তালেবানরা বিরাট সন্ত্রাসী, তাদের যেন আর কোনো পরিচয় নেই
পর্ব ১২
প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২১
নির্যাতিত একটা জাতির মানুষের বিরুদ্ধে খুনীদের পক্ষ নিয়ে মনগড়া কথা বলার মতো আপরাধ আর কি হতে পারে? তালিবানদের বিরুদ্ধে মনগড়া কল্পকাহিনির কিছু উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। বর্তমান রচনায় যা কিছু বলা হয়েছে, তা আফগানিস্তানে মার্কিন আক্রমণের আগের ঘটনা। মার্কিন আক্রমণের পরের কথা কিছু লেখা হয়নি বা আক্রমণের সময়কার বর্ণনা নেই। বর্তমান পর্বে শুধু মার্কিনদের আক্রমণের পরের একটি কি দুটো ঘটনা বিবৃত করা হবে।
দুই হাজার এক সালের অক্টোবরে আফগানিস্তানে মার্কিন হামলার সময় নভেম্বর মাসে বিদেশি সাহায্য সংস্থার দুজন মহিলা কর্মী দীর্ঘদিন বন্দি ছিলেন তালিবানদের হাতে। তারা যখন মুক্তি পেল তখন তাদের নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করা হয়। জানার বিষয় ছিল, তালিবানরা তাদের প্রতি কতটা বর্বর আচরণ করেছে। সিএনএন-এ সেই সাংবাদিক সম্মেলন দেখানো হয়েছিল। কিন্তু দুজন মহিলাই তালিবানদের সম্পর্কে সামান্য খারাপ মন্তব্য করলেন না।
বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে তারা জানালেন, তালিবানরা তাদের সঙ্গে অত্যন্ত ভালো ব্যবহার করেছেন এবং তাদেরকে কেবলমাত্র নামাজের সময় ছাড়া অন্য সবসময়ই গান বা আনন্দ করবার করতে বলেছেন। ঘটনা হলো, যখন বোমায় বিধ্বস্ত ঘরবাড়ির শহরে মহিলা দুটি অসহায়, তালিবানরা তাদের ফেলে রেখে যায়নি বরং নিজেদের সঙ্গে আশ্রয় দিয়েছিল। এই দুই মহিলা কর্মী ছিলেন তরুণ বয়সের। যখন তারা মনমরা হয়ে বসে থাকতন, তালিবানরা তাদের বলতো ভয়ের কিছু নেই।
বলেছিল বোন, আমরা প্রাণ দিয়ে হলেও তোমাদের রক্ষা করবো। দুজন মনমরা হলেই বলতো তোমরা গান গেয়ে আনন্দ করো। নিজেরা না খেয়ে মেয়ে দুটিকে খাইয়েছে। সাংবাদিকরা নানা প্রশ্ন করেও তাদের কাছ থেকে তালিবানদের সম্পর্কে ভীতিজনক তথ্য উদ্ধার করতে পারেনি। পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমের জন্য এটা ক্ষতির একটা কারণ হয়ে গেল। ফলে মুক্তিপ্রাপ্ত দুজনকে নিয়ে তারা আর হৈ চৈ করেনি।
প্রচার মাধ্যমের পরিকল্পনা ছিল বন্দি দুজনকে নিয়ে অনেকগুলি অনুষ্ঠান করে তালিবানদের কুকীর্তির কথা প্রকাশ করবে। কিন্তু উল্টো মুক্তিপ্রাপ্ত দুজন এমন প্রশংসা করলো তালিবানদের যে, বাকি অনুষ্ঠানগুলির পরিকল্পনা বাতিল করে দিয়েছিল। সাম্প্রতিক সময় তালিবানদের কাবুল দখলের পরের আর একটি ঘটনার কথা বলা যাক। ভারতীয় দুশো নাগরিক, যারা কাবুলের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করতো, কাবুল তালিবানদের দখলে গেলে তারা ভারতে ফিরবার জন্য বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিল অনেক ঘণ্টা ধরে।
