্যাপক রাব্বানী, ভিন্ন দিকে তাঁর এককালের ছাত্র হেকমতিয়ার তাঁর বিরুদ্ধে গোলাবর্ষণ করছে। লড়াই থামানোর উদ্দেশ্যে রাব্বানী তাঁর প্রাক্তন শিষ্য হেকমতিয়ারকে বললেন, ‘তুমি প্রধানমন্ত্রী হও’। হেকমতিয়ার রাজি হলেন। কুরআন ছুঁয়ে শপথ নিলেন, তিনি আর যুদ্ধ করবেন না। কিন্তু যুদ্ধ থামলো না। কারণ হেকমতিয়ার চাইলে কী হবে, তার মদতদাতা মার্কিন-সৌদি ও পাকিস্তান যুদ্ধ থামাতে রাজি নয়। মদতদাতারা হেকমতিয়ারকে বললো, তুমি প্রধানমন্ত্রী কেন, তুমি হবে রাষ্ট্রপতি। রাব্বানীর দয়ায় কেন প্রধানমন্ত্রী হবে, নিজে লড়াই করে রাষ্ট্রপতি হও।

১৯৯৩ সালে হেকমতিয়ারকে রাব্বানী সরকারের প্রধানমন্ত্রী করা হয়। তিনি তা গ্রহণ করেন আবার মার্কিন উস্কানীতে তা ত্যাগ করে চলে আসেন। ১৯৯৪ সালের জানুয়ারি মাসে মার্কিন-পাক-সৌদিপন্থী হেকমতিয়ারের শক্তি বাড়লো। কাবুলে যুদ্ধ আর থামলো না। হেকমতিয়ারের সঙ্গে তখন যোগ দিল নাজিবুল্লাহর সঙ্গে জোট বাঁধা জেনারেল আবদুল রসিদ দস্তুম। দস্তুম তখন রাব্বানীদের উপর ক্ষেপা নিজের প্রাপ্য গুরুত্ব পাচ্ছেন না বলে। হেকমতিয়ার এবং অপেক্ষাকৃত উদারপন্থী দস্তুমের আঁতাতের ফলে কাবুলে পুরোপুরি গৃহযুদ্ধ বেধে গেল রাব্বানী-মাসুদের জোটের সঙ্গে। ১৯৯৪ সালের এই গৃহযুদ্ধে মারা গেল পঁচিশ হাজার আফগান। এদের অধিকাংশই নিরীহ মানুষ। তারা মারা গিয়েছিল রকেট এবং গোলার আঘাতে। ১৯৯৫ সালে কাবুলের এক তৃতীয়াংশ জঞ্জাল শহরে পরিণত হলো। বুরহানউদ্দিন রাব্বানী একদা ছিলেন কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক। মাসুদ আর হেকমতিয়ার দুজনেই ছাত্রজীবনে ছিলেন রাব্বানীর রাজনৈতিক শিষ্য। কিন্তু রাশিয়ানরা চলে যাবার পর রাব্বানী আর হেকমতিয়ার হয়ে গেলেন পরস্পরের শত্রু।

রাব্বানী বিরোধ মিটাতে চাইলেও, পারলেন না মার্কিন-পাক আর সৌদি চক্রান্তে। সারা আফগানিস্তান জুড়ে তখন ভ্রাতৃঘাতী লড়াই চলছে, সারা দেশ জুড়ে বিরাট এক বিশৃঙ্খলা। নানারকম নৈরাজ্যে সাধারণ মানুষজন চরমভাবে হতাশাগ্রস্ত। যখন এসব ঘটছে তখন নতুন একটি দলের উত্থান আরম্ভ হয়েছে। সে দলটির নাম তালিবান। তালিবানদের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা মুহাম্মাদ ওমর, যিনি রুশ সেনাদের সঙ্গে লড়াই করে একটি চোখ হারিয়ে বাড়িতে বসেছিলেন। ভিন্ন দিকে নাজিবুল্লাহ সরকারের পতনের পর কেন্দ্রীয় কোনো শাসক নেই। প্রাক্তন মুজাহিদরা ছোট বা বড় দল গড়ে এলাকা অনুযায়ী শাসন চালাচ্ছে। চালাচ্ছে মাদক ব্যবসা। সমানে চলছে সাধারণ মানুষের উপর লুটপাট। এমনকী নির্বিচারে মেয়েদের ধর্ষণ। আফগানিস্তানে তখন বন্দুকই হচ্ছে আইন। এই সময় পাকিস্তান সীমান্তের স্পিন বলদাখ চেকপয়েন্ট জুড়ে চলছিল একরকম ‘মাৎস্যনায়ম’। ব্যবসায়ীরা পথ চলতে পারতেন না, সবকিছু লুটপাট হয়ে যেতো। ভয়াবহ এক পরিস্থিতি। ওমর তার সহপাঠী তিরিশ জনকে নিয়ে চেকপয়েন্ট দখল করে শায়েস্তা করলেন লুটতরাজকারীদের। এতে ব্যবসায়ীরা খুশি হলেন। কারণ বহুদিন ধরেই তাঁরা পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তান হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে বা পশ্চিম এশিয়ায় তাঁদের পণ্য পাঠাতে পারছিলেন না।
স্পিন বলদাখের এই অংশ দিয়েই সৌদি ও পাকিস্তানী ব্যবসায়ীরা পণ্য সরবরাহ করতেন। তাঁরা অর্থ সাহায্য করলেন ওমরদের, বললেন নিরাপত্তা চাই। জানালেন প্রয়োজনে আরো অর্থ দেবেন তাঁরা। ওমরের পাশে তখন শুধু ব্যবসায়ীরা নয়, সাধারণ মানুষরাও জুটলো নিজেদের মুক্তির আশায়। কারণ লুটতরাজ, ধর্ষণ বন্ধ করার ফতোয়া দিয়েছে ওমরের দল। তাঁদের দখল করা এলাকায় চুরির শাস্তি হাত কেটে দেয়া, ধর্ষণ নিষিদ্ধ আর নিষিদ্ধ মাদক ব্যবসা। চলবে