তালেবানরা বিরাট সন্ত্রাসী, তাদের যেন আর কোনো পরিচয় নেই

পর্ব ৯

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৫, ২০২১

মার্কিন শক্তি আফগানিস্তান দখল করে নেয়ার আগে তালিবান সরকারকে বলছে সন্ত্রাসী। তাদের অপরাধ ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দেয়া। কিন্তু মার্কিন শক্তি বা তার দালালরা মার্কিনীদের দীর্ঘ দুশো বছরের সন্ত্রাসের কথা বলছে না। মার্কিন নাগরিক নোম চমস্কি যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাস ও দস্যুতা নিয়ে বলছেন, লাখ লাখ আদিবাসীকে বহিষ্কার করেছি কিংবা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করেছি। আমরা মেক্সিকোর অর্ধেক ভূখণ্ড দখল করে নিয়েছি, মধ্য-আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের সর্বত্র এবং কখনো কখনো এ অঞ্চলের বাইরেও ব্যাপক লুটপাট চালিয়েছি। আমরা হাওয়াই ও ফিলিপাইন দখল করে নিয়েছি এবং এই দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে লাখ লাখ ফিলিপাইনবাসীকে হত্যা করেছি।

তিনি বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বজুড়ে আধিপত্যের সীমা বিস্তার করেছে। ঠিক এর জন্য এরা সবসময়ই অন্যদেরকে হত্যা করেছে, লড়াইটা চলেছে অন্য কোনো জায়গায়; অন্যরাই সবসময় যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা ব্যাপক নরহত্যার শিকার হয়েছে। খুব রাখঢাক না করে চমস্কি সত্য উচ্চারণ করলেও, কিছু ভদ্রলোকরা এসব সত্য দেখতে নারাজ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তানের উপার লড়াই চাপিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও তাদের বিচারে আফগানিস্তান বা তালিবানরা সন্ত্রাসী। দালালীর কী চমৎকার নমুনা! ব্রিটিশরা ভারত দখল করে রেখেছিল দুশো বছর। বিভিন্ন রাজ্য দখলে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল। কিন্তু নিজেদের দখলকে তারা কীভাবে বিশ্লেষণ করতো।

ফ্রুড তার ‘ইংলিশ ইন দ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজ’ গ্রন্থে ইংরেজদের সাম্রাজ্য বিস্তারের পক্ষে লিখেছিলেন, স্বাধীনতা সবাই চায়, কিন্তু দুর্বল জাতি তখনই স্বাধীন হতে পারে যখন তারা শক্তিমান ও ন্যায়বান জাতির অধীন। ঠিক একই সুরে ব্রিটিশ আগ্রাসনের আর এক সেনাপতি সেসিল রোড্স্ লিখলেন, আমরাই পৃথিবীর শ্রেষ্ট জাতি। আমাদের ভদ্রতা, স্বাধীনতা ও শান্তির আদর্শই শ্রেষ্ঠ। এবং দুনিয়ার যত বেশি স্থানে আমরা বসবাস করবো, মানবজাতির পক্ষে ততই মঙ্গল। রোজবেরি লিখেছিলেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য হচ্ছে মানুষের সার্বিক মঙ্গলের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। পৃথিবী আগে এমন জিনিস দেখেনি। জোসেফ চেম্বারলেন বলছিলেন, আমি বিশ্বাস করি, ব্রিটিশ জাতিই হচ্ছে মানব-ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ শাসক জাতি। প্রখ্যাত লেখক উইনউড রীড পর্যন্ত তার ‘মারটাডোম অফ ম্যান’ গ্রন্থে লিখে বসলেন, আমি ঘৃণা করি সেই রোগগ্রস্ত রাজনীতিকদের, যারা বলেন দেশগুলির অধিবাসীরাই সে দেশের মালিক, এবং দেশ কেড়ে নেয়াটা অপরাধ।

