তালেবানরা বিরাট সন্ত্রাসী, তাদের যেন আর কোনো পরিচয় নেই
পর্ব ৮
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৩, ২০২১
নিশ্চয়ই নারীর অবহেলায় সবার মনে খারাপ হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু নারীকে মুক্তি দেয়ার উপায়টা কী? কখনো কখনো বাইরের শক্তি বা সভ্যতা এতে খুব কার্যকর হয়। মুঘলদের সঙ্গে বা মুসলমান সংস্কৃতির যেমন সংমিশ্রণ ঘটেছিল। কিন্তু মার্কিন আক্রমণ কি আফগানিস্তানের মানুষের মুক্তি চেয়েছিল বা মুক্তি আনতে পেরেছে? মাখমালবাফ জানাচ্ছেন, দূর থেকে তালিবানদের মনে হবে অবিবেচক আর ভয়ঙ্কর মৌলবাদী। যখন কাছে যাবেন, দেখবেন ক্ষুধার্ত কতগুলো পশতুন এতিমদের। যখন আপনি তালিবানদের আত্মপ্রকাশ পর্যালোচনা করবেন, দেখতে পাবেন পাকিস্তানের জাতীয় রাজনৈতিক স্বার্থ সেখানে যুক্ত। কিন্তু তালিবানদের ইতিবাচক দিকগুলিকেও মাথায় রাখতে হবে। যখন দিশেহারা পুরো আফগান আর তাদের প্রত্যাশা তালিবানদের কাছে এমন একটা রাষ্ট্র, যেখানে অস্ত্রের ঝনঝনানি নেই; তালেবানরা সফলতার সঙ্গে সে কাজটা করতে পেরেছিল। মনে রাখতে হবে, জনগণের সমর্থন ছাড়া একটা শক্তি এতদ্রুত সারাদেশে প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। ধর্মতত্ত্বের ছাত্র তালিবানরা, কুরান-সুন্নাহর আলোকে দেশ চালাবার কথা ভেবেছিল। ভারতবর্ষের বহু আধুনিক মানুষরা যেমন কুরান্ সুন্নাহ, কেউ বা গীতা আর উপনিষদকে কেন্দ্র করে ভারত শাসন করতে চেয়েছিল। কিন্তু এই তালেবানরা তবুও ইরানের সমর্থন পেল না। ইরান তাদের মনে করতো মৌলবাদী। ইরানের বিরুদ্ধে তালেবানদের ব্যবহার করতে চেয়েছিল মার্কিন দোসর সৌদি আরব আর আরব আমিরাত। পাকিস্তানের টাকা ছিল না তালেবানদের চালিয়ে নেয়ার, টাকাটা আসতো সৌদি আরব আর আরব আমিরাত থেকে। বুঝে না বুঝে তালিবানরা দাবার ঘুঁটি হয়ে গেল একসঙ্গে অনেকের। বারবার মনে রাখতে হবে, রাজনীতি আর ক্ষমতা কানাগলির চক্রে আটকে যায়; সোজা পথ ধরে হাঁটে না।
দুই দশক ধরে আফগানিস্তানে চলে আসা অস্ত্রের ঝনঝনানি কিন্তু তালিবানরা বন্ধ করে ফেললো। নিরস্ত্রীকরণ আর শান্তির কথা বলে পাঠালো তালিবানরা, জনগণ তাদের সাদরে গ্রহণ করলো। অল্প সময়ের মধ্যে আফগানিস্তানের বেশিরভাগ অংশ তালেবানদের দখলে চলে এলো। তখনই আফগানিস্তানে পাকিস্তানের শেকড় প্রকাশিত হলো। সকলের স্মরণ থাকবে তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদী বা এলটিটির কথা, যারা ভারতে সহযোগিতা পেয়ে শ্রীলঙ্কায় নানারকম সংকট তৈরি করেছিল। ভালো কি মন্দ সে বিচারে না গিয়ে বলা যায়, তামিল বিচ্ছিন্নবাদীদের দাবির গুরুত্ব অবশ্যই ছিল, কিন্তু তাদের যারা সহযোগিতা করেছিল তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল? পাকিস্তানের উদ্দেশ্য যাই হোক, তালিবানরা অনেক ক্ষেত্রেই সফল হয়েছিল আবার অনেক ক্ষেত্রে হয়ে দাঁড়িয়েছিল কট্টর। সেগুলির একটাকে বাদ দিয়ে আর একটার আলোচনা করা চলে না। নারীর উপর নতুন ধরনের নৃশংসতা নেমে এসেছিল, ধর্মের বিধানের নামে ব্যাভিচারিনীকে পাথর মেরে হত্যা করা। কী ভয়াবহ! কী নিষ্ঠুরতা! ভিন্ন দিকে নিরস্ত্রীকরণ এবং শান্তির অগ্রদূত পরিচয়দানকারী ধার্মিক তালিবানরা দ্রুত জনসমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়। অন্যান্য দলগুলি অসফল ছিল নিরাপত্তাদানে। হেরাতের লোকরা কথা বলে ফার্সি ভাষায় আর তালিবানরা পশতুন। তবুও হেরাতের দোকানদাররা বলেছিল, তালিবানদের আসার আগে প্রায় প্রতিদিন দোকানপাট লুট করতো অস্ত্রধারীরা এবং ক্ষুধার্ত লোকেরা। সেটা বন্ধ করতে পেরেছে তালিবানরা। এমনকি যারা তালিবানদের বিরোধিতা করে, তারাও তাদের আনা নিরাপত্তায় খুশি।
নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা হয়েছে দুটি কারণে। একটা হলো জনগণকে নিরস্ত্রীকরণ এবং অপরটি হচ্ছে মারাত্মক শাস্তির বিধান; যেমন চোরদের হাত কেটে নেয়া। এই শাস্তি এতোই কঠোর আর এতোই দ্রুত ঘটতো যে, হেরাতের বিশ হাজার ক্ষুধার্ত মানুষের সামনে একটুকরো রুটি পড়ে থাকতে দেখে কেউ সেটা তুলে নেয়ার সাহস করবে না। মাখমালবাফ লিখেছেন, দু বছর ধরে আফগানিস্তানে যাচ্ছে আর আসছে এমন ট্রাক চালকদের আমি দেখেছি, তারা তাদের বাহনে কখনো তালা লাগায় না। তাদের কখনো কিছু চুরি যায়নি।
মাখমালবাফ স্থানীয় মানুষদের কাছেই শুনেছিলেন, তালিবানদের আগের অন্যান্য গোত্র বা দলগুলি কেমন করে মানুষের জীবন ও সম্ভ্রম নষ্ট করেছে। ব্যাভিচারী নারীকে ধর্মের বিধান দ্বারা পাথর ছুড়ে মারার ঘটনাটা তালিবানদের জন্য মঙ্গলজনক হয়নি, এটা সত্যি। কিন্তু তার মানে এ নয় যে, আফগানরা তালিবানদের বিরুদ্ধে মার্কিন শাসন চেয়েছিল। বিভিন্ন কারণে ব্যক্তির শিরোশ্চেদ দৃশ্য দেখাটা যে কোনো মানুষের জন্য স্বাভাবিকভাবেই ভয়ঙ্কর আর বীভৎস। কিন্তু শিরোচ্ছেদ আর কটা হয়, কিন্তু ভূমিমাইন বিস্ফোরণে মারা যায় অনেক বেশি মানুষ। তা নিয়ে সভ্য সমাজ মাথা ঘামায় না বা তাদের মধ্যে অনুভূতির প্রকাশ দেখা যায় না। কারণ রাশিয়ানরা আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে এই মাইনগুলি পুঁতে রেখে গিয়েছিল। প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় তখন সাতজন আফগান মাইনের উপর পা ফেলে মারা যেত।
মাইন অপসারণের জন্য কানাডার বিশেষজ্ঞরা এসেছিলেন, দুর্দশার ব্যাপকতা দেখে সব আশা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। তখন বলা হয়েছে, আফগানিস্তানের জনগণকে পরের পঞ্চাশ বছর তাদের ভূমি নিরাপদ ও বাসযোগ্য করতে দলে দলে মাইনের ওপর পা ফেলতে হবে। কারণ পরবর্তীতে সংগ্রহের জন্য কোনোরকম নকশা না রেখে বা পরিকল্পনা ছাড়াই একগোত্র আর এক গোত্রের বিরুদ্ধে মাইন পেতেছিল রাশিয়ানদের দখলের সময়ে। মানে একটা জাতি মাইন পেতে রেখেছে নিজেরই বিরুদ্ধে। ঘটনাটা ঘটে রাশিয়ানদের পক্ষে আর বিপক্ষে যুদ্ধ করার সময়ে। যাই হোক, নিরস্ত্রীকরণের উদ্যোগ এবং শাস্তি বিধান যেমন চোরের হাত কেটে নেয়া, ব্যভিচারীকে পাথর ছুঁড়ে মারা এবং প্রতিপক্ষকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে তালিবানরা তখন আফগানিস্তানে এক আপাতঃনিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিল। মোল্লা ওমর সম্পর্কে তখন প্রায় আফগান জনগণ মনে করতো, সে হচ্ছে দুনিয়াতে আল্লাহর প্রতিনিধি যে মানুষের আইনের বদলে দেশে সংবিধান হিসেবে এনেছে কুরআন। সন্দেহ নেই, খুবই পশ্চাদপদ একটা চিন্তা আজকের সমাজে। কুরআন বহু মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সংবিধান নয়। আফগানিস্তানের তালিবানরা বিশ্বাস করেছে সেই কুরআন তাদের সঙ্কটের সমাধান দেবে। বাইরের মানুষদের সেটা পছন্দ না হতেই পারে। কিন্তু আফগানিস্তান সম্পর্কে যে-কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার প্রথম কার রয়েছে? বাইরের মানুষের নাকি আফগানিস্তানের জনগণের? চলবে