আমীর আবদুর রহমান
তালেবানরা বিরাট সন্ত্রাসী, তাদের যেন আর কোনো পরিচয় নেই
পর্ব ১৩
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২১
খুব ভালোভাবে আফগানিস্তানের সমাজ ও রাজনীতি বোঝার জন্য আবার পিছনে ফিরে তাকানো যেতে পারে। মুঘল আমলে আফগানিস্তান কিছুকাল ভারতবর্ষ তথা হিন্দুস্তানের অন্তর্ভুক্ত ছিল। জওহরলাল নেহরু আফগানিস্তান নিয়ে লিখছেন, তখন আফগানিস্তান স্বাধীন রাজ্য; আর তখন রুশ সাম্রাজ্য ভেঙে তার জায়গায় জন্ম নিয়েছে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন। তিনি জানাচ্ছেন, ১৭৪৭ সালেই একবার পশতুন আর পাঠানজাতির নেতৃত্বে আফগানিস্তান ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। রুশ সামাজ্য আর ইংরেজরা বহুদিন ধরেই নানারকম ষড়যন্ত্র করে চলেছিল আফগানিস্তানকে নিজের হাতের মুঠোয় পাবার জন্য। সেই সব চক্রান্তের ফলেই উনিশ শতকের শেষে ইংল্যান্ড আর আফগানিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বাধলো। যুদ্ধে ইংরেজরা বারবার বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েও কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতার ভিতর দিয়ে শেষ পর্যন্ত ইংরেজেদর প্রাধান্য সৃষ্টি হলো। ইংরেজরা তখন আফগান রাজবংশের বহু লোককে রাজবন্দী হিসেবে উত্তর ভারতের বহুস্থানে আটক করে রাখে। সিংহাসন গেল ব্রিটেনের মিত্রস্থানীয় আমীরদের দখলে, আফগান প্রতিরক্ষার ভার ব্রিটেনের হাতে চলে গেল। আফগানিস্তানের বৈদেশিক নীতি সম্পূর্ণরূপেই ব্রিটিশের নির্দেশ অনুসারে চলতে লাগল। ইংরেজরা এই বিজয় সম্পন্ন করে ১৮৭৯ সালে।
সকল রাষ্ট্রের কাছে আফগানিস্তানের একটা রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল তার ভৌগলিক অবস্থানের জন্য। যার একদিকে চীন আর একদিকে রাশিয়া, ভিন্ন দিকে ইরান আর একদিকে তৎকালীন বিরাট ভারতবর্ষ। স্বভাবতই এসব দেশের উপর প্রভাব বিস্তার করা জন্য আফগানিস্তান দখল করার গুরুত্ব ছিল। ভিন্ন দিকে আফগানিস্তানের সঙ্কট ছিল তার কোনো সমূদ্র ছিল না, সমূদ্র আর আফগানিস্তানের মাঝখানে হচ্ছে বেলুচিস্তান। সমূদ্রপথে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে আফগানিস্তানের যোগাযোগ রাখার পথটা ছিল তখন ভারতবর্ষ বা বেলুচিস্তান। ভারতবর্ষের ব্রিটিশ সরকার সেই সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে নানাদিক থেকেই আফগানিস্তানের উপর জুলুম চালাতো। ব্রিটিশরা আফগানিস্তান দখল করলেও আমীরদের উপর পুরো আস্থা রাখতে পারেনি। ফলে আমীরদের নিজেদের অনুগত করে রাখার জন্য ইংরেজ কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ টাকা এঁদের সাহায্য দিতে থাকলো। এইরকমই বৃত্তিভোগী রাজা ছিলেন আমীর আবদুর রহমান, ১৯০১ সালে এঁর দীর্ঘকালব্যাপী রাজত্বের অবসান হয়। তার পর এলেন আমীর হাবিবুল্লাহ, ব্রিটিশের সঙ্গে তারও সম্প্রীতি ছিল। কিন্তু আফগান দরবারের ভিতরেই নানারকম ষড়যন্ত্র চলতো। ১৯১৯ সালেই সেটা টের পাওয়া গেল, পরপর দুটা প্রাসাদ-বিপ্লব ঘটে যাওয়ার মধ্য দিয়ে।
প্রথমে আমীর হাবিবুল্লাহকে খুন করা হলো এবং তার ভাই নাসরুল্লাহ আমীর হয়ে বসলেন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই নাসরুল্লাহকে সরিয়ে দেওয়া হলো, এবারে আমীর হলেন আমানুল্লাহ; মানে হাবিবুল্লাহর পুত্রদের একজন। ব্রিটিশদের প্রতি কোনো প্রকার আনুগত্য স্বীকার করে থাকাটা আমানুল্লাহর পছন্দ ছিল না, তিনি পূর্ণ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। ফলে আবার ব্রিটিশদের সঙ্গে আফগানদের যুদ্ধ বাধল। ভারতের ব্রিটিশ সরকারের শক্তি আমানুল্লাহর চেয়ে অনেক বেশি ছিল। কিন্তু যুদ্ধ করবার মতো খুব একটা ভরসা পেল না ব্রিটিশ, কারণ সোভিয়েত সাহায্য লাভ করার সম্ভাবনা ছিল আফগানিস্তান সরকারের। ফলে ইংরেজরা হাত গুটিয়ে নিয়ে আফগানদের সঙ্গে সন্ধি করতে এগিয়ে গেল। সন্ধিতে ইংরেজরা আফগানিস্তানের স্বাধীনতা মেনে নিয়েছিল। যা আমানুল্লাহ চেয়েছিলেন তা পেয়ে গেলেন কিন্তু ব্রিটিশরা তাঁর উপর প্রসন্ন রইলো না।
যখন আমানুল্লাহ ক্ষমতায় এলেন, তিনি একটি নতুন নীতির প্রবর্তন করলেন। সেই নীতিটি হচ্ছে পাশ্চাত্য দেশের অনুকরণে দ্রুত আফগানিস্তানের ভিতরে সংস্কার সাধন। স্ত্রী সৌরিয়া এই কাজে তাঁকে প্রচুর সাহায্য করেছিলেন। সৌরিয়া খানিকটা শিক্ষা লাভ করেছিলেন ইউরোপে, আফগানিস্তানে নারীদের যেভাবে বোরখা বা অবগুণ্ঠনের আড়ালে আবদ্ধ রাখা হতো তিনি তার উপর নিদারুণ চটা ছিলেন। ফলে শুরু হলো অদ্ভুত অভিযান, ‘পাশ্চাত্তীকরণ’। ঠিক সেই একই সময়কালে তুরস্কের কামাল পাশার সংস্কার আমানুল্লাহর আদর্শ হয়ে দাড়ালো। তিনি আফগানদের প্যান্ট কোট, সাহেবী টুপি পরালেন, দাড়ি কামাতে পর্যন্ত বাধ্য করলেন। কিন্তু আমানুল্লাহর ক্ষমতার ভিত্তি কামাল পাশার মতো সৃদৃঢ় ছিল না, কামাল পাশার পিছনে ছিল একটি সুদক্ষ এবং অভিজ্ঞ সেনাবাহিনী। ভিন্ন দিকে আফগানরা ছিল তুর্কিদের চেয়ে অনেক বেশি সেকেলে। চলবে