ভারতীয় ভদ্রলোকরা কিন্তু এই ব্রিটিশদেরই প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল। ভারতীয় কৃষক আর কারিগরদের উপর ব্রিটিশ শাসকদের অত্যাচারে তারা কখনো কর্ণপাত করেনি। শাসক ব্রিটিশরা তাদের ইংরেজি শিখিয়েছে আর লুটপাটের সামান্য ভাগ দিয়েছে, এতেই তারা ধন্য ছিল। স্যার চার্লস ওয়েন্টওয়ার্থ ডিল্ক্ আঠারশো আটষট্টি সালে তাঁর ‘গ্রেটার ব্রিটেন’ গ্রন্থে লিখলেন, এংলো-স্যাকসন জাতিই হচ্ছে একমাত্র জাতি যার অধিকার আছে অন্যদের নিশ্চিহ্ন করা। অন্য দেশ দখল করাটা যে অন্যায় সেই বিমূর্ত ধারণার কোনো স্থান নেই যখন আমরা আফগানিস্তান ও আবিসিনিয়ার কথা বিবেচনা করি। কারণ জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগ ও-সব দেশে নেই, এবং একটা আবিসিনীয় সর্দারের শ্রেষ্ঠ শাসনের চেয়ে সর্বনিকৃষ্ট ব্রিটিশ শাসনও অনেক ভালো।

তিনি আঠারশো নব্বই সালে সারা পৃথিবীকে নিজ স্বার্থেই ব্রিটেনের পদানত হতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবী, ইতিহাসের অধ্যাপক স্যার জে আর সীলি আঠারশো তেরো সালে তাঁর ‘দি এক্সপানশন অব ইংল্যান্ড’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, ভারতে ইংরেজ সাম্রাজ্য গড়ে ফেলেছে অন্যমনস্কভাবে। ভারত ব্রিটিনের ঘাড়ে এক বোঝা। তবে ছেড়ে আসা যাচ্ছে না, কারণ যে ব্রিটিশদের শান্তি সেখানে এখন বিরাজ করছে, তা বিঘ্নিত হবে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বহু এরকম কণ্ঠ আছে যারা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পক্ষে নানারকম আস্ফালন করে গেছেন। পাশাপাশি দেশীয় এক শ্রেণীর তথাকথিত শিক্ষিত সুবিধাভোগী দালালরা তাঁদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়েছিলেন। বর্তমান সময়ে সাম্রাজ্যবাদের এমন দালালদের অভাব নেই। যারা তালিবান শাসনের মধ্যে সামান্য ভালো কিছু দেখতে পায় না। মনে করে সেখানে বিদেশী মার্কিন শাসনটাই ছিল আফগানিস্তানের জন্য মঙ্গলজনক।

সন্ত্রাসকে কীভাবে উপস্থাপন করা হয় ক্ষমতাবানদের পক্ষ থেকে সেটা এর আগেও লক্ষ্য করা গেছে। ভারতের সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনকে ‘সন্ত্রাসবাদ’ বা ‘সন্ত্রাসী আন্দোলন’ বলে চিহ্নিত করেছিল ব্রিটিশ সরকার। বর্তমানে বিভিন্ন দেশের ভদ্রলোকরা তাই করছে নিজেদের প্রগতিশীল চেহারা তুলে ধরার জন্য। ব্রিটিশদের চোখ দিয়ে দেখতে গেলে তিতুমীর, মঙ্গলপাণ্ডে, লক্ষ্মীবাঈ, ক্ষুদিরাম, ভগৎ সিং, সূর্যসেন, সকলেই সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত হবে। ফলে আফগানিস্তানের মানুষ ভিন্ন কোনো দেশে গিয়ে বোমা না ফেলেও হয়ে গেল সন্ত্রাসী। সবচেয়ে বেশি আলোচিত তালেবানদের কথা ধরা যাক। কখনো কি তারা ভিন্ন কোনো দেশ আক্রমণ করেছে বা ভিন্ন কোনো দেশ দখল করতে গিয়েছে? হ্যা তালেবানরা ধর্মীয়ভাবে কট্টর। শুধু তালেবানরা কেন, পুরো আফগানিস্তান খুব ধর্ম মেনে চলে। বহু যুগ ধরে সেখানে পুরুষেরা বহুগামী, কয়েকটা বিয়ে করে। নারীরা পর্দা মানে। সেটা নতুন করে তালেবানদের ব্যাপার নয়। বহুকাল ধরে সেটা চলে আসছে। সেটা তাদের সমাজের সমস্যা। সেটার সমাধান করবে তার জনগণ। যদি বাইরের কোনো মহৎ শক্তি তার সমাধান করতে চায়, তাদের দেশ দখল করতে হবে কেন? সংস্কৃতির আদান প্রদান চালাবে, দ্বিপাক্ষিক ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে তুলবে। চলবে