আহমদ শাহ মাসুদ
তালেবানরা বিরাট সন্ত্রাসী, তাদের যেন আর কোনো পরিচয় নেই
পর্ব ১৫
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২১
বিন লাদেনের মতোই মুজাহিদিন দুই বিখ্যাত নেতা আহমদ শাহ মাসুদ, গুলাবউদ্দিন হেকমতিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মানুষ। মাসুদ নিজে তাজিক, কাবুলেই তাঁর বেড়ে ওঠা এবং পড়াশুনা। মাসুদের জন্ম ১৯৫২ সালে। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন একজন সামরিক কর্মকর্তা। যদিও তিনি কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদধারী একজন প্রকৌশলী ছিলেন। রাশিয়ানরা যাদের জন্য আফগানিস্তান ছাড়তে বাধ্য হয় তাঁদের অন্যতম মাসুদ। পঞ্জশির এলাকা জুড়ে তাঁর রাজত্ব ছিল। রাশিয়ানরা দেশ ছাড়ার পর নাজিবুল্লাহ সঙ্গে আঁতাত গড়ে তুলেছিলেন মাসুদ এবং রাব্বানী। কিন্তু নাজিবুল্লাহ ক্ষমতাচ্যুত হলে নাজিবুল্লাহর পাশে দাঁড়াননি মাসুদ। বরং নিজেরাই দখল করেন রাষ্ট্রক্ষমতা।
চল্লিশ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী ছিল মাসুদের। দস্তুম ছিলেন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র্রপতি নাজিবুল্লাহর সামরিক সেনাপতি। পরে নিজেই গঠন করেন একটি বিদ্রোহী বাহিনী। তিনি উজবেকদের স্বার্থ দেখেন উত্তর আফগানিস্তানে। তাঁর অধীনে তখন ছিল আটটি প্রদেশ। তাঁর রাজধানী ছিল মাজারই শরীফ থেকে আশি মাইল দূরে জোজান প্রদেশের সেবেরগানে। পরে তিনি মাজারই শরীফ দখল করে নেন।
ছাত্রজীবনে কাবুলেই মাসুদের সঙ্গে দেখা হয় রাব্বানী আর হেকমতিয়ারের। হেকমতিয়ার তখন কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় ছাত্রনেতা। তাঁদের সকলের নেতা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বুরহানউদ্দিন রাব্বানী। ঘটনাচক্রে মাসুদ পরে পেশওয়ারের কাছে চেরাত সামরিক শিবিরে সামরিক শিক্ষা লাভ করেন। আফগানিস্তানের ক্ষমতায় তখন সমাজতন্ত্রীদের সাহায্যপুষ্ট রাজা দাউদ। দাউদের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য আই. এস. আই.-র পক্ষ থেকে ১৯৭৫ সালে মাসুদকে পাঠানো হয় আফগানিস্তানে। সঙ্গী ত্রিশ জন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই ত্রিশ জনের অর্ধেক মারা গেলেন বা গ্রেফতার হলেন। মাসুদ জোট গঠন করলেন রাব্বানীর দলের সঙ্গে।
রাব্বানী তখন দল গঠন করেছেন জামাত-ই-ইসলামী। জামাত-ই-ইসলামী তুলনামূলকভাবে উদারপন্থী। রাব্বানী জামাত-ই-ইসলাম গঠনের সময়ে তাঁর এক শিষ্য মাসুদকে সঙ্গে পেলেও আর এক শিষ্য হেকমতিয়ারকে সঙ্গে পেলেন না। হেকমতিয়ার গঠন করলেন কট্টরপন্থী দল হেজব-ই-ইসলামী। ১৯৭৬ সালে আই, এস. আই রাব্বানীকে ছেড়ে হেকমতিয়ারকে সাহায্য দিতে শুরু করে এবং মাসুদের আর তাঁর সঙ্গীদের উপর শুরু হলো গুপ্তচর সন্দেহে অত্যাচার। মাসুদের কয়েকজন সঙ্গী মারাও গেলেন হেকমতিয়ার এবং পাকিস্তানের হাতে। সেই থেকে হেকমতিয়ার এবং পাকিস্তান মাসুদের শত্রু।
১৯৭৮ সালে সাম্যবাদীরা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে দাউদকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করলে মাসুদ প্রমাদ গুনলেন। চলে এলেন পঞ্জশির উপত্যকায়। গঠন করলেন সশস্ত্র বাহিনী। শুরু করলেন বিদ্রোহ। ১৯৮০ সালে পঞ্জশির তাঁর ক্ষমতায় চলে গেল। মাসুদ তখন পেতেন ইরানের সাহায্য। ভিন্ন দিকে আফগানিস্তানে সিআইএ-র সবচেয়ে প্রিয় লোকটির নাম গুলাবউদ্দিন হেকমতিয়ার। তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু রাব্বানীর সঙ্গে। ১৯৭২ সালে যোগ দেন আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি ‘পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ আফগানিস্তান’-এ। একজন মাওবাদী ছাত্রকে খুন করার অপরাধে তাঁর কারাদণ্ড হয়। তিনি তখন পালাতে সক্ষম হন। যান পাকিস্তানের পেশওয়ারে।
এই ঘটনার ভিতর দিয়েই তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। ফলে তিনি কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তিবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হলেও, শেষ পর্যন্ত আর প্রকৌশলী হওয়া হলো না। কিন্তু তাঁর বন্ধুদের কাছে তিনি ‘প্রকৌশলী হেকমতিয়ার’ হিসেবেই পরিচিত, হেকমতিয়ার নিজেও এই ‘প্রকৌশলী হেকমতিয়ার’ উপাধিটি ব্যবহার করতে পছন্দ করতেন। তিনি পাকিস্তানে বসেই ১৯৭৪ সালে গড়ে তোলের নিজস্ব রাজনৈতিক দল হিজব-ই-ইসলামী। সাম্যবাদী চিন্তা থেকে তখন তিনি সরে গেছেন। পরবর্তী দু বছর পাকিস্তানে বসে আই এস আই-এর কাছে শিক্ষা নেন বিদ্রোহের। তিনি রাব্বানী সরকারের বিরুদ্ধে লড়েছেন আবার রাব্বানী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। পরবর্তীতে আবার তাঁর কামানের লক্ষ্য ছিল রাব্বানী। বর্ণময় এক বিদ্রোহী এই মানুষটি। চলবে