সকলেই তখন তারা ক্ষুধার্ত আর অনেকেই ছিল ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। সে সময়ে দুজন তালিবান সৈন্য এসে ভারতীয় সেই দলটিকে তাদের সঙ্গে যেতে বলে। যখন বাসে করে যাচ্ছিল, সকলেই মৃত্যু ভয়ে ভীত হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর বাস থামিয়ে একজন তালিবান সৈন্য সে বাসে উঠে সকলকে সাহস জোগায়, বলে তাদের ভয় পাবার কোনো কারণ নেই। তাদের সকলের পাসপোর্টগুলি নিয়ে নেয়া হয় আর বলে দেয়া হয়, গন্তব্যস্থলে যখন জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে সবাই যেন সত্যি কথাটাই বলে।
তালিবানরা বলেন, মিথ্যা বলার কোনো দরকার নেই, ভয় পাবার দরকার নেই। গন্তব্যস্থলে পৌঁছলে মহিলাদের সুন্দর কক্ষে বসতে দেয়। তালিবানরা কেউ সামান্যতম তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা দূরে থাক, কেউ তাদের দিকে চোখ তুলেও তাকায়নি। তালিবানরা যখন বুঝতে পারে, দীর্ঘ সময় ভারতীয় এই দলটি না খেয়ে আছে, তখন সকলের জন্য দুপুরে আফগানিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় আর সুস্বাদু খাবারটির আয়োজন করে। সহজভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এবং বলা হয় আপনারা দেশে ফিরে যাচ্ছেন কেন।
নিজের নিজের কর্মস্থলে থেকে যান, আপনাদের এখানে কোনো ভয় পাবার কিছু নেই। সকলকে সম্মান দিয়েই তালিবানরা কথা বলেছেন। কথাগুলি জানান কলকাতায় ফিরে এসে তমাল ভট্টাচার্য বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে। তিনি বলেন তালিবানরা খুব ভালো উর্দু বলতে পারেন, আবার অনেকে খুব ভালো ইংরেজি বলেন। যদিও কলকাতার অনুষ্ঠান উপস্থাপক নানাভাবে তালিবানদের নিষ্ঠুরতার কথা প্রচার করতে অন্যদের সাহায্য নিয়েছেন। কিন্তু মানুষ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা যার, তার কথা বিশ্বাস করবে? নাকি প্রচার মাধ্যমগুলিকে?
অরুন্ধতী রায় লিখেছেন, সন্ত্রাস বিরোধী আন্তর্জাতিক কোয়ালিশন আসলে বিশ্বের শীর্ষ ধনী দেশগুলির একটা চিত্র। বিশ্বের প্রায় সমস্ত অস্ত্র এরাই তৈরি করে। দুনিয়ার সবচেয়ে প্রাণঘাতী, সবচেয়ে ধ্বংসক্ষমতাসম্পন্ন মারণাস্ত্র; রাসায়নিক, জীবানু ও পরমাণু অস্ত্র এদের হাতে রয়েছে। ইতিহাসের বেশির ভাগ যুদ্ধ এরাই করেছে, সবচেয়ে বেশি গণহত্যার রক্তে এদেরই হাত রঞ্জিত। অসংখ্য স্বৈরাচার আর নিপীড়নকে এরা মদদ দিয়েছে; অর্থ, অস্ত্র যুগিয়েছে। এরা সংহিসতা আর যুদ্ধের সংস্কৃতিকে পূজা করেছে। তালিবানরা যতই অপকর্ম করে থাক না কেন, এদের দলে ঢোকার মতো অপকর্মে সিদ্ধ হতে কখনোই তারা পারবে না।
উপরে দুজন পাশ্চাত্য নারীর কাছে তালিবানদের চরিত্র জানা গেছে আর জানা গেছে ভারতীয় নাগরিক তমাল ভট্টাচার্যর মুখে। সেটা বলে দেয় তালিবানরা মোটেই অমানুষ নন। বরং তাদের ব্যবহার অনেক বেশি নম্র আর মানবতাবাদী। নারীর প্রশ্নে তালিবানদের দৃষ্টিভঙ্গি কী আর তা নিয়ে বিভিন্ন নারীবাদী প্রতিষ্ঠানের মন্তব্য নিয়ে সামনের পর্বে আলোচনা করা হবে। চলবে